বাংলাদেশ বেতারের পথচলা

দেওয়ান বাশার

১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত ১০ম বিশ্ব বেতার দিবস। বিশ্ব বেতার দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য : নিউ ওয়ার্ল্ড নিউ রেডিও অর্থাৎ নতুন বিশ্ব, নতুন বেতার। এই প্রতিপাদ্যটি মূলত তিনটি যুগোপযোগী বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত (বিবর্তন, উদ্ভাবন ও সংযোগ)।

এবারের প্রতিপাদ্যের মধ্যেই সময়ের সঙ্গে টিকে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। শুধু তাই নয় এবারের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে আরও তিনটি শব্দ জুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো : বিবর্তন, উদ্ভাবন ও সংযোগ। মূলত প্রতিপাদ্যের মধ্যেই বেতার মাধ্যম নিয়ে বর্তমান সময়ের সংশয়, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত নিহিত।

বিশ্বব্যাপী বেতার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গণমাধ্যম। সব স্তরের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর অনন্য দক্ষতা প্রকাশ করে যে, বেতার সমাজে বৈচিত্র্যের অভিজ্ঞতাকে রূপ দিতে পারে ভিন্ন মাত্রায়। কথা বলার অধিকারকে সংরক্ষিত করে তা উপস্থাপন ও শোনার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসাবে দাঁড় করাতে পারে বেতার। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে বেতারের পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ পৃথিবী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেতারও তার সময়ের সঙ্গে পথ চলবে। নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের সঙ্গে পথচলা নয় বরং সামগ্রিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজস্ব পথে এগিয়ে যাওয়া। বর্তমান করোনাকালে বেতার তার গ্রহণযোগ্যতা ও সামর্থ্য প্রমাণ করেছে। অবরুদ্ধ জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চলমান রেখেছে। গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পদ্ধতি চলমান রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বেতার।

বিবর্তন দ্বারা সময়ের সঙ্গে বেতারের যুগোপযোগী পথচলার স্থায়িত্বকে বোঝানো হয়েছে। বেতারের ঐতিহাসিক মুহূর্তের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি, সম্প্রচার এবং জনসাধারণের বক্তব্য একটি যুগকে চিহ্নিত করেছে। বেতারের ঐতিহাসিক পথচলায় কণ্ঠস্বর এবং সংগীত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। মানুষের সঙ্গে বেতারের দীর্ঘ পথচলার ইতিহাস বেতারকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। সময়ের হাত ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবর্তনের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের ইতিহাস বেতার ধারণ করেছে স্বমহিমায়। পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেতারের ভূমিকা অপরিসীম।

সময়ের হাত ধরে বেতারকে সবসময় নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। উদ্ভাবন দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে বিশ্ব পরিবর্তনের সঙ্গে বেতার তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রগতির উদ্ভাবনী ধারায় নিজেকে চলমান রাখা। মানুষের জীবনাচরণে বেতার সবসময় সবখানে সমান প্রভাব বিস্তার করেছে নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা দ্বারা। আমরা জানি আচরণ এবং জীবনধারা অনুসারে বেতার সর্বত্র এবং সবার কাছে খুব সহজে পৌঁছে যায়। প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং আধুনিকায়নের ফলে বেতার এখন শুধু একটি শব্দ মাধ্যম নয়- বেতার আজ টিভিতে শোনা যায় এবং টিভিও শোনা যায় বেতারে। মোবাইলের সহজলভ্যতায় জনগণকে এখন বেতার সেট আলাদা করে কিনতে হয় না, প্রতিটি মোবাইল ফোনে বেতার শোনার সুবিধা থাকায় তারা এখন মোবাইল সেটেই বেতার শুনছে। মানুষের দৈনিন্দিন জীবনের প্রয়োজনে মানুষের চাহিদানুযায়ী বেতার তথ্য, বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কৃষি ও যে কোন মহামারিতে অবদান রেখে চলেছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের খবর একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে জানানোর কাজটি বেতার মাধ্যমের জন্য সহজতর হয়েছে।

১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেতার শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বলিষ্ঠ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বেতারে প্রচার ছিল সাহসী ও তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিপাগল দেশপ্রেমিক জনতাকে উজ্জীবিত করতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বেতারের সতর্কতামূলক বার্তা সাধারণ মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। করোনাকালে আমরা দেখছি বেতার কীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সহজেই বেতারের মাধ্যমে অল্প সময় এবং খরচে জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে বেতার। বাংলাদেশ বেতার জন্মলগ্ন থেকে দেশীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ বেতারের ১৪টি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থানীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ও জীবনের মান উন্নয়নের মঞ্চ হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করছে। এছাড়াও এফএম রেডিও ও কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলগুলো স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করে যাচ্ছে নিরন্তর।

[লেখক : সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহী]

আরও খবর

বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১১ ফাল্গুন ১৪২৭ ১১ রজব ১৪৪২

বাংলাদেশ বেতারের পথচলা

দেওয়ান বাশার

১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত ১০ম বিশ্ব বেতার দিবস। বিশ্ব বেতার দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য : নিউ ওয়ার্ল্ড নিউ রেডিও অর্থাৎ নতুন বিশ্ব, নতুন বেতার। এই প্রতিপাদ্যটি মূলত তিনটি যুগোপযোগী বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত (বিবর্তন, উদ্ভাবন ও সংযোগ)।

এবারের প্রতিপাদ্যের মধ্যেই সময়ের সঙ্গে টিকে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। শুধু তাই নয় এবারের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে আরও তিনটি শব্দ জুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো : বিবর্তন, উদ্ভাবন ও সংযোগ। মূলত প্রতিপাদ্যের মধ্যেই বেতার মাধ্যম নিয়ে বর্তমান সময়ের সংশয়, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত নিহিত।

বিশ্বব্যাপী বেতার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গণমাধ্যম। সব স্তরের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর অনন্য দক্ষতা প্রকাশ করে যে, বেতার সমাজে বৈচিত্র্যের অভিজ্ঞতাকে রূপ দিতে পারে ভিন্ন মাত্রায়। কথা বলার অধিকারকে সংরক্ষিত করে তা উপস্থাপন ও শোনার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসাবে দাঁড় করাতে পারে বেতার। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে বেতারের পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ পৃথিবী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেতারও তার সময়ের সঙ্গে পথ চলবে। নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের সঙ্গে পথচলা নয় বরং সামগ্রিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজস্ব পথে এগিয়ে যাওয়া। বর্তমান করোনাকালে বেতার তার গ্রহণযোগ্যতা ও সামর্থ্য প্রমাণ করেছে। অবরুদ্ধ জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চলমান রেখেছে। গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পদ্ধতি চলমান রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বেতার।

বিবর্তন দ্বারা সময়ের সঙ্গে বেতারের যুগোপযোগী পথচলার স্থায়িত্বকে বোঝানো হয়েছে। বেতারের ঐতিহাসিক মুহূর্তের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি, সম্প্রচার এবং জনসাধারণের বক্তব্য একটি যুগকে চিহ্নিত করেছে। বেতারের ঐতিহাসিক পথচলায় কণ্ঠস্বর এবং সংগীত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। মানুষের সঙ্গে বেতারের দীর্ঘ পথচলার ইতিহাস বেতারকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। সময়ের হাত ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবর্তনের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের ইতিহাস বেতার ধারণ করেছে স্বমহিমায়। পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেতারের ভূমিকা অপরিসীম।

সময়ের হাত ধরে বেতারকে সবসময় নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। উদ্ভাবন দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে বিশ্ব পরিবর্তনের সঙ্গে বেতার তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রগতির উদ্ভাবনী ধারায় নিজেকে চলমান রাখা। মানুষের জীবনাচরণে বেতার সবসময় সবখানে সমান প্রভাব বিস্তার করেছে নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা দ্বারা। আমরা জানি আচরণ এবং জীবনধারা অনুসারে বেতার সর্বত্র এবং সবার কাছে খুব সহজে পৌঁছে যায়। প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং আধুনিকায়নের ফলে বেতার এখন শুধু একটি শব্দ মাধ্যম নয়- বেতার আজ টিভিতে শোনা যায় এবং টিভিও শোনা যায় বেতারে। মোবাইলের সহজলভ্যতায় জনগণকে এখন বেতার সেট আলাদা করে কিনতে হয় না, প্রতিটি মোবাইল ফোনে বেতার শোনার সুবিধা থাকায় তারা এখন মোবাইল সেটেই বেতার শুনছে। মানুষের দৈনিন্দিন জীবনের প্রয়োজনে মানুষের চাহিদানুযায়ী বেতার তথ্য, বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কৃষি ও যে কোন মহামারিতে অবদান রেখে চলেছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের খবর একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে জানানোর কাজটি বেতার মাধ্যমের জন্য সহজতর হয়েছে।

১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেতার শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বলিষ্ঠ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বেতারে প্রচার ছিল সাহসী ও তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিপাগল দেশপ্রেমিক জনতাকে উজ্জীবিত করতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বেতারের সতর্কতামূলক বার্তা সাধারণ মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। করোনাকালে আমরা দেখছি বেতার কীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সহজেই বেতারের মাধ্যমে অল্প সময় এবং খরচে জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে বেতার। বাংলাদেশ বেতার জন্মলগ্ন থেকে দেশীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ বেতারের ১৪টি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থানীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ও জীবনের মান উন্নয়নের মঞ্চ হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করছে। এছাড়াও এফএম রেডিও ও কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলগুলো স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করে যাচ্ছে নিরন্তর।

[লেখক : সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহী]