স্মৃতিতে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

মো. জয়নাল আবেদীন

কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস কেড়ে নিল দেশের অগণিত কৃতী সন্তানদের। সর্বশেষ সংযোজন দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম বিশ্লেষক, খ্যাতিমান ব্যাংকার ও শিশু সংগঠক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় ভালো হলেও করোনা-উত্তর স্বাস্থ্য জটিলতায় হেরে যান। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকতা জগতের উজ্জ্বল তারকা সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যু সংবাদ আমাকে মানসিকভাবে কাবু করে ফেলে। ওই দিন একটি পত্রিকায় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের স্বাস্থ্য বিষয়ক রিপোর্ট পড়ে আমার মনে আশঙ্কা জাগে যে, হয়তো তিনিও চলে যাবেন। বুধবার সকালে তাই হলো।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে দেখার আগেই তার নামের সাথে পরিচিতি লাভ হয় তার লেখা পড়ে। তিনি দৈনিক সংবাদ ও সাপ্তাহিক একতায় নিয়মিত লিখতেন। ছাত্রজীবন থেকেই আমি ছিলাম এ পত্রিকা দুটির পাঠক। ১৯৭৭ সালে ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত হয়ে তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে। তিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের প্রশিক্ষণালয়ের কাণ্ডারি। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষার আগে তার চেষ্টায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রশিক্ষণালয়ে বিশেষ কোচিং হতো। একবার সেখানে গিয়ে দেখি তিনি ক্লাস নিচ্ছেন। খুবই রাশভারি ও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি।

এটিএম শামসুল হুদার পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগ দেন। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তখন আতাউদ্দিন খান। চেয়ারম্যান সাহেব এটিএম শামসুল হুদার বিদায় ও খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের আগমন উপলক্ষে ঢাকা ক্লাবে নৈশভোজের আয়োজন করেন। প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম পর্যন্ত আমন্ত্রণ দেওয়ায় আমিও নৈশভোজে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। খাওয়া-দাওয়ার এক ফাঁকে আমি সাবেক এমডি সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলি যে, তার নির্দেশমতে চট্টগ্রামের টি-বোর্ড শাখার বিশাল জালিয়াতির বিভাগীয় মামলার তদন্ত টিমের সদস্যরা এখনো দুটি স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট পায়নি। এটিএম শামসুল হুদা সাথে সাথেই খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে আমাদের বিষয়টি

কার্যকর করার জন্য বলেন। এ নিয়ে আমি ও কেএম আসাদুজ্জামান একাধিকবার নোট লিখে এমডি সাহেবকে দিলে তিনি স্বাক্ষর করে সংশ্লিষ্ট বিভাগে নোট পাঠাতেন। কিন্তু কৃষি ব্যাংকে কর্মরত ক্ষুদ্র ধ্যান-ধারণার একটি চক্রের কারণে আমরা তা কার্যকর করতে পারিনি।

তার সময়ে আমরা কৃষি ব্যাংকে অফিসার কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। তঁর পরামর্শে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে আনা হয় স্বাধীন বাংলা বেতারের চরমপত্রখ্যাত এমআর আখতার মুকুলকে।

কৃষি ব্যাংকের পরে তিনি অগ্রণী ব্যাংকের এডির দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে যান সোনালী ব্যাংকে। এক শিল্পপতির অযৌক্তিক আবদার তিনি না রাখায় অসময়ে তাকে বদলি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর করা হয়। সেই শিল্পপতি বিএনপিতে যোগ দেওয়ার পরে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা হলে ইব্রাহিম খালেদ তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যার কথায় আমাকে অসময়ে সোনালী ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে বদলি করেছিলেন তিনি কি আপনার দলে যোগ দিয়েছিলেন?’ এ কথা পরবর্তীকালে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে তার থেকে জেনেছি। খুবই সাহসী ও নীতিবান মানুষ ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ১৯৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ পানির দামে দেশের উঠতি পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করলে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রতিবাদ করে পত্রিকায় তার যুক্তি তুলে ধরে নিবন্ধ লিখেন। এজন্য তিনি স্বৈরশাসকের রোষানলের শিকার হয়ে ব্যাংকিং খাতের বাহিরে বদলি হন।

অবসর নিয়ে তিনি পূবালী ব্যাংকের এমডি হন। নিয়োগের শর্ত ছিল ব্যাংকের চেয়ারম্যন ও পরিচালকরা তার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। শর্ত মেনে নিলে তিনি যোগদান করেন। পূবালী ব্যাংকের আর্থিক দুর্বল স্বাস্থ্য তার সুযোগ্য নেতৃত্বে সবল হয়। পূবালী ব্যাংকের পর তিনি দুইবার কৃষি ব্যাংকের পর্ষদ চেয়ারম্যান হন। এ সময়ে আমি জনতা ও রূপালী ব্যাংকে কাজ করে কৃষি ব্যাংকে ফিরে আসি। বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে লক্ষ্য করেছি তিনি কোনো তদবির পাত্তা দিতেন না। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে কখনও হস্তক্ষেপ করতেন না। এক মন্ত্রীর স্ত্রী প্রকল্প ঋণের জন্য তাকে বাসায় ফোন করলে তিনি ভবিষ্যতে তাকে ফোন না করতে বলে দেন। দ্বিতীয় দিন ফোন করলে তিনি অর্থমন্ত্রীকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান।

ব্যাংকিং খাতে আমলাতন্ত্রের খবরদারির ঘোরবিরোধী ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করবে ব্যাংক- অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ বিলুপ্ত করার যুক্তি তার মতো করে জোরে আর কে বলবে? তিনি ছিলেন দেশের আর্থিক খাতের শ্রেষ্ঠ বিশ্লেষক।

শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারির জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। কৃষি ব্যাংকের বোর্ড রুমে বসেই কমিটির সভা করতেন। শেয়ারবাজারে লুটপাটকারীদের নাম-পরিচয় তুলে ধরে তিনি তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন এবং সুনির্দিষ্ট পরামর্শ প্রদান করেছিলেন। ব্যাংকিং খাতের লুটপাট ও লুটেরা শ্রেণীকর্তৃক টাকা বিদেশে পাচারকারীদের কঠোরভাবে শায়েস্তা করার জন্য টিভির টকশোতে তার কণ্ঠ ছিল সোচ্চার।

নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি কচিকাঁচার আসরের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘকাল। আমি অবসরে গিয়ে কচিকাঁচার আসরে কাজ করতে চাই জানালে তিনি খুশি হয়ে বলেছিলেন- ‘এ যুগে তো কেউ এ ধরনের কাজে আগ্রহ দেখায় না। কচিকাঁচার অফিসে এসো, তোমাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে নিব।’ কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে একটি বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালক করায় আমি আর কচিকাঁচার জন্য সময় করতে পারিনি; যা ভেবে নিজেকে অপরাধী মনে হয়।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মননশীল কাজের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্তের জন্য বিজ্ঞাপনের আবেদন তাকে দিলে তিনি সাথে সাথে এক বছরের চারটি সংখ্যার জন্য বিজ্ঞাপন দিতে নির্দেশ দেন।

তার সাথে ব্যাংকের বাহিরের জগতেও আমার রয়েছে শত শত স্মৃতি। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সেমিনারে-সম্মেলনে কতবার কতভাবে তার সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, মতবিনিময় হয়েছে। দৈনিক পত্রিকায় তার লেখা পড়ে কোন বিষয় বুঝতে না পারলে আমি ফোন করে জানতে চাইতাম। তিনি খুশি হয়ে বুঝিয়ে দিতেন।

একবার তাকে কৃষি ব্যাংকের এক ফাঁকিবাজ জিএমের ওপর ভীষণ ক্ষেপে যেতে দেখেছিলাম। তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক কিন্তু তা কখনও জাহির করতেন না। মনেপ্রাণে তিনি খাঁটি বাঙালি ছিলেন। ধারণ করতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের প্রতি ছিল অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা।

মৃত্যু তাকে কেড়ে নিলেও তিনি আমাদের চেতনা ও মননে অমর হয়ে থাকবেন তার কর্মগুণের মাধ্যমে। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।

[লেখক : ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী (অব.),

পরিচালক, আইবিবিএল]

শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ১৩ রজব ১৪৪২

স্মৃতিতে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

মো. জয়নাল আবেদীন

কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস কেড়ে নিল দেশের অগণিত কৃতী সন্তানদের। সর্বশেষ সংযোজন দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম বিশ্লেষক, খ্যাতিমান ব্যাংকার ও শিশু সংগঠক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় ভালো হলেও করোনা-উত্তর স্বাস্থ্য জটিলতায় হেরে যান। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকতা জগতের উজ্জ্বল তারকা সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যু সংবাদ আমাকে মানসিকভাবে কাবু করে ফেলে। ওই দিন একটি পত্রিকায় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের স্বাস্থ্য বিষয়ক রিপোর্ট পড়ে আমার মনে আশঙ্কা জাগে যে, হয়তো তিনিও চলে যাবেন। বুধবার সকালে তাই হলো।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে দেখার আগেই তার নামের সাথে পরিচিতি লাভ হয় তার লেখা পড়ে। তিনি দৈনিক সংবাদ ও সাপ্তাহিক একতায় নিয়মিত লিখতেন। ছাত্রজীবন থেকেই আমি ছিলাম এ পত্রিকা দুটির পাঠক। ১৯৭৭ সালে ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত হয়ে তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে। তিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের প্রশিক্ষণালয়ের কাণ্ডারি। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষার আগে তার চেষ্টায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রশিক্ষণালয়ে বিশেষ কোচিং হতো। একবার সেখানে গিয়ে দেখি তিনি ক্লাস নিচ্ছেন। খুবই রাশভারি ও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি।

এটিএম শামসুল হুদার পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগ দেন। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তখন আতাউদ্দিন খান। চেয়ারম্যান সাহেব এটিএম শামসুল হুদার বিদায় ও খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের আগমন উপলক্ষে ঢাকা ক্লাবে নৈশভোজের আয়োজন করেন। প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম পর্যন্ত আমন্ত্রণ দেওয়ায় আমিও নৈশভোজে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। খাওয়া-দাওয়ার এক ফাঁকে আমি সাবেক এমডি সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলি যে, তার নির্দেশমতে চট্টগ্রামের টি-বোর্ড শাখার বিশাল জালিয়াতির বিভাগীয় মামলার তদন্ত টিমের সদস্যরা এখনো দুটি স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট পায়নি। এটিএম শামসুল হুদা সাথে সাথেই খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে আমাদের বিষয়টি

কার্যকর করার জন্য বলেন। এ নিয়ে আমি ও কেএম আসাদুজ্জামান একাধিকবার নোট লিখে এমডি সাহেবকে দিলে তিনি স্বাক্ষর করে সংশ্লিষ্ট বিভাগে নোট পাঠাতেন। কিন্তু কৃষি ব্যাংকে কর্মরত ক্ষুদ্র ধ্যান-ধারণার একটি চক্রের কারণে আমরা তা কার্যকর করতে পারিনি।

তার সময়ে আমরা কৃষি ব্যাংকে অফিসার কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। তঁর পরামর্শে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে আনা হয় স্বাধীন বাংলা বেতারের চরমপত্রখ্যাত এমআর আখতার মুকুলকে।

কৃষি ব্যাংকের পরে তিনি অগ্রণী ব্যাংকের এডির দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে যান সোনালী ব্যাংকে। এক শিল্পপতির অযৌক্তিক আবদার তিনি না রাখায় অসময়ে তাকে বদলি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর করা হয়। সেই শিল্পপতি বিএনপিতে যোগ দেওয়ার পরে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা হলে ইব্রাহিম খালেদ তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যার কথায় আমাকে অসময়ে সোনালী ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে বদলি করেছিলেন তিনি কি আপনার দলে যোগ দিয়েছিলেন?’ এ কথা পরবর্তীকালে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে তার থেকে জেনেছি। খুবই সাহসী ও নীতিবান মানুষ ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ১৯৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ পানির দামে দেশের উঠতি পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করলে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রতিবাদ করে পত্রিকায় তার যুক্তি তুলে ধরে নিবন্ধ লিখেন। এজন্য তিনি স্বৈরশাসকের রোষানলের শিকার হয়ে ব্যাংকিং খাতের বাহিরে বদলি হন।

অবসর নিয়ে তিনি পূবালী ব্যাংকের এমডি হন। নিয়োগের শর্ত ছিল ব্যাংকের চেয়ারম্যন ও পরিচালকরা তার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। শর্ত মেনে নিলে তিনি যোগদান করেন। পূবালী ব্যাংকের আর্থিক দুর্বল স্বাস্থ্য তার সুযোগ্য নেতৃত্বে সবল হয়। পূবালী ব্যাংকের পর তিনি দুইবার কৃষি ব্যাংকের পর্ষদ চেয়ারম্যান হন। এ সময়ে আমি জনতা ও রূপালী ব্যাংকে কাজ করে কৃষি ব্যাংকে ফিরে আসি। বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে লক্ষ্য করেছি তিনি কোনো তদবির পাত্তা দিতেন না। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে কখনও হস্তক্ষেপ করতেন না। এক মন্ত্রীর স্ত্রী প্রকল্প ঋণের জন্য তাকে বাসায় ফোন করলে তিনি ভবিষ্যতে তাকে ফোন না করতে বলে দেন। দ্বিতীয় দিন ফোন করলে তিনি অর্থমন্ত্রীকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান।

ব্যাংকিং খাতে আমলাতন্ত্রের খবরদারির ঘোরবিরোধী ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করবে ব্যাংক- অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ বিলুপ্ত করার যুক্তি তার মতো করে জোরে আর কে বলবে? তিনি ছিলেন দেশের আর্থিক খাতের শ্রেষ্ঠ বিশ্লেষক।

শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারির জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। কৃষি ব্যাংকের বোর্ড রুমে বসেই কমিটির সভা করতেন। শেয়ারবাজারে লুটপাটকারীদের নাম-পরিচয় তুলে ধরে তিনি তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন এবং সুনির্দিষ্ট পরামর্শ প্রদান করেছিলেন। ব্যাংকিং খাতের লুটপাট ও লুটেরা শ্রেণীকর্তৃক টাকা বিদেশে পাচারকারীদের কঠোরভাবে শায়েস্তা করার জন্য টিভির টকশোতে তার কণ্ঠ ছিল সোচ্চার।

নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি কচিকাঁচার আসরের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘকাল। আমি অবসরে গিয়ে কচিকাঁচার আসরে কাজ করতে চাই জানালে তিনি খুশি হয়ে বলেছিলেন- ‘এ যুগে তো কেউ এ ধরনের কাজে আগ্রহ দেখায় না। কচিকাঁচার অফিসে এসো, তোমাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে নিব।’ কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে একটি বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালক করায় আমি আর কচিকাঁচার জন্য সময় করতে পারিনি; যা ভেবে নিজেকে অপরাধী মনে হয়।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মননশীল কাজের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্তের জন্য বিজ্ঞাপনের আবেদন তাকে দিলে তিনি সাথে সাথে এক বছরের চারটি সংখ্যার জন্য বিজ্ঞাপন দিতে নির্দেশ দেন।

তার সাথে ব্যাংকের বাহিরের জগতেও আমার রয়েছে শত শত স্মৃতি। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সেমিনারে-সম্মেলনে কতবার কতভাবে তার সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, মতবিনিময় হয়েছে। দৈনিক পত্রিকায় তার লেখা পড়ে কোন বিষয় বুঝতে না পারলে আমি ফোন করে জানতে চাইতাম। তিনি খুশি হয়ে বুঝিয়ে দিতেন।

একবার তাকে কৃষি ব্যাংকের এক ফাঁকিবাজ জিএমের ওপর ভীষণ ক্ষেপে যেতে দেখেছিলাম। তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক কিন্তু তা কখনও জাহির করতেন না। মনেপ্রাণে তিনি খাঁটি বাঙালি ছিলেন। ধারণ করতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের প্রতি ছিল অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা।

মৃত্যু তাকে কেড়ে নিলেও তিনি আমাদের চেতনা ও মননে অমর হয়ে থাকবেন তার কর্মগুণের মাধ্যমে। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।

[লেখক : ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী (অব.),

পরিচালক, আইবিবিএল]