ভাষা আন্দোলনে সেদিনের কিশোরীরা

বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামলে পুলিশের গুলিবর্ষণে শহীদ হন সালাম, রফিক, শফিক, বরকতসহ নাম না জানা অনেকে। ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির এ আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা অংশ নিয়েছিলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে, অকুতোভয় মেয়েরা ভাষার দাবির মিছিলগুলোতে ছিলেন সামনের সারিতে। এই আন্দোলনে নারীর ভূমিকা ছিল গৃহিণী থেকে গণপরিষদের সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। যাদের অগ্রভাগে ছিলেন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সেসব নারীর কথা যারা তখন ছিলেন বয়সে কিশোরী-তরুণী।

লায়লা নূর

আন্দোলন ও সংগ্রামের সূতিকাগার বলে পরিচিত কুমিল্লার এক সংগ্রামী নারী লায়লা নূর।

১৯৪৮ সাল থেকে ৫২-এর সব আন্দোলনেই তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করতে গিয়ে অন্য মেয়েদের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান এবং অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাকে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তার পদচারণা ছিল অবিস্মরণীয়।

হালিমা খাতুন

বাগেরহাটের মেয়ে হালিমা খাতুন ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তার দল ছিল মেয়েদের প্রথম দল। সিদ্ধান্ত ছিল ছেলেরা দশজন। আর মেয়েরা চারজন করে বেরিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড পার হবেন। কিন্তু পুলিশের গুলিতে হতাহত হন অনেকে। হালিমা খাতুন তার সঙ্গে থাকা জুলেখা, নূরী, সেতারাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আহতদের সেবা শুশ্রƒষা করে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। তিনি নিজেও আহত হয়েছিলেন। শহীদ রফিকের ছবির একটি ব্লক তৈরি করে সলিমুল্লাহ হলে রাখা হয়েছিল। হল পুলিশের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই ব্লকটি উদ্ধার করেছিলেন হালিমা খাতুন। এখন পর্যন্ত রফিকের যে ছবিটি দেখা যায়, সেটি ওই ব্লক থেকে তৈরি।

শরিফা খাতুন

ফেনীর মেয়ে শরিফা খাতুন ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসলে তিনি বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্কুলের ছাত্রীরাও মিছিলে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখার জন্য তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।

চেমন আরা

ভাষা সংগ্রামী চেমন আরা। তখন ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। তিনি সক্রিয়ভাবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ‘তমদুন মজলিস’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেন। অধ্যাপক চেমন আরা ভাষা আন্দোলনের চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ও লেখালেখির মাধ্যমে অবদান রেখে চলেছেন।

প্রতিভা মুৎসুদ্দি

ভাষা সংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দি আমাদের সমাজের এক মহান আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তিনি ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ঘোষিত বক্তব্যের প্রতিবাদে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তখন তিনি চট্টগ্রামের রাউজানে মহামুনি অ্যাংলো পালি ইনস্টিটিউটের ছাত্রী। চট্টগ্রামের রাউজানের পাহাড়তলীর মেয়ে প্রতিভা ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

রওশন আরা

ভাষা সংগ্রামী রওশন আরা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে আরও অনেকের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। যেসব ছাত্রছাত্রী তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে রওশন আরা ছিলেন অন্যতম। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারসেল নিক্ষেপে যেসব মেয়ে আহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন।

নাদেরা বেগম

সাহসী নারী নাদেরা বেগম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তিনি মেয়েদের ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতেন। মিছিলে-মিটিংয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার। তাকেও জেলে যেতে হয় এবং নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হতে হয়। তিনি ছিলেন মুনীর চৌধুরীর বোন। বঙ্গবন্ধু লেখেন- আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভেতর, যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় স্কুলের মেয়েরা ছাদে উঠে সেøাগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোটো ছোটো মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দী ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’- নানা ধরনের স্লোগান। এই সময়ে শামসুল হক সাহেবকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘হক সাহেব ওই দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবেন না। হক সাহেব আমাকে বলতেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব’।

ড. সুফিয়া আহমদ

ভাষা আন্দোলনে নারীদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন ড. সুফিয়া আহমদ।

‘৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে তার ওপর দায়িত্ব ছিল আনন্দময়ী ও বাংলাবাজার স্কুলের ছাত্রীদের একত্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় নিয়ে আসা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এগিয়ে গেলে পুলিশের লাঠিচার্জে তিনি আহত হন।

সূত্র [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, মুজিবুর রহমান, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড]

বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১২ ফাল্গুন ১৪২৭ ১২ রজব ১৪৪২

ভাষা আন্দোলনে সেদিনের কিশোরীরা

এমএ কাশেম সরকার, তারাকান্দা (ময়মনসিংহ)

image

বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামলে পুলিশের গুলিবর্ষণে শহীদ হন সালাম, রফিক, শফিক, বরকতসহ নাম না জানা অনেকে। ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির এ আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা অংশ নিয়েছিলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে, অকুতোভয় মেয়েরা ভাষার দাবির মিছিলগুলোতে ছিলেন সামনের সারিতে। এই আন্দোলনে নারীর ভূমিকা ছিল গৃহিণী থেকে গণপরিষদের সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। যাদের অগ্রভাগে ছিলেন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সেসব নারীর কথা যারা তখন ছিলেন বয়সে কিশোরী-তরুণী।

লায়লা নূর

আন্দোলন ও সংগ্রামের সূতিকাগার বলে পরিচিত কুমিল্লার এক সংগ্রামী নারী লায়লা নূর।

১৯৪৮ সাল থেকে ৫২-এর সব আন্দোলনেই তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করতে গিয়ে অন্য মেয়েদের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান এবং অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাকে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তার পদচারণা ছিল অবিস্মরণীয়।

হালিমা খাতুন

বাগেরহাটের মেয়ে হালিমা খাতুন ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তার দল ছিল মেয়েদের প্রথম দল। সিদ্ধান্ত ছিল ছেলেরা দশজন। আর মেয়েরা চারজন করে বেরিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড পার হবেন। কিন্তু পুলিশের গুলিতে হতাহত হন অনেকে। হালিমা খাতুন তার সঙ্গে থাকা জুলেখা, নূরী, সেতারাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আহতদের সেবা শুশ্রƒষা করে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। তিনি নিজেও আহত হয়েছিলেন। শহীদ রফিকের ছবির একটি ব্লক তৈরি করে সলিমুল্লাহ হলে রাখা হয়েছিল। হল পুলিশের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই ব্লকটি উদ্ধার করেছিলেন হালিমা খাতুন। এখন পর্যন্ত রফিকের যে ছবিটি দেখা যায়, সেটি ওই ব্লক থেকে তৈরি।

শরিফা খাতুন

ফেনীর মেয়ে শরিফা খাতুন ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসলে তিনি বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্কুলের ছাত্রীরাও মিছিলে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখার জন্য তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।

চেমন আরা

ভাষা সংগ্রামী চেমন আরা। তখন ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। তিনি সক্রিয়ভাবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ‘তমদুন মজলিস’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেন। অধ্যাপক চেমন আরা ভাষা আন্দোলনের চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ও লেখালেখির মাধ্যমে অবদান রেখে চলেছেন।

প্রতিভা মুৎসুদ্দি

ভাষা সংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দি আমাদের সমাজের এক মহান আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তিনি ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ঘোষিত বক্তব্যের প্রতিবাদে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তখন তিনি চট্টগ্রামের রাউজানে মহামুনি অ্যাংলো পালি ইনস্টিটিউটের ছাত্রী। চট্টগ্রামের রাউজানের পাহাড়তলীর মেয়ে প্রতিভা ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

রওশন আরা

ভাষা সংগ্রামী রওশন আরা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে আরও অনেকের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। যেসব ছাত্রছাত্রী তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে রওশন আরা ছিলেন অন্যতম। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারসেল নিক্ষেপে যেসব মেয়ে আহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন।

নাদেরা বেগম

সাহসী নারী নাদেরা বেগম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তিনি মেয়েদের ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতেন। মিছিলে-মিটিংয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার। তাকেও জেলে যেতে হয় এবং নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হতে হয়। তিনি ছিলেন মুনীর চৌধুরীর বোন। বঙ্গবন্ধু লেখেন- আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভেতর, যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় স্কুলের মেয়েরা ছাদে উঠে সেøাগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোটো ছোটো মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দী ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’- নানা ধরনের স্লোগান। এই সময়ে শামসুল হক সাহেবকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘হক সাহেব ওই দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবেন না। হক সাহেব আমাকে বলতেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব’।

ড. সুফিয়া আহমদ

ভাষা আন্দোলনে নারীদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন ড. সুফিয়া আহমদ।

‘৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে তার ওপর দায়িত্ব ছিল আনন্দময়ী ও বাংলাবাজার স্কুলের ছাত্রীদের একত্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় নিয়ে আসা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এগিয়ে গেলে পুলিশের লাঠিচার্জে তিনি আহত হন।

সূত্র [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, মুজিবুর রহমান, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড]