ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষায় বাংলা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি

অমর একুশের ভাষা শহীদদের সম্মানে এবং বিশ্বে বিভিন্ন ভাষার লোকসংখ্যা বিবেচনায় জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবির মধ্যদিয়ে গতকাল রাজধানীসহ সারাদেশে ‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হয়েছে। যথাযথ মর্যাদা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি স্মরণ করেছে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গকারী বাংলা মায়ের অকুতভয় দামাল ছেলেদের। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনতার হাতে ছিল পুষ্পার্ঘ্য, কণ্ঠে সেই কালজয়ী গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...।’ দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের দাবিও উঠেছে। পাশপাশি ছিল সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিহত করার প্রত্যয়।

প্রতি বছর একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙালির শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব। এরপর নামে সাধারণ মানুষের ঢল। প্রভাতফেরি করেও দলে দলে মানুষ ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়, সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত চলে এ পর্ব। তবে করোনা মহামারীর কারণে এবার সব কর্মসূচি পালতি হয়েছে সীমিত পরিসরে।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। রোববার প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ১ মিনিটে) রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাদের সামরিক সচিবরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এসএম সালাহউদ্দিন ইসলাম এবং এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকীব আহমেদ চৌধুরী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় অমর একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাজানো হয়। তারা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। একুশের প্রথম প্রহরে স্পিকারের পক্ষে জাতীয় সংসদের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতির পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এসময় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লির সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী ও লে. কর্নেল মুহাম্মদ ফারুক খান (অব.), তথ্যমন্ত্রী ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পরাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) প্রধান এবং আনসার বাহিনী প্রধান পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা, বিদেশি সংস্থার প্রধানগণ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

এর আগে মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় উপস্থিত হন। এ সময় হাজার হাজার মানুষ খালি পায়ে বুকে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে অপেক্ষায় থাকেন।

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা যখন অন্যায়ভাবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালির ওপরে চাপিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সারা পূর্ব বাংলা ফুঁসে উঠেছিল প্রতিবাদে, বিক্ষোভে। ঢাকার রাজপথ হয়ে উঠেছিল উত্তাল। ৬৯ বছর আগে এই দিনে (২১ ফেব্রুয়রি) পাকিস্তানি শাসকদের হুমকি-ধমকি, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভেঙে মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পথে নেমে এসেছিল ছাত্র, শিক্ষক, শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী অসংখ্য মানুষ। বসন্তের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তাদের বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া একটি মিছিলে গুলি চালানো হলো। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ বাংলা মায়ের অকুতোভয় সন্তানদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হলো দেশের মাটি। এক অভূতপূর্ব অধ্যায় সংযোজিত হলো মানব ইতিহাসে। সেই অনন্য ইতিহাসকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেসকো (জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা) ১৯৯৯ সালে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বাঙালির আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দিনটি সারা বিশ্বেই পালিত হয়ে আসছে।

যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই বীর শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে রাজধানীসহ সারাদেশের শহীদ মিনারে প্রভাতফেরি নিয়ে গেছেন সর্বস্তরের মানুষ। সাদা-কালো পোশাকে পুষ্পার্ঘ্য নিয়ে বড়দের সঙ্গে অংশ নিয়েছে নতুন প্রজন্ম। বাদ যায়নি কোমলমতি শিশুরাও। ফুলে ফুলে ভরে উঠে বাঙালির শোক আর অহংকারের এই মিনার। করোনাকালে জাতির এ ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস বিশ্ববাসীকে আবার জানান দিল- ‘সত্য সংগ্রাম আর মর্যাদার লড়াইয়ে বাঙালি পিছু হটার জাতি নয়, বাঙালিকে দাবায়ে রাখা যায়নি, যাবেও না।’

দিবসটি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানÑ অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও সিনেট সদস্যরা, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, গণফোরাম, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।

জাতিসংঘের সামনে অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা

কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ প্রকোপের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সামনে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে শনিবার দুপুর ১টা ১ মিনিটে উপস্থিত সর্বকনিষ্ঠ শিশু ৬ বছরের অনন্যা রায় প্রিয়ার হাত দিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যদিয়ে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ও বাঙালির চেতনা মঞ্চের উদ্যোগে জাতিসংঘের সামনে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। জাতিসংঘস্থ বাংলাদেশ মিশন, বাংলাদেশ কনস্যুলেট, বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, সাংষ্কৃতিক এবং আঞ্চলিক সংগঠনের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্যদিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কর্মসূচি পালিত হয়।

বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে দোয়া

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২১ উদযাপন উপলক্ষে গতকাল সকালে বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে আলোচনা, কুরআনখানি, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মো. মুশফিকুর রহমানের উপস্থিতিতে দোয়া ও মুনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান। অনুষ্ঠানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সব পরিচালকরা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মুসল্লিরা উপস্থিত ছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। দিবসটি উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সব বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, ৫০টি ইসলামিক মিশন, ৭টি ইমাম প্রশিক্ষণ একডেমি ও সব অফিসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টায় আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনায় কুরআনখানি দোয়া ও মুনাজাতের আয়োজন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। দিবসটি উপলক্ষে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আহ্বান জানানো হয়।

মুজিববর্ষ উদযাপন কমিটি

দিবসটি উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, কমিটির অন্যান্য সদস্যরা এবং কমিটির কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সম্মিলিতভাবে ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরাম

রোববার সকালে সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের সভাপতি একেএম জি কিবরিয়া মজুমদার, সিনিয়র সহসভাপতি এস এম মঞ্জুর, সহসভাপতি তারিক মাহমুদ, সহসভাপতি মঞ্জুর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আসিফ হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল খায়ের উজ্জ্বলসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের নেতারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। গতকাল ছিল সরকারি ছুটির দিন। ভাষাশহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। একই সঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হয় শোকের কালো পতাকা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়েছে।

সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৯ ফাল্গুন ১৪২৭ ৯ রজব ১৪৪২

ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষায় বাংলা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ -সংবাদ

অমর একুশের ভাষা শহীদদের সম্মানে এবং বিশ্বে বিভিন্ন ভাষার লোকসংখ্যা বিবেচনায় জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবির মধ্যদিয়ে গতকাল রাজধানীসহ সারাদেশে ‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হয়েছে। যথাযথ মর্যাদা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি স্মরণ করেছে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গকারী বাংলা মায়ের অকুতভয় দামাল ছেলেদের। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনতার হাতে ছিল পুষ্পার্ঘ্য, কণ্ঠে সেই কালজয়ী গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...।’ দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের দাবিও উঠেছে। পাশপাশি ছিল সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিহত করার প্রত্যয়।

প্রতি বছর একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙালির শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব। এরপর নামে সাধারণ মানুষের ঢল। প্রভাতফেরি করেও দলে দলে মানুষ ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়, সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত চলে এ পর্ব। তবে করোনা মহামারীর কারণে এবার সব কর্মসূচি পালতি হয়েছে সীমিত পরিসরে।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। রোববার প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ১ মিনিটে) রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাদের সামরিক সচিবরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এসএম সালাহউদ্দিন ইসলাম এবং এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকীব আহমেদ চৌধুরী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় অমর একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাজানো হয়। তারা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। একুশের প্রথম প্রহরে স্পিকারের পক্ষে জাতীয় সংসদের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতির পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এসময় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লির সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী ও লে. কর্নেল মুহাম্মদ ফারুক খান (অব.), তথ্যমন্ত্রী ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পরাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) প্রধান এবং আনসার বাহিনী প্রধান পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা, বিদেশি সংস্থার প্রধানগণ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

এর আগে মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় উপস্থিত হন। এ সময় হাজার হাজার মানুষ খালি পায়ে বুকে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে অপেক্ষায় থাকেন।

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা যখন অন্যায়ভাবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালির ওপরে চাপিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সারা পূর্ব বাংলা ফুঁসে উঠেছিল প্রতিবাদে, বিক্ষোভে। ঢাকার রাজপথ হয়ে উঠেছিল উত্তাল। ৬৯ বছর আগে এই দিনে (২১ ফেব্রুয়রি) পাকিস্তানি শাসকদের হুমকি-ধমকি, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভেঙে মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পথে নেমে এসেছিল ছাত্র, শিক্ষক, শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী অসংখ্য মানুষ। বসন্তের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তাদের বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া একটি মিছিলে গুলি চালানো হলো। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ বাংলা মায়ের অকুতোভয় সন্তানদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হলো দেশের মাটি। এক অভূতপূর্ব অধ্যায় সংযোজিত হলো মানব ইতিহাসে। সেই অনন্য ইতিহাসকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেসকো (জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা) ১৯৯৯ সালে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বাঙালির আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দিনটি সারা বিশ্বেই পালিত হয়ে আসছে।

যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই বীর শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে রাজধানীসহ সারাদেশের শহীদ মিনারে প্রভাতফেরি নিয়ে গেছেন সর্বস্তরের মানুষ। সাদা-কালো পোশাকে পুষ্পার্ঘ্য নিয়ে বড়দের সঙ্গে অংশ নিয়েছে নতুন প্রজন্ম। বাদ যায়নি কোমলমতি শিশুরাও। ফুলে ফুলে ভরে উঠে বাঙালির শোক আর অহংকারের এই মিনার। করোনাকালে জাতির এ ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস বিশ্ববাসীকে আবার জানান দিল- ‘সত্য সংগ্রাম আর মর্যাদার লড়াইয়ে বাঙালি পিছু হটার জাতি নয়, বাঙালিকে দাবায়ে রাখা যায়নি, যাবেও না।’

দিবসটি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানÑ অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও সিনেট সদস্যরা, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, গণফোরাম, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।

জাতিসংঘের সামনে অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা

কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ প্রকোপের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সামনে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে শনিবার দুপুর ১টা ১ মিনিটে উপস্থিত সর্বকনিষ্ঠ শিশু ৬ বছরের অনন্যা রায় প্রিয়ার হাত দিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যদিয়ে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ও বাঙালির চেতনা মঞ্চের উদ্যোগে জাতিসংঘের সামনে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। জাতিসংঘস্থ বাংলাদেশ মিশন, বাংলাদেশ কনস্যুলেট, বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, সাংষ্কৃতিক এবং আঞ্চলিক সংগঠনের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্যদিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কর্মসূচি পালিত হয়।

বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে দোয়া

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২১ উদযাপন উপলক্ষে গতকাল সকালে বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে আলোচনা, কুরআনখানি, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মো. মুশফিকুর রহমানের উপস্থিতিতে দোয়া ও মুনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান। অনুষ্ঠানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সব পরিচালকরা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মুসল্লিরা উপস্থিত ছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। দিবসটি উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সব বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, ৫০টি ইসলামিক মিশন, ৭টি ইমাম প্রশিক্ষণ একডেমি ও সব অফিসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টায় আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনায় কুরআনখানি দোয়া ও মুনাজাতের আয়োজন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। দিবসটি উপলক্ষে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আহ্বান জানানো হয়।

মুজিববর্ষ উদযাপন কমিটি

দিবসটি উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, কমিটির অন্যান্য সদস্যরা এবং কমিটির কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সম্মিলিতভাবে ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরাম

রোববার সকালে সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের সভাপতি একেএম জি কিবরিয়া মজুমদার, সিনিয়র সহসভাপতি এস এম মঞ্জুর, সহসভাপতি তারিক মাহমুদ, সহসভাপতি মঞ্জুর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আসিফ হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল খায়ের উজ্জ্বলসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের নেতারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। গতকাল ছিল সরকারি ছুটির দিন। ভাষাশহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। একই সঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হয় শোকের কালো পতাকা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়েছে।