একুশের অবদান দুই প্রতীকে

আহমদ রফিক

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে দেশ ভাগ এবং ভারত ‘পাকিস্তান’ নামক দুই ডোমিনিয়ন গঠনের মাধ্যমে। এ বিভাজন ও গঠন জিন্নাহর যুক্তিহীন দ্বিজাতি (হিন্দু-মুসলমান) তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে, শাসক শ্রেণীর ইচ্ছা পূরণে। ভারত ভাগের সঙ্গে বিভক্ত হয় পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশ, রক্তস্নান ও বাস্তুত্যাগের চরম দুর্ভোগ ও দুর্দশার মধ্য দিয়ে। আত্ম উন্নয়নে ভারতীয় ও বিশেষত বাঙালি মুসলমানের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান। যা গঠিত হয় পশ্চিম ভারতীয় ও বিশেষত বাঙালি মুসলমানের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান। যা গঠিত হয় পশ্চিম ভারতীয় কয়েকটি প্রদেশ (পশ্চিম পাকিস্তান) ও বিভক্ত বঙ্গের পূর্ব-উত্তরাঞ্চল (পূর্ব পাকিস্তান) নিয়ে।

কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্নে চিড় ধরে, ভাঙনের সূচনা ঘটে পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই যখন পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় শাসক শ্রেণীর জিন্নাহ লিয়াকত থেকে মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতারা বলতে থাকেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়, অথচ গোটা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন প্রদেশের জাতিগত ভাষা উর্দু নয়।

রাষ্ট্রভাষা ও উন্নয়নবিষয়ক বৈষম্য এবং বাংলা, বাঙালি সম্পর্কে অবজ্ঞা, অবহেলা, সচেতন বাঙালি সমাজ মূলত ছাত্র-যুবা শ্রেণী ও কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্রধানত ছাত্র-যুবা নেতৃত্বে ১৯৪৮ মার্চ থেকে ১৯৫০ হয়ে ১৯৫৮-র ফেব্রুয়ারিতে (একুশে ফেব্রুয়ারিকে মূলত কেন্দ্র করে) শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। শুরুতে (১৯৪৮) আন্দোলন রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রিক হলেও ১৯৫২-তে এর চরিত্র জাতীয়তাবাদের ব্যাপকতায় আত্মপ্রকাশ করে।

একুশের সেøাগানগুলো তার প্রমাণ বহন করে, যেমন : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে (জাতীয় জীবনের) বাংলা চালু কর’। একুশের প্রধান বৈশিষ্ট্য শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তার এবং সর্বশ্রেণীর মানুষের (যেমন শিক্ষিত শ্রেণী থেকে শ্রমিক কৃষক শ্রেণী) এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ। একুশের সর্বজনীন চরিত্রই এর সফলতার মূল কারণ।

আন্দোলন দমনে শাসকদের কঠোরনীতি এবং পুলিশের গুলি চালনায় ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি মিছিলে অংশগ্রহণকারী অন্তত ১২ জনের মৃত্যু (শহীদ) আন্দোলনকে সর্বজনীন করে তোলে, সেই সঙ্গে তৈরি হয় চিরায়ত কয়েকটি প্রতীক ‘শহীদ দিবস’ (২১ ফেব্রুয়ারি) ও ‘শহীদ মিনার’ এবং সংশ্লিষ্ট সে্লাগান ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। শহীদ স্মৃতি অমর করে, তুলতেই ঢাকা থেকে দেশের সর্বত্র (প্রথানত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে) তৈরি করা হয় ছোট বড় নানা আকারের শহীদ মিনার।

যতবার শাসক শ্রেণী শহীদ মিনার ভেঙেছে, ততবারই তা আবার গঠিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের স্থায়ী প্রতীকরূপে। শহীদ মিনার ছিল শোক, প্রতিবাদ ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক, যেমন ২১-এ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’। বছরের পর বছর জাতীয় পরিসরে ‘শহীদ দিবস’ পালিত হয়েছে এবং হচ্ছে শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে। এসব কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনোস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ স্বীকৃতি পেয়েছে, যা বাংলাভাষী মানুষের পক্ষেই গর্ব ও অহংকারের বিষয়।

ভাষা আন্দোল একুশে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কারণে দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্টি করে চলেছে নানা মাত্রিক একুশে সাহিত্য তথা ভাষা আন্দোলন বিষয়ক সাহিত্য যা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সংক্ষেপে একে আমরা বলি ‘একুশে সাহিত্য’ যা কবিতায় ও নানা গাদ্যভাষ্যে পরিব্যাপ্ত। একুশে বাঙালির জীবনকে জড়িয়ে আছে একটি মহীরুহের মতন তার ডালপালা ও পাতার বিস্তারে। একুশে সাহিত্য বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য হিসেবে পরিচিত। প্রেরণা লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের জন্য।

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৮ ফাল্গুন ১৪২৭ ৮ রজব ১৪৪২

একুশের অবদান দুই প্রতীকে

আহমদ রফিক

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে দেশ ভাগ এবং ভারত ‘পাকিস্তান’ নামক দুই ডোমিনিয়ন গঠনের মাধ্যমে। এ বিভাজন ও গঠন জিন্নাহর যুক্তিহীন দ্বিজাতি (হিন্দু-মুসলমান) তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে, শাসক শ্রেণীর ইচ্ছা পূরণে। ভারত ভাগের সঙ্গে বিভক্ত হয় পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশ, রক্তস্নান ও বাস্তুত্যাগের চরম দুর্ভোগ ও দুর্দশার মধ্য দিয়ে। আত্ম উন্নয়নে ভারতীয় ও বিশেষত বাঙালি মুসলমানের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান। যা গঠিত হয় পশ্চিম ভারতীয় ও বিশেষত বাঙালি মুসলমানের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান। যা গঠিত হয় পশ্চিম ভারতীয় কয়েকটি প্রদেশ (পশ্চিম পাকিস্তান) ও বিভক্ত বঙ্গের পূর্ব-উত্তরাঞ্চল (পূর্ব পাকিস্তান) নিয়ে।

কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্নে চিড় ধরে, ভাঙনের সূচনা ঘটে পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই যখন পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় শাসক শ্রেণীর জিন্নাহ লিয়াকত থেকে মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতারা বলতে থাকেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়, অথচ গোটা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন প্রদেশের জাতিগত ভাষা উর্দু নয়।

রাষ্ট্রভাষা ও উন্নয়নবিষয়ক বৈষম্য এবং বাংলা, বাঙালি সম্পর্কে অবজ্ঞা, অবহেলা, সচেতন বাঙালি সমাজ মূলত ছাত্র-যুবা শ্রেণী ও কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্রধানত ছাত্র-যুবা নেতৃত্বে ১৯৪৮ মার্চ থেকে ১৯৫০ হয়ে ১৯৫৮-র ফেব্রুয়ারিতে (একুশে ফেব্রুয়ারিকে মূলত কেন্দ্র করে) শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। শুরুতে (১৯৪৮) আন্দোলন রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রিক হলেও ১৯৫২-তে এর চরিত্র জাতীয়তাবাদের ব্যাপকতায় আত্মপ্রকাশ করে।

একুশের সেøাগানগুলো তার প্রমাণ বহন করে, যেমন : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে (জাতীয় জীবনের) বাংলা চালু কর’। একুশের প্রধান বৈশিষ্ট্য শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তার এবং সর্বশ্রেণীর মানুষের (যেমন শিক্ষিত শ্রেণী থেকে শ্রমিক কৃষক শ্রেণী) এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ। একুশের সর্বজনীন চরিত্রই এর সফলতার মূল কারণ।

আন্দোলন দমনে শাসকদের কঠোরনীতি এবং পুলিশের গুলি চালনায় ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি মিছিলে অংশগ্রহণকারী অন্তত ১২ জনের মৃত্যু (শহীদ) আন্দোলনকে সর্বজনীন করে তোলে, সেই সঙ্গে তৈরি হয় চিরায়ত কয়েকটি প্রতীক ‘শহীদ দিবস’ (২১ ফেব্রুয়ারি) ও ‘শহীদ মিনার’ এবং সংশ্লিষ্ট সে্লাগান ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। শহীদ স্মৃতি অমর করে, তুলতেই ঢাকা থেকে দেশের সর্বত্র (প্রথানত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে) তৈরি করা হয় ছোট বড় নানা আকারের শহীদ মিনার।

যতবার শাসক শ্রেণী শহীদ মিনার ভেঙেছে, ততবারই তা আবার গঠিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের স্থায়ী প্রতীকরূপে। শহীদ মিনার ছিল শোক, প্রতিবাদ ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক, যেমন ২১-এ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’। বছরের পর বছর জাতীয় পরিসরে ‘শহীদ দিবস’ পালিত হয়েছে এবং হচ্ছে শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে। এসব কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনোস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ স্বীকৃতি পেয়েছে, যা বাংলাভাষী মানুষের পক্ষেই গর্ব ও অহংকারের বিষয়।

ভাষা আন্দোল একুশে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কারণে দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্টি করে চলেছে নানা মাত্রিক একুশে সাহিত্য তথা ভাষা আন্দোলন বিষয়ক সাহিত্য যা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সংক্ষেপে একে আমরা বলি ‘একুশে সাহিত্য’ যা কবিতায় ও নানা গাদ্যভাষ্যে পরিব্যাপ্ত। একুশে বাঙালির জীবনকে জড়িয়ে আছে একটি মহীরুহের মতন তার ডালপালা ও পাতার বিস্তারে। একুশে সাহিত্য বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য হিসেবে পরিচিত। প্রেরণা লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের জন্য।