স্কুল খোলা নিয়ে বিভক্ত মানুষ

দেশের অধিকাংশ অভিভাবক ও শিক্ষক এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে নন। তারা এখনই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করছেন না। কিন্তু এর বাইরে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন।

গতকাল প্রকাশিত একটি বেসরকারি জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করছেন না। প্রায় ৫১ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, তাদের সন্তানরা স্কুল স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে চলতে সক্ষম না। তবে অভিভাবক ও শিক্ষক বাদে অন্যান্য শ্রেণী-পেশার ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ স্কুল এখন খুলে দেয়ার পক্ষে। যদিও ৫২ শতাংশ মানুষ স্কুল খুলে দেয়ার পর করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) বাস্তবায়নে ‘নাগরিক প্ল্যাটফর্ম অনলাইন জরিপ ২০২১ ফেব্রুয়ারি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল অনুষ্ঠিত ‘অবশেষে স্কুল খুলছে : আমরা কতখানি প্রস্তুত?’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়।

যদিও গতমাসে প্রকাশিত ‘গণস্বাক্ষরতা অভিযান’র এক জরিপে বলা হয়, ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত স্কুলে ফিরতে চায়। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা ও এনজিও স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে।

শিক্ষামন্ত্রীর পরিকল্পনায় যা ছিল

আগামী ২৪ মে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষে ক্লাস শুরু হবে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ২২ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।

স্কুল-কলেজ খোলার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, স্কুল-কলেজ খোলার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। করোনা মোকাবিলা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে কবে থেকে স্কুল-কলেজের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান শুরু হবে, তা জানিয়ে দেয়া হবে।

এছাড়াও ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিবেশ পর্যালোচনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিনের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলে পুনরায় খুলে দেয়ার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা পর্যালোচনা করবেন এবং এরপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আইইডিসিআরের পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে জনস্বাস্থ্যের যে পরিস্থিতি তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায়। কারণ শনাক্তের হার ৫-এর নিচে প্রায় চার সপ্তাহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে যে, শনাক্তের হার যদি পরপর দুই সপ্তাহ ৫ শতাংশের কম থাকে তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায়। তবে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একসঙ্গে খোলা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।’

বড়দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে খুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব বিশ^বিদ্যালয় শহরের বাইরে.... যেগুলোতে আবাসিক সুবিধা আছে সেগুলো আগে খুলে দেয়া যায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে.... যাতে বেশি মানুষ এক সঙ্গে না যায় সেজন্য ভাগ ভাগ করে ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ক্লাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে; অতিরিক্ত শিক্ষকেরও ব্যবস্থা করতে হবে।’

এভাবে পর্যায়ক্রমে সব বিশ^বিদ্যালয়, এরপর কলেজ ও হাইস্কুল এবং সবার শেষে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন খুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে দেশের ক্ষতি, অর্থনীতিরও ক্ষতি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘করোনার প্রথমদিকে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হলেও বর্তমানে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছুটি রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও করোনা প্রতিরোধে তা খুব একটা কার্যকর মনে হয় না। কারণ শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে নেই, সবাই রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাটবাজারে যাচ্ছে, বাবা-মা’র সঙ্গে বিনোদনমূলক ভ্রমণে যাচ্ছে, মার্কেটগুলোতেও মানুষের ভিড়। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লাভ কী?’

‘নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ’র জরিপে আরও যা আছে

১৭ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি এই অনলাইন জরিপ পরিচালনা করা হয় বলে জানান বেসরকারি গবেষণা সংস্তা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) যুগ্ম পরিচালক অভ্র ভট্টাচার্য। মোট এক হাজার ৯৬০ জনের ওপর পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অভিভাবক ছিলেন ৫৭৬ জন এবং শিক্ষক ছিলেন ৩৭০ জন। বাকি ব্যক্তিরা অন্যান্য শ্রেণী-পেশার সদস্য ও প্রতিনিধি।

অভ্র ভট্রাচার্য জানান, অভিভাবকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, স্কুল খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার প্রণীত স্বাস্থ্য নির্দেশিকা সম্পর্কে তারা অবগত কি-না। এর জবাবে প্রায় ৮৭ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা এই স্বাস্থ্য নির্দেশিকা সম্পর্কে অবগত। ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে তারা নিরাপদ বোধ করছেন না। বাকি অন্য অভিভাবকরা ইতিবাচক মত দিয়েছেন। ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, সন্তানরা স্কুল স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে চলতে সক্ষম না। এছাড়া ৬৭ শতাংশ অভিভাবক সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত ফি দিতে আগ্রহী নন।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় ভার্চুয়্যাল সংলাপে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নেহাল আহমেদ, প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক শফিকুল ইসলামসহ বিভিন্ন এলাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

বক্তারা পর্যায়ক্রমে এলাকাভিত্তিক স্কুল খুলে শ্রেণীভিত্তিক ক্লাস শুরুর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। জরিপে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে।

৮৭ শতাংশ শিক্ষক স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ করছেন উল্লেখ করে জরিপকালে সমপরিমাণ শিক্ষক মনে করেন, স্কুলের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা নিশ্চিত করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। প্রায় ৬৯ শতাংশ শিক্ষক অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহনে সরকারি অনুদানের কথা বলেছেন। কিন্তু অভিভাবক ও শিক্ষক বাদে অন্যান্য শ্রেণীপেশার ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ সরকারের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করেন।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি আছে। দীর্ঘ ছুটির কারণে দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বিঘিœত হচ্ছে।

‘গণসাক্ষরতা অভিযান’র জরিপে যা ছিল

গত ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জোট ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’ পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ’ এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। এরমধ্যে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত ক্লাসে ফিরে আসতে চায়। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক, ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ৮০% এনজিও কর্মকর্তা স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে প্রাথমিক স্কুল খোলার ক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।

৭৯.৭ শতাংশ শিক্ষক বিদ্যালয় খুলে দেয়ার আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টির ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছেন। ৯০.৭ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস তৈরিতে অভিভাবকগণ তাদের সচেতন করবেন।

ওইদিন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, ‘সরকারকে ধাপে ধাপে সক্ষমতা অর্জন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে হবে। যাতে পরবর্তী ধাপে ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। সবার সুরক্ষা নিশ্চিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করে স্কুলগুলোকে পুনরায় সচল করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে কখন খোলা হবে সে বিষয়ে সরকারের স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়া উচিত। এতে শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিতে পারবে।’

বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১১ ফাল্গুন ১৪২৭ ১১ রজব ১৪৪২

স্কুল খোলা নিয়ে বিভক্ত মানুষ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

দেশের অধিকাংশ অভিভাবক ও শিক্ষক এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে নন। তারা এখনই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করছেন না। কিন্তু এর বাইরে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন।

গতকাল প্রকাশিত একটি বেসরকারি জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করছেন না। প্রায় ৫১ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, তাদের সন্তানরা স্কুল স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে চলতে সক্ষম না। তবে অভিভাবক ও শিক্ষক বাদে অন্যান্য শ্রেণী-পেশার ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ স্কুল এখন খুলে দেয়ার পক্ষে। যদিও ৫২ শতাংশ মানুষ স্কুল খুলে দেয়ার পর করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) বাস্তবায়নে ‘নাগরিক প্ল্যাটফর্ম অনলাইন জরিপ ২০২১ ফেব্রুয়ারি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল অনুষ্ঠিত ‘অবশেষে স্কুল খুলছে : আমরা কতখানি প্রস্তুত?’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়।

যদিও গতমাসে প্রকাশিত ‘গণস্বাক্ষরতা অভিযান’র এক জরিপে বলা হয়, ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত স্কুলে ফিরতে চায়। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা ও এনজিও স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে।

শিক্ষামন্ত্রীর পরিকল্পনায় যা ছিল

আগামী ২৪ মে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষে ক্লাস শুরু হবে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ২২ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।

স্কুল-কলেজ খোলার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, স্কুল-কলেজ খোলার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। করোনা মোকাবিলা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে কবে থেকে স্কুল-কলেজের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান শুরু হবে, তা জানিয়ে দেয়া হবে।

এছাড়াও ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিবেশ পর্যালোচনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিনের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলে পুনরায় খুলে দেয়ার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা পর্যালোচনা করবেন এবং এরপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আইইডিসিআরের পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে জনস্বাস্থ্যের যে পরিস্থিতি তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায়। কারণ শনাক্তের হার ৫-এর নিচে প্রায় চার সপ্তাহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে যে, শনাক্তের হার যদি পরপর দুই সপ্তাহ ৫ শতাংশের কম থাকে তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায়। তবে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একসঙ্গে খোলা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।’

বড়দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে খুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব বিশ^বিদ্যালয় শহরের বাইরে.... যেগুলোতে আবাসিক সুবিধা আছে সেগুলো আগে খুলে দেয়া যায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে.... যাতে বেশি মানুষ এক সঙ্গে না যায় সেজন্য ভাগ ভাগ করে ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ক্লাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে; অতিরিক্ত শিক্ষকেরও ব্যবস্থা করতে হবে।’

এভাবে পর্যায়ক্রমে সব বিশ^বিদ্যালয়, এরপর কলেজ ও হাইস্কুল এবং সবার শেষে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন খুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে দেশের ক্ষতি, অর্থনীতিরও ক্ষতি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘করোনার প্রথমদিকে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হলেও বর্তমানে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছুটি রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও করোনা প্রতিরোধে তা খুব একটা কার্যকর মনে হয় না। কারণ শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে নেই, সবাই রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাটবাজারে যাচ্ছে, বাবা-মা’র সঙ্গে বিনোদনমূলক ভ্রমণে যাচ্ছে, মার্কেটগুলোতেও মানুষের ভিড়। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লাভ কী?’

‘নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ’র জরিপে আরও যা আছে

১৭ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি এই অনলাইন জরিপ পরিচালনা করা হয় বলে জানান বেসরকারি গবেষণা সংস্তা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) যুগ্ম পরিচালক অভ্র ভট্টাচার্য। মোট এক হাজার ৯৬০ জনের ওপর পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অভিভাবক ছিলেন ৫৭৬ জন এবং শিক্ষক ছিলেন ৩৭০ জন। বাকি ব্যক্তিরা অন্যান্য শ্রেণী-পেশার সদস্য ও প্রতিনিধি।

অভ্র ভট্রাচার্য জানান, অভিভাবকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, স্কুল খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার প্রণীত স্বাস্থ্য নির্দেশিকা সম্পর্কে তারা অবগত কি-না। এর জবাবে প্রায় ৮৭ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা এই স্বাস্থ্য নির্দেশিকা সম্পর্কে অবগত। ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে তারা নিরাপদ বোধ করছেন না। বাকি অন্য অভিভাবকরা ইতিবাচক মত দিয়েছেন। ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, সন্তানরা স্কুল স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে চলতে সক্ষম না। এছাড়া ৬৭ শতাংশ অভিভাবক সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত ফি দিতে আগ্রহী নন।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় ভার্চুয়্যাল সংলাপে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নেহাল আহমেদ, প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক শফিকুল ইসলামসহ বিভিন্ন এলাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

বক্তারা পর্যায়ক্রমে এলাকাভিত্তিক স্কুল খুলে শ্রেণীভিত্তিক ক্লাস শুরুর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। জরিপে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে।

৮৭ শতাংশ শিক্ষক স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ করছেন উল্লেখ করে জরিপকালে সমপরিমাণ শিক্ষক মনে করেন, স্কুলের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা নিশ্চিত করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। প্রায় ৬৯ শতাংশ শিক্ষক অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহনে সরকারি অনুদানের কথা বলেছেন। কিন্তু অভিভাবক ও শিক্ষক বাদে অন্যান্য শ্রেণীপেশার ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ সরকারের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করেন।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি আছে। দীর্ঘ ছুটির কারণে দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বিঘিœত হচ্ছে।

‘গণসাক্ষরতা অভিযান’র জরিপে যা ছিল

গত ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জোট ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’ পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ’ এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। এরমধ্যে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত ক্লাসে ফিরে আসতে চায়। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক, ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ৮০% এনজিও কর্মকর্তা স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে প্রাথমিক স্কুল খোলার ক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।

৭৯.৭ শতাংশ শিক্ষক বিদ্যালয় খুলে দেয়ার আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টির ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছেন। ৯০.৭ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস তৈরিতে অভিভাবকগণ তাদের সচেতন করবেন।

ওইদিন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, ‘সরকারকে ধাপে ধাপে সক্ষমতা অর্জন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে হবে। যাতে পরবর্তী ধাপে ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। সবার সুরক্ষা নিশ্চিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করে স্কুলগুলোকে পুনরায় সচল করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে কখন খোলা হবে সে বিষয়ে সরকারের স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়া উচিত। এতে শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিতে পারবে।’