আলী আহমদ চুনকা : সাধারণ মানুষের নেতা

সালাম জুবায়ের

আমরা সাধারণভাবে বলি, একজন রাজনীতিবিদ, তিনি যে দেশ বা যে সমাজেরই হন না কেন, যদি তার প্রাত্যহিক জনবান্ধব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান, মানুষের দুঃসময়ে কল্যাণের লক্ষ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তবে সেই রাজনীতিবিদ তার এলাকার গণমানুষের মনে স্থান করে নিতে পারেন এবং সেই মানুষ কোন দিনই সেই রাজনীতিবিদকে ভুলে যেতে পারে না বা তাকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার আসনে বসাতে কার্পণ্য করে না। এটা ইতিহাসের সত্য। এই সত্য যুগে যুগে বারবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্ন দেশের রাজনীতি ও সামাজিক ইতিহাসে। প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে খ্যাত শীতলক্ষ্যা পাড়ের শিল্পনগরী ও নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক নেতা আলী আহমদ চুনকার ক্ষেত্রে এ প্রবাদ বাক্যটি সর্বাংশে সত্য।

আলী আহমদ চুনকাকে নিয়ে এসব কথা, এসব অনুভব শুধু আমার নয়, নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি মানুষের- স্বাধীনতা পূর্ব প্রজন্ম, বিশেষ করে পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের প্রজন্ম থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর পরবর্তী প্রজন্ম- সবার মনেই আলোড়ন তোলে। নারায়ণগঞ্জে সেই ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন- ছয় দফার আন্দোলন থেকে ’৬৯ গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন দেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন- প্রতিটি ক্ষেত্রে আলী আহমদ চুনকা ছিলেন নেতৃত্বের প্রতিভূ, প্রাণপুরুষ। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি একদিকে আদর্শবাদী রাজনীতি, অন্যদিকে সামাজিক জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি একজন জনহিতৈষী মানুষ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের ‘কাছের মানুষ’ হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সক্ষমতা সব নেতা বা সমাজকর্মীর জীবনে পাওয়া হয়ে ওঠে না। আলী আহমদ চুনকা পেয়েছিলেন। সে জন্য তিনি শিল্প শহর নারায়ণগঞ্জেই শুধু নয়, সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘নারায়ণগঞ্জের চুনকা’ হিসেবে।

আলী আহমদ চুনকা জীবদ্দশায় নীতি-আদর্শের রাজনীতির একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। কি রাজনীতি, কি সামাজিক কর্মকাণ্ড- সবখানেই আলী আহমদ চুনকা আপোষহীন একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে এবং অন্যদের কাছেও পরিচিত হতে পছন্দ করতেন। এজন্য নারায়ণগঞ্জের সব বয়স এবং শ্রেণী-পেশার মানুষ তাকে কি রাজনীতি কি সামাজিক কর্মকাণ্ড- সব স্তরেই তাকে সত্যনিষ্ঠ এবং আপোষহীন ব্যক্তিত্য হিসেবেই বিবেচনা করতেন। তিনি অশীতিপর প্রবীণের কাছে যেমন তেমনি তার সন্তানতুল্য নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছেও ছিলেন ‘আমাদের চুনকা ভাই’। এই সম্মান তাকে অর্জন করতে হয়েছে সবার জন্যই- বয়সের পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে, নিরলস এবং নিঃস্বার্থভাবে কাজের মধ্যে ডুবে থেকে। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জে তিনি ছিলেন প্রায় প্রবাদ পুরুষের মতো। আর এসব গুণাবলী অর্জনের মধ্যদিয়ে নারায়ণগঞ্জের তিন প্রজন্মের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘আপন মানুষ’। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে- সব শ্রেণী-পেশার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ, সবাই ভালোবাসতেন তাকে, একদিকে রাজনীতি সচেতন মানুষ, অন্যদিকে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। তিনি নারায়ণগঞ্জকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষ এর চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন তাকে। এই আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জের মাটি ও মানুষের সঙ্গে আলী আহমদ চুনকার যে আন্তরিক ও সজ্জন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা-ই তাকে নারায়ণগঞ্জের অবিসংবাদিত রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে জাতীয়ভাবে গৌরবান্বিত করেছে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংগ্রামশীল সাধারণ মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বিজাতীয় পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিতারিত করে নিজের জন্মভূমিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই মহাসংগ্রামে নারায়ণগঞ্জের আদর্শবাদী রাজনীতিক হিসেবে আলী আহমদ চুনকা অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একাধারে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতের ত্রিপুরায় বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং স্মরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে তিনি নারায়ণগঞ্জের যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আগরতলা গিয়েছেন তাদের খোঁজখবর নিতেন। তারা কীভাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেবেন তার ব্যবস্থা করে দিতেন। তাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় গ্রুপ সংগঠিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও চুনকা সবাইকে যুদ্ধের মাঠে ফেলে নিজে বাড়ি ফিরে যাননি। যুদ্ধের অস্ত্র নিয়ে এলাকায় ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা কে কীভাবে কোথায় আছেন তার খোঁজখবর নিতে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছেন।

আলী আহমদ চুনকা দুইবার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হয়েছেন। দ্বিতীয়বার ১৯৭৮ সালে তিনি তখনকার ডাকসাইটে দুই নেতাকে হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। সেই সময়ে সামরিক সরকারবিরোধী ভূমিকার জন্য তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। সেই জনপ্রিয়তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেননি। সে সময় তিনি নারায়ণগঞ্জের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তার সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। সেই সময়ে তিনি সংসদ নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু সরকারের দলের লোকেরা প্রশাসনের সঙ্গে কারসাজি করে তাকে হারিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ’৭৫ পরবর্তী দুই দশক ছিল অত্যন্ত সংকটকাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর যে অপ্রত্যাশিত গভীর রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকট তৈরি হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সে সংকট নিরসনের জন্য যারা ঢাকা এবং বিভিন্ন জেলা শহরে সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালনে করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন আলী আহমদ চুনকা। তিনি সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু এবং জেলা-জুলুমের ভয় উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে দিনরাত কাজ করেছেন। এজন্য তাকে সরকারের নজরদারির মধ্যে এবং গৃহবন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছে। ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হলে তিনি বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাহস জুগিয়েছেন। তার জ্যেষ্ঠ সন্তান ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং ছেলেরা এখন সন্ত্রাস এবং ক্ষমতালোভী সুবিধাবাদী রাজনীতির বৈরী পরিবেশে আদর্শবাদী রাজনীতির নীতি ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন। সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধ স্র্রোতে দাঁড়িয়ে পিতার আপোষহীন নীতি গ্রহণ ধারণ করে এখন নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে পিতা আলী আহমদ চুনকার আদর্শ বাঁচিয়ে রেখেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অভিমত: বহুমুখী গুণে গুণান্বিত সেলিনা হায়াৎ আইভীর মধ্যে পিতা জননেতা চুনকার অনেক গুণাবলী ফুটে উঠেছে।

নারায়ণগঞ্জের শ্রেণী-পেশা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব আলী আহমদ চুনকার মৃত্যুবার্ষিকী ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিনে নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাকে স্মরণ করে একজন ভিন্নমাত্রার রাজনীতিক এবং সমাজহিতৈষী আদর্শবাদী মানুষ হিসেবে। তার স্মৃতি এখনও নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে সজীব হয়ে আছে। আগামী দিনগুলোতেও মানুষ তাকে ভুলবে না- এটাই একজন নেতা হিসেবে আলী আহমদ চুনকার জীবনের সাফল্য। এ সাফল্য আগামী প্রজন্মের মানুষকে দেশপ্রেমে এবং আদর্শবাদী সৃজনশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে অনুপ্রাণিত করবে- ‘আমাদের চুনকা ভাইয়ের’ মৃত্যুবার্ষিকীতে এই প্রত্যাশা সবার।

[ লেখক : সাংবাদিক ]

বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১২ ফাল্গুন ১৪২৭ ১২ রজব ১৪৪২

আলী আহমদ চুনকা : সাধারণ মানুষের নেতা

সালাম জুবায়ের

আমরা সাধারণভাবে বলি, একজন রাজনীতিবিদ, তিনি যে দেশ বা যে সমাজেরই হন না কেন, যদি তার প্রাত্যহিক জনবান্ধব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান, মানুষের দুঃসময়ে কল্যাণের লক্ষ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তবে সেই রাজনীতিবিদ তার এলাকার গণমানুষের মনে স্থান করে নিতে পারেন এবং সেই মানুষ কোন দিনই সেই রাজনীতিবিদকে ভুলে যেতে পারে না বা তাকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার আসনে বসাতে কার্পণ্য করে না। এটা ইতিহাসের সত্য। এই সত্য যুগে যুগে বারবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্ন দেশের রাজনীতি ও সামাজিক ইতিহাসে। প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে খ্যাত শীতলক্ষ্যা পাড়ের শিল্পনগরী ও নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক নেতা আলী আহমদ চুনকার ক্ষেত্রে এ প্রবাদ বাক্যটি সর্বাংশে সত্য।

আলী আহমদ চুনকাকে নিয়ে এসব কথা, এসব অনুভব শুধু আমার নয়, নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি মানুষের- স্বাধীনতা পূর্ব প্রজন্ম, বিশেষ করে পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের প্রজন্ম থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর পরবর্তী প্রজন্ম- সবার মনেই আলোড়ন তোলে। নারায়ণগঞ্জে সেই ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন- ছয় দফার আন্দোলন থেকে ’৬৯ গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন দেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন- প্রতিটি ক্ষেত্রে আলী আহমদ চুনকা ছিলেন নেতৃত্বের প্রতিভূ, প্রাণপুরুষ। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি একদিকে আদর্শবাদী রাজনীতি, অন্যদিকে সামাজিক জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি একজন জনহিতৈষী মানুষ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের ‘কাছের মানুষ’ হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সক্ষমতা সব নেতা বা সমাজকর্মীর জীবনে পাওয়া হয়ে ওঠে না। আলী আহমদ চুনকা পেয়েছিলেন। সে জন্য তিনি শিল্প শহর নারায়ণগঞ্জেই শুধু নয়, সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘নারায়ণগঞ্জের চুনকা’ হিসেবে।

আলী আহমদ চুনকা জীবদ্দশায় নীতি-আদর্শের রাজনীতির একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। কি রাজনীতি, কি সামাজিক কর্মকাণ্ড- সবখানেই আলী আহমদ চুনকা আপোষহীন একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে এবং অন্যদের কাছেও পরিচিত হতে পছন্দ করতেন। এজন্য নারায়ণগঞ্জের সব বয়স এবং শ্রেণী-পেশার মানুষ তাকে কি রাজনীতি কি সামাজিক কর্মকাণ্ড- সব স্তরেই তাকে সত্যনিষ্ঠ এবং আপোষহীন ব্যক্তিত্য হিসেবেই বিবেচনা করতেন। তিনি অশীতিপর প্রবীণের কাছে যেমন তেমনি তার সন্তানতুল্য নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছেও ছিলেন ‘আমাদের চুনকা ভাই’। এই সম্মান তাকে অর্জন করতে হয়েছে সবার জন্যই- বয়সের পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে, নিরলস এবং নিঃস্বার্থভাবে কাজের মধ্যে ডুবে থেকে। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জে তিনি ছিলেন প্রায় প্রবাদ পুরুষের মতো। আর এসব গুণাবলী অর্জনের মধ্যদিয়ে নারায়ণগঞ্জের তিন প্রজন্মের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘আপন মানুষ’। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে- সব শ্রেণী-পেশার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ, সবাই ভালোবাসতেন তাকে, একদিকে রাজনীতি সচেতন মানুষ, অন্যদিকে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। তিনি নারায়ণগঞ্জকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষ এর চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন তাকে। এই আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জের মাটি ও মানুষের সঙ্গে আলী আহমদ চুনকার যে আন্তরিক ও সজ্জন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা-ই তাকে নারায়ণগঞ্জের অবিসংবাদিত রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে জাতীয়ভাবে গৌরবান্বিত করেছে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংগ্রামশীল সাধারণ মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বিজাতীয় পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিতারিত করে নিজের জন্মভূমিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই মহাসংগ্রামে নারায়ণগঞ্জের আদর্শবাদী রাজনীতিক হিসেবে আলী আহমদ চুনকা অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একাধারে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতের ত্রিপুরায় বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং স্মরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে তিনি নারায়ণগঞ্জের যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আগরতলা গিয়েছেন তাদের খোঁজখবর নিতেন। তারা কীভাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেবেন তার ব্যবস্থা করে দিতেন। তাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় গ্রুপ সংগঠিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও চুনকা সবাইকে যুদ্ধের মাঠে ফেলে নিজে বাড়ি ফিরে যাননি। যুদ্ধের অস্ত্র নিয়ে এলাকায় ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা কে কীভাবে কোথায় আছেন তার খোঁজখবর নিতে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছেন।

আলী আহমদ চুনকা দুইবার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হয়েছেন। দ্বিতীয়বার ১৯৭৮ সালে তিনি তখনকার ডাকসাইটে দুই নেতাকে হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। সেই সময়ে সামরিক সরকারবিরোধী ভূমিকার জন্য তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। সেই জনপ্রিয়তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেননি। সে সময় তিনি নারায়ণগঞ্জের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তার সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। সেই সময়ে তিনি সংসদ নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু সরকারের দলের লোকেরা প্রশাসনের সঙ্গে কারসাজি করে তাকে হারিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ’৭৫ পরবর্তী দুই দশক ছিল অত্যন্ত সংকটকাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর যে অপ্রত্যাশিত গভীর রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকট তৈরি হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সে সংকট নিরসনের জন্য যারা ঢাকা এবং বিভিন্ন জেলা শহরে সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালনে করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন আলী আহমদ চুনকা। তিনি সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু এবং জেলা-জুলুমের ভয় উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে দিনরাত কাজ করেছেন। এজন্য তাকে সরকারের নজরদারির মধ্যে এবং গৃহবন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছে। ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হলে তিনি বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাহস জুগিয়েছেন। তার জ্যেষ্ঠ সন্তান ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং ছেলেরা এখন সন্ত্রাস এবং ক্ষমতালোভী সুবিধাবাদী রাজনীতির বৈরী পরিবেশে আদর্শবাদী রাজনীতির নীতি ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন। সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধ স্র্রোতে দাঁড়িয়ে পিতার আপোষহীন নীতি গ্রহণ ধারণ করে এখন নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে পিতা আলী আহমদ চুনকার আদর্শ বাঁচিয়ে রেখেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অভিমত: বহুমুখী গুণে গুণান্বিত সেলিনা হায়াৎ আইভীর মধ্যে পিতা জননেতা চুনকার অনেক গুণাবলী ফুটে উঠেছে।

নারায়ণগঞ্জের শ্রেণী-পেশা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব আলী আহমদ চুনকার মৃত্যুবার্ষিকী ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিনে নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাকে স্মরণ করে একজন ভিন্নমাত্রার রাজনীতিক এবং সমাজহিতৈষী আদর্শবাদী মানুষ হিসেবে। তার স্মৃতি এখনও নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে সজীব হয়ে আছে। আগামী দিনগুলোতেও মানুষ তাকে ভুলবে না- এটাই একজন নেতা হিসেবে আলী আহমদ চুনকার জীবনের সাফল্য। এ সাফল্য আগামী প্রজন্মের মানুষকে দেশপ্রেমে এবং আদর্শবাদী সৃজনশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে অনুপ্রাণিত করবে- ‘আমাদের চুনকা ভাইয়ের’ মৃত্যুবার্ষিকীতে এই প্রত্যাশা সবার।

[ লেখক : সাংবাদিক ]