শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে

পাকিস্তান গণপরিষদে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে সোচ্চার প্রতিবাদী ও কুমিল্লার কৃতী সন্তান ভাষা সংগ্রামী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচিহ্ন আজ বিলুপ্তির পথে। তিনি শুধু বাংলাভাষার জন্য প্রতিবাদী কণ্ঠই নয়, দেশের জন্যও উৎসর্গ করে গিয়েছেন প্রাণ। শুধুমাত্র সংরক্ষণের অভাবেই আজ হারাতে বসেছে তার স্মৃতিচিহ্ন। ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হন বাংলার এই সূর্যসন্তান। অবহেলা অনাদরে স্মৃতিচিহ্ন তার বাড়িটি ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। যে বাড়িতে তিনি আমৃত্যু কাটিয়েছেন, সেখানে নেই কোন স্মৃতি ফলক, পরিণত হয়েছে জঙ্গলে। এদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এ বাড়িটি পরিদর্শন করতে এসে এখানে ‘ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও গত প্রায় ১১ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

একইভাবে তার জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার পৈতৃক বাড়িও সংরক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে। কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে না ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তার অবদান সম্পর্কে তুলে ধরার।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে সোচ্চার প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য পাক-সরকারের রোষাণলে পড়েন। তিনি ওইদিন অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। এতে প্রথম ক্ষিপ্ত হন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। এরপর থেকেই তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত করতে থাকে পাকিস্তান সরকার।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গভীর রাতে বর্বর পাকবাহিনী নগরীর ধর্মসাগরের এ বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে কুমিল্লা সেনানিবাসে ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মৃতদেহ খুঁজে পায়নি কেউই।

ভাষা সংগ্রামী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর বৃহত্তর কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জগৎবন্ধু দত্ত পেশায় আইনজীবী ছিলেন। তিনি ১৯০৫ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯০৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯১০ সালে আইন পরীক্ষায় উর্ত্তীন হন। একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন, এমনকি তিনি কুমিল্লা বাঙ্গরা হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। পরে ১৯১১ সালে কুমিল্লা জেলা বারে যোগদান করে নিয়মিত অনুশীলন শুরু করেন। অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত গুণী এই রাজনীতিক কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্র ধর্মসাগর দীঘির পশ্চিমপাড়ে বসবাসের জন্য একখ- জমি কিনে টিনের আটচালা ঘর নির্মাণ করেছিলেন। এই বাড়িতেই কাটিয়েছেন আমৃত্যু। স্বাদেশিকতা ছিল তার সহজাত। ১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে একটি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আতাউর রহমান খান-এর মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দী করা হয় এবং এর ফলে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন। ধীরেন্দ্রনাথের বড় ছেলে সঞ্জীব দত্ত ছিলেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক। স্ত্রী প্রতীতি দেবী বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ঋত্তিক ঘটকের যমজ বোন। তাদের বড় মেয়ে আরমা দত্ত বর্তমানে কুমিল্লার সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য।

তার জন্ম ভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তোরণ’, ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেতু’, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাগার, রামরাইল শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা মঞ্চ ইত্যাদি।

গতকাল সরজমিনে যেয়ে দেখা যায়, তিনি যেই বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছে সেখানে তার নামে রামরাইল শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাগার, রামরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় করা হয়েছে এবং পুরাতন ঘড় গুলিতে ১০ থেকে ১২টি পরিবার বসবাস করেন। রামরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফায়েজা বেগম জানান, এখানে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সবাই ধীর বাবু বলে জানে। তিনি রামরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ১০৭ শতক জায়গা দান করেছেন। ধীর বাবু শিশুদের খুব পছন্দ করতেন তার বাসার সামনের রাস্তার পাশে একটি বকুল গাছ ছিল, গাছটি কাটা দিয়ে বাধা ছিল। তিনি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বকুল গাছে কাটা বাধা দেখে জিজ্ঞেস করেন গাছটি কাটা দিয়ে বাধা কেন তারা বলেন শিশুরা বকুল খেয়ে ফেলে তিনি বলেন এইটা একটা কথা হল। শিশুরা খাবে তোমরা কাটা দিয়ে রাখবা! তিনি অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন মুসলিমদের সঙ্গে ও তার অনেক ভালো সর্ম্পক ছিল তিনি মারা গেছেন এত বছর হয়ে গেছে এখনও তাকে সবাই অনেক ভালোবাসেন। কিন্তু এখানে স্মৃতিবহ ঘরবাড়ি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান।

এদিকে কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগরপাড়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি চরম অবহেলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পরিণত হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তরাও। ছয় কক্ষ বিশিষ্ট এই বাড়ির চারটি কক্ষই এখন ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে। বাড়িটির দুইটি কক্ষে একটি পরিবার বর্তমানে বসবাস করছে। বাকি ৪টি কক্ষে পঁচা পানি, ময়লা-আর্বজনা ও জঙ্গলে পরির্পূণ। কক্ষের ইটগুলোও পড়ছে খসে খসে।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির অভ্যন্তরে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। দরজা-জানালা ভেঙে পড়ছে। বাড়ির সীমানা প্রাচীর যা ছিল তা অনেক আগেই খসে পড়েছে। ২০০১ সাল থেকে বাড়িটি দেখভাল করে আসছেন মুরাদনগর উপজেলার ছালিয়াকান্দি গ্রামের হতদরিদ্র সুজন মিয়া। প্রায় ১০ বছর আগে তিনি মারা যাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যরা বাড়ির সামনে একটি চা স্টল দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি বাড়ির দুটি কক্ষে বসবাস করছেন।

সেখানে কথা হয় রিপন স্টোরের মালিক চা দোকানদার রিপন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে এ বাড়িটি আমার বাবা দেখাশোনা করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে এখন আমরা দেখাশোনা করছি। মাঝে মাঝে ওনার (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত) মেয়ে আরমা দত্ত এখানে আসেন। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাস আসলে সাংবাদিকসহ অনেকেই এ বাড়িটির খোঁজ নেন। কিন্তু তারপরে এ বাড়ির খোঁজ কেউ রাখেন না।’

২০১০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে কুমিল্লা নগরীর ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়স্থ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ বাড়িটি পরিদর্শনে গিয়ে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এ বাড়িটি ‘ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি যাদুঘর’ নির্মাণের কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই আশ্বাস আজও আলোর মুখ দেখেনি।

কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছরে দেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার বর্তমানে ক্ষমতায়। এছাড়া শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনী আরমা দত্ত বর্তমানে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপি। এরপরও এ বাড়িটি দীর্ঘবছর ধরে অবহেলায় থাকবে, এটা আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এ বাড়িটিকে সংরক্ষণের পাশাপাশি এখানে জাদুঘর নির্মাণের যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।’

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘এটি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নিজস্ব সম্পত্তি। বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যরা বিবেচনা করবেন। এক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার নেই।’

এ বিষয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনী ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি আরমা দত্ত বলেন, ‘হৃদয়ে আমাদের অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি সবাই উদাসীন, ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ বা একুশ তারিখ এলেই আমাদের এই বাড়ি নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এটা আমাদের পারিবারিক বিষয় এবং বাড়িটি কী হবে না হবে, তা আমরা বিবেচনা করব। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে শুধুমাত্র কুমিল্লা স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। আর এজন্য এগিয়ে এসেছেন সদর আসনের এমপি হাজী আকম বাহাউদ্দিন বাহার। এর বাইরে কী কুমিল্লায় আর কেউ নেই। এজন্য কুমিল্লার লোকজনের লজ্জা হওয়া উচিত।

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৮ ফাল্গুন ১৪২৭ ৮ রজব ১৪৪২

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে

জাহিদুর রহমান, কুমিল্লা ও মানিক মিয়া, ব্রাক্ষণবাড়িয়া

image

কুমিল্লা : ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি এইভাবেই অবহেলায় পড়ে আছে -সংবাদ

পাকিস্তান গণপরিষদে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে সোচ্চার প্রতিবাদী ও কুমিল্লার কৃতী সন্তান ভাষা সংগ্রামী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচিহ্ন আজ বিলুপ্তির পথে। তিনি শুধু বাংলাভাষার জন্য প্রতিবাদী কণ্ঠই নয়, দেশের জন্যও উৎসর্গ করে গিয়েছেন প্রাণ। শুধুমাত্র সংরক্ষণের অভাবেই আজ হারাতে বসেছে তার স্মৃতিচিহ্ন। ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হন বাংলার এই সূর্যসন্তান। অবহেলা অনাদরে স্মৃতিচিহ্ন তার বাড়িটি ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। যে বাড়িতে তিনি আমৃত্যু কাটিয়েছেন, সেখানে নেই কোন স্মৃতি ফলক, পরিণত হয়েছে জঙ্গলে। এদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এ বাড়িটি পরিদর্শন করতে এসে এখানে ‘ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও গত প্রায় ১১ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

একইভাবে তার জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার পৈতৃক বাড়িও সংরক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে। কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে না ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তার অবদান সম্পর্কে তুলে ধরার।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে সোচ্চার প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য পাক-সরকারের রোষাণলে পড়েন। তিনি ওইদিন অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। এতে প্রথম ক্ষিপ্ত হন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। এরপর থেকেই তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত করতে থাকে পাকিস্তান সরকার।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গভীর রাতে বর্বর পাকবাহিনী নগরীর ধর্মসাগরের এ বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে কুমিল্লা সেনানিবাসে ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মৃতদেহ খুঁজে পায়নি কেউই।

ভাষা সংগ্রামী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর বৃহত্তর কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জগৎবন্ধু দত্ত পেশায় আইনজীবী ছিলেন। তিনি ১৯০৫ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯০৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯১০ সালে আইন পরীক্ষায় উর্ত্তীন হন। একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন, এমনকি তিনি কুমিল্লা বাঙ্গরা হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। পরে ১৯১১ সালে কুমিল্লা জেলা বারে যোগদান করে নিয়মিত অনুশীলন শুরু করেন। অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত গুণী এই রাজনীতিক কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্র ধর্মসাগর দীঘির পশ্চিমপাড়ে বসবাসের জন্য একখ- জমি কিনে টিনের আটচালা ঘর নির্মাণ করেছিলেন। এই বাড়িতেই কাটিয়েছেন আমৃত্যু। স্বাদেশিকতা ছিল তার সহজাত। ১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে একটি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আতাউর রহমান খান-এর মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দী করা হয় এবং এর ফলে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন। ধীরেন্দ্রনাথের বড় ছেলে সঞ্জীব দত্ত ছিলেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক। স্ত্রী প্রতীতি দেবী বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ঋত্তিক ঘটকের যমজ বোন। তাদের বড় মেয়ে আরমা দত্ত বর্তমানে কুমিল্লার সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য।

তার জন্ম ভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তোরণ’, ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেতু’, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাগার, রামরাইল শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা মঞ্চ ইত্যাদি।

গতকাল সরজমিনে যেয়ে দেখা যায়, তিনি যেই বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছে সেখানে তার নামে রামরাইল শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাগার, রামরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় করা হয়েছে এবং পুরাতন ঘড় গুলিতে ১০ থেকে ১২টি পরিবার বসবাস করেন। রামরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফায়েজা বেগম জানান, এখানে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সবাই ধীর বাবু বলে জানে। তিনি রামরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ১০৭ শতক জায়গা দান করেছেন। ধীর বাবু শিশুদের খুব পছন্দ করতেন তার বাসার সামনের রাস্তার পাশে একটি বকুল গাছ ছিল, গাছটি কাটা দিয়ে বাধা ছিল। তিনি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বকুল গাছে কাটা বাধা দেখে জিজ্ঞেস করেন গাছটি কাটা দিয়ে বাধা কেন তারা বলেন শিশুরা বকুল খেয়ে ফেলে তিনি বলেন এইটা একটা কথা হল। শিশুরা খাবে তোমরা কাটা দিয়ে রাখবা! তিনি অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন মুসলিমদের সঙ্গে ও তার অনেক ভালো সর্ম্পক ছিল তিনি মারা গেছেন এত বছর হয়ে গেছে এখনও তাকে সবাই অনেক ভালোবাসেন। কিন্তু এখানে স্মৃতিবহ ঘরবাড়ি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান।

এদিকে কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগরপাড়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি চরম অবহেলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পরিণত হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তরাও। ছয় কক্ষ বিশিষ্ট এই বাড়ির চারটি কক্ষই এখন ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে। বাড়িটির দুইটি কক্ষে একটি পরিবার বর্তমানে বসবাস করছে। বাকি ৪টি কক্ষে পঁচা পানি, ময়লা-আর্বজনা ও জঙ্গলে পরির্পূণ। কক্ষের ইটগুলোও পড়ছে খসে খসে।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির অভ্যন্তরে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। দরজা-জানালা ভেঙে পড়ছে। বাড়ির সীমানা প্রাচীর যা ছিল তা অনেক আগেই খসে পড়েছে। ২০০১ সাল থেকে বাড়িটি দেখভাল করে আসছেন মুরাদনগর উপজেলার ছালিয়াকান্দি গ্রামের হতদরিদ্র সুজন মিয়া। প্রায় ১০ বছর আগে তিনি মারা যাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যরা বাড়ির সামনে একটি চা স্টল দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি বাড়ির দুটি কক্ষে বসবাস করছেন।

সেখানে কথা হয় রিপন স্টোরের মালিক চা দোকানদার রিপন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে এ বাড়িটি আমার বাবা দেখাশোনা করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে এখন আমরা দেখাশোনা করছি। মাঝে মাঝে ওনার (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত) মেয়ে আরমা দত্ত এখানে আসেন। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাস আসলে সাংবাদিকসহ অনেকেই এ বাড়িটির খোঁজ নেন। কিন্তু তারপরে এ বাড়ির খোঁজ কেউ রাখেন না।’

২০১০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে কুমিল্লা নগরীর ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়স্থ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ বাড়িটি পরিদর্শনে গিয়ে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এ বাড়িটি ‘ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি যাদুঘর’ নির্মাণের কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই আশ্বাস আজও আলোর মুখ দেখেনি।

কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছরে দেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার বর্তমানে ক্ষমতায়। এছাড়া শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনী আরমা দত্ত বর্তমানে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপি। এরপরও এ বাড়িটি দীর্ঘবছর ধরে অবহেলায় থাকবে, এটা আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এ বাড়িটিকে সংরক্ষণের পাশাপাশি এখানে জাদুঘর নির্মাণের যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।’

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘এটি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নিজস্ব সম্পত্তি। বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যরা বিবেচনা করবেন। এক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার নেই।’

এ বিষয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনী ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি আরমা দত্ত বলেন, ‘হৃদয়ে আমাদের অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি সবাই উদাসীন, ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ বা একুশ তারিখ এলেই আমাদের এই বাড়ি নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এটা আমাদের পারিবারিক বিষয় এবং বাড়িটি কী হবে না হবে, তা আমরা বিবেচনা করব। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে শুধুমাত্র কুমিল্লা স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। আর এজন্য এগিয়ে এসেছেন সদর আসনের এমপি হাজী আকম বাহাউদ্দিন বাহার। এর বাইরে কী কুমিল্লায় আর কেউ নেই। এজন্য কুমিল্লার লোকজনের লজ্জা হওয়া উচিত।