সাত কলেজের পরীক্ষা হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হবে না

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে গতকাল ও আজকের পরীক্ষার নতুন সূচিও প্রকাশ করা হয়েছে। তবে হল-ক্যাম্পাস বন্ধই থাকবে।

গতকাল বিকেলে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে গতকাল বিকেলে এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয় বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এমএ খায়ের জানিয়েছেন।

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো নেয়ার সিন্ধান্ত হলেও জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের (এনইউ) অধীনে কোন কলেজেই অনার্স-মাস্টার্স পরীক্ষা নেয়া হবে না বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পূর্ব ঘোষিত সূচি অনুযায়ী, কিছুদিনের মধ্যেই জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশের কলেজ পর্যায়ে ডিগ্রি (পাস) কোর্স ও মাস্টার্সের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। এই পরীক্ষাগুলো এখন পিছিয়ে গেল।

সাত সরকারি কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও ঢাবি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো অব্যাহত থাকবে। গতকাল এবং আজকের পরীক্ষাগুলোর তারিখ পরে জানিয়ে দেয়া হবে। তবে শর্ত দেয়া হয়েছে, পরীক্ষা চলাকালে কলেজগুলোর হোস্টেল খোলা যাবে না এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও অধ্যক্ষদের এক সভায় কলেজগুলোর সব পরীক্ষা ২৪ মে পর্যন্ত স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের পরই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং হল-ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার দাবিতে নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। রাতে তারা ফিরে যায়, কিন্তু তারা গতকাল সকাল ১১টার দিকে পুনরায় নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। দুপুরে শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নগরীর বড় অংশজুড়ে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান, উপউপাচার্য এবং সাত কলেজের অধ্যক্ষরা ওই ভার্চুয়াল সভায় অংশ নেন। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। আনন্দ প্রকাশ করে স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।

ইডেন কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান বলেন, ‘আমার ফাইনাল ইয়ারের মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি ছিল, সেটিই আজকে হওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ করে কেন এই পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়া হলো? দেশে কী সবকিছু বন্ধ আছে? তাহলে আমাদের সঙ্গে এই নাটক কেন? একটা পরীক্ষার জন্য কি আরও এক বছর ঘরে বসে থাকতে হবে? এমনিতেই ২০১৯ সালের পরীক্ষা ২০২১ সালে নেয়া হচ্ছে।’

সাত কলেজের পরীক্ষার নতুন সূচি

ঢাবি অধিভুক্ত সাতটি বড় সরকারি কলেজের দুটি পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। গতকাল চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা ও আজকের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। গতকাল রাতে সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত (ফোকাল পয়েন্ট) ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার সংবাদকে বলেন, ‘আজকের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা আগামী ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকালের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ১৩ মার্চে।’

নির্ধারিত রুটিনে (সূচি) সাত সরকারি কলেজের বাকি পরীক্ষাগুলো নেয়া হবে। সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়কারী ড. এএসএম মাকসুদ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাত কলেজের পরীক্ষা রুটিন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে।’ তিনি জানান, সাত কলেজের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষা স্থগিত থাকবে। আগামী ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর এসব প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা নেয়া হবে।

এর আগে ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ভার্চুয়ালি এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, আগামী ২৪ মে (পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর) থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ১৭ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হল খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এর পরই দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের চলমান পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এক বৈঠকে ঢাবি অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজের চলমান সব পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ।

৭ কলেজকে ঢাবি অধিভুক্তির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফল হয়নি

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও সেশনজট কমানোর লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হলোÑ ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।

অধিভুক্তির ফলে শিক্ষার্থীদের কী লাভ হলো- জানতে চাইলে সরকারি সাত কলেজের সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার সংবাদকে বলেন, ‘এতে শিক্ষার মানের যে উন্নতি হয়েছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে অনেক ক্লাসমুখী হয়েছে। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত না থাকলে তাদের ফরম পূরণ করতে দেয়া হয় না। কঠোর অবস্থানের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ফেলও করছে। এই সংখ্যা দিয়ে শিক্ষার মান বোঝা যায় না। তারপরও নিশ্চয়ই মানসম্মত হয়নি; তাই ফেল করছে।’

গত ডিসেম্বরের প্রথমদিকে ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। দাবিগুলো ছিল, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ২.০০/২.২৫/২.৫০ পয়েন্টে পরবর্তী বর্ষে প্রমোটেড নিয়ম বাতিল করা এবং সর্বনিম্ন তিন বিষয় পর্যন্ত অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের প্রমোটেড দেয়া। অনার্স ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় বর্ষের ইম্প্রুভ পরীক্ষা এক মাসের মধ্যে নেয়া এবং তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা অতি দ্রুত নিয়ে ফল প্রকাশ করা। ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীদের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা অতিদ্রুত নিয়ে ফল প্রকাশ করা এবং সব বর্ষের ফলাফল সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করা।

একটি সেশনে একের অধিক বর্ষের শিক্ষার্থী রাখা যাবে না, ডিগ্রি ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের চলমান বিশেষ পরীক্ষা অতি দ্রুত নিয়ে এক মাসের মধ্যে ফল প্রকাশ করা এবং সব ইম্প্রুভ পরীক্ষা অতি দ্রুত নেয়া। এছাড়াও ডিগ্রি (পাস কোর্স), অনার্স, মাস্টার্স-সহ সব বর্ষের ফলাফলে গণহারে অকৃতকার্য হওয়ার কারণসহ খাতা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় ছেড়ে ঢাবি অধিভুক্তি হওয়ার পর সেশনজটসহ নানা সমস্যা ও সংকট আরও বেড়েছে। এখন পরীক্ষার পর ফল প্রকাশ করতে দেরি হয়। ঢাবির অধিভুক্ত হয়েও মূল লক্ষ্য সেশনজট থেকে মুক্তি অর্জন হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত সময়ে পরীক্ষা নিয়ে সেশনজট থেকে বেরিয়ে আসছে।’

৭ কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ২ লাখ

ঢাবি অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী পাঠলাভ করছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় বলা হয়, সাত কলেজের প্রত্যেকটি একেকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমান। এর মধ্যে তিতুমীর কলেজেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫৪ হাজার, যা ঢাবির মোট শিক্ষার্থীর চেয়েও বেশি। বাকি ছয় কলেজের প্রত্যেকটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। ঢাবির প্রায় ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নিয়োজিত থাকা শিক্ষক-কর্মচারী দিয়েই ওই সাত কলেজের দুই লাখ শিক্ষার্থীর যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে ঢাবি কর্তৃপক্ষের ওপরও বাড়তি চাপ পরেছে।

আন্দোলনের ঘোষণা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের

পূর্ব ঘোষিত রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বহাল রাখার দাবি জানিয়ে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্দন করেছে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ঐক্য পরিষদ’।

এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষা স্থগিত করেছেন। আমরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এই সিদ্ধান্ত বাতিল করে পরীক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্স পরীক্ষা গত মার্চে হওয়ার কথা থাকলেও করোনা সংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই পরীক্ষা নিতে পারেনি।’

সংগঠনের আহ্বায়ক মিনা আল আমিন বলেন, ‘মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে আহ্বান জানাচ্ছি, অনতিবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে এদেশের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করুন। যদি এই আহ্বানকে উপেক্ষা করা হয় তবে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।’

শিক্ষার্থীদের দাবি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সেশনের মাস্টার্স অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা ২০২১ সালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপনীতে পৌঁছাতে পারেনি। টানা সেশনজটের পরে যখন সংকট উত্তরণের অবস্থায় শিক্ষার্থীরা, ঠিক তখনই পরীক্ষা স্থগিতের মতো সিদ্ধান্ত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা জীবনের কালো অধ্যায় বলে বিবেচিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে সব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলমান থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা স্থগিত করা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সারা দেশে আট শতাধিক কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। এর মধ্যে বেসরকারি কলেজ তিন শতাধিক।

বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১২ ফাল্গুন ১৪২৭ ১২ রজব ১৪৪২

সাত কলেজের পরীক্ষা হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হবে না

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে গতকাল ও আজকের পরীক্ষার নতুন সূচিও প্রকাশ করা হয়েছে। তবে হল-ক্যাম্পাস বন্ধই থাকবে।

গতকাল বিকেলে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে গতকাল বিকেলে এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয় বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এমএ খায়ের জানিয়েছেন।

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো নেয়ার সিন্ধান্ত হলেও জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের (এনইউ) অধীনে কোন কলেজেই অনার্স-মাস্টার্স পরীক্ষা নেয়া হবে না বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পূর্ব ঘোষিত সূচি অনুযায়ী, কিছুদিনের মধ্যেই জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশের কলেজ পর্যায়ে ডিগ্রি (পাস) কোর্স ও মাস্টার্সের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। এই পরীক্ষাগুলো এখন পিছিয়ে গেল।

সাত সরকারি কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও ঢাবি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো অব্যাহত থাকবে। গতকাল এবং আজকের পরীক্ষাগুলোর তারিখ পরে জানিয়ে দেয়া হবে। তবে শর্ত দেয়া হয়েছে, পরীক্ষা চলাকালে কলেজগুলোর হোস্টেল খোলা যাবে না এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও অধ্যক্ষদের এক সভায় কলেজগুলোর সব পরীক্ষা ২৪ মে পর্যন্ত স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের পরই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং হল-ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার দাবিতে নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। রাতে তারা ফিরে যায়, কিন্তু তারা গতকাল সকাল ১১টার দিকে পুনরায় নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। দুপুরে শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নগরীর বড় অংশজুড়ে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান, উপউপাচার্য এবং সাত কলেজের অধ্যক্ষরা ওই ভার্চুয়াল সভায় অংশ নেন। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। আনন্দ প্রকাশ করে স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।

ইডেন কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান বলেন, ‘আমার ফাইনাল ইয়ারের মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি ছিল, সেটিই আজকে হওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ করে কেন এই পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়া হলো? দেশে কী সবকিছু বন্ধ আছে? তাহলে আমাদের সঙ্গে এই নাটক কেন? একটা পরীক্ষার জন্য কি আরও এক বছর ঘরে বসে থাকতে হবে? এমনিতেই ২০১৯ সালের পরীক্ষা ২০২১ সালে নেয়া হচ্ছে।’

সাত কলেজের পরীক্ষার নতুন সূচি

ঢাবি অধিভুক্ত সাতটি বড় সরকারি কলেজের দুটি পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। গতকাল চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা ও আজকের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। গতকাল রাতে সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত (ফোকাল পয়েন্ট) ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার সংবাদকে বলেন, ‘আজকের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা আগামী ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকালের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ১৩ মার্চে।’

নির্ধারিত রুটিনে (সূচি) সাত সরকারি কলেজের বাকি পরীক্ষাগুলো নেয়া হবে। সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়কারী ড. এএসএম মাকসুদ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাত কলেজের পরীক্ষা রুটিন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে।’ তিনি জানান, সাত কলেজের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষা স্থগিত থাকবে। আগামী ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর এসব প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা নেয়া হবে।

এর আগে ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ভার্চুয়ালি এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, আগামী ২৪ মে (পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর) থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ১৭ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হল খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এর পরই দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের চলমান পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এক বৈঠকে ঢাবি অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজের চলমান সব পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ।

৭ কলেজকে ঢাবি অধিভুক্তির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফল হয়নি

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও সেশনজট কমানোর লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হলোÑ ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।

অধিভুক্তির ফলে শিক্ষার্থীদের কী লাভ হলো- জানতে চাইলে সরকারি সাত কলেজের সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার সংবাদকে বলেন, ‘এতে শিক্ষার মানের যে উন্নতি হয়েছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে অনেক ক্লাসমুখী হয়েছে। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত না থাকলে তাদের ফরম পূরণ করতে দেয়া হয় না। কঠোর অবস্থানের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ফেলও করছে। এই সংখ্যা দিয়ে শিক্ষার মান বোঝা যায় না। তারপরও নিশ্চয়ই মানসম্মত হয়নি; তাই ফেল করছে।’

গত ডিসেম্বরের প্রথমদিকে ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। দাবিগুলো ছিল, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ২.০০/২.২৫/২.৫০ পয়েন্টে পরবর্তী বর্ষে প্রমোটেড নিয়ম বাতিল করা এবং সর্বনিম্ন তিন বিষয় পর্যন্ত অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের প্রমোটেড দেয়া। অনার্স ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় বর্ষের ইম্প্রুভ পরীক্ষা এক মাসের মধ্যে নেয়া এবং তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা অতি দ্রুত নিয়ে ফল প্রকাশ করা। ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীদের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা অতিদ্রুত নিয়ে ফল প্রকাশ করা এবং সব বর্ষের ফলাফল সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করা।

একটি সেশনে একের অধিক বর্ষের শিক্ষার্থী রাখা যাবে না, ডিগ্রি ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের চলমান বিশেষ পরীক্ষা অতি দ্রুত নিয়ে এক মাসের মধ্যে ফল প্রকাশ করা এবং সব ইম্প্রুভ পরীক্ষা অতি দ্রুত নেয়া। এছাড়াও ডিগ্রি (পাস কোর্স), অনার্স, মাস্টার্স-সহ সব বর্ষের ফলাফলে গণহারে অকৃতকার্য হওয়ার কারণসহ খাতা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় ছেড়ে ঢাবি অধিভুক্তি হওয়ার পর সেশনজটসহ নানা সমস্যা ও সংকট আরও বেড়েছে। এখন পরীক্ষার পর ফল প্রকাশ করতে দেরি হয়। ঢাবির অধিভুক্ত হয়েও মূল লক্ষ্য সেশনজট থেকে মুক্তি অর্জন হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত সময়ে পরীক্ষা নিয়ে সেশনজট থেকে বেরিয়ে আসছে।’

৭ কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ২ লাখ

ঢাবি অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী পাঠলাভ করছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় বলা হয়, সাত কলেজের প্রত্যেকটি একেকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমান। এর মধ্যে তিতুমীর কলেজেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫৪ হাজার, যা ঢাবির মোট শিক্ষার্থীর চেয়েও বেশি। বাকি ছয় কলেজের প্রত্যেকটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। ঢাবির প্রায় ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নিয়োজিত থাকা শিক্ষক-কর্মচারী দিয়েই ওই সাত কলেজের দুই লাখ শিক্ষার্থীর যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে ঢাবি কর্তৃপক্ষের ওপরও বাড়তি চাপ পরেছে।

আন্দোলনের ঘোষণা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের

পূর্ব ঘোষিত রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বহাল রাখার দাবি জানিয়ে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্দন করেছে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ঐক্য পরিষদ’।

এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষা স্থগিত করেছেন। আমরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এই সিদ্ধান্ত বাতিল করে পরীক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্স পরীক্ষা গত মার্চে হওয়ার কথা থাকলেও করোনা সংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই পরীক্ষা নিতে পারেনি।’

সংগঠনের আহ্বায়ক মিনা আল আমিন বলেন, ‘মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে আহ্বান জানাচ্ছি, অনতিবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে এদেশের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করুন। যদি এই আহ্বানকে উপেক্ষা করা হয় তবে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।’

শিক্ষার্থীদের দাবি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সেশনের মাস্টার্স অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা ২০২১ সালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপনীতে পৌঁছাতে পারেনি। টানা সেশনজটের পরে যখন সংকট উত্তরণের অবস্থায় শিক্ষার্থীরা, ঠিক তখনই পরীক্ষা স্থগিতের মতো সিদ্ধান্ত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা জীবনের কালো অধ্যায় বলে বিবেচিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে সব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলমান থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা স্থগিত করা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সারা দেশে আট শতাধিক কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। এর মধ্যে বেসরকারি কলেজ তিন শতাধিক।