ভাষা আন্দোলনে গণমাধ্যমের ভূমিকা

শাকিবুল হাসান

ভাষা আন্দোলনের শুরু ১৯৪৮ সালে। ঢাকায় তখন প্রধান দৈনিক পত্রিকা আজাদ এবং ইংরেজি মর্নিং নিউজ। দুটিই ছিল মুসলিম লীগের সমর্থক সংবাদপত্র। ভাষা আন্দোলন, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা করার জন্য ছাত্র প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর (তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দীন) চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দান ইত্যাদি খবর মুসলিম লীগ সমর্থক কাগজগুলোতে ছাপা হয়েছে বৈকি, তেমন গুরুত্ব ও সমর্থন পায়নি। বড় দুটি দৈনিকের সমর্থন ও সাহায্য না পেলেও ১৯৪৯, ১৯৫০, ১৯৫১ এই তিন বছর ভাষা আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত কয়েকটি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা।

১৯৪৮ সালে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই দৈনিক ইত্তেহাদ এই আন্দোলনে জোরালো সমর্থন দেয়। পত্রিকাটি তখনও কলকাতা থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল এবং আজাদের মতো, ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ততকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কাগজটির ঢাকায় আসা নিষিদ্ধ করে দেন। এই কাগজের উদ্যোক্তারা (পরে যারা আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন) ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে ইত্তেহাদ প্রকাশের চেষ্টা করে মুসলিম লীগ সরকারের বাধা দানের নীতির ফলে ব্যর্থ হন এবং পরে তারা সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশ করেন। এই সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ভাষা আন্দোলনে জোরালো সমর্থন জানায়।

১৯৪৮-৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনে সবচাইতে বেশি শক্তিশালী সমর্থন জোগায় সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকা। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন তখনকার প্রগতিশীল যুব নেতা মাহমুদ আলী। নওবেলালের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মাসিক সীমান্ত পত্রিকা। এই সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব আলম চৌধুরীই প্রথম ভাষা শহীদদের ওপর কবিতা লেখেন, আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি, কাঁদতে আসিনি।

আগে বাঙালি মুসলমান পরিচালিত সংবাদপত্রের নাম রাখা হতো উর্দু, ফার্সি বা আরবিতে। যেমন-সোলতান, তকবির, আজাদ, সওগাত ইত্যাদি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের প্রভাবেই সম্ভবত বাঙালি মুসলমান তাদের সংবাদপত্র ও সাময়িকীর নাম বাংলায় রাখা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে ক্ষমতাসীন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যে দৈনিক সংবাদপত্রটি প্রকাশ করেন, তার নাম রাখা হয় ‘সংবাদ।’ মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’ এই নামকরণের প্রতিবাদ জানান। ‘আজাদের’ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পত্রিকাটির নামকরণে হিন্দুয়ানি বাংলাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। মুসলমানি বাংলায় পত্রিকাটির নাম রাখা উচিত ছিল “খবর।”

১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক রূপান্তরিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সবচাইতে শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় ইত্তেফাক। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মোসাফির তার রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে অবিরাম শক্তিশালী যুক্তি উত্থাপন করতে থাকেন। এ সময় ঢাকার কোনো সংবাদপত্রেরই (একমাত্র মর্নিং নিউজ ছাড়া) ভাষা আন্দোলন-বিরোধী কোনো ভূমিকা ছিল না।

শিক্ষার্থী, বরেন্দ্র কলেজ রাজশাহী

শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ১৩ ফাল্গুন ১৪২৭ ১৩ রজব ১৪৪২

ভাষা আন্দোলনে গণমাধ্যমের ভূমিকা

শাকিবুল হাসান

ভাষা আন্দোলনের শুরু ১৯৪৮ সালে। ঢাকায় তখন প্রধান দৈনিক পত্রিকা আজাদ এবং ইংরেজি মর্নিং নিউজ। দুটিই ছিল মুসলিম লীগের সমর্থক সংবাদপত্র। ভাষা আন্দোলন, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা করার জন্য ছাত্র প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর (তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দীন) চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দান ইত্যাদি খবর মুসলিম লীগ সমর্থক কাগজগুলোতে ছাপা হয়েছে বৈকি, তেমন গুরুত্ব ও সমর্থন পায়নি। বড় দুটি দৈনিকের সমর্থন ও সাহায্য না পেলেও ১৯৪৯, ১৯৫০, ১৯৫১ এই তিন বছর ভাষা আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত কয়েকটি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা।

১৯৪৮ সালে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই দৈনিক ইত্তেহাদ এই আন্দোলনে জোরালো সমর্থন দেয়। পত্রিকাটি তখনও কলকাতা থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল এবং আজাদের মতো, ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ততকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কাগজটির ঢাকায় আসা নিষিদ্ধ করে দেন। এই কাগজের উদ্যোক্তারা (পরে যারা আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন) ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে ইত্তেহাদ প্রকাশের চেষ্টা করে মুসলিম লীগ সরকারের বাধা দানের নীতির ফলে ব্যর্থ হন এবং পরে তারা সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশ করেন। এই সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ভাষা আন্দোলনে জোরালো সমর্থন জানায়।

১৯৪৮-৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনে সবচাইতে বেশি শক্তিশালী সমর্থন জোগায় সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকা। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন তখনকার প্রগতিশীল যুব নেতা মাহমুদ আলী। নওবেলালের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মাসিক সীমান্ত পত্রিকা। এই সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব আলম চৌধুরীই প্রথম ভাষা শহীদদের ওপর কবিতা লেখেন, আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি, কাঁদতে আসিনি।

আগে বাঙালি মুসলমান পরিচালিত সংবাদপত্রের নাম রাখা হতো উর্দু, ফার্সি বা আরবিতে। যেমন-সোলতান, তকবির, আজাদ, সওগাত ইত্যাদি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের প্রভাবেই সম্ভবত বাঙালি মুসলমান তাদের সংবাদপত্র ও সাময়িকীর নাম বাংলায় রাখা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে ক্ষমতাসীন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যে দৈনিক সংবাদপত্রটি প্রকাশ করেন, তার নাম রাখা হয় ‘সংবাদ।’ মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’ এই নামকরণের প্রতিবাদ জানান। ‘আজাদের’ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পত্রিকাটির নামকরণে হিন্দুয়ানি বাংলাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। মুসলমানি বাংলায় পত্রিকাটির নাম রাখা উচিত ছিল “খবর।”

১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক রূপান্তরিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সবচাইতে শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় ইত্তেফাক। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মোসাফির তার রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে অবিরাম শক্তিশালী যুক্তি উত্থাপন করতে থাকেন। এ সময় ঢাকার কোনো সংবাদপত্রেরই (একমাত্র মর্নিং নিউজ ছাড়া) ভাষা আন্দোলন-বিরোধী কোনো ভূমিকা ছিল না।

শিক্ষার্থী, বরেন্দ্র কলেজ রাজশাহী