ভাষা আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল কিশোরগঞ্জের ছাত্রসমাজ

বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথ যেমন শহীদদের তাজা খুনে রঞ্জিত হয়েছিল, কিশোরগঞ্জের ছাত্রসমাজেরও ছিল গৌরবোজ্বল ভূমিকা। তারা সেসময় উত্তাল করে তুলেছিলের জেলার সমগ্র জনপদ। সেই আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এখানে যেমন সভা-সমাাবেশ আর মিছিল হয়েছে, পাশাপাশি তারুণ্যের গর্বিত পথিকৃৎ সেদিনের ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়াও জারি হয়েছে। অনেকে কারাবন্দীও হয়েছেন। সেদিনকার ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানিকারীদের হাতে গোনা কয়েকজন জীবিত থাকলেও অনেকেই আজ বেঁচে নেই।

ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কিশোরগঞ্জ মহকুমা শাখার আহ্বায়ক ছিলেন বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা হেদায়েত হোসেন। তিনি তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের কিশোরগঞ্জ মহকুমা শাখার প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়কও ছিলেন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। আর ’৫৪ সনে তিনি গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের সেই সময়টাতে পশ্চাতপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারির গুলিতে কয়েকজন শহীদ হওয়ার খবর কিশোরগঞ্জে পৌঁছে একদিন পর। এখানকার ছাত্র সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ২৩ ফেব্রুয়ারি মুসলিম ইনস্টিটিউট (বর্তমান জেলা পাবলিক লাইব্রেরি) প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রদের বিক্ষোভ সমাবেশ। হেদায়েত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশের একমাত্র বক্তা ছাত্রনেতা আবু তাহের খান পাঠান পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি হরতালের ঘোষণা দেন। এ সময় উপস্থিত ছাত্র-জনতা সমস্বরে সমর্থন জানান। বিভিন্ন সময় ভাষা সৈনিকদের বয়ানে জানা যায়, সে সময়কার ছাত্রনেতা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (আশরাফ মাস্টার), গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শহীদ আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহাম্মদ, প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা গঙ্গেশ সরকার, আবু সিদ্দিক, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, অধ্যক্ষ আ.ফ.ম শামসুল হুদা, মোশারফ হোসেন আকঞ্জি, আব্দুল মতিন, আবু নাঈম, নজরুল ইসলাম, ফজলুল হক, আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, মিছিরউদ্দীন আহমেদ, শহীদুল হক, শামছুদ্দিন আহম্মদ, এম.এ আনিস, মাসুদুল আমিন খান, ফুলে হোসেন প্রমুখ তখনকার উত্তাল ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া, কিশোরগঞ্জের কৃতী সন্তান বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক ডা. মাজহারুল হকও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করার সুবাদে রাজধানীর ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষিত কর্মসূচী অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর ও করিমগঞ্জে ধর্মঘট পালিত হয়। তখন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর তল্পিবাহক নেতারা শহরের মোড়ে মোড়ে উর্দু ভাষার পক্ষে গণস্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেও সচেতন জনগণের বাধার মুুখে তা ব্যর্থ হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কয়েকজন শহীদ হবার পর তাদের স্মরণে কিশোগঞ্জে উত্তোলিত হয় কালো পতাকা। ২৩ ফেব্রুয়ারি শোক র‌্যালি বের হলে তাতে ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীর হামলায় কয়েকজন আহত হন। ২৫ ফেব্রুয়ারি শহরের রথখলা ময়দানে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় কিশোরগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার। নগ্ন পদে প্রভাতফেরি করে তাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এখন প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে কিশোরগঞ্জের জীবিত ও প্রয়াত ভাষা সৈনিকদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্মাননা জানানো হয়।

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৮ ফাল্গুন ১৪২৭ ৮ রজব ১৪৪২

ভাষা আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল কিশোরগঞ্জের ছাত্রসমাজ

মোস্তফা কামাল, কিশোরগঞ্জ

image

বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথ যেমন শহীদদের তাজা খুনে রঞ্জিত হয়েছিল, কিশোরগঞ্জের ছাত্রসমাজেরও ছিল গৌরবোজ্বল ভূমিকা। তারা সেসময় উত্তাল করে তুলেছিলের জেলার সমগ্র জনপদ। সেই আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এখানে যেমন সভা-সমাাবেশ আর মিছিল হয়েছে, পাশাপাশি তারুণ্যের গর্বিত পথিকৃৎ সেদিনের ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়াও জারি হয়েছে। অনেকে কারাবন্দীও হয়েছেন। সেদিনকার ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানিকারীদের হাতে গোনা কয়েকজন জীবিত থাকলেও অনেকেই আজ বেঁচে নেই।

ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কিশোরগঞ্জ মহকুমা শাখার আহ্বায়ক ছিলেন বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা হেদায়েত হোসেন। তিনি তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের কিশোরগঞ্জ মহকুমা শাখার প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়কও ছিলেন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। আর ’৫৪ সনে তিনি গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের সেই সময়টাতে পশ্চাতপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারির গুলিতে কয়েকজন শহীদ হওয়ার খবর কিশোরগঞ্জে পৌঁছে একদিন পর। এখানকার ছাত্র সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ২৩ ফেব্রুয়ারি মুসলিম ইনস্টিটিউট (বর্তমান জেলা পাবলিক লাইব্রেরি) প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রদের বিক্ষোভ সমাবেশ। হেদায়েত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশের একমাত্র বক্তা ছাত্রনেতা আবু তাহের খান পাঠান পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি হরতালের ঘোষণা দেন। এ সময় উপস্থিত ছাত্র-জনতা সমস্বরে সমর্থন জানান। বিভিন্ন সময় ভাষা সৈনিকদের বয়ানে জানা যায়, সে সময়কার ছাত্রনেতা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (আশরাফ মাস্টার), গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শহীদ আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহাম্মদ, প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা গঙ্গেশ সরকার, আবু সিদ্দিক, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, অধ্যক্ষ আ.ফ.ম শামসুল হুদা, মোশারফ হোসেন আকঞ্জি, আব্দুল মতিন, আবু নাঈম, নজরুল ইসলাম, ফজলুল হক, আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, মিছিরউদ্দীন আহমেদ, শহীদুল হক, শামছুদ্দিন আহম্মদ, এম.এ আনিস, মাসুদুল আমিন খান, ফুলে হোসেন প্রমুখ তখনকার উত্তাল ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া, কিশোরগঞ্জের কৃতী সন্তান বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক ডা. মাজহারুল হকও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করার সুবাদে রাজধানীর ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষিত কর্মসূচী অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর ও করিমগঞ্জে ধর্মঘট পালিত হয়। তখন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর তল্পিবাহক নেতারা শহরের মোড়ে মোড়ে উর্দু ভাষার পক্ষে গণস্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেও সচেতন জনগণের বাধার মুুখে তা ব্যর্থ হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কয়েকজন শহীদ হবার পর তাদের স্মরণে কিশোগঞ্জে উত্তোলিত হয় কালো পতাকা। ২৩ ফেব্রুয়ারি শোক র‌্যালি বের হলে তাতে ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীর হামলায় কয়েকজন আহত হন। ২৫ ফেব্রুয়ারি শহরের রথখলা ময়দানে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় কিশোরগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার। নগ্ন পদে প্রভাতফেরি করে তাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এখন প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে কিশোরগঞ্জের জীবিত ও প্রয়াত ভাষা সৈনিকদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্মাননা জানানো হয়।