রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্ত হত্যা মামলার আসামিরা : সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের নজির!

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

বাংলাদেশে বরাবরই সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং শীর্ষ আমলাদের মুখ থেকে একটি বহুল কথিত বাক্য হচ্ছে- ‘আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর।’ এ বক্তব্যের সপক্ষে গত একযুগে বড় কিছু দৃশ্যমানতা আমরা দেখতেও পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার ও দণ্ড এ সরকার কার্যকর করেছেন। একুশে আগস্ট সংঘটিত নারকীয় গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার চার্জশিট, র‌্যাবের হাতে নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত সাত হত্যাকাণ্ডসহ বেশকিছু ভয়াবহ মামলার বিচার ও দণ্ড সম্পন্ন হয়েছে। যদিও এসব নিম্নআদালতের বিচার ও দণ্ড উচ্চ আদালতে আপিলে বিবেচনাধীন। সবচেয়ে বড় কথা একাত্তরে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এসব ফিরিস্তি শুনলে মনে হতে পারে, করিৎকর্মা সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন! তাদের সদিচ্ছার তুলনা হয় না; কিন্তু অন্য অনেক পরিসংখ্যান এর বিপক্ষে খুবই আশঙ্কাজনক তথ্য দিচ্ছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি রাতেও বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে ওয়ান্টেড তালিকায় দেখা গেছে একজন হারিছ আহমেদের নাম। অথচ একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়- ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে এ সাজা মাফের প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিন গোপন থাকা বিষয়টি আলোয় নিয়ে আসে গণমাধ্যম। পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকায় পলাতক শীর্ষ অপরাধীদের নাম ও ছবি থাকে। গত বুধবার রাতেও বহুল আলোচিত হারিছের নাম ও ছবি দেখা গেছে। হারিছ আহমেদ ও তার আরো দুই ভাই আনিস আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন ওই তালিকায়। এর মধ্যে হারিছ ও জোসেফ দুটি করে এবং আনিস একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় ২০১৮ সালের ২৭ মে জোসেফ মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই দেশের বাইরে চলে যান। হারিছ ও আনিস পুলিশ রেকর্ডে দীর্ঘদিন পলাতক। তাদের দুজনের দণ্ড মওকুফ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতি থাকাকালে কুখ্যাত সব য্দ্ধুাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড হয়েছে। তাদের অনেকেই প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাদের কোন সুযোগ দেননি। এর জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করার পরই তিনজন হত্যা মামলার আসামিকে মুক্ত জীবনযাপন করার সুযোগ করে দিলেন তিনি। এদের মধ্যে দু’জনই ছিলেন বিদেশে পলাতক!

২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন জিল্লুর রহমান। বছর ঘোরার আগেই তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবরকে ক্ষমা করে কারামুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। দুদক ও এনবিআরের চারটি মামলায় ১৮ বছর দণ্ড ও ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত পলাতক শাহাদাবকে। এই দণ্ড মওকুফ করা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হলেও পরবর্তীকালে সাংবিধানিক এ ক্ষমতা ব্যবহারে রাষ্ট্রপতিরা বিশেষ যত্নশীল হয়েছিলেন- এমনটি বলা যাবে না। আরেকটি বছর যেতে না যেতেই ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যুদণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত ২০ জনকে ‘গণক্ষমা’ ক্ষমা করে দেন রাষ্ট্রপতি। যুবদল নেতা সাব্বির আহমেদ গামা হত্যা মামলায় ওই সাজাপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।

ক্ষমার নজির হিসেবে সেটি শেষ ঘটনা ছিল না। বছর ঘুরে আসার আগেই লক্ষ্মীপুরের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা ‘কিলার’ খ্যাত পুত্র বিপ্লবের সাজা হ্রাস করেন। ফেনীর আলোচিত অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যাসহ অন্য একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির দিন গুনছিল বিপ্লব। ফাঁসি এড়াতে আইনি কাঠামোর ভেতরে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছিল বিপ্লবের পরিবার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ রায়ে বলেছিলেন- ‘সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে বিপ্লব হত্যাকারী, তাই তার সাজা হ্রাস করার কোন প্রশ্ন নাই।’ আদালতে ব্যর্থ হলে কী হবে অপরাধী ছেলেকে রক্ষা করতে রাজনৈতিক পরিচয়ের ফলাফল মিলে যায় হাতেনাতে। মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে দুটি হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপতি দুইবার করে সাজা হ্রাস করে মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড করা হয়।

অপরাধীদের সাজা মাফে পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদও কম যাননি। দুই দশক আগে একটি জোড়া খুনের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মহিউদ্দিন ঝিন্টুকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন ২০০৫ সালে ক্ষমা করে দেন। ঝিন্টু ক্ষমা পাওয়ার আগে ওই মামলারই এক আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। ঝিন্টু ক্ষমা নিয়ে সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল সংসদে ও বাইরে সমালোচনায় ছিল মুখর। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপির দেখানো পথেই হাঁটতে শুরু করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই খুন ও দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় একের পর এক কারাগার থেকে বেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন নীরব দর্শক। প্রসঙ্গত এর আগে আওয়ামী নেতা ময়েজউদ্দিন হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আজম খানকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন এরশাদ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কুখ্যাত ‘সেভেন মার্ডার’ এর প্রধান আসামি শফিউল আলম প্রধানকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া মাত্র দুটি কাজ করতে পারেন। এর একটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। ফলে অপরাধীদের সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে তিনি সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। যদিও সংবিধানের ৪৯নং অনুচ্ছেদে ‘এরকম কোন পরামর্শ’র বিধান উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং রাষ্ট্রপতি চাইলেই সাজা মওকুফের সুপারিশ ফেরত পাঠাতে পারেন এবং একটি নৈতিক অবস্থান তৈরিও করতে পারেন। আমরা ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে মনে করতে পারি। তিনি ‘জননিরাপত্তা আইন’ নামে একটি বিতর্কিত আইনে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এ কারণে তৎকালীন সরকারের সাথে তার তিক্ততা সৃষ্টি হলেও মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমান বা নিকট অতীতের কোন রাষ্ট্রপতি সাজাপ্রাপ্ত একজন খুনিকে ক্ষমা না করে তার অবস্থানের নৈতিক দৃঢ়তা এবং মর্যাদা স্থাপনের নজির দেখালে সেটি অনুকরণীয় হতে পারত।

বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে ২১ জনেরও বেশি বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্ত জীবনযাপন করছেন। রাষ্ট্রপতির এই এখতিয়ার কীভাবে প্রয়োগ করা হয়, আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কতটা কাজ করছে, এ নিয়ে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন এন্তার। সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক পত্রিকান্তরে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতা প্রয়োগের কারণ যেহেতু ব্যাখ্যা করা হয় না, সেখানে অস্বচ্ছতার কারণে জনমনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। বছর কয়েক আগে এরকম একটি ইস্যু নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল- সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত। এ বিষয়ক একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশও ছিল সেই রায়ে। বলাই বাহুল্য, তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের মতে, সাধারণ জনগণের মধ্যে নানান প্রশ্ন তৈরি করে যে, কেন ক্ষমা করা হলো? কার প্রভাবে ক্ষমা করা হলো? কোন স্বার্থে ক্ষমা করা হলো ইত্যাদি ইত্যাদি! এই প্রশ্নগুলো আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের জন্য খুব একটা সুখকর ব্যাপার নয়। তবে সব সরকারের আমলে এক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য কমন- স্বচ্ছতা এবং সংবিধান অনুযায়ী সাজা মওকুফের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে।

দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান ‘দায়মুক্তি’ প্রদান করেছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রদেয় ক্ষমতাবলে তিনি যে কোন আসামির দণ্ড মওকুফ করে দিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার অধিকার কোনো সাধারণ অধিকার নয়। আমাদের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ ধারণ করে আছে, ইংলিশ কমন ল-এর ‘রয়্যাল প্রিরোগেটিভ’ (Royal Prerogative) বাংলায় যাকে বলা হচ্ছে- ‘রাজকীয় বিশেষ অধিকার’। সংবিধানে ‘বিশেষ অধিকার’ হিসেবে এটি লেখা হলেও এটি ইংরেজি অর্থেই ‘প্রিরোগেটিভ’।

এর কি কোন প্রতিকার নেই! একজন প্রাক্তন জেলা ও দায়রা জজ এ প্রসঙ্গে বলেন, গত পঞ্চাশ বছরে রাষ্ট্রপতির এ অধিকারের আওতায় যত খুনি-সন্ত্রাসী ক্ষমা পেয়ে গেছে, তাদের একটি তালিকা জনগণের সামনে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে প্রকাশ করা দরকার। জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে উত্থাপন করে আলোচনা করা যেতে পারে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি নজির স্থাপন করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়কালে যে সব দণ্ড ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল- হরিয়ানার স্বরাষ্ট্র সচিবকে সেগুলো হলফনামা দিয়ে প্রকাশ করতে হয়েছিল। বাংলাদেশেও এরকম উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে আইনজ্ঞরা মনে করছেন। কারণ সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন বলে আইনজ্ঞরা মনে করছেন।

মৌলিক ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে, আইনের শাসনের ভিত্তিমূলকে আরো শক্তিশালী করতে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে এ অধিকার দিয়েছে। এর মর্যাদা ও যথাপ্রয়োগ রাষ্ট্রপতি ও সরকারসমূহ বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিচ্ছেন। রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গাইডলাইন বেঁধে দিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী জাতীয় সংসদ এ নজির বিবেচনায় নিতে পারেন। তারা নিশ্চয়ই পারেন এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করতে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সেটি হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্মী]

বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১২ ফাল্গুন ১৪২৭ ১২ রজব ১৪৪২

রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্ত হত্যা মামলার আসামিরা : সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের নজির!

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

বাংলাদেশে বরাবরই সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং শীর্ষ আমলাদের মুখ থেকে একটি বহুল কথিত বাক্য হচ্ছে- ‘আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর।’ এ বক্তব্যের সপক্ষে গত একযুগে বড় কিছু দৃশ্যমানতা আমরা দেখতেও পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার ও দণ্ড এ সরকার কার্যকর করেছেন। একুশে আগস্ট সংঘটিত নারকীয় গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার চার্জশিট, র‌্যাবের হাতে নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত সাত হত্যাকাণ্ডসহ বেশকিছু ভয়াবহ মামলার বিচার ও দণ্ড সম্পন্ন হয়েছে। যদিও এসব নিম্নআদালতের বিচার ও দণ্ড উচ্চ আদালতে আপিলে বিবেচনাধীন। সবচেয়ে বড় কথা একাত্তরে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এসব ফিরিস্তি শুনলে মনে হতে পারে, করিৎকর্মা সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন! তাদের সদিচ্ছার তুলনা হয় না; কিন্তু অন্য অনেক পরিসংখ্যান এর বিপক্ষে খুবই আশঙ্কাজনক তথ্য দিচ্ছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি রাতেও বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে ওয়ান্টেড তালিকায় দেখা গেছে একজন হারিছ আহমেদের নাম। অথচ একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়- ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে এ সাজা মাফের প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিন গোপন থাকা বিষয়টি আলোয় নিয়ে আসে গণমাধ্যম। পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকায় পলাতক শীর্ষ অপরাধীদের নাম ও ছবি থাকে। গত বুধবার রাতেও বহুল আলোচিত হারিছের নাম ও ছবি দেখা গেছে। হারিছ আহমেদ ও তার আরো দুই ভাই আনিস আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন ওই তালিকায়। এর মধ্যে হারিছ ও জোসেফ দুটি করে এবং আনিস একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় ২০১৮ সালের ২৭ মে জোসেফ মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই দেশের বাইরে চলে যান। হারিছ ও আনিস পুলিশ রেকর্ডে দীর্ঘদিন পলাতক। তাদের দুজনের দণ্ড মওকুফ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতি থাকাকালে কুখ্যাত সব য্দ্ধুাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড হয়েছে। তাদের অনেকেই প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাদের কোন সুযোগ দেননি। এর জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করার পরই তিনজন হত্যা মামলার আসামিকে মুক্ত জীবনযাপন করার সুযোগ করে দিলেন তিনি। এদের মধ্যে দু’জনই ছিলেন বিদেশে পলাতক!

২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন জিল্লুর রহমান। বছর ঘোরার আগেই তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবরকে ক্ষমা করে কারামুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। দুদক ও এনবিআরের চারটি মামলায় ১৮ বছর দণ্ড ও ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত পলাতক শাহাদাবকে। এই দণ্ড মওকুফ করা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হলেও পরবর্তীকালে সাংবিধানিক এ ক্ষমতা ব্যবহারে রাষ্ট্রপতিরা বিশেষ যত্নশীল হয়েছিলেন- এমনটি বলা যাবে না। আরেকটি বছর যেতে না যেতেই ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যুদণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত ২০ জনকে ‘গণক্ষমা’ ক্ষমা করে দেন রাষ্ট্রপতি। যুবদল নেতা সাব্বির আহমেদ গামা হত্যা মামলায় ওই সাজাপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।

ক্ষমার নজির হিসেবে সেটি শেষ ঘটনা ছিল না। বছর ঘুরে আসার আগেই লক্ষ্মীপুরের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা ‘কিলার’ খ্যাত পুত্র বিপ্লবের সাজা হ্রাস করেন। ফেনীর আলোচিত অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যাসহ অন্য একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির দিন গুনছিল বিপ্লব। ফাঁসি এড়াতে আইনি কাঠামোর ভেতরে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছিল বিপ্লবের পরিবার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ রায়ে বলেছিলেন- ‘সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে বিপ্লব হত্যাকারী, তাই তার সাজা হ্রাস করার কোন প্রশ্ন নাই।’ আদালতে ব্যর্থ হলে কী হবে অপরাধী ছেলেকে রক্ষা করতে রাজনৈতিক পরিচয়ের ফলাফল মিলে যায় হাতেনাতে। মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে দুটি হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপতি দুইবার করে সাজা হ্রাস করে মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড করা হয়।

অপরাধীদের সাজা মাফে পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদও কম যাননি। দুই দশক আগে একটি জোড়া খুনের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মহিউদ্দিন ঝিন্টুকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন ২০০৫ সালে ক্ষমা করে দেন। ঝিন্টু ক্ষমা পাওয়ার আগে ওই মামলারই এক আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। ঝিন্টু ক্ষমা নিয়ে সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল সংসদে ও বাইরে সমালোচনায় ছিল মুখর। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপির দেখানো পথেই হাঁটতে শুরু করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই খুন ও দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় একের পর এক কারাগার থেকে বেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন নীরব দর্শক। প্রসঙ্গত এর আগে আওয়ামী নেতা ময়েজউদ্দিন হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আজম খানকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন এরশাদ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কুখ্যাত ‘সেভেন মার্ডার’ এর প্রধান আসামি শফিউল আলম প্রধানকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া মাত্র দুটি কাজ করতে পারেন। এর একটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। ফলে অপরাধীদের সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে তিনি সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। যদিও সংবিধানের ৪৯নং অনুচ্ছেদে ‘এরকম কোন পরামর্শ’র বিধান উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং রাষ্ট্রপতি চাইলেই সাজা মওকুফের সুপারিশ ফেরত পাঠাতে পারেন এবং একটি নৈতিক অবস্থান তৈরিও করতে পারেন। আমরা ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে মনে করতে পারি। তিনি ‘জননিরাপত্তা আইন’ নামে একটি বিতর্কিত আইনে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এ কারণে তৎকালীন সরকারের সাথে তার তিক্ততা সৃষ্টি হলেও মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমান বা নিকট অতীতের কোন রাষ্ট্রপতি সাজাপ্রাপ্ত একজন খুনিকে ক্ষমা না করে তার অবস্থানের নৈতিক দৃঢ়তা এবং মর্যাদা স্থাপনের নজির দেখালে সেটি অনুকরণীয় হতে পারত।

বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে ২১ জনেরও বেশি বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্ত জীবনযাপন করছেন। রাষ্ট্রপতির এই এখতিয়ার কীভাবে প্রয়োগ করা হয়, আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কতটা কাজ করছে, এ নিয়ে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন এন্তার। সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক পত্রিকান্তরে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতা প্রয়োগের কারণ যেহেতু ব্যাখ্যা করা হয় না, সেখানে অস্বচ্ছতার কারণে জনমনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। বছর কয়েক আগে এরকম একটি ইস্যু নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল- সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত। এ বিষয়ক একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশও ছিল সেই রায়ে। বলাই বাহুল্য, তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের মতে, সাধারণ জনগণের মধ্যে নানান প্রশ্ন তৈরি করে যে, কেন ক্ষমা করা হলো? কার প্রভাবে ক্ষমা করা হলো? কোন স্বার্থে ক্ষমা করা হলো ইত্যাদি ইত্যাদি! এই প্রশ্নগুলো আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের জন্য খুব একটা সুখকর ব্যাপার নয়। তবে সব সরকারের আমলে এক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য কমন- স্বচ্ছতা এবং সংবিধান অনুযায়ী সাজা মওকুফের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে।

দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান ‘দায়মুক্তি’ প্রদান করেছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রদেয় ক্ষমতাবলে তিনি যে কোন আসামির দণ্ড মওকুফ করে দিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার অধিকার কোনো সাধারণ অধিকার নয়। আমাদের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ ধারণ করে আছে, ইংলিশ কমন ল-এর ‘রয়্যাল প্রিরোগেটিভ’ (Royal Prerogative) বাংলায় যাকে বলা হচ্ছে- ‘রাজকীয় বিশেষ অধিকার’। সংবিধানে ‘বিশেষ অধিকার’ হিসেবে এটি লেখা হলেও এটি ইংরেজি অর্থেই ‘প্রিরোগেটিভ’।

এর কি কোন প্রতিকার নেই! একজন প্রাক্তন জেলা ও দায়রা জজ এ প্রসঙ্গে বলেন, গত পঞ্চাশ বছরে রাষ্ট্রপতির এ অধিকারের আওতায় যত খুনি-সন্ত্রাসী ক্ষমা পেয়ে গেছে, তাদের একটি তালিকা জনগণের সামনে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে প্রকাশ করা দরকার। জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে উত্থাপন করে আলোচনা করা যেতে পারে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি নজির স্থাপন করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়কালে যে সব দণ্ড ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল- হরিয়ানার স্বরাষ্ট্র সচিবকে সেগুলো হলফনামা দিয়ে প্রকাশ করতে হয়েছিল। বাংলাদেশেও এরকম উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে আইনজ্ঞরা মনে করছেন। কারণ সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন বলে আইনজ্ঞরা মনে করছেন।

মৌলিক ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে, আইনের শাসনের ভিত্তিমূলকে আরো শক্তিশালী করতে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে এ অধিকার দিয়েছে। এর মর্যাদা ও যথাপ্রয়োগ রাষ্ট্রপতি ও সরকারসমূহ বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিচ্ছেন। রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গাইডলাইন বেঁধে দিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী জাতীয় সংসদ এ নজির বিবেচনায় নিতে পারেন। তারা নিশ্চয়ই পারেন এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করতে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সেটি হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্মী]