তোফায়লে আহমদে
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারিÑ এই গানটি আমাদের শিহরিত করে আর জাগরিত করে। আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের এক মহা সন্ধিক্ষণে আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। একদা আমাদের সব রাজনৈতিক এবং সামাজিক অঙ্গীকারের ও মহাদিন। আজ থেকে ৬৯ বছর আগে যে দিনটি শুধু মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার দিন হিসাবে রক্তাপ্লুত লাল সবুজের পতাকার মতো তৈরি হয়েছিল আমাদের চৈতন্যে, ক্রমে সেই দিনের আসা থেকে জন্ম নিয়েছিল এমন একটি অগ্নিবিন্দু যার মধ্যে নিহিত ছিল আমাদের স্বাধীনতার শিখা। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন এক মহাকার আর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তা রূপান্তরিত হয়েছিল এক বিশাল অগ্নিগোলকের স্পন্দন। যার আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী সব শক্তি সব বুহ্য আর তাই আমরা পেয়েছিলাম নতুন স্বাধীনতাকেও, একটি নতুন দেশ যার নাম বাংলাদেশ। নতুন অর্থে নতুন স্বপ্নে এবং কর্মচাঞ্চেল্যে আবিষ্কার করার দিন একুশে ফেব্রুয়ারি।
আমাদের জীবনের সব সত্য কল্যাণ ও প্রগতিকে নতুন কনে উজ্জীবিত আর উজ্জ্বলতর করার দিনও একুশে ফেব্রুয়ারি। অসত্য অকল্যাণ এবং অমঙ্গলকে আমাদের জীবনের সব চিন্তা ও চৈতন্য থেকে নির্বাসনের দিন। একুশ আমাদের সব বৈষম্য অবসানের দিন। একুশ আমাদের রাষ্ট্রীয় সব সন্ত্রাস স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসানের দিন। কুসংস্কার, কুপম-কতা, সাম্প্রদায়িকতার অবসানের দিন। মানুষের অমর্যাদার অবসানের পর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠার দিন।
উর্দু-বাংলার আনুষ্ঠানিক বিরোধ দেখা দেয় ১৯২৮ সালে। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশিকা স্তরে মুসলমান ছাত্রদের জন্য উর্দু বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করে, কিন্ত এ নিয়ে এমন আপত্তি উঠছে যে তারা সে প্রস্তাব নিয়ে আর অগ্রসর হয়নি। বরঞ্চ বাংলাকে মাদরাসা শিক্ষার বাহন করার জন্য ও একটি রীতিমতো আন্দোলন দেখা দেয়। মাতৃভাষাকে শিক্ষার সব পর্যায়ের মাধ্যম রূপে প্রয়োগ করার জন্য আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লা, মোহাম্মদ আকরম খা প্রমুখ লেখক এবং সওগাত ও শিখা পত্রিকা দাবি জানিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে ভাষার জন্য যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা একদিনে সফল হয়নি। ১৯৪৮ সালে ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ তারিখ রেসকোর্স ময়দানে ভাষন দেন, ১৯৪৮ সালে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কায়েদা আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর এক রাষ্ট্র এক রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয়ে যে ভাষন দিয়েছিলেন টফৎঁ ধহফ টফৎঁ ংযধষষ নব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধরহ (উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা) এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র ছাত্র সমাজ চুপ করে বসে থাকেনি। নিরলস ব্যক্তি স্বার্থহীনভাবে নিজেদের মধ্যে সুসংগতভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এ আন্দোলনে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতের মতো মেধাবীদের জাতি হারিয়েছেন। রাজ শাসন যে দেশে স্বৈরাচারী সমাজ শাসন বৈষম্যমূলক গণতন্ত্র, অপসৃয়মাণ আর অধিকাংশ সাধারণ মানুষ অসহায়ত্ব, সেই সময় সেই দেশে সাহসী প্রতিবাদী জীবনমুখী আন্দোলনে শাসকদের রোষে পড়তে হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্বে ছিলেন ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল মতিন, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, নারী নেতৃত্ব ছিল রওশন আরা বাচ্চুসহ অনেকে জীবন বাজি রেখে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। শত সহস্র আত্মত্যাগ বাধা উপেক্ষা করে সেদিনের ভাষা আন্দোলন সফল হয়েছিল সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে যার স্বীকৃতি লাভ করে, একই সঙ্গে উর্দু ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করে, পরে অবশ্য জিন্নাহ তার ভূল স্বীকার করেছেন। এ অঞ্চলের (পূর্ব বাংলার) জাতীয় সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যেই নিহিত ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ, যা ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এত বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। এর মধ্যে শিখিয়েছে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম সকলে আমরা পরের তরে।
আজ যখন সভ্যতা একটি নতুন সহস্র বছরে উপনীত, তখন মানবজাতির একটি অংশ হিসাবে আমরা যেন বিষণœতার স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের দিকে নিজেদের টেনে না নিয়ে যাই। শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কর্মে এবং জীবনে প্রয়োগ করি, সত্য এবং কল্যাণ- সুন্দর এবং মঙ্গল যেন আমরা শুধু নিজেদের জন্যই নয় এবং সারা পৃথিবীর জন্যই গ্রহণ করতে পারি। একুশের চেতনা শানিত হবে একদিন নিজেদের চিত্তে ও চৈতন্যে কর্মে ও ব্যবহারে। রাষ্ট্র, তার সংস্কৃতি, জনগণের আকাক্সক্ষা শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা সবার। আজকের একুশ হোক তাই জীবনের সব সত্য কল্যাণ ও প্রগতিকে উজ্জ্বলতর করার দিন। দেশপ্রেমিক গনতান্ত্রিক শাসনের প্রত্যাশা সবার।
[লেখক : উন্নয়ন কর্মী]
matiarahmanr@gmail.com
মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১০ ফাল্গুন ১৪২৭ ১০ রজব ১৪৪২
তোফায়লে আহমদে
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারিÑ এই গানটি আমাদের শিহরিত করে আর জাগরিত করে। আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের এক মহা সন্ধিক্ষণে আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। একদা আমাদের সব রাজনৈতিক এবং সামাজিক অঙ্গীকারের ও মহাদিন। আজ থেকে ৬৯ বছর আগে যে দিনটি শুধু মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার দিন হিসাবে রক্তাপ্লুত লাল সবুজের পতাকার মতো তৈরি হয়েছিল আমাদের চৈতন্যে, ক্রমে সেই দিনের আসা থেকে জন্ম নিয়েছিল এমন একটি অগ্নিবিন্দু যার মধ্যে নিহিত ছিল আমাদের স্বাধীনতার শিখা। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন এক মহাকার আর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তা রূপান্তরিত হয়েছিল এক বিশাল অগ্নিগোলকের স্পন্দন। যার আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী সব শক্তি সব বুহ্য আর তাই আমরা পেয়েছিলাম নতুন স্বাধীনতাকেও, একটি নতুন দেশ যার নাম বাংলাদেশ। নতুন অর্থে নতুন স্বপ্নে এবং কর্মচাঞ্চেল্যে আবিষ্কার করার দিন একুশে ফেব্রুয়ারি।
আমাদের জীবনের সব সত্য কল্যাণ ও প্রগতিকে নতুন কনে উজ্জীবিত আর উজ্জ্বলতর করার দিনও একুশে ফেব্রুয়ারি। অসত্য অকল্যাণ এবং অমঙ্গলকে আমাদের জীবনের সব চিন্তা ও চৈতন্য থেকে নির্বাসনের দিন। একুশ আমাদের সব বৈষম্য অবসানের দিন। একুশ আমাদের রাষ্ট্রীয় সব সন্ত্রাস স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসানের দিন। কুসংস্কার, কুপম-কতা, সাম্প্রদায়িকতার অবসানের দিন। মানুষের অমর্যাদার অবসানের পর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠার দিন।
উর্দু-বাংলার আনুষ্ঠানিক বিরোধ দেখা দেয় ১৯২৮ সালে। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশিকা স্তরে মুসলমান ছাত্রদের জন্য উর্দু বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করে, কিন্ত এ নিয়ে এমন আপত্তি উঠছে যে তারা সে প্রস্তাব নিয়ে আর অগ্রসর হয়নি। বরঞ্চ বাংলাকে মাদরাসা শিক্ষার বাহন করার জন্য ও একটি রীতিমতো আন্দোলন দেখা দেয়। মাতৃভাষাকে শিক্ষার সব পর্যায়ের মাধ্যম রূপে প্রয়োগ করার জন্য আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লা, মোহাম্মদ আকরম খা প্রমুখ লেখক এবং সওগাত ও শিখা পত্রিকা দাবি জানিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে ভাষার জন্য যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা একদিনে সফল হয়নি। ১৯৪৮ সালে ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ তারিখ রেসকোর্স ময়দানে ভাষন দেন, ১৯৪৮ সালে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কায়েদা আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর এক রাষ্ট্র এক রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয়ে যে ভাষন দিয়েছিলেন টফৎঁ ধহফ টফৎঁ ংযধষষ নব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধরহ (উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা) এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র ছাত্র সমাজ চুপ করে বসে থাকেনি। নিরলস ব্যক্তি স্বার্থহীনভাবে নিজেদের মধ্যে সুসংগতভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এ আন্দোলনে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতের মতো মেধাবীদের জাতি হারিয়েছেন। রাজ শাসন যে দেশে স্বৈরাচারী সমাজ শাসন বৈষম্যমূলক গণতন্ত্র, অপসৃয়মাণ আর অধিকাংশ সাধারণ মানুষ অসহায়ত্ব, সেই সময় সেই দেশে সাহসী প্রতিবাদী জীবনমুখী আন্দোলনে শাসকদের রোষে পড়তে হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্বে ছিলেন ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল মতিন, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, নারী নেতৃত্ব ছিল রওশন আরা বাচ্চুসহ অনেকে জীবন বাজি রেখে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। শত সহস্র আত্মত্যাগ বাধা উপেক্ষা করে সেদিনের ভাষা আন্দোলন সফল হয়েছিল সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে যার স্বীকৃতি লাভ করে, একই সঙ্গে উর্দু ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করে, পরে অবশ্য জিন্নাহ তার ভূল স্বীকার করেছেন। এ অঞ্চলের (পূর্ব বাংলার) জাতীয় সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যেই নিহিত ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ, যা ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এত বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। এর মধ্যে শিখিয়েছে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম সকলে আমরা পরের তরে।
আজ যখন সভ্যতা একটি নতুন সহস্র বছরে উপনীত, তখন মানবজাতির একটি অংশ হিসাবে আমরা যেন বিষণœতার স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের দিকে নিজেদের টেনে না নিয়ে যাই। শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কর্মে এবং জীবনে প্রয়োগ করি, সত্য এবং কল্যাণ- সুন্দর এবং মঙ্গল যেন আমরা শুধু নিজেদের জন্যই নয় এবং সারা পৃথিবীর জন্যই গ্রহণ করতে পারি। একুশের চেতনা শানিত হবে একদিন নিজেদের চিত্তে ও চৈতন্যে কর্মে ও ব্যবহারে। রাষ্ট্র, তার সংস্কৃতি, জনগণের আকাক্সক্ষা শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা সবার। আজকের একুশ হোক তাই জীবনের সব সত্য কল্যাণ ও প্রগতিকে উজ্জ্বলতর করার দিন। দেশপ্রেমিক গনতান্ত্রিক শাসনের প্রত্যাশা সবার।
[লেখক : উন্নয়ন কর্মী]
matiarahmanr@gmail.com