স্বাধীনতার সময়ের শূন্য রিজার্ভ এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলার

১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে সম্পদ সঞ্চয় তো দূরের কথা তিন বেলা ক্ষুধা নিবারণও করতে পারে করতে পারেনি অনেক মানুষ। অভাব অনটন ও দুর্ভিক্ষে পড়ে ক্ষুধার জ্বালায় মারা গেছে মৃত্যুবরণ করা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল সেদিন। সেই বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার। এখন সেই দিনের অবহেলিত ও ক্ষুধার্ত দেশটি বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতি।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত হন। তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আপন হাতে সাজাতে থাকেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আসতে থাকে গতি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে বেশ কিছু বছর অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। পরে আবার ধীরে ধীরে চলতে থাকে দেশের অর্থনীতির চাকা। একটা সময় গতি আসে। গত এক-দেড় দশকে সেই চাকায় এমন গতি এসেছে যে, পাকিস্তানকেই অনেক সূচকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) এক প্রতিবেদন মতে, ২০৩২ সালে বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ। ৪১তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। একইসঙ্গে ২০৩৩ সালে অর্থনীতির দিক থেকে অনেক উন্নত দেশ যেমন মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশকে অতিক্রম করবে দেশ। আগামী ১৫ বছরে দেশের জিডিপি আড়াইগুণেরও বেশি বাড়বে। ২০৩৩ সালে জিডিপির আকার দাঁড়াবে ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকায়।

স্বাধীনতার সময় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল শূন্য। এখন সেই দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। দেশের প্রতিষ্ঠালগ্নে ১২৯ মার্কিন ডলার আয় করা মানুষের মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ৬৪ ডলার ছাড়িয়েছে। ১৯৭২ সালে মাত্র চার হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা দেশের অর্থনীতির আকার এখন ১১ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ এবং ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ অর্থবছর পর্যন্ত মাথাপিছু সঞ্চয় ছিল জিডিপির ২ শতাংশ। ১৯৭২ সালে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য বাজেটে জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল মাত্র ১১২ টাকা, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের জন্য দেয়া বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ ২০ হাজার টাকার বেশি। ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট থেকে এসে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেট দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশ।

গত কয়েক বছর ধরেই রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দশ বছর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরের জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গত বছরের অক্টোবরে। চলতি বছরের ৩০ জুন সেই রিজার্ভ বেড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে উঠে। তারপর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গত ১ সেপ্টেম্বর তা ৩৯ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। অক্টোবরের ৮ তারিখে ছাড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। এরপর এই রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে রেমিট্যান্স। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮৮২ কোটি ৫৬ লাখ ( ৮.৮২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। আর নভেম্বর মাসের ২৫ দিনে অর্থাৎ ১ নভেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সবমিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এর আগে এই মহামারীর মধ্যেই অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

পূর্ব পাকিস্তান আমলে এই ভূখণ্ডে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান থাকলেও স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যাংকগুলোর নামও তিনি নিজেই দেন। এরপর আসে বিদেশি ও বেসরকারি ব্যাংক। বর্তমানে দেশে কার্যরত দেশি, বিদেশি ও সরকারি মিলে ৬২টি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে ৬১টি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অন্যদিকে শুরুতে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান না থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৩৩টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

রবিবার, ২৮ মার্চ ২০২১ , ১৪ চৈত্র ১৪২৭ ১৩ শাবান ১৪৪২

স্বাধীনতার সময়ের শূন্য রিজার্ভ এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলার

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশ

image

১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে সম্পদ সঞ্চয় তো দূরের কথা তিন বেলা ক্ষুধা নিবারণও করতে পারে করতে পারেনি অনেক মানুষ। অভাব অনটন ও দুর্ভিক্ষে পড়ে ক্ষুধার জ্বালায় মারা গেছে মৃত্যুবরণ করা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল সেদিন। সেই বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার। এখন সেই দিনের অবহেলিত ও ক্ষুধার্ত দেশটি বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতি।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত হন। তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আপন হাতে সাজাতে থাকেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আসতে থাকে গতি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে বেশ কিছু বছর অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। পরে আবার ধীরে ধীরে চলতে থাকে দেশের অর্থনীতির চাকা। একটা সময় গতি আসে। গত এক-দেড় দশকে সেই চাকায় এমন গতি এসেছে যে, পাকিস্তানকেই অনেক সূচকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) এক প্রতিবেদন মতে, ২০৩২ সালে বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ। ৪১তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। একইসঙ্গে ২০৩৩ সালে অর্থনীতির দিক থেকে অনেক উন্নত দেশ যেমন মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশকে অতিক্রম করবে দেশ। আগামী ১৫ বছরে দেশের জিডিপি আড়াইগুণেরও বেশি বাড়বে। ২০৩৩ সালে জিডিপির আকার দাঁড়াবে ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকায়।

স্বাধীনতার সময় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল শূন্য। এখন সেই দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। দেশের প্রতিষ্ঠালগ্নে ১২৯ মার্কিন ডলার আয় করা মানুষের মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ৬৪ ডলার ছাড়িয়েছে। ১৯৭২ সালে মাত্র চার হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা দেশের অর্থনীতির আকার এখন ১১ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ এবং ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ অর্থবছর পর্যন্ত মাথাপিছু সঞ্চয় ছিল জিডিপির ২ শতাংশ। ১৯৭২ সালে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য বাজেটে জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল মাত্র ১১২ টাকা, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের জন্য দেয়া বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ ২০ হাজার টাকার বেশি। ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট থেকে এসে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেট দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশ।

গত কয়েক বছর ধরেই রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দশ বছর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরের জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গত বছরের অক্টোবরে। চলতি বছরের ৩০ জুন সেই রিজার্ভ বেড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে উঠে। তারপর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গত ১ সেপ্টেম্বর তা ৩৯ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। অক্টোবরের ৮ তারিখে ছাড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। এরপর এই রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে রেমিট্যান্স। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮৮২ কোটি ৫৬ লাখ ( ৮.৮২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। আর নভেম্বর মাসের ২৫ দিনে অর্থাৎ ১ নভেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সবমিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এর আগে এই মহামারীর মধ্যেই অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

পূর্ব পাকিস্তান আমলে এই ভূখণ্ডে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান থাকলেও স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যাংকগুলোর নামও তিনি নিজেই দেন। এরপর আসে বিদেশি ও বেসরকারি ব্যাংক। বর্তমানে দেশে কার্যরত দেশি, বিদেশি ও সরকারি মিলে ৬২টি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে ৬১টি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অন্যদিকে শুরুতে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান না থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৩৩টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে।