রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিল

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে মদত দেয়ার কারণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের একজন জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের প্রস্তাব করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা জামুকা। একই প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী এবং মোসলেহ উদ্দিনের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডিত চার পলাতক খুনির খেতাব স্থগিতের জন্য ইতিপূর্বে হাইকোর্ট একটি আদেশও দিয়েছিল। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় তার জড়িত থাকা, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগে সহায়তা দিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা, সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করা, একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি ‘জয় বাংলা’ বদল করে সেøাগান দেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘বাঙালি জাতীয়বাদ’-এর স্থলে বসিয়ে দেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। অনেকের ধারণা, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার আমলেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২০০৩ সনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বঙ্গবন্ধু এবং জিয়াউর রহমানকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে। যিনি বাংলাদেশের স্থপতি, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তাকে ‘স্বাধীনতা’ পদক দেয়ার মধ্যে ব্যাঙ্গ-পরিহাস থাকতে পারে। অন্যদিকে যৌথভাবে এই পদক দেয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানকে সমমর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার প্রয়াসও পরিলক্ষিত হয়। এই প্রয়াস রুদ্ধ করতেই ২০১৬ সনে আওয়ামী লীগ সরকার জিয়ার স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। খেতাব, পদক প্রত্যাহারের রীতি নতুন কিছু নয়। ১৯৬৩ সনে চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা ড. মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে সিতারা-ই-খিদমত উপাধীতে ভূষিত করলেও ৬ দফা আন্দোলন সমর্থন করার কারণে তার খেতাব পাকিস্তান সরকার কেড়ে নিয়েছিল। যারা আজ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের প্রস্তাবে নাখোশ ও মনক্ষুণœ তাদের খুশি হতে দেখা যায় মায়ানমারের অং সাং সূচির আন্তর্জাতিক কিছু খেতাব বাতিল হওয়ায়।

বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের সবাই আইনগত বৈধতা হারিয়েছেন। ১৯৭৫ সন থেকে ১৯৭৯ সন পর্যন্ত সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ২০০৫ সনে হাইকোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসা ও থাকা অবৈধ, তাই বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। ২০১০ সনে হাইকোর্টের রায়ে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার কারণে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের ক্ষমতায় আসা ও সেই সময়ের সব কর্মকা- অবৈধ হিসেবে গণ্য। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য পেশোয়ার হাইকোর্ট পাকিস্তানের জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমানের মৌন সমর্থন নিয়ে তর্কণ্ডবিতর্কের শেষ নেই, বিভিন্ন প্রেক্ষিত বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের নীরব ভূমিকা থাকার কথা কম-বেশি সবাই বিশ্বাস করে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর জিয়াউর রহমানের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ‘সো হোয়াট’ বিএনপির জন্য এখনও অস্বস্তিকর। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বাঁচানোর জন্য খোন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অংশ করায় বঙ্গবন্ধুর হত্যা ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। তবে বিচারের রায়ের পূর্বে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর হওয়ায় তার সংশ্লিষ্টতা আদালত দ্বারা প্রমাণিত নয়, কারণ বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তির বিচার হয় না।

ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভালোলাগা থেকেও রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়েছে। একাত্তরে শর্শিনা মাদ্রাসার ছাত্ররা রাজাকারে যোগ দেয়, তখন শর্শিনার দরবার, দরবারসংলগ্ন মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার ছাত্রাবাসসহ সব স্থাপনায় রাজাকার ও আলবদরদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এই শর্শিনার পীর আলহাজ মাওলানা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য জেলে নেয়া হয়েছিল; অথচ ১৯৮০ সনে জিয়াউর রহমানের আমলে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহের সঙ্গে শিক্ষার জন্য তাকে ‘স্বাধীনতা’ পদক দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পরে যে চারটি বীর খেতাব দেয়া হয়েছিল সেগুলো রণাঙ্গনে বীরত্বের জন্য; জিয়াউর রহমানসহ ৬৮ জনকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আমলে। তাই খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে তা খেতাব প্রদানকে বিতর্কিত করে তুলতে পারে। ইতোমধ্যে বিএনপি এই উদ্যোগের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলেছে। বিএনপির অভিযোগ অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কারণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক কাজই অতীতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নামকরণ করেছিল ‘এমএ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’; ২০০১ সনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে এই বিমানবন্দরের নাম পাল্টে দেয়; চট্টগ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় দরবেশ শাহ আমানতের নামে নামকরণ করা হলে তা আর আওয়ামী লীগের পক্ষে পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না বিধায় বিএনপি বিমানবন্দরের নামকরণ করে ‘শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। আওয়ামী লীগও একই কৌশল চালিয়ে প্রতিশোধ হিসেবে জিয়াউর রহমানের নামের বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে আরেকজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় দরবেশের নামে ঢাকার বিমানবন্দরের নামকরণ করে ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’।

খেতাব বাতিলের ব্যাপারে জামুকা যে প্রস্তাব এনেছে তা এখনও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গৃহীত হয়নি। জিয়াউর রহমান ব্যতীত অন্যদের খেতাব বাতিলে জনগণ মাথা ঘামাবে না, কারণ ওদের কোন জনভিত্তি নেই; কিন্তু বিএনপি জনপ্রিয় দল হওয়ায় এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জনতার নিকট একটি ইতিবাচক ইমেজ গড়ে উঠেছে। বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৯তম স্থানে আসেন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান। পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান হতে আনীত অস্ত্র খালাসের দায়িত্ব পালন থেকে ফিরিয়ে এনে জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধমুখী করার দায়িত্ব যারা পালন করেছিলেন তারাই তাকে মুক্তিযোদ্ধা হতে সহায়তা করেছিলেন, তিনিই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পড়েছিলেন, তিনিই যুদ্ধের ১১টি সেক্টরের মধ্যে একটি সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন, তিনিই বঙ্গবন্ধুর অধীনে চাকরি করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ বলে সম্বোধন করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করেছে।

জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা বলেই তার দল মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। বিএনপিতে মুক্তযুদ্ধবিরোধী শক্তি অনেক। বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে বলে দেশের একটি বৃহৎ অংশকে বিপরীত স্রোতে আস্তে আস্তে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তাই জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের প্রস্তাবটি বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অপরিহার্য ও জরুরি বলে মনে হয় না; রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের জন্যও এই পদক্ষেপ স্বস্তিকর হবে বলে মনে হয় না।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৮ ফাল্গুন ১৪২৭ ৮ রজব ১৪৪২

রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিল

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে মদত দেয়ার কারণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের একজন জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের প্রস্তাব করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা জামুকা। একই প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী এবং মোসলেহ উদ্দিনের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডিত চার পলাতক খুনির খেতাব স্থগিতের জন্য ইতিপূর্বে হাইকোর্ট একটি আদেশও দিয়েছিল। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় তার জড়িত থাকা, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগে সহায়তা দিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা, সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করা, একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি ‘জয় বাংলা’ বদল করে সেøাগান দেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘বাঙালি জাতীয়বাদ’-এর স্থলে বসিয়ে দেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। অনেকের ধারণা, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার আমলেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২০০৩ সনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বঙ্গবন্ধু এবং জিয়াউর রহমানকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে। যিনি বাংলাদেশের স্থপতি, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তাকে ‘স্বাধীনতা’ পদক দেয়ার মধ্যে ব্যাঙ্গ-পরিহাস থাকতে পারে। অন্যদিকে যৌথভাবে এই পদক দেয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানকে সমমর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার প্রয়াসও পরিলক্ষিত হয়। এই প্রয়াস রুদ্ধ করতেই ২০১৬ সনে আওয়ামী লীগ সরকার জিয়ার স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। খেতাব, পদক প্রত্যাহারের রীতি নতুন কিছু নয়। ১৯৬৩ সনে চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা ড. মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে সিতারা-ই-খিদমত উপাধীতে ভূষিত করলেও ৬ দফা আন্দোলন সমর্থন করার কারণে তার খেতাব পাকিস্তান সরকার কেড়ে নিয়েছিল। যারা আজ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের প্রস্তাবে নাখোশ ও মনক্ষুণœ তাদের খুশি হতে দেখা যায় মায়ানমারের অং সাং সূচির আন্তর্জাতিক কিছু খেতাব বাতিল হওয়ায়।

বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের সবাই আইনগত বৈধতা হারিয়েছেন। ১৯৭৫ সন থেকে ১৯৭৯ সন পর্যন্ত সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ২০০৫ সনে হাইকোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসা ও থাকা অবৈধ, তাই বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। ২০১০ সনে হাইকোর্টের রায়ে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার কারণে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের ক্ষমতায় আসা ও সেই সময়ের সব কর্মকা- অবৈধ হিসেবে গণ্য। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য পেশোয়ার হাইকোর্ট পাকিস্তানের জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমানের মৌন সমর্থন নিয়ে তর্কণ্ডবিতর্কের শেষ নেই, বিভিন্ন প্রেক্ষিত বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের নীরব ভূমিকা থাকার কথা কম-বেশি সবাই বিশ্বাস করে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর জিয়াউর রহমানের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ‘সো হোয়াট’ বিএনপির জন্য এখনও অস্বস্তিকর। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বাঁচানোর জন্য খোন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অংশ করায় বঙ্গবন্ধুর হত্যা ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। তবে বিচারের রায়ের পূর্বে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর হওয়ায় তার সংশ্লিষ্টতা আদালত দ্বারা প্রমাণিত নয়, কারণ বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তির বিচার হয় না।

ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভালোলাগা থেকেও রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়েছে। একাত্তরে শর্শিনা মাদ্রাসার ছাত্ররা রাজাকারে যোগ দেয়, তখন শর্শিনার দরবার, দরবারসংলগ্ন মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার ছাত্রাবাসসহ সব স্থাপনায় রাজাকার ও আলবদরদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এই শর্শিনার পীর আলহাজ মাওলানা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য জেলে নেয়া হয়েছিল; অথচ ১৯৮০ সনে জিয়াউর রহমানের আমলে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহের সঙ্গে শিক্ষার জন্য তাকে ‘স্বাধীনতা’ পদক দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পরে যে চারটি বীর খেতাব দেয়া হয়েছিল সেগুলো রণাঙ্গনে বীরত্বের জন্য; জিয়াউর রহমানসহ ৬৮ জনকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আমলে। তাই খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে তা খেতাব প্রদানকে বিতর্কিত করে তুলতে পারে। ইতোমধ্যে বিএনপি এই উদ্যোগের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলেছে। বিএনপির অভিযোগ অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কারণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক কাজই অতীতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নামকরণ করেছিল ‘এমএ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’; ২০০১ সনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে এই বিমানবন্দরের নাম পাল্টে দেয়; চট্টগ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় দরবেশ শাহ আমানতের নামে নামকরণ করা হলে তা আর আওয়ামী লীগের পক্ষে পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না বিধায় বিএনপি বিমানবন্দরের নামকরণ করে ‘শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। আওয়ামী লীগও একই কৌশল চালিয়ে প্রতিশোধ হিসেবে জিয়াউর রহমানের নামের বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে আরেকজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় দরবেশের নামে ঢাকার বিমানবন্দরের নামকরণ করে ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’।

খেতাব বাতিলের ব্যাপারে জামুকা যে প্রস্তাব এনেছে তা এখনও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গৃহীত হয়নি। জিয়াউর রহমান ব্যতীত অন্যদের খেতাব বাতিলে জনগণ মাথা ঘামাবে না, কারণ ওদের কোন জনভিত্তি নেই; কিন্তু বিএনপি জনপ্রিয় দল হওয়ায় এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জনতার নিকট একটি ইতিবাচক ইমেজ গড়ে উঠেছে। বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৯তম স্থানে আসেন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান। পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান হতে আনীত অস্ত্র খালাসের দায়িত্ব পালন থেকে ফিরিয়ে এনে জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধমুখী করার দায়িত্ব যারা পালন করেছিলেন তারাই তাকে মুক্তিযোদ্ধা হতে সহায়তা করেছিলেন, তিনিই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পড়েছিলেন, তিনিই যুদ্ধের ১১টি সেক্টরের মধ্যে একটি সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন, তিনিই বঙ্গবন্ধুর অধীনে চাকরি করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ বলে সম্বোধন করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করেছে।

জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা বলেই তার দল মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। বিএনপিতে মুক্তযুদ্ধবিরোধী শক্তি অনেক। বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে বলে দেশের একটি বৃহৎ অংশকে বিপরীত স্রোতে আস্তে আস্তে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তাই জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের প্রস্তাবটি বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অপরিহার্য ও জরুরি বলে মনে হয় না; রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের জন্যও এই পদক্ষেপ স্বস্তিকর হবে বলে মনে হয় না।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com