শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, টিএসসি আর প্রান্তিকজনের ইতিহাস

আফসান চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নতুন ভবন নির্মাণ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন পত্রপত্রিকায় অনেক আলোচনা-সমালোচনা খেয়াল করছি। এদের অনেকে মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর উন্নয়নের দরকার। আবার অনেকেই মনে করছেন, উন্নয়ন হতে হলে ইতিহাস বা ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই হতে হবে। উন্নয়ন বলতে শুধু বহুতল বিশাল ভবন নির্মাণ করে ‘ইতিহাস ঐতিহ্যের খেতা পুড়ি’ ধরনের কার্যক্রমকে বোঝায় না।

কিন্তু আমি তো এদের কোন পথেই হাঁটছি না। এর কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিকে ছাত্র-শিক্ষকের প্রাণকেন্দ্র বলা হলেও আমার জন্য এটি প্রাণকেন্দ্র ছিল না। ১৯৭২-৭৭ সাল পর্যন্ত ছাত্রজীবনে আমি খুব বেশি টিএসসিতে যাইনি। আমার আড্ডাস্থল ছিল শরীফ মিয়ার ক্যন্টিন।

কিন্তু এই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন আসলে কী ছিল?

শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন ছিল শিল্প-সাহিত্য-চিত্রকলা-সঙ্গীতের এক মহা তীর্থস্থান। কে আসতেন না সেখানে? শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তৎপর এমন সবাই আসতেন। তারা যে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন, তা নয়।

এই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের কথা কিন্তু এখন প্রায় মানুষই ভুলে গেছে বা জানে না। অথচ আমাদের প্রজন্মের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হতো এই ছোট্ট ছাপড়া বেঁড়ার ছাউনির নিচে।

এই ছোট্ট ছাপড়াটা কীভাবে সেই সৃজনশীল প্রতিভা ধরদের মুক্তচিন্তার ছাউনি আর সৃষ্টির আশ্বাস দিত, তা এখন ভাবলে অবাক লাগে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একে উঠিয়ে দিয়েছিল। আমার মনে আছে সেদিনের কথা, শরীফ মিয়া চুপ করে বসে ছিলেন। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মনে খুব আঘাত লেগেছিল আমার। কারণ, শরীফ মিয়ার ওই ছোট্ট ঝুপড়ির সঙ্গে মিশে আছে আমাদের আত্মার বন্ধন।

কিন্তু এই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন যখন গুঁড়িয়ে দেয়া হলো, তা নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য বা প্রচার হলো না, যতটা আজ টিএসসিকে নিয়ে হচ্ছে। কারণ, টিএসসি তো শরীফ মিয়ার মতো ছোট্ট কোন ছাপড়া নয়। এখানে শিক্ষক-ছাত্রসহ সব বড় বড় ব্যক্তিত্বের যাতায়াত। গ্রিক স্থপতির নির্মিত এই টিএসসিতে সরকারি অনুদানও রয়েছে অনেক। তাই টিএসসির জন্যই আমাদের সব কান্না থাকবে; ও রকম একটা ঝুপড়ির জন্য তো নয়।

কিন্তু শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন আমাদের যা দিয়েছে, তা নিয়ে আজ কোথাও কোন কিছু উচ্চারিত হয় না। আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও সগর্বে বলতে পারি, আমি শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন থেকে যা শিখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তা শিখিনি। কিন্তু ক্যান্টিনটি নিয়ে কেউ তেমন কোন দুঃখ করেনি। এই ক্যান্টিন নিয়ে একটি লেখাও লিখেছিলাম; কিন্তু সেটিও তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ, ও রকম একটা সামান্য ঝুপড়ির জন্য কাঁদলে তো আর নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক বলে প্রচার করা সাজে না!

কিন্তু কেন? তাহলে কি মানুষের মন নির্বাচিত ইতিহাসকে নিয়েই কাঁদে শুধু? বাংলাদেশের মানুষ কি তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখতে কেবল বেছে বেছে প্রাতিষ্ঠানিক আর বড় বড় ইতিহাসকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়?

উত্তর, হ্যাঁ। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বড় বড় কথা বলি ঠিকই, কিন্তু জানতে চাই না এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের সাধারণ মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা; জানতে চাই না জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের সেসব শহীদের কথা; জানতে চাই না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব শহীদের আত্মত্যাগের গল্প।

বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে বড় বড় সেমিনার, বক্তৃতা এবং বিশেষ দিনগুলোতে বড় বড় স্তম্ভে ফুল দিয়েই আমাদের দায়িত্ব খালাস। যে কারণে আমাদের ইতিহাসগুলোও রয়ে যায় ভীষণভাবে অসম্পূর্ণ এবং নির্বাচিত।

আমাদের এই স্মৃতিবিলাসিতা যদি নস্টালজিয়ার সীমানা পার হয়ে ঐতিহাসিকতার সীমানায় যেত, ভালো হতো। তাহলে আমরা দালান-কোঠার বাইরে গিয়ে স্মৃতি খুঁজতাম, রক্ষা করার চেষ্টা করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন স্মৃতিরক্ষার যে আন্দোলন চলছে, সেখানে কতটুকু ৭১-এর স্মৃতি মিশে আছে?

আমাদের চোখে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রের প্রতীক মধুর ক্যান্টিন। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে জড়ো হতো। কিন্তু মধুদা মানুষটা কে ছিলেন, তার কী হয়েছিলÑ সেই খবর আমরা রাখি না। কারণ, আমাদের কাছে ক্যান্টিনটি বড়; সেই মানুষ বা তার ভূমিকা নয়।

এই মধুদার মতো অনেক হিন্দুর সেই ভয়াল ২৫ মার্চ রাতে মেরে ফেলা হয় জগন্নাথ হলে; আমরা তাদের খবর রাখিও না, রাখতে চাইও না। কারণ, তাদের নিয়ে তেমন কোন স্মৃতিস্তম্ভ দালান-কোঠার চিহ্ন নেই।

তাই এ কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, প্রান্তিক মানুষদের ভুলে যাওয়াটাই আমাদের ইতিহাস চর্চার অন্যতম লক্ষ্য।

টিএসসি থাকল কি গেল, এতে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু এসে যায় না: গেলে যাবে, থাকলে থাকবে। ওটা আমার ইতিহাসের অংশ নয়; তাই কোন বাড়তি পিরিতও নেই।

তবে কোনটা মনে রাখার যোগ্য আর কোনটা অযোগ্য, তার একটা নিরিখ করা দরকার। সেই নিরিখে সাধারণ ঝুপড়ি বা সাধারণ মানুষের ইতিহাস থাকবে না। কারণ, তার জন্য ফেসবুক গরম করার দরকার হয় না; কারণ, ব্রাত্যদের, প্রান্তিকদের ইতিহাসকে হয়তো ইতিহাস বলেই আমরা স্বীকৃতি দিই না।

ঝুপড়ির আবার ইতিহাস কী? গরিবের আবার মুক্তিযুদ্ধ কী? জগন্নাথ হলের যে নারী এই রাতের দাহ্য স্মৃতি ভুলতে পারে না, সে কে? তাই আমরা ‘৭১ খুঁজি বড় বড় দালান-কোঠায়, কংক্রিটের মিনারে, বড় মানুষদের স্মৃতিচারণে। ...

আমরা তো গ্রামে গিয়ে জানতে চাইব না, ‘কয়জন মারা গেছিল? কেমনে? কয়টা বিধবা হইছিল? হেরা গেছিল কই? কেমনে? পাকিস্তান আর্মি হেগো কবরের ওপর খাড়ায়া মুতছিল?’ ওইসব ইতিহাস তো দূরের কথা, স্মৃতিধারণেরও যোগ্য নয়। তাই কেউ জানে না, সত্যিকারের ’৭১ দেখতে কেমন ছিল।

যেদিন শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন ভেঙে দিল, আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। কবি নির্মলেন্দু গুণ তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন মাটিতে বসা শরীফ মিয়াকে, ‘এবার কী করবেন, কই যাবেন?’ শরীফ মিয়া না তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘জানি না।’

সত্যিকারের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে আমরা লালন করতে পারি না আমাদের মাঝে। টিএসসির বেলায়ও আমি তাই-ই বলব। খুব খারাপ শোনালেও এটাই বাস্তব। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের মতো (আপাত চোখে) ক্ষুদ্র ইতিহাস, ঐতিহ্যগুলোকে আমরা মনে রাখতে চাই না। কারণ টিএসসির মতো বড় বড়, খ্যাতিমান বিষয়ের প্রতিই আমাদের যাবতীয় সব আগ্রহ আর আবেগ।

আমাদের ইতিহাস কোনটা, সেটা নির্ভর করে আমরা কে, আর কী মনে রাখতে চাই।

আমরা কোন স্মৃতি বা প্রতিষ্ঠান রক্ষা করার জন্য লড়তে চাই, কেন ক্ষমতাবান বা অভিজাত মানুষের ইতিহাস মনে রাখি আর প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস ভুলে যাই? এটি কোন ধরনের ইতিহাস সচেতনতা? এই প্রশ্নটিই আমার সবার কাছে। তার সুতা ধরে টান দিলে অনেক দূর পর্যন্ত যাবে, একেবারে টিএসসি পর্যন্ত।

[লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক]

সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৯ ফাল্গুন ১৪২৭ ৯ রজব ১৪৪২

শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, টিএসসি আর প্রান্তিকজনের ইতিহাস

আফসান চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নতুন ভবন নির্মাণ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন পত্রপত্রিকায় অনেক আলোচনা-সমালোচনা খেয়াল করছি। এদের অনেকে মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর উন্নয়নের দরকার। আবার অনেকেই মনে করছেন, উন্নয়ন হতে হলে ইতিহাস বা ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই হতে হবে। উন্নয়ন বলতে শুধু বহুতল বিশাল ভবন নির্মাণ করে ‘ইতিহাস ঐতিহ্যের খেতা পুড়ি’ ধরনের কার্যক্রমকে বোঝায় না।

কিন্তু আমি তো এদের কোন পথেই হাঁটছি না। এর কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিকে ছাত্র-শিক্ষকের প্রাণকেন্দ্র বলা হলেও আমার জন্য এটি প্রাণকেন্দ্র ছিল না। ১৯৭২-৭৭ সাল পর্যন্ত ছাত্রজীবনে আমি খুব বেশি টিএসসিতে যাইনি। আমার আড্ডাস্থল ছিল শরীফ মিয়ার ক্যন্টিন।

কিন্তু এই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন আসলে কী ছিল?

শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন ছিল শিল্প-সাহিত্য-চিত্রকলা-সঙ্গীতের এক মহা তীর্থস্থান। কে আসতেন না সেখানে? শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তৎপর এমন সবাই আসতেন। তারা যে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন, তা নয়।

এই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের কথা কিন্তু এখন প্রায় মানুষই ভুলে গেছে বা জানে না। অথচ আমাদের প্রজন্মের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হতো এই ছোট্ট ছাপড়া বেঁড়ার ছাউনির নিচে।

এই ছোট্ট ছাপড়াটা কীভাবে সেই সৃজনশীল প্রতিভা ধরদের মুক্তচিন্তার ছাউনি আর সৃষ্টির আশ্বাস দিত, তা এখন ভাবলে অবাক লাগে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একে উঠিয়ে দিয়েছিল। আমার মনে আছে সেদিনের কথা, শরীফ মিয়া চুপ করে বসে ছিলেন। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মনে খুব আঘাত লেগেছিল আমার। কারণ, শরীফ মিয়ার ওই ছোট্ট ঝুপড়ির সঙ্গে মিশে আছে আমাদের আত্মার বন্ধন।

কিন্তু এই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন যখন গুঁড়িয়ে দেয়া হলো, তা নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য বা প্রচার হলো না, যতটা আজ টিএসসিকে নিয়ে হচ্ছে। কারণ, টিএসসি তো শরীফ মিয়ার মতো ছোট্ট কোন ছাপড়া নয়। এখানে শিক্ষক-ছাত্রসহ সব বড় বড় ব্যক্তিত্বের যাতায়াত। গ্রিক স্থপতির নির্মিত এই টিএসসিতে সরকারি অনুদানও রয়েছে অনেক। তাই টিএসসির জন্যই আমাদের সব কান্না থাকবে; ও রকম একটা ঝুপড়ির জন্য তো নয়।

কিন্তু শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন আমাদের যা দিয়েছে, তা নিয়ে আজ কোথাও কোন কিছু উচ্চারিত হয় না। আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও সগর্বে বলতে পারি, আমি শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন থেকে যা শিখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তা শিখিনি। কিন্তু ক্যান্টিনটি নিয়ে কেউ তেমন কোন দুঃখ করেনি। এই ক্যান্টিন নিয়ে একটি লেখাও লিখেছিলাম; কিন্তু সেটিও তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ, ও রকম একটা সামান্য ঝুপড়ির জন্য কাঁদলে তো আর নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক বলে প্রচার করা সাজে না!

কিন্তু কেন? তাহলে কি মানুষের মন নির্বাচিত ইতিহাসকে নিয়েই কাঁদে শুধু? বাংলাদেশের মানুষ কি তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখতে কেবল বেছে বেছে প্রাতিষ্ঠানিক আর বড় বড় ইতিহাসকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়?

উত্তর, হ্যাঁ। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বড় বড় কথা বলি ঠিকই, কিন্তু জানতে চাই না এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের সাধারণ মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা; জানতে চাই না জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের সেসব শহীদের কথা; জানতে চাই না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব শহীদের আত্মত্যাগের গল্প।

বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে বড় বড় সেমিনার, বক্তৃতা এবং বিশেষ দিনগুলোতে বড় বড় স্তম্ভে ফুল দিয়েই আমাদের দায়িত্ব খালাস। যে কারণে আমাদের ইতিহাসগুলোও রয়ে যায় ভীষণভাবে অসম্পূর্ণ এবং নির্বাচিত।

আমাদের এই স্মৃতিবিলাসিতা যদি নস্টালজিয়ার সীমানা পার হয়ে ঐতিহাসিকতার সীমানায় যেত, ভালো হতো। তাহলে আমরা দালান-কোঠার বাইরে গিয়ে স্মৃতি খুঁজতাম, রক্ষা করার চেষ্টা করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন স্মৃতিরক্ষার যে আন্দোলন চলছে, সেখানে কতটুকু ৭১-এর স্মৃতি মিশে আছে?

আমাদের চোখে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রের প্রতীক মধুর ক্যান্টিন। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে জড়ো হতো। কিন্তু মধুদা মানুষটা কে ছিলেন, তার কী হয়েছিলÑ সেই খবর আমরা রাখি না। কারণ, আমাদের কাছে ক্যান্টিনটি বড়; সেই মানুষ বা তার ভূমিকা নয়।

এই মধুদার মতো অনেক হিন্দুর সেই ভয়াল ২৫ মার্চ রাতে মেরে ফেলা হয় জগন্নাথ হলে; আমরা তাদের খবর রাখিও না, রাখতে চাইও না। কারণ, তাদের নিয়ে তেমন কোন স্মৃতিস্তম্ভ দালান-কোঠার চিহ্ন নেই।

তাই এ কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, প্রান্তিক মানুষদের ভুলে যাওয়াটাই আমাদের ইতিহাস চর্চার অন্যতম লক্ষ্য।

টিএসসি থাকল কি গেল, এতে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু এসে যায় না: গেলে যাবে, থাকলে থাকবে। ওটা আমার ইতিহাসের অংশ নয়; তাই কোন বাড়তি পিরিতও নেই।

তবে কোনটা মনে রাখার যোগ্য আর কোনটা অযোগ্য, তার একটা নিরিখ করা দরকার। সেই নিরিখে সাধারণ ঝুপড়ি বা সাধারণ মানুষের ইতিহাস থাকবে না। কারণ, তার জন্য ফেসবুক গরম করার দরকার হয় না; কারণ, ব্রাত্যদের, প্রান্তিকদের ইতিহাসকে হয়তো ইতিহাস বলেই আমরা স্বীকৃতি দিই না।

ঝুপড়ির আবার ইতিহাস কী? গরিবের আবার মুক্তিযুদ্ধ কী? জগন্নাথ হলের যে নারী এই রাতের দাহ্য স্মৃতি ভুলতে পারে না, সে কে? তাই আমরা ‘৭১ খুঁজি বড় বড় দালান-কোঠায়, কংক্রিটের মিনারে, বড় মানুষদের স্মৃতিচারণে। ...

আমরা তো গ্রামে গিয়ে জানতে চাইব না, ‘কয়জন মারা গেছিল? কেমনে? কয়টা বিধবা হইছিল? হেরা গেছিল কই? কেমনে? পাকিস্তান আর্মি হেগো কবরের ওপর খাড়ায়া মুতছিল?’ ওইসব ইতিহাস তো দূরের কথা, স্মৃতিধারণেরও যোগ্য নয়। তাই কেউ জানে না, সত্যিকারের ’৭১ দেখতে কেমন ছিল।

যেদিন শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন ভেঙে দিল, আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। কবি নির্মলেন্দু গুণ তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন মাটিতে বসা শরীফ মিয়াকে, ‘এবার কী করবেন, কই যাবেন?’ শরীফ মিয়া না তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘জানি না।’

সত্যিকারের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে আমরা লালন করতে পারি না আমাদের মাঝে। টিএসসির বেলায়ও আমি তাই-ই বলব। খুব খারাপ শোনালেও এটাই বাস্তব। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের মতো (আপাত চোখে) ক্ষুদ্র ইতিহাস, ঐতিহ্যগুলোকে আমরা মনে রাখতে চাই না। কারণ টিএসসির মতো বড় বড়, খ্যাতিমান বিষয়ের প্রতিই আমাদের যাবতীয় সব আগ্রহ আর আবেগ।

আমাদের ইতিহাস কোনটা, সেটা নির্ভর করে আমরা কে, আর কী মনে রাখতে চাই।

আমরা কোন স্মৃতি বা প্রতিষ্ঠান রক্ষা করার জন্য লড়তে চাই, কেন ক্ষমতাবান বা অভিজাত মানুষের ইতিহাস মনে রাখি আর প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস ভুলে যাই? এটি কোন ধরনের ইতিহাস সচেতনতা? এই প্রশ্নটিই আমার সবার কাছে। তার সুতা ধরে টান দিলে অনেক দূর পর্যন্ত যাবে, একেবারে টিএসসি পর্যন্ত।

[লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক]