সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
প্রতিটি ঐতিহ্যবাহী জাতি-ই তার নিজস্ব ভাষাকে দরদ দিয়ে লালন করে থাকে। এমনো কিছু দেশ রয়েছে যেখানে গিয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বললে বা কিছু জানতে চাইলে তারা মুখ ফিরেও তাকাতে চায় না। একবার ইউরোপের একটি দেশে বেড়াতে গিয়ে সে ধারণাই আমি পেয়েছি। কি পর্যটক, কি স্থায়ী বাসিন্দা কোন কিছুর তোয়াক্কাই তারা করেনা। আবার কখনো কখনো এও দেখা যায়, নেহায়েত প্রয়োজনে যদি ইংরেজির আশ্রয় নিতেই হয় তাহলে তাদের কথায় বা উচ্চারিত স্বরের মাধ্যমে স্বীয় জাতি সত্তার অস্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে। ফ্রেন্স, ইটালিয়ান, পোলিশ কিংবা রাশিয়ানরা ইংরেজিতে কথা বললেও তাদের একটা নিজস্ব কণ্ঠস্বর (Ac-cent) বজায় রাখে যাতে করে সহজেই তারা তাদের নিজেদের জাতীয় পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় মতবিনিময়ের আন্তর্জাতিক মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে ব্যবহার করলেও তারা তাদের স্বীয় মাতৃভাষার কণ্ঠ স্বর বা Ac-cent কে পরিহার করে নিজেকে মেকি ইংলিশের রসাতলে ডুবিয়ে দেন না।
আমরা যারা প্রবাসে আছি তাদের অনেকের মধ্যে এ মেকি ভূতটা কাজ করে বেশ। নিজেকে স্থানীয়ভাবে ‘অতিযোগ্য’ করে তোলার মনমানসিকতায় নিজেদের স্বকীয় কণ্ঠস্বরকে বিকৃত করে তা গুলিয়ে ফেলে ইংলিশ নামক আগ্রাসনধর্মী ভাষাটির অতলান্তিকে। আমি ইংলিশকে খাটো করে দেখছি না বা শুদ্ধভাবে ইংলিশ বলা থেকে বিরত থাকতেও বলছি না। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বাংলা ব্যবহার করতে না পারলে ইংরেজিতে ভাব আদান প্রদান করেও শুধু মাত্র কণ্ঠস্বরের স্বকীয়তার মাধ্যমেই স্বীয় জাতীয়তাবাদের পরিচয় ঘটানো সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, ‘অতিযোগ্য’ বা ‘অতিআধুনিক’ মুদ্রা দোষে দুষ্ট হয়ে আমাদের প্রবাসীদের অনেকেই বরং উল্টো পথে হাঁটেন।
দু’বছর আগের কথা। নিউইয়র্ক প্রবাসী এক আইরিশ ভদ্রলোক। সেখানে তিনি একটি পত্রিকায় কর্মরত। এক চা সন্ধার দাওয়াতে তার সঙ্গে দেখা। যিনি আমাদের হোস্ট, তিনি হলেন ওই ভদ্রলোকের বড় বোন। প্রৌঢ়া এ মহিলা আমার স্ত্রীকে মেয়ের মতো স্নেহ করেন। সে সুবাদে তার প্রবাসী ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই মূলত এ চা সন্ধ্যার আয়োজন।
প্রায় এক দশকের মতো আয়ারল্যান্ডে বসবাস করার পরো আমার কথায় কোন আইরিশ অপ-পবহঃ পাননি। বিষয়টা তাকে বেশ অবাক করেছে। সে সূত্র ধরেই তিনি বললেন, ১৪ বছর ধরে আমি আমেরিকায়। কিন্তু এমেরিকান ইংলিশ আমাকে কাবু করতে পারেনি। আমি আমার স্বীয় ভাষার স্বকীয়তাকে হারাতে দেইনি। এ জন্য স্থানীয়দের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। তাতে কি! নিজের স্বাতন্ত্র ধরে রাখতে পারছি সেতো কম কথা নয়।’
আইরিশ ভদ্রলোকের উদাহরণটি টানলাম এ জন্যে যে, ওদের নিজস্ব ভাষা (আইরিশ) থাকলেও কেউ এ ভাষায় কথা বলে না। সবাই ইংরেজিতেই কথা বার্তা বলে। ব্রিটিশ প্রদত্ত ইংরেজি-ই তাদের আপন ভাষা। সে ভাষা প্রাপ্তির জন্য তাদের কোন যুদ্ধ করতে হয়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের গুলিতে কাউকে শহীদ হতে হয়নি। তারপরও ব্রিটিশ বা আইরিশ ইংলিশের পুরোনো ঐতিহ্য যেন আমেরিকান ইংলিশের কাছে মলিন না হয়ে যায় সে ব্যাপারে তারা সদা তৎপর।
আমাদের প্রবাসীরা বিভিন্ন দিবস বা উৎসব পালন করার মতো শোক ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারিকেও বেশ ঘটা করে পালন করেন। যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে শহীদ মিনার গড়ে তোলার গৌরবও অর্জন করেছেন। যেসব দেশ পিছিয়ে ছিল তারাও এখন আর কম এগিয়ে নেই। এ রকম অগ্রগামী দেশের মধ্যে আয়ারল্যান্ডও একটি। এখানেও একুশ পালিত হয় জমজমাটভাবে। কয়েক বছর আগে আয়ারল্যান্ডে গলওয়ে বাঙালি কমিউনিটি কর্তৃক সল্টহিল হোটেলে আলোচনা সভা পালন করতে গিয়ে কাটের তৈরি শহীদ মিনারে গাদা গাদা ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছিল তা সত্যি যেমন ছিল আবেগঘন মুহূর্ত, তেমনি মনোমুগ্ধকরও বটে। আইরিশ বাঙালি তথা নতুন প্রজন্মের জন্য ছিল যেন এক সাক্ষাৎ ইতিহাস।
রাজধানী ডাবলিনও পিছিয়ে নেই। আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত সব বাঙালি ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গেয়ে প্রভাত ফেরির মাধ্যমে সমস্থ শহর ঘুরে বেড়ায়। উদ্দেশ্য, শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক স্থানীয়ভাবে দেশি-বিদেশি সবার কাছে এর মর্ম বাণী পৌঁছে দেয়া। যথাযত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে একটা শহীদ মিনার গড়ে তোলার চেষ্টা করা। মূলত এ ধরনের চেষ্টা বিশ্বের অনেক দেশেই বাঙালিরা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে হ্যাঁ যে সব দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে, সে সব দেশে সরকারি উদ্যোগে হলেও শহীদ মিনার গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। একুশের চেতনাকে বহির্বিশ্বে সমুন্নত ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শহীদ মিনারের বিকল্প নেই।
ভাষা দিবসকে সামনে রেখে প্রবাসীরা যা করছেন তা সবই সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় কার্যক্রম। কিন্তু ওই একটি বিশেষ দিনে কেবল র্যালি, সভা সমাবেশের ভেতরেই যেন একুশের চেতনা আটকে না থাকে সে দিকে আমাদের সবিশেষ নজর দিতে হবে। বাঙালিয়ানা কণ্ঠ বজায়ে রেখেও যে শুদ্ধ ইংরেজি বলা সম্ভব তাও দরদ দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। মেকি ইংলিশে বলীয়ান হয়ে মাতৃভাষার মর্মমুলে যেন আমরা নিজের অজান্তেই কেউ আঘাত না হানি।
যারা প্রবাসে কর্মরত তারা ব্যক্তিগতভাবেও বিভিন্ন উপায়ে বাংলা ভাষার পরিচিতি তুলে ধরতে পারেন। যে কোন দেশেই একজন প্রবাসী বসবাস করুননা কেন, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন সহকর্মীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ মেলে। দিনে দিনে ভাব বা সখ্য গড়ে উঠে। তার সুবাদে একজন প্রবাসী ব্যক্তি যদি ১০ জন ভিনদেশীর কাছে আমাদের ভাষার ঐতিহ্য, একুশের অহঙ্কার ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার গৌরব বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন সে ক্ষেত্রে প্রচার ও প্রসারের মাত্রা এক বিরাট পরিসংখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, এমন ইতিহাস কি পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি আছে?
অনেক প্রবাসী মা বাবা আছেন যারা সন্তান-সন্ততির সঙ্গে বাসা বাড়িতেও কথা বলার ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। একুশের চেতনাকে সমুন্নত রেখে বাংলা ভাষার গৌরবোজ্জ্বলকে ধরে রাখতে হলে এ ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। শুধু তাই নয়, বিদেশে জন্ম নেয়া এমন অনেক শিশু কিশোর আছে যারা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারলেও লেখাপড়ার ক্ষেত্রে একেবারেই অক্ষম। সে অক্ষমতা তাদের নিজের দোষে নয়। অনেক মা বাবার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কর্ম ব্যস্ততা বা সীমাবদ্ধতার দরুন বাংলায় হাতেখড়ি দিয়ে উঠতে পারেন না। কিছু বাংলা মিশনারি স্কুল থাকলেও সেগুলোতে সব ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি সম্ভব হয়ে উঠে না। তাছাড়া স্থানীয় স্কুলগুলোতেও বাংলা শিক্ষা দানের কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রবাসী ছেলেমেয়েদের এ ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক বাংলা মিশনারি স্কুল গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে প্রবাসী অভিবাবকরা জরো হয়ে বাংলা শিক্ষা প্রচলনের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করতে পারেন। বাংলাকে পাঠ্যসূচির আওতাভুক্ত করতে হবে এমন কোন কথা নেই। কর্তৃপক্ষ যাতে এমন একজন শিক্ষক নিয়োগ করেন যিনি শুধু বাংলা ভাষা পাঠ দানের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবেন। এছাড়াও ডিজিটাল যুগের সুযোগ নিয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিজস্ব মতামত, জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়া যায় অতি সহজেই। শিক্ষা দানের ক্ষেত্রেও কেউ কেউ এ পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। অন লাইনভিত্তিক “এসো বাংলা শিখি” জাতীয় প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। স্কাইপের মাধ্যমে অতি সহজেই প্রাইভেট শিক্ষকের কার্যক্রম চালানো সম্ভব। ঘরে বসেও বিশ্বের যে কোন দেশে বসবাসরত ইচ্ছুক ছেলেমেয়েদের বাংলা শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে। অনেকে এটাকে আর্থিক উপার্জনের একটি আংশিক উপায় হিসেবেও বেছে নিতে পারেন।
পৃথিবীর কোন ভাষাই সম্ভবত আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব মুক্ত নয়। এমনকি ইংরেজি ভাষাতেও রয়েছে আঞ্চলিকতার ব্যপক প্রভাব। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও এর প্রভাবমুক্ত নয়। সন্দেহ নেই, আঞ্চলিক ভাষা যোগ হয়ে কখনও কখনও মূল ভাষাকে অলঙ্কারের সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ করে তোলে। কিন্তু সে আঞ্চলিক ভাষা যদি মূল ভাষার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে চায় সেখানেই যতো আশঙ্কা। আজকাল দেশ বিদেশের অনেক ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে এর ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রবাসে কিছু স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে বিভিন্ন টক শো, লাইভ শো বা প্রচারিত নাটকের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার বেশ প্রচলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এ মাত্রা ছাড়িয়ে প্রিন্ট মিডিয়াতেও এক দিন তা পা ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হলেও একেবারে অমূলক বলা যাবে না।
কথ্য ভাষার অন্য রূপ আঞ্চলিক ভাষা। সে অর্থে আমরা কেউ এর বাইরে নই। তাই আঞ্চলিক ভাষার প্রতি গভীর মমতা ও শ্রদ্ধাবোধ রেখেই বলছি, জাতীয় অঙ্গনে শুদ্ধ বাংলা বিকাশের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা যেন কণ্টক হয়ে না দাঁড়ায় সে বিষয়টা আমাদের সবার মাথায় রাখা উচিত। অন্যথায় আঞ্চলিক ভাষাও কোন দিন নিজ নিজ অস্তিত্ব বা স্বীকৃতির প্রশ্নে আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সব সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের মা মাটি ও প্রকৃতির ভাষা “বাংলাকে” এক মহা নক্ষত্রে রূপান্তরিত করার চেষ্টায় ব্রত হওয়া সবারই উচিত। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার যে আবগঘন জোয়ার, একে কাজে লাগানোর প্রকৃষ্ট সময় এখনি।
[লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী কবি,
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]
Shajed70@yahoo.com
সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৯ ফাল্গুন ১৪২৭ ৯ রজব ১৪৪২
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
প্রতিটি ঐতিহ্যবাহী জাতি-ই তার নিজস্ব ভাষাকে দরদ দিয়ে লালন করে থাকে। এমনো কিছু দেশ রয়েছে যেখানে গিয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বললে বা কিছু জানতে চাইলে তারা মুখ ফিরেও তাকাতে চায় না। একবার ইউরোপের একটি দেশে বেড়াতে গিয়ে সে ধারণাই আমি পেয়েছি। কি পর্যটক, কি স্থায়ী বাসিন্দা কোন কিছুর তোয়াক্কাই তারা করেনা। আবার কখনো কখনো এও দেখা যায়, নেহায়েত প্রয়োজনে যদি ইংরেজির আশ্রয় নিতেই হয় তাহলে তাদের কথায় বা উচ্চারিত স্বরের মাধ্যমে স্বীয় জাতি সত্তার অস্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে। ফ্রেন্স, ইটালিয়ান, পোলিশ কিংবা রাশিয়ানরা ইংরেজিতে কথা বললেও তাদের একটা নিজস্ব কণ্ঠস্বর (Ac-cent) বজায় রাখে যাতে করে সহজেই তারা তাদের নিজেদের জাতীয় পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় মতবিনিময়ের আন্তর্জাতিক মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে ব্যবহার করলেও তারা তাদের স্বীয় মাতৃভাষার কণ্ঠ স্বর বা Ac-cent কে পরিহার করে নিজেকে মেকি ইংলিশের রসাতলে ডুবিয়ে দেন না।
আমরা যারা প্রবাসে আছি তাদের অনেকের মধ্যে এ মেকি ভূতটা কাজ করে বেশ। নিজেকে স্থানীয়ভাবে ‘অতিযোগ্য’ করে তোলার মনমানসিকতায় নিজেদের স্বকীয় কণ্ঠস্বরকে বিকৃত করে তা গুলিয়ে ফেলে ইংলিশ নামক আগ্রাসনধর্মী ভাষাটির অতলান্তিকে। আমি ইংলিশকে খাটো করে দেখছি না বা শুদ্ধভাবে ইংলিশ বলা থেকে বিরত থাকতেও বলছি না। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বাংলা ব্যবহার করতে না পারলে ইংরেজিতে ভাব আদান প্রদান করেও শুধু মাত্র কণ্ঠস্বরের স্বকীয়তার মাধ্যমেই স্বীয় জাতীয়তাবাদের পরিচয় ঘটানো সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, ‘অতিযোগ্য’ বা ‘অতিআধুনিক’ মুদ্রা দোষে দুষ্ট হয়ে আমাদের প্রবাসীদের অনেকেই বরং উল্টো পথে হাঁটেন।
দু’বছর আগের কথা। নিউইয়র্ক প্রবাসী এক আইরিশ ভদ্রলোক। সেখানে তিনি একটি পত্রিকায় কর্মরত। এক চা সন্ধার দাওয়াতে তার সঙ্গে দেখা। যিনি আমাদের হোস্ট, তিনি হলেন ওই ভদ্রলোকের বড় বোন। প্রৌঢ়া এ মহিলা আমার স্ত্রীকে মেয়ের মতো স্নেহ করেন। সে সুবাদে তার প্রবাসী ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই মূলত এ চা সন্ধ্যার আয়োজন।
প্রায় এক দশকের মতো আয়ারল্যান্ডে বসবাস করার পরো আমার কথায় কোন আইরিশ অপ-পবহঃ পাননি। বিষয়টা তাকে বেশ অবাক করেছে। সে সূত্র ধরেই তিনি বললেন, ১৪ বছর ধরে আমি আমেরিকায়। কিন্তু এমেরিকান ইংলিশ আমাকে কাবু করতে পারেনি। আমি আমার স্বীয় ভাষার স্বকীয়তাকে হারাতে দেইনি। এ জন্য স্থানীয়দের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। তাতে কি! নিজের স্বাতন্ত্র ধরে রাখতে পারছি সেতো কম কথা নয়।’
আইরিশ ভদ্রলোকের উদাহরণটি টানলাম এ জন্যে যে, ওদের নিজস্ব ভাষা (আইরিশ) থাকলেও কেউ এ ভাষায় কথা বলে না। সবাই ইংরেজিতেই কথা বার্তা বলে। ব্রিটিশ প্রদত্ত ইংরেজি-ই তাদের আপন ভাষা। সে ভাষা প্রাপ্তির জন্য তাদের কোন যুদ্ধ করতে হয়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের গুলিতে কাউকে শহীদ হতে হয়নি। তারপরও ব্রিটিশ বা আইরিশ ইংলিশের পুরোনো ঐতিহ্য যেন আমেরিকান ইংলিশের কাছে মলিন না হয়ে যায় সে ব্যাপারে তারা সদা তৎপর।
আমাদের প্রবাসীরা বিভিন্ন দিবস বা উৎসব পালন করার মতো শোক ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারিকেও বেশ ঘটা করে পালন করেন। যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে শহীদ মিনার গড়ে তোলার গৌরবও অর্জন করেছেন। যেসব দেশ পিছিয়ে ছিল তারাও এখন আর কম এগিয়ে নেই। এ রকম অগ্রগামী দেশের মধ্যে আয়ারল্যান্ডও একটি। এখানেও একুশ পালিত হয় জমজমাটভাবে। কয়েক বছর আগে আয়ারল্যান্ডে গলওয়ে বাঙালি কমিউনিটি কর্তৃক সল্টহিল হোটেলে আলোচনা সভা পালন করতে গিয়ে কাটের তৈরি শহীদ মিনারে গাদা গাদা ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছিল তা সত্যি যেমন ছিল আবেগঘন মুহূর্ত, তেমনি মনোমুগ্ধকরও বটে। আইরিশ বাঙালি তথা নতুন প্রজন্মের জন্য ছিল যেন এক সাক্ষাৎ ইতিহাস।
রাজধানী ডাবলিনও পিছিয়ে নেই। আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত সব বাঙালি ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গেয়ে প্রভাত ফেরির মাধ্যমে সমস্থ শহর ঘুরে বেড়ায়। উদ্দেশ্য, শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক স্থানীয়ভাবে দেশি-বিদেশি সবার কাছে এর মর্ম বাণী পৌঁছে দেয়া। যথাযত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে একটা শহীদ মিনার গড়ে তোলার চেষ্টা করা। মূলত এ ধরনের চেষ্টা বিশ্বের অনেক দেশেই বাঙালিরা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে হ্যাঁ যে সব দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে, সে সব দেশে সরকারি উদ্যোগে হলেও শহীদ মিনার গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। একুশের চেতনাকে বহির্বিশ্বে সমুন্নত ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শহীদ মিনারের বিকল্প নেই।
ভাষা দিবসকে সামনে রেখে প্রবাসীরা যা করছেন তা সবই সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় কার্যক্রম। কিন্তু ওই একটি বিশেষ দিনে কেবল র্যালি, সভা সমাবেশের ভেতরেই যেন একুশের চেতনা আটকে না থাকে সে দিকে আমাদের সবিশেষ নজর দিতে হবে। বাঙালিয়ানা কণ্ঠ বজায়ে রেখেও যে শুদ্ধ ইংরেজি বলা সম্ভব তাও দরদ দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। মেকি ইংলিশে বলীয়ান হয়ে মাতৃভাষার মর্মমুলে যেন আমরা নিজের অজান্তেই কেউ আঘাত না হানি।
যারা প্রবাসে কর্মরত তারা ব্যক্তিগতভাবেও বিভিন্ন উপায়ে বাংলা ভাষার পরিচিতি তুলে ধরতে পারেন। যে কোন দেশেই একজন প্রবাসী বসবাস করুননা কেন, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন সহকর্মীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ মেলে। দিনে দিনে ভাব বা সখ্য গড়ে উঠে। তার সুবাদে একজন প্রবাসী ব্যক্তি যদি ১০ জন ভিনদেশীর কাছে আমাদের ভাষার ঐতিহ্য, একুশের অহঙ্কার ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার গৌরব বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন সে ক্ষেত্রে প্রচার ও প্রসারের মাত্রা এক বিরাট পরিসংখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, এমন ইতিহাস কি পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি আছে?
অনেক প্রবাসী মা বাবা আছেন যারা সন্তান-সন্ততির সঙ্গে বাসা বাড়িতেও কথা বলার ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। একুশের চেতনাকে সমুন্নত রেখে বাংলা ভাষার গৌরবোজ্জ্বলকে ধরে রাখতে হলে এ ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। শুধু তাই নয়, বিদেশে জন্ম নেয়া এমন অনেক শিশু কিশোর আছে যারা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারলেও লেখাপড়ার ক্ষেত্রে একেবারেই অক্ষম। সে অক্ষমতা তাদের নিজের দোষে নয়। অনেক মা বাবার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কর্ম ব্যস্ততা বা সীমাবদ্ধতার দরুন বাংলায় হাতেখড়ি দিয়ে উঠতে পারেন না। কিছু বাংলা মিশনারি স্কুল থাকলেও সেগুলোতে সব ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি সম্ভব হয়ে উঠে না। তাছাড়া স্থানীয় স্কুলগুলোতেও বাংলা শিক্ষা দানের কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রবাসী ছেলেমেয়েদের এ ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক বাংলা মিশনারি স্কুল গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে প্রবাসী অভিবাবকরা জরো হয়ে বাংলা শিক্ষা প্রচলনের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করতে পারেন। বাংলাকে পাঠ্যসূচির আওতাভুক্ত করতে হবে এমন কোন কথা নেই। কর্তৃপক্ষ যাতে এমন একজন শিক্ষক নিয়োগ করেন যিনি শুধু বাংলা ভাষা পাঠ দানের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবেন। এছাড়াও ডিজিটাল যুগের সুযোগ নিয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিজস্ব মতামত, জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়া যায় অতি সহজেই। শিক্ষা দানের ক্ষেত্রেও কেউ কেউ এ পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। অন লাইনভিত্তিক “এসো বাংলা শিখি” জাতীয় প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। স্কাইপের মাধ্যমে অতি সহজেই প্রাইভেট শিক্ষকের কার্যক্রম চালানো সম্ভব। ঘরে বসেও বিশ্বের যে কোন দেশে বসবাসরত ইচ্ছুক ছেলেমেয়েদের বাংলা শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে। অনেকে এটাকে আর্থিক উপার্জনের একটি আংশিক উপায় হিসেবেও বেছে নিতে পারেন।
পৃথিবীর কোন ভাষাই সম্ভবত আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব মুক্ত নয়। এমনকি ইংরেজি ভাষাতেও রয়েছে আঞ্চলিকতার ব্যপক প্রভাব। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও এর প্রভাবমুক্ত নয়। সন্দেহ নেই, আঞ্চলিক ভাষা যোগ হয়ে কখনও কখনও মূল ভাষাকে অলঙ্কারের সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ করে তোলে। কিন্তু সে আঞ্চলিক ভাষা যদি মূল ভাষার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে চায় সেখানেই যতো আশঙ্কা। আজকাল দেশ বিদেশের অনেক ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে এর ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রবাসে কিছু স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে বিভিন্ন টক শো, লাইভ শো বা প্রচারিত নাটকের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার বেশ প্রচলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এ মাত্রা ছাড়িয়ে প্রিন্ট মিডিয়াতেও এক দিন তা পা ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হলেও একেবারে অমূলক বলা যাবে না।
কথ্য ভাষার অন্য রূপ আঞ্চলিক ভাষা। সে অর্থে আমরা কেউ এর বাইরে নই। তাই আঞ্চলিক ভাষার প্রতি গভীর মমতা ও শ্রদ্ধাবোধ রেখেই বলছি, জাতীয় অঙ্গনে শুদ্ধ বাংলা বিকাশের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা যেন কণ্টক হয়ে না দাঁড়ায় সে বিষয়টা আমাদের সবার মাথায় রাখা উচিত। অন্যথায় আঞ্চলিক ভাষাও কোন দিন নিজ নিজ অস্তিত্ব বা স্বীকৃতির প্রশ্নে আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সব সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের মা মাটি ও প্রকৃতির ভাষা “বাংলাকে” এক মহা নক্ষত্রে রূপান্তরিত করার চেষ্টায় ব্রত হওয়া সবারই উচিত। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার যে আবগঘন জোয়ার, একে কাজে লাগানোর প্রকৃষ্ট সময় এখনি।
[লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী কবি,
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট]
Shajed70@yahoo.com