ভাষা আন্দোলন জাদুঘর : মনে করিয়ে দেয় সেই দিনগুলো

ধানমন্ডির ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’ নতুন প্রজন্মের তরুণদের সামনে তুলে ধরছে একদিকে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ ঘটনাবলি, অন্যদিকে ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচিহ্ন। যে কেউ সেখানে গিয়ে ৬৯ বছর আগের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা পাওয়ার পাশাপাশি যারা জীবন দিয়ে এদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলা ভাষার মর্যাদা তাদের সম্পর্কেও জানতে পারছেন। ভাষা সৈনিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাভাষার পরিচয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, এ আন্দোলনের যাবতীয় তথ্যাবলি এবং ভাষা শহীদ ও ভাষাসৈনিকদের যাবতীয় স্মৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় এ জাদুঘর।

যেকোন জাতিসত্তা গঠনে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। পৃথিবীতে ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার ইতিহাস শুধু বাংলাদেশেই সৃষ্টি হয়েছে। তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে এ ভূখণ্ডে ভাষা কেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সর্বোপরি একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নের সূচনাও হয় এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। বাঙালির ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসই বিবৃত হয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘরের প্রতিটি কোণে। ছোট কিন্তু দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য সব সংগ্রহ দর্শনার্থীদের অনুসন্ধিৎসু মনকে কিছুটা হলেও আবেগাক্রান্ত করে জ্ঞানের এ বাতিঘর।

ভাষা সৈনিকদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘর ঘুরে জানা যায়, দেশের ‘ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন অধ্যায়ের বর্ণনা। একই সঙ্গে একটি ‘ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক জাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় কিছু ব্যক্তির সংগ্রাম।

ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অধ্যাপক এমএ বার্ণিকের উদ্যোগে সর্বপ্রথম একটি অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করা হয় ১৯৮৯ সালে। কমিটিতে অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলামকে আহ্বায়ক, আবুল কাসেম, মোস্তফা মাহবুবুল আলম, কাজী আবদুর রহিম, মাহমুদ বিন কাসেম, এমআর মাহবুবুকে সদস্য এবং এমএ বার্ণিককে সদস্য-সম্পাদক করে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু হয়। পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. শামসুল হককে নির্বাচন করা হয়। ১৯৮৯ সালের ২ জুন ঢাকাস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। জাদুঘরের প্রথম অফিস অস্থায়ীভাবে ড. নূরুল হক ভূইয়ার আসাদ গেটস্থ বাসভবন ২/৯, ব্লক-এ, লালমাটিয়া স্থাপন করা হয়। পরে ১৬ ওয়েস্ট অ্যান্ড স্ট্রিট, ধানমন্ডি অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসভবন ও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট হয়ে ২০০৬ সালে ধানমন্ডির ১০ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়ি কাজী গোলাম মাহবুবের বাসভবনে স্থানান্তরিত হয়। কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের আর্থিক সহযোগিতায় জাদুঘরের আলাদা প্রদর্শন বিভাগ ও অন্যান্য কার্যক্রমে গতি সঞ্চার হয়। বর্তমানে জাদুঘর যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- ভাষা-আন্দোলনের পত্রপত্রিকা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসবিষয়ক তথ্যবহুল গ্রন্থ প্রকাশ, ভাষা-আন্দোলন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, সাময়িকী সংগ্রহ এবং একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্য গ্রন্থ সংগ্রহ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বর্ষপঞ্জিকে ভিত্তি করে মুহম্মদ তকীয়ুল্লাহ কর্তৃক প্রণীত ‘প্রমিত বাংলা বর্ষপঞ্জি’ ভাষা আন্দোলন জাদুঘর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।

ভাষা শহীদ অহিউল্লাহর ছবি কারও কাছেই ছিল না। এ জাদুঘরের উদ্যোগে অহিউল্লাহর গঠন প্রকৃতির বিবরণের ভিত্তিতে শিল্পী শ্যামল বিশ্বাসকে দিয়ে একটি ছবি অঙ্কন করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জাদুঘরের ‘প্রদর্শন বিভাগ’ চালু করা হয়েছে। জীবিত ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সব ভাষাসৈনিক ও ভাষা শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ কার্যক্রম চলছে।

জাদুঘরে প্রদর্শনীর মধ্যে রয়েছে ভাষা সৈনিকদের ব্যবহৃত ডায়েরি, লাঠি, ঘড়ি, কলম, মেডেলসহ দেয়ালজুড়ে হাজারো ছবি। যেগুলোর মধ্যে সেই সময়ের বিভিন্ন স্থাপত্য, সড়ক, মিছিল অন্যতম। আর এ ছবিগুলো যেন গল্প বলে চলে ইতিহাসের। চোখের সামনে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়টাকে। এ পর্যন্ত ভাষাসৈনিকের শতাধিক পূর্ণাঙ্গ জীবনী সংগৃহীত হয়েছে।

ভাষাশহীদ পরিবার, ভাষাসৈনিক পরিবার, জীবিত ভাষাসৈনিক এবং আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্মৃতিচিহ্ন বা স্মারক সংগৃহীত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কে বর্তমান নির্বাহী পরিচালক এলমুন্নাহার লিপি বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের মাতৃভাষার পরিচয়, ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, এ আন্দোলনের যাবতীয় তথ্যাবলি এবং ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের যাবতীয় স্মৃতি সংরক্ষণ করে জাতির কাছে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এসব ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসেন ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ভাষা সংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব। তিনি ২০০৫ সালে ধানমন্ডিতে তার নিজ বাসভবনে একটি কক্ষে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু করেন। ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ ভাষা সংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজী গোলাম মাহবুবের স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষায় তার স্ত্রী পেয়ারী মাহবুব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তারই সক্রিয় উদ্যোগে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর।

বর্তমানে ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের আলাদা আলাদা জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ, প্রতিবছর ভাষা সংগ্রামীদের মিলন মেলার আয়োজন, নিয়মিত প্রকাশনা ‘ভাষা’ প্রকাশ, মাতৃভাষা দিবসের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, ভাষা সংগ্রামীদের নামে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ, ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও সম্মাননা প্রদানের জন্য কাজ করা, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে লাইব্রেরি, গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরে সংরক্ষিত দুর্লভ তথ্য ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি সংগ্রহের মাধ্যমে আরও বিস্তৃতির কাজ চলছে জাদুঘরে। যা দর্শনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত থাকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

এলমুন্নাহার লিপি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’ আরও সুগঠিতভাবে গড়ে তুলতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানটিকে আর বড় পরিসরে গড়ে তুলতে, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণে এবং আরও গবেষণামূলক কাজের সুযোগ সৃষ্টিতেও সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা আবশ্যক বলে মনে করেন তিনি।

মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১০ ফাল্গুন ১৪২৭ ১০ রজব ১৪৪২

ভাষা আন্দোলন জাদুঘর : মনে করিয়ে দেয় সেই দিনগুলো

মোহাম্মদ উল্লাহ

image

ধানমন্ডির ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’ নতুন প্রজন্মের তরুণদের সামনে তুলে ধরছে একদিকে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ ঘটনাবলি, অন্যদিকে ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচিহ্ন। যে কেউ সেখানে গিয়ে ৬৯ বছর আগের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা পাওয়ার পাশাপাশি যারা জীবন দিয়ে এদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলা ভাষার মর্যাদা তাদের সম্পর্কেও জানতে পারছেন। ভাষা সৈনিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাভাষার পরিচয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, এ আন্দোলনের যাবতীয় তথ্যাবলি এবং ভাষা শহীদ ও ভাষাসৈনিকদের যাবতীয় স্মৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় এ জাদুঘর।

যেকোন জাতিসত্তা গঠনে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। পৃথিবীতে ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার ইতিহাস শুধু বাংলাদেশেই সৃষ্টি হয়েছে। তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে এ ভূখণ্ডে ভাষা কেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সর্বোপরি একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নের সূচনাও হয় এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। বাঙালির ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসই বিবৃত হয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘরের প্রতিটি কোণে। ছোট কিন্তু দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য সব সংগ্রহ দর্শনার্থীদের অনুসন্ধিৎসু মনকে কিছুটা হলেও আবেগাক্রান্ত করে জ্ঞানের এ বাতিঘর।

ভাষা সৈনিকদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘর ঘুরে জানা যায়, দেশের ‘ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন অধ্যায়ের বর্ণনা। একই সঙ্গে একটি ‘ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক জাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় কিছু ব্যক্তির সংগ্রাম।

ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অধ্যাপক এমএ বার্ণিকের উদ্যোগে সর্বপ্রথম একটি অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করা হয় ১৯৮৯ সালে। কমিটিতে অধ্যাপক ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলামকে আহ্বায়ক, আবুল কাসেম, মোস্তফা মাহবুবুল আলম, কাজী আবদুর রহিম, মাহমুদ বিন কাসেম, এমআর মাহবুবুকে সদস্য এবং এমএ বার্ণিককে সদস্য-সম্পাদক করে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু হয়। পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. শামসুল হককে নির্বাচন করা হয়। ১৯৮৯ সালের ২ জুন ঢাকাস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। জাদুঘরের প্রথম অফিস অস্থায়ীভাবে ড. নূরুল হক ভূইয়ার আসাদ গেটস্থ বাসভবন ২/৯, ব্লক-এ, লালমাটিয়া স্থাপন করা হয়। পরে ১৬ ওয়েস্ট অ্যান্ড স্ট্রিট, ধানমন্ডি অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসভবন ও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট হয়ে ২০০৬ সালে ধানমন্ডির ১০ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়ি কাজী গোলাম মাহবুবের বাসভবনে স্থানান্তরিত হয়। কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের আর্থিক সহযোগিতায় জাদুঘরের আলাদা প্রদর্শন বিভাগ ও অন্যান্য কার্যক্রমে গতি সঞ্চার হয়। বর্তমানে জাদুঘর যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- ভাষা-আন্দোলনের পত্রপত্রিকা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসবিষয়ক তথ্যবহুল গ্রন্থ প্রকাশ, ভাষা-আন্দোলন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, সাময়িকী সংগ্রহ এবং একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্য গ্রন্থ সংগ্রহ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বর্ষপঞ্জিকে ভিত্তি করে মুহম্মদ তকীয়ুল্লাহ কর্তৃক প্রণীত ‘প্রমিত বাংলা বর্ষপঞ্জি’ ভাষা আন্দোলন জাদুঘর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।

ভাষা শহীদ অহিউল্লাহর ছবি কারও কাছেই ছিল না। এ জাদুঘরের উদ্যোগে অহিউল্লাহর গঠন প্রকৃতির বিবরণের ভিত্তিতে শিল্পী শ্যামল বিশ্বাসকে দিয়ে একটি ছবি অঙ্কন করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জাদুঘরের ‘প্রদর্শন বিভাগ’ চালু করা হয়েছে। জীবিত ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সব ভাষাসৈনিক ও ভাষা শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ কার্যক্রম চলছে।

জাদুঘরে প্রদর্শনীর মধ্যে রয়েছে ভাষা সৈনিকদের ব্যবহৃত ডায়েরি, লাঠি, ঘড়ি, কলম, মেডেলসহ দেয়ালজুড়ে হাজারো ছবি। যেগুলোর মধ্যে সেই সময়ের বিভিন্ন স্থাপত্য, সড়ক, মিছিল অন্যতম। আর এ ছবিগুলো যেন গল্প বলে চলে ইতিহাসের। চোখের সামনে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়টাকে। এ পর্যন্ত ভাষাসৈনিকের শতাধিক পূর্ণাঙ্গ জীবনী সংগৃহীত হয়েছে।

ভাষাশহীদ পরিবার, ভাষাসৈনিক পরিবার, জীবিত ভাষাসৈনিক এবং আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্মৃতিচিহ্ন বা স্মারক সংগৃহীত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কে বর্তমান নির্বাহী পরিচালক এলমুন্নাহার লিপি বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের মাতৃভাষার পরিচয়, ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, এ আন্দোলনের যাবতীয় তথ্যাবলি এবং ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের যাবতীয় স্মৃতি সংরক্ষণ করে জাতির কাছে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এসব ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসেন ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ভাষা সংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব। তিনি ২০০৫ সালে ধানমন্ডিতে তার নিজ বাসভবনে একটি কক্ষে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু করেন। ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ ভাষা সংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজী গোলাম মাহবুবের স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষায় তার স্ত্রী পেয়ারী মাহবুব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তারই সক্রিয় উদ্যোগে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর।

বর্তমানে ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের আলাদা আলাদা জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ, প্রতিবছর ভাষা সংগ্রামীদের মিলন মেলার আয়োজন, নিয়মিত প্রকাশনা ‘ভাষা’ প্রকাশ, মাতৃভাষা দিবসের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, ভাষা সংগ্রামীদের নামে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ, ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও সম্মাননা প্রদানের জন্য কাজ করা, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে লাইব্রেরি, গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরে সংরক্ষিত দুর্লভ তথ্য ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি সংগ্রহের মাধ্যমে আরও বিস্তৃতির কাজ চলছে জাদুঘরে। যা দর্শনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত থাকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

এলমুন্নাহার লিপি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’ আরও সুগঠিতভাবে গড়ে তুলতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানটিকে আর বড় পরিসরে গড়ে তুলতে, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণে এবং আরও গবেষণামূলক কাজের সুযোগ সৃষ্টিতেও সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা আবশ্যক বলে মনে করেন তিনি।