বিশ্বের প্রথম নারী ভাষাশহীদ

ইসমাইল মাহমুদ

অবিভক্ত বাংলার সিলেটে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভাষার জন্য বিশ্বের প্রথম নারী শহীদ কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য। পিতা রামরমন ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন কমলা। দেশভাগের সময় কমলার পরিবার পাকিস্তানে থেকে গেলেও ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বাস্তু কার্যক্রম শুরু হলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে কমলার পরিবার। এরই মধ্যে কমলার পিতা রামরমন ভট্টাচার্য মৃত্যুবরণ করেন। এ অবস্থায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করা নিরাপদ মনে না করায় বিধবা সুপ্রাবাসিনী দেবী সাত সন্তানকে নিয়ে সিলেট ছেড়ে ভারতে চলে যান। সেখানে তিনি আশ্রয় নেন একসময়ের অবিভিক্ত বৃহত্তর সিলেটের অংশ শিলচরে। সেখানে যাওয়ার সময় কমলার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। একে তো উদ্বাস্তু, তার ওপর ছিল পরিবারের চরম আর্থিক অনটন।

শিলচরে যাওয়ার পর কমলার বড় বোন বেনু ভট্টাচার্য নার্সিংয়ের চাকরি পেয়ে চলে যান শিমুলগুড়ি। কমলার মেজ বোন প্রতিভা ভট্টাচার্য লাভ করেন স্কুলের শিক্ষকতা। তিনিই পরিবারটিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পরের বছর কমলা ভর্তি হন স্থানীয় ‘ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউট’-এ। তার বই-খাতা কেনার পয়সা পর্যন্ত ছিল না। সহপাঠীদের নিকট থেকে বই ধার করে খাতায় লিখে পড়া শুরু করেন কমলা।

চরম অভাবের মাঝে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন কমলা ভট্টাচার্য। স্বপ্ন দেখছিলেন স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করে একটা চাকরি নিয়ে পরিবার আর মায়ের কষ্ট দূর করবেন। ১৯৬১ সালে কমলা দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সামনেই তখন তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। সে সময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে বরাক উপত্যকা।

১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে কাছাড়ে তখন গঠিত হয় ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’। সে অনুষ্ঠানে ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’ নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হন কমলা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কমলা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিতে থাকেন।

১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের দিনে আন্দোলনকারীদের সংকল্প দিবসে কমলাও অংশগ্রহণ করেন এবং সবার সঙ্গে শপথ নেন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভোরে মেজ বোন প্রতিভা ভট্টাচার্যের শাড়ি আর ব্লাউজ পরে কমলা হরতাল সফল করতে বের হয়ে যান। যাওয়ার আগে ঘরে কিছুই না থাকায় খালি পেটেই বের হন তিনি। সঙ্গে ছিল ১১ বছর বয়সী ছোট বোন মঙ্গলা ভট্টাচার্য।

আন্দোলনের তীব্রতা বেগবান হলে রাজ্য সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সরকার পুলিশের সঙ্গে সহায়তার জন্য শিলচার রেলওয়ে স্টেশনে পাঠায় আসাম রাইফেল বাহিনীকে। ২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে ছাত্র জনতাকে উদ্দেশ্য করে ১৭ রাউন্ড গুলি করে পুলিশ-রাউফেল বাহিনী। এতে প্রাণ হারান কমলাসহ ১১ ভাষাসৈনিক। পরে রাজ্য সরকার কমলাসহ সেই ১১ জন শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

বর্তমানে ভারতের শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তিসহ একটি ব্রোঞ্জ ফলক রয়েছে। এছাড়া শিলচর রেলওয়ে স্টেশনকে ভাষা শহীদ স্টেশন হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১১ সালে কমলার স্কুল ‘ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউট’-এ কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করা হয় এবং শিলচরের পাবলিক স্কুলের পাশের সড়কটির নামকরণ করা হয় ‘কমলা ভট্টাচার্য সড়ক’।

feature.ismail2021@gmail.com

সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৯ ফাল্গুন ১৪২৭ ৯ রজব ১৪৪২

বিশ্বের প্রথম নারী ভাষাশহীদ

ইসমাইল মাহমুদ

অবিভক্ত বাংলার সিলেটে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভাষার জন্য বিশ্বের প্রথম নারী শহীদ কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য। পিতা রামরমন ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন কমলা। দেশভাগের সময় কমলার পরিবার পাকিস্তানে থেকে গেলেও ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বাস্তু কার্যক্রম শুরু হলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে কমলার পরিবার। এরই মধ্যে কমলার পিতা রামরমন ভট্টাচার্য মৃত্যুবরণ করেন। এ অবস্থায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করা নিরাপদ মনে না করায় বিধবা সুপ্রাবাসিনী দেবী সাত সন্তানকে নিয়ে সিলেট ছেড়ে ভারতে চলে যান। সেখানে তিনি আশ্রয় নেন একসময়ের অবিভিক্ত বৃহত্তর সিলেটের অংশ শিলচরে। সেখানে যাওয়ার সময় কমলার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। একে তো উদ্বাস্তু, তার ওপর ছিল পরিবারের চরম আর্থিক অনটন।

শিলচরে যাওয়ার পর কমলার বড় বোন বেনু ভট্টাচার্য নার্সিংয়ের চাকরি পেয়ে চলে যান শিমুলগুড়ি। কমলার মেজ বোন প্রতিভা ভট্টাচার্য লাভ করেন স্কুলের শিক্ষকতা। তিনিই পরিবারটিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পরের বছর কমলা ভর্তি হন স্থানীয় ‘ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউট’-এ। তার বই-খাতা কেনার পয়সা পর্যন্ত ছিল না। সহপাঠীদের নিকট থেকে বই ধার করে খাতায় লিখে পড়া শুরু করেন কমলা।

চরম অভাবের মাঝে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন কমলা ভট্টাচার্য। স্বপ্ন দেখছিলেন স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করে একটা চাকরি নিয়ে পরিবার আর মায়ের কষ্ট দূর করবেন। ১৯৬১ সালে কমলা দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সামনেই তখন তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। সে সময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে বরাক উপত্যকা।

১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে কাছাড়ে তখন গঠিত হয় ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’। সে অনুষ্ঠানে ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’ নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হন কমলা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কমলা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিতে থাকেন।

১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের দিনে আন্দোলনকারীদের সংকল্প দিবসে কমলাও অংশগ্রহণ করেন এবং সবার সঙ্গে শপথ নেন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভোরে মেজ বোন প্রতিভা ভট্টাচার্যের শাড়ি আর ব্লাউজ পরে কমলা হরতাল সফল করতে বের হয়ে যান। যাওয়ার আগে ঘরে কিছুই না থাকায় খালি পেটেই বের হন তিনি। সঙ্গে ছিল ১১ বছর বয়সী ছোট বোন মঙ্গলা ভট্টাচার্য।

আন্দোলনের তীব্রতা বেগবান হলে রাজ্য সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সরকার পুলিশের সঙ্গে সহায়তার জন্য শিলচার রেলওয়ে স্টেশনে পাঠায় আসাম রাইফেল বাহিনীকে। ২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে ছাত্র জনতাকে উদ্দেশ্য করে ১৭ রাউন্ড গুলি করে পুলিশ-রাউফেল বাহিনী। এতে প্রাণ হারান কমলাসহ ১১ ভাষাসৈনিক। পরে রাজ্য সরকার কমলাসহ সেই ১১ জন শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

বর্তমানে ভারতের শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তিসহ একটি ব্রোঞ্জ ফলক রয়েছে। এছাড়া শিলচর রেলওয়ে স্টেশনকে ভাষা শহীদ স্টেশন হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১১ সালে কমলার স্কুল ‘ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউট’-এ কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করা হয় এবং শিলচরের পাবলিক স্কুলের পাশের সড়কটির নামকরণ করা হয় ‘কমলা ভট্টাচার্য সড়ক’।

feature.ismail2021@gmail.com