ভাষার গান ও কবিতায়

সিলেটে উন্মোচিত হলো প্রথম আন্তর্জাতিক মানের শহীদ মিনার

২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা। কিছুক্ষণ পরই ভাষা শহীদদের স্মরণে জাতির শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার কথা। এর আগেই দেশবাসীর জন্য একটি সুখবর দেয় সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটি। ৫২টি ভাষার বর্ণ দিয়ে ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ক্যাম্পাসে উন্মোচিত হয় দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের একটি শহীদ মিনার। কবিতা ও ভাষার গানের মধ্যদিয়ে এই শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ রাগীব আলী।

প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই শহীদ মিনারের স্থপতি রাজন দাস বলেন, ‘মা’ ধ্বনিতেই এর তাৎপর্য নিহিত। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই গর্ভধারিনী জননীর নামের উচ্চারণ সন্তানের মুখে ‘ম’ ধ্বনি দিয়েই শুরু হয়। এ এক আশ্চর্য। জগতের মধুরতম শব্দ এই ‘মা’। এক ‘অবাক আলোর লিপি’। মায়ের ভাষাতেই মানবজাতির সবচেয়ে বেশি সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য।

বাঙালির ইতিহাসে এই মাতৃভাষাই তাকে বারবার আত্মপরিচয়ের সত্য ঠিকানা বাতলে দিয়েছে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ বাঙালি জাতির সেই আত্ম-আবিষ্কারের দিন, নবজাগরণের দিন, স্বাধীনতার-চেতনার উন্মেষের দিন। ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ‘মুখের ভাষা কাইরা নিতে’- আসাদের সেদিন রুখে দিয়েছিল বাঙালি জাতি। প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলা মায়ের জবান। এই ঐতিহাসিক ঘটনা জগতমায়ের সভায় এই সত্যটা উন্মোচন করে যে, সূর্য যেমন আদিকাল থেকে আলো ও জীবনের উৎস, তেমনি মাতৃভাষা সন্তানমাত্রেরই জীবনধারণ ও আত্মপ্রকাশের একমাত্র উৎস, এর কোন ব্যতিক্রম হয় না, মাতৃভাষার কন্ঠরোধ করা যায় না, একে মুছে ফেলা যায় না। মাতৃভাষাহীন জাতি মৃতপ্রায় জাতি। আমরা চাই ‘জগত জুড়ে উদার সুরে’ মাতৃভাষার মধুর ধ্বনি উচ্চারিত হোক।

এই মিনারে সেই বিশ্বমাতার আসন পাতা হয়েছে। সব মায়ের সম্মিলনের মাঝে বাংলা ‘মা’ মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশের বুকে বাঙালি ভিন্ন অন্য নৃগোষ্ঠীদের নিজস্ব বর্ণমালায় ‘মা’ ধ্বনিটি এই মিনারের খাঁজে খাঁজে খচিত রয়েছে। ইতিহাসের পথের বাঁকে বাংলা ভাষা যেসব ভাষার সাক্ষাৎ পেয়েছে, স্পর্শ পেয়েছে, সেসব ভাষারও মা শব্দটি এই মিনারের শরীরে অলঙ্কার হয়ে আছে। সব মিলিয়ে বাহান্নটি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালায় ‘মা’ শব্দের অংশগ্রহণ রয়েছে এখানে। যেমন কানাড়া, ভোজপুরী, থাই, ফরাসি, ইংরেজি, চাকমা, বম, সিংহলী, নেপালি ইত্যাদি।

পৃথিবীতে আজ প্রায় ৭ হাজার ভাষার মধ্যে ৩ হাজার ভাষাই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। এই মিনার এই ভাষার রাজনীতির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে থাকা এক প্রতিবাদের সূচনামাত্র।

এ বিষয়ে লিডিং ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ রাগীব আলী বলেন, এটা সবচে’ আনন্দের বিষয় যে আন্তর্জাতিক মানের প্রথম একটি শহীদ মিনার সিলেটে নির্মিত হয়েছে। এটি আগামী প্রজন্মের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।

ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বনমালী ভৌমিক বলেন, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের একান্ত ইচ্ছা ও পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক মানের এই শহীদ মিনার নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এ ধরনের আন্তর্জাতিক শহীদ মিনার বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এদিকে, ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার উন্মোচনে শুরুতেই দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর ভাষার গান দিয়ে শুরু হয় উন্মোচন অনুষ্ঠান। এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের সদস্য আবদুল হাই, লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সাদিকা জান্নাত চৌধুরী প্রমুখ।

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৮ ফাল্গুন ১৪২৭ ৮ রজব ১৪৪২

ভাষার গান ও কবিতায়

সিলেটে উন্মোচিত হলো প্রথম আন্তর্জাতিক মানের শহীদ মিনার

আকাশ চৌধুরী

image

২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা। কিছুক্ষণ পরই ভাষা শহীদদের স্মরণে জাতির শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার কথা। এর আগেই দেশবাসীর জন্য একটি সুখবর দেয় সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটি। ৫২টি ভাষার বর্ণ দিয়ে ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ক্যাম্পাসে উন্মোচিত হয় দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের একটি শহীদ মিনার। কবিতা ও ভাষার গানের মধ্যদিয়ে এই শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ রাগীব আলী।

প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই শহীদ মিনারের স্থপতি রাজন দাস বলেন, ‘মা’ ধ্বনিতেই এর তাৎপর্য নিহিত। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই গর্ভধারিনী জননীর নামের উচ্চারণ সন্তানের মুখে ‘ম’ ধ্বনি দিয়েই শুরু হয়। এ এক আশ্চর্য। জগতের মধুরতম শব্দ এই ‘মা’। এক ‘অবাক আলোর লিপি’। মায়ের ভাষাতেই মানবজাতির সবচেয়ে বেশি সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য।

বাঙালির ইতিহাসে এই মাতৃভাষাই তাকে বারবার আত্মপরিচয়ের সত্য ঠিকানা বাতলে দিয়েছে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ বাঙালি জাতির সেই আত্ম-আবিষ্কারের দিন, নবজাগরণের দিন, স্বাধীনতার-চেতনার উন্মেষের দিন। ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ‘মুখের ভাষা কাইরা নিতে’- আসাদের সেদিন রুখে দিয়েছিল বাঙালি জাতি। প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলা মায়ের জবান। এই ঐতিহাসিক ঘটনা জগতমায়ের সভায় এই সত্যটা উন্মোচন করে যে, সূর্য যেমন আদিকাল থেকে আলো ও জীবনের উৎস, তেমনি মাতৃভাষা সন্তানমাত্রেরই জীবনধারণ ও আত্মপ্রকাশের একমাত্র উৎস, এর কোন ব্যতিক্রম হয় না, মাতৃভাষার কন্ঠরোধ করা যায় না, একে মুছে ফেলা যায় না। মাতৃভাষাহীন জাতি মৃতপ্রায় জাতি। আমরা চাই ‘জগত জুড়ে উদার সুরে’ মাতৃভাষার মধুর ধ্বনি উচ্চারিত হোক।

এই মিনারে সেই বিশ্বমাতার আসন পাতা হয়েছে। সব মায়ের সম্মিলনের মাঝে বাংলা ‘মা’ মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশের বুকে বাঙালি ভিন্ন অন্য নৃগোষ্ঠীদের নিজস্ব বর্ণমালায় ‘মা’ ধ্বনিটি এই মিনারের খাঁজে খাঁজে খচিত রয়েছে। ইতিহাসের পথের বাঁকে বাংলা ভাষা যেসব ভাষার সাক্ষাৎ পেয়েছে, স্পর্শ পেয়েছে, সেসব ভাষারও মা শব্দটি এই মিনারের শরীরে অলঙ্কার হয়ে আছে। সব মিলিয়ে বাহান্নটি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালায় ‘মা’ শব্দের অংশগ্রহণ রয়েছে এখানে। যেমন কানাড়া, ভোজপুরী, থাই, ফরাসি, ইংরেজি, চাকমা, বম, সিংহলী, নেপালি ইত্যাদি।

পৃথিবীতে আজ প্রায় ৭ হাজার ভাষার মধ্যে ৩ হাজার ভাষাই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। এই মিনার এই ভাষার রাজনীতির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে থাকা এক প্রতিবাদের সূচনামাত্র।

এ বিষয়ে লিডিং ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ রাগীব আলী বলেন, এটা সবচে’ আনন্দের বিষয় যে আন্তর্জাতিক মানের প্রথম একটি শহীদ মিনার সিলেটে নির্মিত হয়েছে। এটি আগামী প্রজন্মের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।

ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বনমালী ভৌমিক বলেন, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের একান্ত ইচ্ছা ও পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক মানের এই শহীদ মিনার নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এ ধরনের আন্তর্জাতিক শহীদ মিনার বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এদিকে, ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার উন্মোচনে শুরুতেই দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর ভাষার গান দিয়ে শুরু হয় উন্মোচন অনুষ্ঠান। এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের সদস্য আবদুল হাই, লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সাদিকা জান্নাত চৌধুরী প্রমুখ।