চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ২ বছর

ক্ষতিপূরণের আশা ছেড়ে দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরাক্ষতিপূরণের আশা ছেড়ে দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা

পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ২ বছর আগে কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুন লেগে প্রাণ হারান স্থানীয় মোহাম্মদ আসিফ আহম্মেদ নামে এক যুবকের বাবা। ঐ ঘটনায় প্রাণ হারান ৬৮ জন। এসব প্রানহানীর বিচার এবং ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন তিনি। ভেবেছিলেন বিচার হবে- দায়ীদের শাস্তি দেয়া হবে। সেই সঙ্গে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পাবেন। ২ বছর বিচার ও ক্ষতিপূরণের আশায় থাকা এ যুবক সব আশা ছেড়ে দিয়ে এখন নিজের প্রাণহানির শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। মামলার আসামি ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিক পক্ষের লোকজন হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে মামলা তুলে নিতে। পুলিশ গত দুই বছরেও মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করতে পারেনি।

এ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পাননি। এমনকি সব ধরনের কেমিক্যাল সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা থাকলেও তাও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি ঘটনার শঙ্কা নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন চুড়িহাট্টাসহ পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।

স্থানীয়দের ভাষ্য, ২ বছর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় ভয়াবহ এ আগুনের কথা এখনও মনে দাগ কাটে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর মধ্যে। অনেকেই এ আগুনে হারিয়েছেন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। সেই ঘটনার পর একটি মামলা হয়েছে। মামলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটা ভবন মালিকদের আসামি করা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। ঘোষণা দেয়া হয় পুরান ঢাকায় কোন ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা থাকবে না। অভিযানও পরিচালনা করা হয়। ঘটনার পর নরমে-গরমে নানা ধরনের এসব পদক্ষেপে এখন বরফ গলছে। আগের মতোই কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা, দোকান বহল তবিয়তে। তদন্ত কমিটির সুপারিশও আলোর মুখ দেখেনি। মামলা হলেও আসামিদের কোন শাস্তি হয়নি। জামিনে আসা আসামিরা এখন উল্টো মামলার বাদীকে হুমকি দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তরাও কোন সহযোগিতা পাননি। বরং তাদের কয়েকজনকে সুইপার (পরিচ্ছন্নকর্মী) হিসেবে চাকরি দেয়ায় চাকরি নিয়ে অস্বস্তি চলছে।

গতকাল ২ বছর পূর্তিতে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ২ বছর পূর্তিতে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা জড়ো হয় ওয়াহিদ ম্যানসনের সামনে। স্থানীয় সংসদ সদস্য জনা ২০ পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে সাহায্য দিয়েছেন। সেই ৫ হাজার টাকার জন্য ওই ২০ জন গতকাল জড়ো হয়েছিলেন। গণমাধ্যম কর্মীরা ছুটে যান ঘটনাস্থলে। ওয়াহিদ ম্যানসন ঠিকঠাক করে ভাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেছেন মালিকপক্ষ। আশপাশের দোকানগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পুরোপুরি ব্যস্ত এলাকা হয়ে গেছে চুড়িহাট্টা। অনেকে সেই ঘটনা মনে না রাখলেও স্বজন হারানো ব্যক্তিরা এখনও প্রতিবছর ২০ ফেব্রুয়ারি ছুটে আসেন ওয়াহিদ ম্যানশনের কাছে। ভয়াবহ সেই ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে দাঁড়িয়ে হারানো প্রিয়জনের স্মৃতি মনে করে বুকভাসান চোখের জলে।

গতকালও তার ব্যতিক্রম ছিল না। চুরি হাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংঘ নামে একটি সংগঠনও গঠন করা হয়। সেই সংগঠনের মূল লক্ষ্য এ ঘটনার বিচার হওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহত-আহত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন এবং পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করার দাবি বাস্তবায়ন। চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, আগুনে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া ওয়াহেদ ম্যানশনে সংস্কার কাজ করা হয়েছে, বোঝার উপায় নেই, এখানেই এতো মানুষ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছিলেন। ভবনটির পশ্চিম পাশের পুড়ে যাওয়া ভবন এবং পূর্ব পাশের ভবনের নিচতলায় অবস্থিত রাজমহল হোটেল ছাড়াও আশপাশের দোকানগুলো আবার পুরোদমে চালু হয়েছে। আর ওয়াহেদ ম্যানশনের ঠিক সামনের উত্তর পাশের ভবনটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলে তৈরি করা হচ্ছে নতুন ভবন। গতকাল চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, সেই ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনসহ আশপাশের ভবনগুলোতে আগুনে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্বজনরা নানা দাবি জানিয়ে ব্যানার টানিয়েছেন। ‘চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংস্থার’ একটি ব্যানারে আগুনে পুড়ে নিহতদের নামের তালিকা দিয়ে সেখানে লেখা রয়েছে।

আগুনে দুই সন্তান হারিয়ে এখনও পাগলপ্রায় বৃদ্ধ সাহেব উল্লাহ জানান, ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের নিচে মোবাইল দোকান ছিল তার দুই ছেলে মাসুদ রানা এবং মাহবুবুর রহমান রাজু। দুই ছেলেই মোবাইল মেরামতের কাজ করতেন। ঘটনার দিন দুই ছেলেই আগুনে পুড়ে মারা যান। এর মধ্যে ছোট ছেলে রাজু মারা যাওয়ার ২৮ দিন আগে বিয়ে করেছিলেন। উপার্জনক্ষম দুই সন্তান এভাবে চলে যাওয়ার পর তিনি বিপাকে পড়েছেন। কেউ খবর নেয়নি।

চুরিহাট্টার আগুনে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের সভাপতি মো. নাছির উদ্দিন জানান, সেইদিন আগুনে তার একমাত্র ছেলে ওয়াদিউদ্দিন মাহি মারা যান। ওয়াদি উদ্দিন ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যক্তিগত কাজে ওয়াহিদ ম্যানশনের কাছে এসেছিলেন। আগুন লাগার পর তার ছেলে আর বাঁচতে পারেননি।

চুরিহাট্টা একতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক ও আগুনে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংঘের নেতা আশিকুর রহমান সৈনিক জানান, ভয়াবহ এ ঘটনার দু’বছর পার হয়ে গেলেও আগুনের ঘটনায় দায়ীদের কোন বিচার না হওয়া হতাশাজনক।

কেমন আছেন নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো

গতকাল সরেজমিনে গেলে ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে দেখা মিলে চুরিহাট্টার আগুনে বাবা ভগ্নিপতি এবং চাচাতো ভাইকে হারানো নুরনবীর সঙ্গে। নুরনবীর বাবা সজল মিয়া ছিলেন ওয়াহিদ ম্যানসনের সিকিউরিটি গার্ড। আগুনের দিন তিনি ডিউটি শেষ করে বের হওয়ার সময় আগুন লাগে। কিন্তু তিনি নিজেকে আর বাঁচাতে পারেননি। ওয়াহিদ মিয়ার সঙ্গে সেই আগুনে মারা যান তার মেয়ের জামাই মো. ইব্রাহিম এবং ভাইয়ের ছেলে আনোয়ার।

নুরনবী জানান, নিহতের পরিবার হিসেবে তাকে সিটি করপোরেশনে মাস্টাররোলে পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে মাসিক ১৪ হাজার টাকা বেতনে একটি চাকরি দিয়েছে। ওই ঘটনায় তার ভগ্নিপতি ইব্রাহিম মারা যাওয়ার তার বোনকেও একই পদে চাকরি দেয়া হয়েছে। চাকরি স্থায়ী হয়নি। ঘটনায় তার এক চাচাতো ভাইও মারা গেছেন। চাচাতো ভাইয়ের পরিবার পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে চাকরি করতে রাজি নয় বলে তারা এ চাকরিতে আর যোগদান করেননি। তিনি ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। আগে কখনও পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কাজ করার অভ্যাস বা অভিজ্ঞতাও নেই। এ চাকরি তাদের জন্য সম্মানজনক নয়। তবুও নিরুপায় হয়ে চাকরিটা করছেন। কারণ চাকরি না করলে মা, বোন, বোনের দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারবেন না। নুরনবীর মতো একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ব্যবসায়ী ফায়সালের স্ত্রী ফাতেমা বেগম। ওই আগুনে ফায়সাল পুড়ে মারা যান।

মামলা তুলে নিতে বাদীকে অব্যাহত হুমকি

আগুনের ঘটনায় মামলার পর পুলিশ এই আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। পরে মামলার দুই প্রধান অভিযুক্ত ওয়াহিদ ম্যাশনের মালিকপক্ষ দুই সহোদর মো. হাসান এবং সোহেল ওরফে শহীদ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর পুলিশ তাদের ‘রিমান্ডে’ নিলেও মামলার তদন্তের কাজে আসে এমন কোন তথ্য বের করতে পারেনি। কিছুদিন জেলে থাকার পর দুই ভাই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। নিজেদের ভবনটি সংস্কারও করে ফেলেছেন। তারা এ ঘটনায় আন্দোলনকারীদের দিকে এমনভাবে তাকান যেন তাদের খেয়ে ফেলবেন।

বাদী মোহাম্মদ আসিফ আহমেদ জানান, ঘটনার দিন তার বাবা ওষুধ কিনতে এসে আগুনে পুড়ে মারা যান। তার বাবা ছাড়াও এ আগুনে বহু পরিবার তাদের স্বজন হারিয়েছেন। এ ঘটনার একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়ার উচিৎ এমন দায়বদ্ধতা থেকে তিনি মামলা করেছেন। চকবাজার থানার তৎকালীন ওসি তাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, আপনি বাদী হন, মামলা চালাবে সরকার। সেই আশ্বাসে তিনি বাদী হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ মামলার তদন্ত গত ২ বছরেও শেষ করতে পারেননি। গত ২ বছর ধরে বিভিন্ন লোক আসামিদের পক্ষ হয়ে তাকে অব্যাহত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন মামলা তুলে নিতে। টেলিফোনে ফোন করে বলা হচ্ছে, এলাকায় থাকতে হবে, মামলা করে শত্রুতা বাড়িয়ে লাভ নেই। মামলা না তুলে নিলে এলাকায় থাকতে পারবে না।

মামলাটি বর্তমানে তদন্তকারী কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবীর হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত যে তদন্ত হয়েছে, তাতে তারা তথ্য পেয়েছেন যে, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের উৎপত্তি ঘটেছে। তবে তদন্ত চলছে, শেষ না হলে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। চকবাজার থানা সূত্র জানায়, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাইকে রিমান্ডে নিলেও গুদাম মালিকদের বিষয়ে তারা তথ্য দিতে পারেনি। তারা তখন বলেছে, জনৈক ইমতিয়াজ আহমেদ ও তার দুই ব্যবসায়িক অংশীদার গুদাম ভাড়া নিয়েছিল। তবে আগুনে তাদের ফাইলপত্র পুড়ে যাওয়ায় গ্রুপটিকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি।

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৮ ফাল্গুন ১৪২৭ ৮ রজব ১৪৪২

চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ২ বছর

ক্ষতিপূরণের আশা ছেড়ে দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরাক্ষতিপূরণের আশা ছেড়ে দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা

সাইফ বাবলু

image

গতকাল অগ্নিকা-ে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংস্থার সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে স্বজনরা -সংবাদ

পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ২ বছর আগে কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুন লেগে প্রাণ হারান স্থানীয় মোহাম্মদ আসিফ আহম্মেদ নামে এক যুবকের বাবা। ঐ ঘটনায় প্রাণ হারান ৬৮ জন। এসব প্রানহানীর বিচার এবং ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন তিনি। ভেবেছিলেন বিচার হবে- দায়ীদের শাস্তি দেয়া হবে। সেই সঙ্গে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পাবেন। ২ বছর বিচার ও ক্ষতিপূরণের আশায় থাকা এ যুবক সব আশা ছেড়ে দিয়ে এখন নিজের প্রাণহানির শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। মামলার আসামি ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিক পক্ষের লোকজন হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে মামলা তুলে নিতে। পুলিশ গত দুই বছরেও মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করতে পারেনি।

এ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পাননি। এমনকি সব ধরনের কেমিক্যাল সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা থাকলেও তাও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি ঘটনার শঙ্কা নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন চুড়িহাট্টাসহ পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।

স্থানীয়দের ভাষ্য, ২ বছর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় ভয়াবহ এ আগুনের কথা এখনও মনে দাগ কাটে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর মধ্যে। অনেকেই এ আগুনে হারিয়েছেন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। সেই ঘটনার পর একটি মামলা হয়েছে। মামলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটা ভবন মালিকদের আসামি করা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। ঘোষণা দেয়া হয় পুরান ঢাকায় কোন ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা থাকবে না। অভিযানও পরিচালনা করা হয়। ঘটনার পর নরমে-গরমে নানা ধরনের এসব পদক্ষেপে এখন বরফ গলছে। আগের মতোই কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা, দোকান বহল তবিয়তে। তদন্ত কমিটির সুপারিশও আলোর মুখ দেখেনি। মামলা হলেও আসামিদের কোন শাস্তি হয়নি। জামিনে আসা আসামিরা এখন উল্টো মামলার বাদীকে হুমকি দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তরাও কোন সহযোগিতা পাননি। বরং তাদের কয়েকজনকে সুইপার (পরিচ্ছন্নকর্মী) হিসেবে চাকরি দেয়ায় চাকরি নিয়ে অস্বস্তি চলছে।

গতকাল ২ বছর পূর্তিতে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ২ বছর পূর্তিতে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা জড়ো হয় ওয়াহিদ ম্যানসনের সামনে। স্থানীয় সংসদ সদস্য জনা ২০ পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে সাহায্য দিয়েছেন। সেই ৫ হাজার টাকার জন্য ওই ২০ জন গতকাল জড়ো হয়েছিলেন। গণমাধ্যম কর্মীরা ছুটে যান ঘটনাস্থলে। ওয়াহিদ ম্যানসন ঠিকঠাক করে ভাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেছেন মালিকপক্ষ। আশপাশের দোকানগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পুরোপুরি ব্যস্ত এলাকা হয়ে গেছে চুড়িহাট্টা। অনেকে সেই ঘটনা মনে না রাখলেও স্বজন হারানো ব্যক্তিরা এখনও প্রতিবছর ২০ ফেব্রুয়ারি ছুটে আসেন ওয়াহিদ ম্যানশনের কাছে। ভয়াবহ সেই ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে দাঁড়িয়ে হারানো প্রিয়জনের স্মৃতি মনে করে বুকভাসান চোখের জলে।

গতকালও তার ব্যতিক্রম ছিল না। চুরি হাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংঘ নামে একটি সংগঠনও গঠন করা হয়। সেই সংগঠনের মূল লক্ষ্য এ ঘটনার বিচার হওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহত-আহত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন এবং পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করার দাবি বাস্তবায়ন। চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, আগুনে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া ওয়াহেদ ম্যানশনে সংস্কার কাজ করা হয়েছে, বোঝার উপায় নেই, এখানেই এতো মানুষ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছিলেন। ভবনটির পশ্চিম পাশের পুড়ে যাওয়া ভবন এবং পূর্ব পাশের ভবনের নিচতলায় অবস্থিত রাজমহল হোটেল ছাড়াও আশপাশের দোকানগুলো আবার পুরোদমে চালু হয়েছে। আর ওয়াহেদ ম্যানশনের ঠিক সামনের উত্তর পাশের ভবনটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলে তৈরি করা হচ্ছে নতুন ভবন। গতকাল চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, সেই ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনসহ আশপাশের ভবনগুলোতে আগুনে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্বজনরা নানা দাবি জানিয়ে ব্যানার টানিয়েছেন। ‘চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংস্থার’ একটি ব্যানারে আগুনে পুড়ে নিহতদের নামের তালিকা দিয়ে সেখানে লেখা রয়েছে।

আগুনে দুই সন্তান হারিয়ে এখনও পাগলপ্রায় বৃদ্ধ সাহেব উল্লাহ জানান, ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের নিচে মোবাইল দোকান ছিল তার দুই ছেলে মাসুদ রানা এবং মাহবুবুর রহমান রাজু। দুই ছেলেই মোবাইল মেরামতের কাজ করতেন। ঘটনার দিন দুই ছেলেই আগুনে পুড়ে মারা যান। এর মধ্যে ছোট ছেলে রাজু মারা যাওয়ার ২৮ দিন আগে বিয়ে করেছিলেন। উপার্জনক্ষম দুই সন্তান এভাবে চলে যাওয়ার পর তিনি বিপাকে পড়েছেন। কেউ খবর নেয়নি।

চুরিহাট্টার আগুনে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের সভাপতি মো. নাছির উদ্দিন জানান, সেইদিন আগুনে তার একমাত্র ছেলে ওয়াদিউদ্দিন মাহি মারা যান। ওয়াদি উদ্দিন ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যক্তিগত কাজে ওয়াহিদ ম্যানশনের কাছে এসেছিলেন। আগুন লাগার পর তার ছেলে আর বাঁচতে পারেননি।

চুরিহাট্টা একতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক ও আগুনে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংঘের নেতা আশিকুর রহমান সৈনিক জানান, ভয়াবহ এ ঘটনার দু’বছর পার হয়ে গেলেও আগুনের ঘটনায় দায়ীদের কোন বিচার না হওয়া হতাশাজনক।

কেমন আছেন নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো

গতকাল সরেজমিনে গেলে ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে দেখা মিলে চুরিহাট্টার আগুনে বাবা ভগ্নিপতি এবং চাচাতো ভাইকে হারানো নুরনবীর সঙ্গে। নুরনবীর বাবা সজল মিয়া ছিলেন ওয়াহিদ ম্যানসনের সিকিউরিটি গার্ড। আগুনের দিন তিনি ডিউটি শেষ করে বের হওয়ার সময় আগুন লাগে। কিন্তু তিনি নিজেকে আর বাঁচাতে পারেননি। ওয়াহিদ মিয়ার সঙ্গে সেই আগুনে মারা যান তার মেয়ের জামাই মো. ইব্রাহিম এবং ভাইয়ের ছেলে আনোয়ার।

নুরনবী জানান, নিহতের পরিবার হিসেবে তাকে সিটি করপোরেশনে মাস্টাররোলে পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে মাসিক ১৪ হাজার টাকা বেতনে একটি চাকরি দিয়েছে। ওই ঘটনায় তার ভগ্নিপতি ইব্রাহিম মারা যাওয়ার তার বোনকেও একই পদে চাকরি দেয়া হয়েছে। চাকরি স্থায়ী হয়নি। ঘটনায় তার এক চাচাতো ভাইও মারা গেছেন। চাচাতো ভাইয়ের পরিবার পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে চাকরি করতে রাজি নয় বলে তারা এ চাকরিতে আর যোগদান করেননি। তিনি ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। আগে কখনও পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কাজ করার অভ্যাস বা অভিজ্ঞতাও নেই। এ চাকরি তাদের জন্য সম্মানজনক নয়। তবুও নিরুপায় হয়ে চাকরিটা করছেন। কারণ চাকরি না করলে মা, বোন, বোনের দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারবেন না। নুরনবীর মতো একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ব্যবসায়ী ফায়সালের স্ত্রী ফাতেমা বেগম। ওই আগুনে ফায়সাল পুড়ে মারা যান।

মামলা তুলে নিতে বাদীকে অব্যাহত হুমকি

আগুনের ঘটনায় মামলার পর পুলিশ এই আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। পরে মামলার দুই প্রধান অভিযুক্ত ওয়াহিদ ম্যাশনের মালিকপক্ষ দুই সহোদর মো. হাসান এবং সোহেল ওরফে শহীদ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর পুলিশ তাদের ‘রিমান্ডে’ নিলেও মামলার তদন্তের কাজে আসে এমন কোন তথ্য বের করতে পারেনি। কিছুদিন জেলে থাকার পর দুই ভাই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। নিজেদের ভবনটি সংস্কারও করে ফেলেছেন। তারা এ ঘটনায় আন্দোলনকারীদের দিকে এমনভাবে তাকান যেন তাদের খেয়ে ফেলবেন।

বাদী মোহাম্মদ আসিফ আহমেদ জানান, ঘটনার দিন তার বাবা ওষুধ কিনতে এসে আগুনে পুড়ে মারা যান। তার বাবা ছাড়াও এ আগুনে বহু পরিবার তাদের স্বজন হারিয়েছেন। এ ঘটনার একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়ার উচিৎ এমন দায়বদ্ধতা থেকে তিনি মামলা করেছেন। চকবাজার থানার তৎকালীন ওসি তাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, আপনি বাদী হন, মামলা চালাবে সরকার। সেই আশ্বাসে তিনি বাদী হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ মামলার তদন্ত গত ২ বছরেও শেষ করতে পারেননি। গত ২ বছর ধরে বিভিন্ন লোক আসামিদের পক্ষ হয়ে তাকে অব্যাহত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন মামলা তুলে নিতে। টেলিফোনে ফোন করে বলা হচ্ছে, এলাকায় থাকতে হবে, মামলা করে শত্রুতা বাড়িয়ে লাভ নেই। মামলা না তুলে নিলে এলাকায় থাকতে পারবে না।

মামলাটি বর্তমানে তদন্তকারী কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবীর হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত যে তদন্ত হয়েছে, তাতে তারা তথ্য পেয়েছেন যে, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের উৎপত্তি ঘটেছে। তবে তদন্ত চলছে, শেষ না হলে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। চকবাজার থানা সূত্র জানায়, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাইকে রিমান্ডে নিলেও গুদাম মালিকদের বিষয়ে তারা তথ্য দিতে পারেনি। তারা তখন বলেছে, জনৈক ইমতিয়াজ আহমেদ ও তার দুই ব্যবসায়িক অংশীদার গুদাম ভাড়া নিয়েছিল। তবে আগুনে তাদের ফাইলপত্র পুড়ে যাওয়ায় গ্রুপটিকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি।