ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

শেখর ভট্টাচার্য

ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখালেখির অধিকাংশই বর্ণনামুখী অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে এর পরিসমাপ্তি। আমাদের স্কুল, কলেজের পাঠ্যবইতেও বর্ণনার ছড়াছড়ি। ধারাবাহিক বর্ণনার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে বর্ণনামুখী লেখা তো পড়তেই হবে; তবে এসব বর্ণনা পড়লে মনে হয় ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৪৮ সালের শুরুর দিকে আর এর পরিসমাপ্তি বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি। এ’ আন্দোলনের কোন দীর্ঘ প্রেক্ষাপট নেই, এর তাৎপর্য শুধু উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনকারীদের নানা নির্যাতন ভোগ করা যা ভাষা শহীদদের আত্মাহুতির মাধ্যমে অর্জিত হয়। এরপর কি, এরপর ‘আমার গল্পটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো’। এ রকম ধারা বর্ণনাতে মনে হয় ভাষা আন্দোলন বুঝি সে সময়ের ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের আমতলায় ছাত্র আন্দোলনের একটি স্থিরচিত্র মাত্র।

শুধু ভাষা আন্দোলন নয় আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের লেখালেখিও অনেকাংশে বর্ণনায় ভরপুর। বর্ণনার সঙ্গে প্রেক্ষাপট, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য না থাকায় আমাদের গড়পড়তা শিক্ষার্থীদের কাছে এসব দিন শুধু একটি জাতীয় দিবস হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ যে কোন জাতীয় দিবসের পূর্বে ইলেকট্রনিক মিডিয়া স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে, সে সমস্থ সাক্ষাৎকারে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করা হয় “আজ কি দিবস?” “এ’ দিবসের তাৎপর্য কি। “শিক্ষার্থীদের উত্তর শুনলে আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়। স্বাধীনতা দিবসে যে “রফিক সালাম বকত প্রান দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলো” এবং “ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছিল, এ ধরনের উত্তর শুনে “অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার” উপক্রম হয়। এ জন্য কোনভাবেই আমাদের শিক্ষার্থীদের দায়ী করা যায় না। এর দায় পাঠক্রম পরিকল্পনা এবং জাতীয় দিবসগুলোর তাৎপর্যবিহীন শুধু বর্ণনার উপস্থাপনা। ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণ এর রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষিত তুলে ধরলে শিক্ষার্থীরা এ রকমভাবে জাতীয় দিবসকে ব্যাখ্যা করত না। ভাষা আন্দোলন যে শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না এর পেছনে ছিল অর্থনৈতিকভাবে শোষণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সে কথাগুলো না থাকায় শিক্ষার্থীরা এ রকম অপ্রাসঙ্গিক এবং অর্থহীন উত্তর দিয়ে থাকে। পাঠ দানের ক্ষেত্রেও আমাদের প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত একটি গ্রহণ যোগ্য, কার্যকর মানের পাঠদান পদ্ধতি তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সামনে সঠিকভাবে ইতিহাস, ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পারছি না।

তবে এ কথাটি ঢালাওভাবে বলা অন্যায়, সংখ্যায় খুব কম হলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেকেই ভিন্নধর্মী লেখা লিখেছেন যার মধ্যে প্রথম যার নাম বলতে হবে তিনি হলেন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর। বদরুদ্দীন উমর এমন একজন চিন্তাবিদ, লেখক যার সঙ্গে আপনার কোন কোন বিষয়ে দ্বিমত হতে পারে কিন্তু তার বক্তব্যকে আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোকে তার মতো করে ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত আর কেউ করতে পারেননি, এ কথাটি অনেকেই মেনে নিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য তুলে ধরে একটি বই লিখা যে সময়ের দাবি ছিল, সেই দাবির প্রতি সবচেয়ে গঠনমূলকভাবে সাড়া দিতে পেরেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত ছিল। এ কথাটি আমরা বারবার বলে থাকি। কিন্তু যে আন্দোলন ছিল, শুধু ছাত্র-তরুণ ও শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন, তা কী করে দুই দশকের মধ্যে একটি জাতির জাগরণ ঘটিয়ে তাকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে নিয়ে আসে, এ বিষয়টিকে একনিষ্ঠভাবে গবেষণা করার প্রয়োজন বদরুদ্দীন উমর ছাড়া আর কেউ প্রয়োজন বোধ করেননি! শুধু ভাষা আন্দোলন নয় বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে বোঝার জন্য এ কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই অসীম গুরুত্ববহ কাজটি নির্মোহভাবে করতে পেরেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। রাজনীতি এবং সংস্কৃতির দক্ষ বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে তার ম্যাগনাম ওপাস পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি নামের তিন খণ্ডের বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেছিলেন ১৯৭০ সালে আর শেষ খণ্ডের প্রথম প্রকাশের কাল ছিল ১৯৮৫ ইংরেজি।

বদরুদ্দীন উমর নিজেই বলেছেন ‘ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রামাণ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি বই লেখা দরকার’Ñএবং তিনি এই বিবেচনা থেকেই এ ইটি লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বদরুদ্দীন উমর বইটি লেখার সময় সম্পূর্ণ নির্মোহ ছিলেন। এ ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যে কোন মতের মানুষের প্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অংশগ্রহণকারীর মতামত নির্দ্বিধায় তুলে ধরেছেন। এই অসাধারণ লেখক সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন, এ আন্দোলনকে আসলে শুধু ভাষার আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা অথবা ব্যাখ্যা করলে সেটা সঠিক হবে না। কারণ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি আন্দোলন কীভাবে কৃষক-শ্রমিকসহ গ্রামগঞ্জ সর্বত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে পৌঁছেছিল, সে ইতিহাস তো জানা প্রয়োজন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তখনকার তরুণ বাম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর বিস্তৃত পরিসরে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ১৯৪৮ থেকে সূচিত আন্দোলন এবং ’৫২-এর অগ্নিঝরা কয়েকটি দিন এবং তারপরে দেশের নানা প্রান্তে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ কীভাবে ধীরে ধীরে সংগ্রামের পথে এসেছে, সে কথা তথ্য-প্রমাণসহ লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয় হলোÑপাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলা ও বাঙালির মূল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার ইতিহাস। সেটি কেবল ভাষার আন্দোলনে সম্পন্ন হয়নি, এ দেশের মূলধারার রাজনীতি এবং কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-তরুণদের বিভিন্ন সংগঠনের ধারাবাহিক আন্দোলনের অবদানও তাতে কম নয়। তিন খণ্ডের এ বইয়ে এসব কথা সবিস্তারে আছে। বইটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে বোঝা যায় ধীরে ধীরে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবি থেকে বাঙালি কেন ও কীভাবে স্বাধীনতার দাবিতে এসে পৌঁছেছিল।

মানুষের জাগরণ, বা উত্থানের পেছনে থাকে কোন না কোন প্রেরণাদায়ী শক্তি। কিছু মানুষের চিন্তার আলো পথ দেখায় কোন সমাজ-জনগোষ্ঠীকে- তৈরি হয় নতুন সমাজ-সভ্যতা। ভাষাকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠার পশ্চাতেও নিশ্চয়ই ক্রিয়াশীল ছিল কিছু মানুষ, তাদের চিন্তা-কর্মকাণ্ড। তবে জগদ্বিখ্যাত দার্শনিকদের মতো তাদের নাম অতটা উজ্জ্বল না হলেও বাঙালির জাতির উত্থানপর্বে এদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য; কিংবা বলা যায়, তারা প্রচলিত অর্থে দার্শনিক নন- কিন্তু তারা যে-জীবনদৃষ্টির দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন, তা দার্শনিক।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগেই নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটি কারও কারও চিন্তায় চলে আসে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, কবি আহসান হাবীব, ভাষাসৈনিক আবদুল হক প্রমুখ বক্তৃতা বিবৃতি এবং পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন প্রকাশ্যে বিবৃতি প্রদান করলে ২৯ জুলাই (১৯৪৭) দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার পক্ষে তার অবস্থান তুলে ধরেন। আরও যারা বক্তব্য বা প্রবন্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটির যৌক্তিক দাবি অর্থাৎ বাংলার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেন তাদের মধ্যে সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী অন্যতম।

দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরে সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর সিলেটে ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক বক্তৃতাটি তার রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদ। এ সময় (১৯৪৮) ভাষা বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে অভিমত ব্যক্ত করেন তা ব্যাপক আলোড়ন তোলে- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের ছাপ এমনভাবে মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ উপর্যুক্ত বক্তব্যগুলোর ধরন ছিল গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক।

ভাষা আন্দোলনকে যেহেতু আমরা সবাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি তাই আমাদের উচিত ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর যোগসূত্রকে সহজভাবে জাতীর সামনে তুলে ধরার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজ করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে আমাদের উচিত পেছন ফিরে তাকানো। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যদি আমরা ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণ এবং তাৎপর্য জানাতে ব্যর্থ হই তাহলে তারা একটি গোলকধাঁধার মধ্যে থেকে জাতির ইতিহাসের অন্তমূলে প্রবেশ করতে উন্মুখ থাকবে। অন্ধকারে পথ হাতড়িয়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছা দুরূহ কাজ। বদরুদ্দীন উমরের মতো যারা ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে বহুমাত্রিকভাবে কাজ করেছেন তাদের গবেষণা কর্মকে আমরা সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারি। এ মুহূর্তে আমাদের উচিত ভাষা আন্দোলনের নির্মোহ ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্নিহিত কারণ, ভাষা আন্দোলনের প্রভাবের ব্যাখ্যা তুলে ধরে পাঠক্রমকে সহজ ও বোধগম্য করে সাজানো। মনে রাখতে হবে, এ ব্যাপারে যত দেরিতে উদ্যোগ নেয়া হবে, জটিলতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে এবং আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অস্পষ্ট এবং তাৎপর্যহীন অতীত ইতিহাস পাঠ করতে বাধ্য করব। সে পথ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া কী ঠিক হবে?

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৮ ফাল্গুন ১৪২৭ ৮ রজব ১৪৪২

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

শেখর ভট্টাচার্য

ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখালেখির অধিকাংশই বর্ণনামুখী অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে এর পরিসমাপ্তি। আমাদের স্কুল, কলেজের পাঠ্যবইতেও বর্ণনার ছড়াছড়ি। ধারাবাহিক বর্ণনার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে বর্ণনামুখী লেখা তো পড়তেই হবে; তবে এসব বর্ণনা পড়লে মনে হয় ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৪৮ সালের শুরুর দিকে আর এর পরিসমাপ্তি বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি। এ’ আন্দোলনের কোন দীর্ঘ প্রেক্ষাপট নেই, এর তাৎপর্য শুধু উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনকারীদের নানা নির্যাতন ভোগ করা যা ভাষা শহীদদের আত্মাহুতির মাধ্যমে অর্জিত হয়। এরপর কি, এরপর ‘আমার গল্পটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো’। এ রকম ধারা বর্ণনাতে মনে হয় ভাষা আন্দোলন বুঝি সে সময়ের ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের আমতলায় ছাত্র আন্দোলনের একটি স্থিরচিত্র মাত্র।

শুধু ভাষা আন্দোলন নয় আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের লেখালেখিও অনেকাংশে বর্ণনায় ভরপুর। বর্ণনার সঙ্গে প্রেক্ষাপট, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য না থাকায় আমাদের গড়পড়তা শিক্ষার্থীদের কাছে এসব দিন শুধু একটি জাতীয় দিবস হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ যে কোন জাতীয় দিবসের পূর্বে ইলেকট্রনিক মিডিয়া স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে, সে সমস্থ সাক্ষাৎকারে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করা হয় “আজ কি দিবস?” “এ’ দিবসের তাৎপর্য কি। “শিক্ষার্থীদের উত্তর শুনলে আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়। স্বাধীনতা দিবসে যে “রফিক সালাম বকত প্রান দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলো” এবং “ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছিল, এ ধরনের উত্তর শুনে “অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার” উপক্রম হয়। এ জন্য কোনভাবেই আমাদের শিক্ষার্থীদের দায়ী করা যায় না। এর দায় পাঠক্রম পরিকল্পনা এবং জাতীয় দিবসগুলোর তাৎপর্যবিহীন শুধু বর্ণনার উপস্থাপনা। ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণ এর রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষিত তুলে ধরলে শিক্ষার্থীরা এ রকমভাবে জাতীয় দিবসকে ব্যাখ্যা করত না। ভাষা আন্দোলন যে শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না এর পেছনে ছিল অর্থনৈতিকভাবে শোষণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সে কথাগুলো না থাকায় শিক্ষার্থীরা এ রকম অপ্রাসঙ্গিক এবং অর্থহীন উত্তর দিয়ে থাকে। পাঠ দানের ক্ষেত্রেও আমাদের প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত একটি গ্রহণ যোগ্য, কার্যকর মানের পাঠদান পদ্ধতি তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সামনে সঠিকভাবে ইতিহাস, ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পারছি না।

তবে এ কথাটি ঢালাওভাবে বলা অন্যায়, সংখ্যায় খুব কম হলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেকেই ভিন্নধর্মী লেখা লিখেছেন যার মধ্যে প্রথম যার নাম বলতে হবে তিনি হলেন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর। বদরুদ্দীন উমর এমন একজন চিন্তাবিদ, লেখক যার সঙ্গে আপনার কোন কোন বিষয়ে দ্বিমত হতে পারে কিন্তু তার বক্তব্যকে আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোকে তার মতো করে ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত আর কেউ করতে পারেননি, এ কথাটি অনেকেই মেনে নিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য তুলে ধরে একটি বই লিখা যে সময়ের দাবি ছিল, সেই দাবির প্রতি সবচেয়ে গঠনমূলকভাবে সাড়া দিতে পেরেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত ছিল। এ কথাটি আমরা বারবার বলে থাকি। কিন্তু যে আন্দোলন ছিল, শুধু ছাত্র-তরুণ ও শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন, তা কী করে দুই দশকের মধ্যে একটি জাতির জাগরণ ঘটিয়ে তাকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে নিয়ে আসে, এ বিষয়টিকে একনিষ্ঠভাবে গবেষণা করার প্রয়োজন বদরুদ্দীন উমর ছাড়া আর কেউ প্রয়োজন বোধ করেননি! শুধু ভাষা আন্দোলন নয় বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে বোঝার জন্য এ কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই অসীম গুরুত্ববহ কাজটি নির্মোহভাবে করতে পেরেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। রাজনীতি এবং সংস্কৃতির দক্ষ বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে তার ম্যাগনাম ওপাস পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি নামের তিন খণ্ডের বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেছিলেন ১৯৭০ সালে আর শেষ খণ্ডের প্রথম প্রকাশের কাল ছিল ১৯৮৫ ইংরেজি।

বদরুদ্দীন উমর নিজেই বলেছেন ‘ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রামাণ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি বই লেখা দরকার’Ñএবং তিনি এই বিবেচনা থেকেই এ ইটি লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বদরুদ্দীন উমর বইটি লেখার সময় সম্পূর্ণ নির্মোহ ছিলেন। এ ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যে কোন মতের মানুষের প্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অংশগ্রহণকারীর মতামত নির্দ্বিধায় তুলে ধরেছেন। এই অসাধারণ লেখক সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন, এ আন্দোলনকে আসলে শুধু ভাষার আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা অথবা ব্যাখ্যা করলে সেটা সঠিক হবে না। কারণ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি আন্দোলন কীভাবে কৃষক-শ্রমিকসহ গ্রামগঞ্জ সর্বত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে পৌঁছেছিল, সে ইতিহাস তো জানা প্রয়োজন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তখনকার তরুণ বাম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর বিস্তৃত পরিসরে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ১৯৪৮ থেকে সূচিত আন্দোলন এবং ’৫২-এর অগ্নিঝরা কয়েকটি দিন এবং তারপরে দেশের নানা প্রান্তে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ কীভাবে ধীরে ধীরে সংগ্রামের পথে এসেছে, সে কথা তথ্য-প্রমাণসহ লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয় হলোÑপাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলা ও বাঙালির মূল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার ইতিহাস। সেটি কেবল ভাষার আন্দোলনে সম্পন্ন হয়নি, এ দেশের মূলধারার রাজনীতি এবং কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-তরুণদের বিভিন্ন সংগঠনের ধারাবাহিক আন্দোলনের অবদানও তাতে কম নয়। তিন খণ্ডের এ বইয়ে এসব কথা সবিস্তারে আছে। বইটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে বোঝা যায় ধীরে ধীরে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবি থেকে বাঙালি কেন ও কীভাবে স্বাধীনতার দাবিতে এসে পৌঁছেছিল।

মানুষের জাগরণ, বা উত্থানের পেছনে থাকে কোন না কোন প্রেরণাদায়ী শক্তি। কিছু মানুষের চিন্তার আলো পথ দেখায় কোন সমাজ-জনগোষ্ঠীকে- তৈরি হয় নতুন সমাজ-সভ্যতা। ভাষাকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠার পশ্চাতেও নিশ্চয়ই ক্রিয়াশীল ছিল কিছু মানুষ, তাদের চিন্তা-কর্মকাণ্ড। তবে জগদ্বিখ্যাত দার্শনিকদের মতো তাদের নাম অতটা উজ্জ্বল না হলেও বাঙালির জাতির উত্থানপর্বে এদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য; কিংবা বলা যায়, তারা প্রচলিত অর্থে দার্শনিক নন- কিন্তু তারা যে-জীবনদৃষ্টির দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন, তা দার্শনিক।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগেই নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটি কারও কারও চিন্তায় চলে আসে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, কবি আহসান হাবীব, ভাষাসৈনিক আবদুল হক প্রমুখ বক্তৃতা বিবৃতি এবং পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন প্রকাশ্যে বিবৃতি প্রদান করলে ২৯ জুলাই (১৯৪৭) দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার পক্ষে তার অবস্থান তুলে ধরেন। আরও যারা বক্তব্য বা প্রবন্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গটির যৌক্তিক দাবি অর্থাৎ বাংলার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেন তাদের মধ্যে সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী অন্যতম।

দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরে সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর সিলেটে ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক বক্তৃতাটি তার রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদ। এ সময় (১৯৪৮) ভাষা বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে অভিমত ব্যক্ত করেন তা ব্যাপক আলোড়ন তোলে- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের ছাপ এমনভাবে মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ উপর্যুক্ত বক্তব্যগুলোর ধরন ছিল গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক।

ভাষা আন্দোলনকে যেহেতু আমরা সবাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি তাই আমাদের উচিত ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর যোগসূত্রকে সহজভাবে জাতীর সামনে তুলে ধরার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজ করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে আমাদের উচিত পেছন ফিরে তাকানো। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যদি আমরা ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণ এবং তাৎপর্য জানাতে ব্যর্থ হই তাহলে তারা একটি গোলকধাঁধার মধ্যে থেকে জাতির ইতিহাসের অন্তমূলে প্রবেশ করতে উন্মুখ থাকবে। অন্ধকারে পথ হাতড়িয়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছা দুরূহ কাজ। বদরুদ্দীন উমরের মতো যারা ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে বহুমাত্রিকভাবে কাজ করেছেন তাদের গবেষণা কর্মকে আমরা সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারি। এ মুহূর্তে আমাদের উচিত ভাষা আন্দোলনের নির্মোহ ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্নিহিত কারণ, ভাষা আন্দোলনের প্রভাবের ব্যাখ্যা তুলে ধরে পাঠক্রমকে সহজ ও বোধগম্য করে সাজানো। মনে রাখতে হবে, এ ব্যাপারে যত দেরিতে উদ্যোগ নেয়া হবে, জটিলতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে এবং আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অস্পষ্ট এবং তাৎপর্যহীন অতীত ইতিহাস পাঠ করতে বাধ্য করব। সে পথ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া কী ঠিক হবে?

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]