দয়া করে বাস্তবসম্মত আশ্বাস দিন

মনজুরুল হক

আশাবাদ, আশ্বাস এবং স্বপ্নকে কখনও জবাবদিহি করতে হয় না। এ এক নির্মাণশৈলী জাত সুবিধা। এই আশাবাদ, আশ্বাস এবং স্বপ্ন পুরোপুরি ব্যর্থ হলেও কারও সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয় না। অর্থদণ্ড কিংবা পদচ্যুতিরও ভয় নেই। তাই সরকারের প্রায় সর্বস্তরে এই তিনটি বিশেষণ আকসার ব্যবহৃত হয়। হয়ে আসছে। হবেও। এরই সর্বশেষ এপিসোড আরও একবার মঞ্চায়িত হয়ে গেল। এখানে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তার বয়ানেই শোনা যাক, ‘উন্নত দেশের কাতারে যেতে আমাদের দুই বছর, পাঁচ বছর এমনকি শতবর্ষী পরিকল্পনাও রয়েছে। এসব পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব আমরা।’

এই ভিশন তো আজকের নয়!

‘ভিশন’ যেহেতু ২০৪১ সালের, তাই ২০১৮ বা ২০১৯ সালের রেফারেন্স ব্যবহার করছি। এর পরও আরও রেফারেন্স পাব। আপনারা পুরো ২০২০ এবং আরও পরেও এই সব আশাবাদের ‘আশাবাদ’ শোনাতেই থাকবেন।

২০৪১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে এক কাতারে যাবে বলে মন্তব্য করেছিলেন সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কানাডা, ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশের কাতারে আমরা যাব। এই রূপকল্প নিয়ে অনেকে সন্দেহ করে, অনেকেই হাসি-ঠাট্টা করছে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই এগোচ্ছেন। আমাদের দুটি প্রকল্প ‘২০২১’ ও ‘২০৪১’। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে।’ (বাংলা ট্রিবিউন, জানুয়ারি ২৫, ২০১৮)

অন্য সব বিষয় বাদ দেয়া যাক। এ ‘স্বাস্থ্যসেবা আজ মানুষের দোরগোড়ায়। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর। ‘বাক্যটিকে এবার করোনাভাইরাসের ইনকিউবেটরে বসিয়ে দিন। কী দেখবেন? সেটা না বললেও চলে! সম্ভবত স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে এমন লেজে-গোবরে দশা দেশের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। এমনকি স্বাধীনতার পর সবকিছু এলামেলো ভাঙাচোরা থাকার সময়ও না।

এর পর এই একই ‘ভিশন’ ব্যাক্ত করেছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা। “বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করেছে। সরকার নারীর উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার ব্যাপক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে নারী দারিদ্র্য হ্রাস করতে পেরেছে। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ অর্জনে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে’ (মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওয়েব সাইট, ০৪.০৮.২০১৯)।

আর এই সর্বশেষ বললেন; পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তবে এবার তিনি একটু ‘কিন্তু’ রেখেছেন! আর সেটা হলো করোনাভাইসের আক্রমণে দেশের অর্থনীতির ‘সামান্য’ চোট খাওয়া!

ওই একই সভায় পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম জানান, ‘রূপকল্প ২০৪১ সাল বাস্তবায়িত হলে মাথাপিছু আয় সাড়ে ১২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এই সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে নয় দশমিক ৯ শতাংশে। এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে চরম দারিদ্র্যের অবসান এবং আর ২০৪১ সালের মধ্যম দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ২০৩১ সালের মধ্যে ১ শতাংশে নিয়ে আসা এবং ২০৪১ সাল পর্যন্ত এই হারই ধরে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।’

এখানেই শেষ নয়। “প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-৪১) মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, দেশের মানুষের সম্ভাব্য আয়ু ২০৩১ সালের মধ্যে ৭৫ বছর এবং ২০৪১ সালে ৮৩ বছরে নিয়ে যাওয়া। মাতৃমৃত্যুর হার ২০৩১ সালে প্রতি লাখে ৭০ জন এবং ২০৪১ সালে তা কমিয়ে ৩৬ জনে নিয়ে আসা। শিশুমৃত্যুর হার ২০৩১ সালের মধ্যে প্রতি হাজারে (জীবিত জন্ম) ১৫ জনে নিয়ে আসা ও ২০৪১ সালে তা চারজনে নিয়ে আসা।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ২০৩১ সালের মধ্যে শতভাগ নিশ্চিত করা এবং তা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ধরে রাখা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ২০৩১ সালের মধ্যে শতভাগ নিশ্চিত করা এবং তা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ধরে রাখা। প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়ার হার ২০৩১ সালের মধ্যে শূন্যে নিয়ে আসা এবং ২০৪১ পর্যন্ত তা ধরে রাখা।”

আরও ছিল। উল্লেখ করলে জনসাধারণ সব কাজকর্ম ফেলে এইসব আশাবাদ আশ্বাস এবং স্বপ্নগুলোর অটোমোশনে বাস্তবায়ন হবে ভেবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে! তাতে করে পর দিনই পরিবারের সদ্যদের পেটের ভাতের জোগান হবে না।

যা হোক, এইসব আশাবাদ, আশ্বাস আর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ নিশ্চিত ইয়োরোপ-আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে! সে সময় দলে দলে ইউরোপ-আমেরিকার লোকজন এখানে অভিবাসী হওয়ার জন্য নিজ নিজ দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে রাত থাকতে লাইনে দাঁড়াবে। তাই যদি হয়, তাহলে ভাবুন তো! এখন দেশের জনসংখ্যা কম-বেশি ১৮ কোটি হলে ২০৪১ সালে কত দাঁড়াতে পারে? ধরে নেয়া যাক কম-বেশি ২৫ কোটি। এবার ভাবুন; এখনকার ১৮ কোটিতেই দেশে প্রতি বর্গমাইলে মোটামুটি ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। তাহলে তখন কতজন করবে? আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩ হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র, কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। ১৯০১ সালের পৌনে তিন কোটি জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি। এখনই অতিরিক্ত জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে পরিবেশের। বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে বাড়িঘর তৈরি করা হচ্ছে। অধিক পরিমাণে ফসলের জন্য উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হচ্ছে; যা নদী ও পুকুরের পানিতে মিশে তা দূষিত করছে। খাবার ও ফসল ফলাতে ভূগর্ভের পানি অধিক পরিমাণে উত্তোলন করা হচ্ছে ফলে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে, যা জলবায়ুর ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এসব মুদ্রার এক পিঠ মাত্র। অন্য পিঠে বিভীষিকাসম যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আছে, যা লুকিয়ে এইসব আশাবাদের গান শোনানো হয়, তার ব্যাকফায়ার যখন ঘটতে থাকবে তখন এই সব বিবৃতিদানকারীদের অনেকেই বেঁচে থাকবেন না পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখার জন্য।

স্বাস্থ্য খাতে কী বেহাল দশা তা লিখে বোঝানোর দরকার নেই। অক্ষরজ্ঞান আছে এমন যে কেউ সেটা জানেন। শিক্ষা নিয়ে ‘ভানুমতির খেল’ চলে। বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান কত নম্বরে সেটাও বলতে-ভাবতে লজ্জা করে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রসঙ্গ তুললে আর দেশের প্রধান বা রাজধানী শহরের সেই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের চিত্রটি তুলে ধরলে তা গিনেজ বুক অব রেকর্ড-এ ঠাঁই পেতে পারে। এরপর রইল আইনশৃঙ্খলা। এ নিয়ে কথা খরচ করার কোন মানে নেই। এক কথায় ক্লিয়ার- এখানে ‘ল-এনফোর্স ডিপার্টমেন্ট’-এর কেউ কেউ অন্যায়-অপরাধ করেও দিব্যি চাকরি করেন। বিচার, আইন এবং নির্বাহী বিভাগ মাঝে মাঝে সে সব দেখে কিছুটা সচকিত হয়। ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করে। তারপর দিন পার হতে থাকলে বুড়িগঙ্গার কালো নোংরা জল মেঘনায় মিশে নতুন কী রঙ ধারণ করেছে কেউ খোঁজ রাখে না।

আমাদের তো এতসব আশ্বাস আর দিবাস্বপ্নের দরকার নেই! আমরা চাই আফ্রিকার সবচেয়ে দরিদ্র দেশটির জনসম্পদের মতো ভাবুন আমাদের জনসাধারণকে। ভুটানের মতো GDP না HDP হোক আমাদের দেশে। ‘ভিক্ষুকমুক্ত’ অঞ্চলে একটিও ভিক্ষুক না থাকুক। আমাদের নারী এবং শিশুরা প্রায় প্রত্যেকটি পুরুষকে ‘ধর্ষক’ না ভাবুক। মুখস্তবিদ্যার আমলারা সাধারণ মানুষকে চাকর-বাকর না ভাবুক। পুলিশ জনগণের বন্ধু হবে এরকম দিবাস্বপ্ন কোন নির্বোধও দেখে না, তবে নিদেনপক্ষে তারা ‘ভাড়াটে খুনি’ না হোক। দুর্নীতিবাজরা না হয় দুর্নীতি করুক, তা যেন বিশ্বরেকর্ড না গড়ে! তারা তেলাপিয়া চাষের গুরুত্ব বুঝতে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ না করুক। শেষ কথা হলো আমরা বাস্তবে সাদা ভাতে নুন-লঙ্কা ডলে একটুখানি ডাল ঢেলে পেট পুরে খেতে চাই। কল্পনার এক কেজি চালের বিরিয়ানিতে তিন কেজি ঘি ঢালতে চাই না।

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্মী]

monjuraul@gmail.com

শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ১৩ রজব ১৪৪২

দয়া করে বাস্তবসম্মত আশ্বাস দিন

মনজুরুল হক

আশাবাদ, আশ্বাস এবং স্বপ্নকে কখনও জবাবদিহি করতে হয় না। এ এক নির্মাণশৈলী জাত সুবিধা। এই আশাবাদ, আশ্বাস এবং স্বপ্ন পুরোপুরি ব্যর্থ হলেও কারও সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয় না। অর্থদণ্ড কিংবা পদচ্যুতিরও ভয় নেই। তাই সরকারের প্রায় সর্বস্তরে এই তিনটি বিশেষণ আকসার ব্যবহৃত হয়। হয়ে আসছে। হবেও। এরই সর্বশেষ এপিসোড আরও একবার মঞ্চায়িত হয়ে গেল। এখানে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তার বয়ানেই শোনা যাক, ‘উন্নত দেশের কাতারে যেতে আমাদের দুই বছর, পাঁচ বছর এমনকি শতবর্ষী পরিকল্পনাও রয়েছে। এসব পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব আমরা।’

এই ভিশন তো আজকের নয়!

‘ভিশন’ যেহেতু ২০৪১ সালের, তাই ২০১৮ বা ২০১৯ সালের রেফারেন্স ব্যবহার করছি। এর পরও আরও রেফারেন্স পাব। আপনারা পুরো ২০২০ এবং আরও পরেও এই সব আশাবাদের ‘আশাবাদ’ শোনাতেই থাকবেন।

২০৪১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে এক কাতারে যাবে বলে মন্তব্য করেছিলেন সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কানাডা, ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশের কাতারে আমরা যাব। এই রূপকল্প নিয়ে অনেকে সন্দেহ করে, অনেকেই হাসি-ঠাট্টা করছে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই এগোচ্ছেন। আমাদের দুটি প্রকল্প ‘২০২১’ ও ‘২০৪১’। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে।’ (বাংলা ট্রিবিউন, জানুয়ারি ২৫, ২০১৮)

অন্য সব বিষয় বাদ দেয়া যাক। এ ‘স্বাস্থ্যসেবা আজ মানুষের দোরগোড়ায়। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর। ‘বাক্যটিকে এবার করোনাভাইরাসের ইনকিউবেটরে বসিয়ে দিন। কী দেখবেন? সেটা না বললেও চলে! সম্ভবত স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে এমন লেজে-গোবরে দশা দেশের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। এমনকি স্বাধীনতার পর সবকিছু এলামেলো ভাঙাচোরা থাকার সময়ও না।

এর পর এই একই ‘ভিশন’ ব্যাক্ত করেছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা। “বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করেছে। সরকার নারীর উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার ব্যাপক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে নারী দারিদ্র্য হ্রাস করতে পেরেছে। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ অর্জনে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে’ (মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওয়েব সাইট, ০৪.০৮.২০১৯)।

আর এই সর্বশেষ বললেন; পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তবে এবার তিনি একটু ‘কিন্তু’ রেখেছেন! আর সেটা হলো করোনাভাইসের আক্রমণে দেশের অর্থনীতির ‘সামান্য’ চোট খাওয়া!

ওই একই সভায় পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম জানান, ‘রূপকল্প ২০৪১ সাল বাস্তবায়িত হলে মাথাপিছু আয় সাড়ে ১২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এই সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে নয় দশমিক ৯ শতাংশে। এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে চরম দারিদ্র্যের অবসান এবং আর ২০৪১ সালের মধ্যম দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ২০৩১ সালের মধ্যে ১ শতাংশে নিয়ে আসা এবং ২০৪১ সাল পর্যন্ত এই হারই ধরে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।’

এখানেই শেষ নয়। “প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-৪১) মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, দেশের মানুষের সম্ভাব্য আয়ু ২০৩১ সালের মধ্যে ৭৫ বছর এবং ২০৪১ সালে ৮৩ বছরে নিয়ে যাওয়া। মাতৃমৃত্যুর হার ২০৩১ সালে প্রতি লাখে ৭০ জন এবং ২০৪১ সালে তা কমিয়ে ৩৬ জনে নিয়ে আসা। শিশুমৃত্যুর হার ২০৩১ সালের মধ্যে প্রতি হাজারে (জীবিত জন্ম) ১৫ জনে নিয়ে আসা ও ২০৪১ সালে তা চারজনে নিয়ে আসা।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ২০৩১ সালের মধ্যে শতভাগ নিশ্চিত করা এবং তা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ধরে রাখা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ২০৩১ সালের মধ্যে শতভাগ নিশ্চিত করা এবং তা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ধরে রাখা। প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়ার হার ২০৩১ সালের মধ্যে শূন্যে নিয়ে আসা এবং ২০৪১ পর্যন্ত তা ধরে রাখা।”

আরও ছিল। উল্লেখ করলে জনসাধারণ সব কাজকর্ম ফেলে এইসব আশাবাদ আশ্বাস এবং স্বপ্নগুলোর অটোমোশনে বাস্তবায়ন হবে ভেবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে! তাতে করে পর দিনই পরিবারের সদ্যদের পেটের ভাতের জোগান হবে না।

যা হোক, এইসব আশাবাদ, আশ্বাস আর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ নিশ্চিত ইয়োরোপ-আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে! সে সময় দলে দলে ইউরোপ-আমেরিকার লোকজন এখানে অভিবাসী হওয়ার জন্য নিজ নিজ দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে রাত থাকতে লাইনে দাঁড়াবে। তাই যদি হয়, তাহলে ভাবুন তো! এখন দেশের জনসংখ্যা কম-বেশি ১৮ কোটি হলে ২০৪১ সালে কত দাঁড়াতে পারে? ধরে নেয়া যাক কম-বেশি ২৫ কোটি। এবার ভাবুন; এখনকার ১৮ কোটিতেই দেশে প্রতি বর্গমাইলে মোটামুটি ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। তাহলে তখন কতজন করবে? আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩ হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র, কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। ১৯০১ সালের পৌনে তিন কোটি জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি। এখনই অতিরিক্ত জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে পরিবেশের। বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে বাড়িঘর তৈরি করা হচ্ছে। অধিক পরিমাণে ফসলের জন্য উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হচ্ছে; যা নদী ও পুকুরের পানিতে মিশে তা দূষিত করছে। খাবার ও ফসল ফলাতে ভূগর্ভের পানি অধিক পরিমাণে উত্তোলন করা হচ্ছে ফলে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে, যা জলবায়ুর ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এসব মুদ্রার এক পিঠ মাত্র। অন্য পিঠে বিভীষিকাসম যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আছে, যা লুকিয়ে এইসব আশাবাদের গান শোনানো হয়, তার ব্যাকফায়ার যখন ঘটতে থাকবে তখন এই সব বিবৃতিদানকারীদের অনেকেই বেঁচে থাকবেন না পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখার জন্য।

স্বাস্থ্য খাতে কী বেহাল দশা তা লিখে বোঝানোর দরকার নেই। অক্ষরজ্ঞান আছে এমন যে কেউ সেটা জানেন। শিক্ষা নিয়ে ‘ভানুমতির খেল’ চলে। বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান কত নম্বরে সেটাও বলতে-ভাবতে লজ্জা করে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রসঙ্গ তুললে আর দেশের প্রধান বা রাজধানী শহরের সেই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের চিত্রটি তুলে ধরলে তা গিনেজ বুক অব রেকর্ড-এ ঠাঁই পেতে পারে। এরপর রইল আইনশৃঙ্খলা। এ নিয়ে কথা খরচ করার কোন মানে নেই। এক কথায় ক্লিয়ার- এখানে ‘ল-এনফোর্স ডিপার্টমেন্ট’-এর কেউ কেউ অন্যায়-অপরাধ করেও দিব্যি চাকরি করেন। বিচার, আইন এবং নির্বাহী বিভাগ মাঝে মাঝে সে সব দেখে কিছুটা সচকিত হয়। ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করে। তারপর দিন পার হতে থাকলে বুড়িগঙ্গার কালো নোংরা জল মেঘনায় মিশে নতুন কী রঙ ধারণ করেছে কেউ খোঁজ রাখে না।

আমাদের তো এতসব আশ্বাস আর দিবাস্বপ্নের দরকার নেই! আমরা চাই আফ্রিকার সবচেয়ে দরিদ্র দেশটির জনসম্পদের মতো ভাবুন আমাদের জনসাধারণকে। ভুটানের মতো GDP না HDP হোক আমাদের দেশে। ‘ভিক্ষুকমুক্ত’ অঞ্চলে একটিও ভিক্ষুক না থাকুক। আমাদের নারী এবং শিশুরা প্রায় প্রত্যেকটি পুরুষকে ‘ধর্ষক’ না ভাবুক। মুখস্তবিদ্যার আমলারা সাধারণ মানুষকে চাকর-বাকর না ভাবুক। পুলিশ জনগণের বন্ধু হবে এরকম দিবাস্বপ্ন কোন নির্বোধও দেখে না, তবে নিদেনপক্ষে তারা ‘ভাড়াটে খুনি’ না হোক। দুর্নীতিবাজরা না হয় দুর্নীতি করুক, তা যেন বিশ্বরেকর্ড না গড়ে! তারা তেলাপিয়া চাষের গুরুত্ব বুঝতে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ না করুক। শেষ কথা হলো আমরা বাস্তবে সাদা ভাতে নুন-লঙ্কা ডলে একটুখানি ডাল ঢেলে পেট পুরে খেতে চাই। কল্পনার এক কেজি চালের বিরিয়ানিতে তিন কেজি ঘি ঢালতে চাই না।

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্মী]

monjuraul@gmail.com