আহমদ শরীফ : প্রেরণার উৎস

সাইফুজ্জামান

আহমদ শরীফ বিরলপ্রজ লেখক। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল তার ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার সাহিত্যে পাণ্ডিত্য, মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের প্রতিফলন ঘটেছে। যুক্তিবাদী দর্শন, রাজনীতি ও গভীর জীবনবোধ আশ্রিত তার রচনায় মুক্তপথের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ গবেষণায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। মধ্যযুগ সাহিত্যের বিশাল ভুবনে যে বিচিত্রতা ও গভীরতা রয়েছে তা ড. আহমদ শরীফ উনিশ শতকের বাঙালি শিতি সমাজের দৃষ্টিগোচর করেন। প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ থেকে তিনি তার গবেষণার রসদ সংগ্রহ করেছেন।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে আহমদ শরীফ দাঁড়িয়েছেন। ধর্মবুদ্ধির গোড়ার কথা সমাজে দর্শন শাস্ত্রের প্রভাব ও স্বরূপ প্রবন্ধে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আহমদ শরীফ সাহসী ও দৃঢ় চেতা।

আহমদ শরীফ উদার মানবতাবাদ, বিশ্বাস ও কর্মে মুক্তির পথকে মানবমুক্তির অবলম্বন হিসেবে প্রচার করেন। আহমদ শরীফের গবেষণার ত্রে বিস্তৃত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও অমূল্য সম্পদকে বিদ্বৎসমাজে পরিচিত করার প্রচেষ্টার তিনি পথিকৃৎ। মানুষের বিশ্বাস, জীবনযাপন ও করণীয় তিনি নিরন্তর ভেবেছেন। বাঙালি শেকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু অর্থের প্রয়োজনে বিদেশ ছুটছে-তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। আহমদ শরীফ তার দিনলিপি ভাবের বুদবুদে অকপটে তার বিশ্বাস, সমাজ অভ্যন্তরের রণ মুখ ও মুখোশের দ্বন্দ্ব ও আড়াল চিত্র বন্দি করেছেন।

ড. আহমদ শরীফ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক। মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী হিসেবেও তার পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। তিনি সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করেননি। সমাজের ডামাডোলের মধ্যে বাস করেও তিনি উদার, নির্লোভ ও অধ্যবসায়ী বিবেকী কণ্ঠস্বর হিসেবে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন। আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। ঊনসত্তর ও সত্তরের বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনা সংগঠনের তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত এক সভায় ড. আহমদ শরীফ ভবিষ্যতের বাঙালি শীর্ষক এক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের আহমদ শরীফ দ্রোহ ও প্রতিবাদকে জীবনচেতনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগরের উত্তরাধিকারের অহঙ্কার তার চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত করে তাকে প্রতিবাদী দরিদ্র নিঃস্ব মানুষের পক্ষে কাজ করার শক্তি জুগিয়েছিল নিঃসন্দেহে। আশির দশকে ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র-মূল্যায়ন’ রচনায় নতুন ভাবনার উৎস সঞ্চার করেন।

আশি ও নব্বই দশকে মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ভাবনা দৈনিক ও সাময়িক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আহমদ শরীফের গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃৃত। সমাজ ও সমকালের বহুমুখী সংকট, সম্ভাবনা ও মুক্তির বিচিত্র উপাদান তার গবেষণায় আত্মীকৃত হয়েছে। সাধারণ মানুষ, সংগ্রামী উপাখ্যান ও বাস্তবতার নিরিখে মানুষের কর্মমুখর সৃজনী অংশগ্রহণকে তিনি উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন। তিনি ছিলেন অটল, হিমালয়ের মতো। আহমদ শরীফ তাই আজও নতুন প্রজন্মের কাছে এক প্রেরণার উৎস। বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব তার ভাবনার প্রধান অংশ ছিল। বক্তব্যের দৃঢ়তা তাকে যুক্তিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার ভেতরকার সম্পর্কে তিনি উপস্থাপন করেছেন। তিনি প্রগতির সারথি ছিলেন। অবস্থান, বক্তব্য ও জীবনযাপনে দ্বৈততা তার ছিল না। দেশাত্মবোধ, ঐতিহ্যপ্রীতি আর সত্য উচ্চারণে আহমদ শরীফ ছিলেন অদ্বিতীয়।

বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১২ ফাল্গুন ১৪২৭ ১২ রজব ১৪৪২

আহমদ শরীফ : প্রেরণার উৎস

সাইফুজ্জামান

আহমদ শরীফ বিরলপ্রজ লেখক। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল তার ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার সাহিত্যে পাণ্ডিত্য, মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের প্রতিফলন ঘটেছে। যুক্তিবাদী দর্শন, রাজনীতি ও গভীর জীবনবোধ আশ্রিত তার রচনায় মুক্তপথের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ গবেষণায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। মধ্যযুগ সাহিত্যের বিশাল ভুবনে যে বিচিত্রতা ও গভীরতা রয়েছে তা ড. আহমদ শরীফ উনিশ শতকের বাঙালি শিতি সমাজের দৃষ্টিগোচর করেন। প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ থেকে তিনি তার গবেষণার রসদ সংগ্রহ করেছেন।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে আহমদ শরীফ দাঁড়িয়েছেন। ধর্মবুদ্ধির গোড়ার কথা সমাজে দর্শন শাস্ত্রের প্রভাব ও স্বরূপ প্রবন্ধে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আহমদ শরীফ সাহসী ও দৃঢ় চেতা।

আহমদ শরীফ উদার মানবতাবাদ, বিশ্বাস ও কর্মে মুক্তির পথকে মানবমুক্তির অবলম্বন হিসেবে প্রচার করেন। আহমদ শরীফের গবেষণার ত্রে বিস্তৃত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও অমূল্য সম্পদকে বিদ্বৎসমাজে পরিচিত করার প্রচেষ্টার তিনি পথিকৃৎ। মানুষের বিশ্বাস, জীবনযাপন ও করণীয় তিনি নিরন্তর ভেবেছেন। বাঙালি শেকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু অর্থের প্রয়োজনে বিদেশ ছুটছে-তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। আহমদ শরীফ তার দিনলিপি ভাবের বুদবুদে অকপটে তার বিশ্বাস, সমাজ অভ্যন্তরের রণ মুখ ও মুখোশের দ্বন্দ্ব ও আড়াল চিত্র বন্দি করেছেন।

ড. আহমদ শরীফ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক। মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী হিসেবেও তার পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। তিনি সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করেননি। সমাজের ডামাডোলের মধ্যে বাস করেও তিনি উদার, নির্লোভ ও অধ্যবসায়ী বিবেকী কণ্ঠস্বর হিসেবে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন। আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। ঊনসত্তর ও সত্তরের বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনা সংগঠনের তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত এক সভায় ড. আহমদ শরীফ ভবিষ্যতের বাঙালি শীর্ষক এক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের আহমদ শরীফ দ্রোহ ও প্রতিবাদকে জীবনচেতনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগরের উত্তরাধিকারের অহঙ্কার তার চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত করে তাকে প্রতিবাদী দরিদ্র নিঃস্ব মানুষের পক্ষে কাজ করার শক্তি জুগিয়েছিল নিঃসন্দেহে। আশির দশকে ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র-মূল্যায়ন’ রচনায় নতুন ভাবনার উৎস সঞ্চার করেন।

আশি ও নব্বই দশকে মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ভাবনা দৈনিক ও সাময়িক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আহমদ শরীফের গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃৃত। সমাজ ও সমকালের বহুমুখী সংকট, সম্ভাবনা ও মুক্তির বিচিত্র উপাদান তার গবেষণায় আত্মীকৃত হয়েছে। সাধারণ মানুষ, সংগ্রামী উপাখ্যান ও বাস্তবতার নিরিখে মানুষের কর্মমুখর সৃজনী অংশগ্রহণকে তিনি উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন। তিনি ছিলেন অটল, হিমালয়ের মতো। আহমদ শরীফ তাই আজও নতুন প্রজন্মের কাছে এক প্রেরণার উৎস। বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব তার ভাবনার প্রধান অংশ ছিল। বক্তব্যের দৃঢ়তা তাকে যুক্তিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার ভেতরকার সম্পর্কে তিনি উপস্থাপন করেছেন। তিনি প্রগতির সারথি ছিলেন। অবস্থান, বক্তব্য ও জীবনযাপনে দ্বৈততা তার ছিল না। দেশাত্মবোধ, ঐতিহ্যপ্রীতি আর সত্য উচ্চারণে আহমদ শরীফ ছিলেন অদ্বিতীয়।