ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চরচারতলা গ্রামে চার মাস ধরে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য 

ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট : প্রতিদিনই আগুন, নির্বিকার পুলিশ প্রশাসন

ভাঙচুর-লুটপাটে নিঃস্ব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের চরচারতলা গ্রামের শতাধিক পরিবার। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাজারো নারী-পুরুষ। গত ২২ জানুয়ারি রাতে ওই গ্রামের লতিফ বাড়ি ও মুন্সি বাড়ির মধ্যে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে টেঁটার আঘাতে নিহত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সির ভাই জামাল মুন্সি। ঘটনার পরদিন থেকে চেয়ারম্যান ও তার লোকজন প্রতিপক্ষে লোকজনের ঘরের মালামাল লুটপাট এমনকি টিনের চাল পর্যন্ত খুলে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখনও ঘরবাড়ি আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। অভিযোগ থানা পুলিশ প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার অনুগত হয়েই কাজ করছে। হামলা-ভাঙচুরের কোন মামলা থানা নেয়নি।

শুধু কান্নাই সম্বল বৃদ্ধ হালেমা খাতুনের। স্বামী নেই। ৪ সন্তানের ৩ জনই প্রতিবন্ধী। আরেক ছেলে প্রবাসী। লুটপাটে সবার ঘরই এখন ফাকা। এটাই সম্বল অসহায় এই বৃদ্ধার। জানান, ঘরে কোন খাটপালঙ্ক নেই। পানির মোটর, ফ্যান সবই লুট হয়ে গেছে। রান্নাবান্না করে খাওয়ার মতো কিছুই নেই। শূন্য একটি ঘর দেখিয়ে কাঁদছিলেন অনবরত।

আশুগঞ্জের চরচারতলার খন্দকার বাড়ির আলী রাজা খন্দকারের স্ত্রী হালিমা। ফরিদা বেগমের ৪০ বছরের সাজানো সংসারের কোন কিছুই নেই। লুটপাটে শূন্য তার ঘরও। আলমারি ভেঙে সোনা-গহনা সব কিছুই নিয়ে গেছে সরকারবাড়ি আর মুন্সিবাড়ির লোকজন। জানুয়ারি মাসে তার ঘরে হামলা হওয়ার কয়েকদিন আগে ৪ লাখ টাকা খরচ করে ঘরে টাইলস বসিয়ে ছিলেন। আরও সাজসজ্জা করেছিলেন। সেই ঘরে এখন ধ্বংসের ছাপ।

স্বামী সালাউদ্দিন মিয়া ছাড়াও তার দুই মেয়ের জামাই প্রবাসী। ফলে দামি জিনিসপত্রে ঠাসা ছিল এই ঘর। খন্দকার বাড়ি ছাড়াও হামলা-লুটপাটে নিস্ব চরচারতলার এমন আরও অনেক পরিবার। লতিফ বাড়ির ধনাঢ্য সেলিম পারভেজের ডুপ্লেক্স বাসভবনের শুধু ইটগুলো ছাড়া কোন কিছুই নেই। লুট করে নেয়া হয়েছে মসজিদের পাখাও।

গত প্রায় ৪ মাস ধরে নির্বিঘেœ চলছে ঘরবাড়িতে লুটপাট। কোন কোন বাড়িতে অবস্থানকারী মহিলাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। বাড়ি ছাড়ার জন্যে হুমকি দেয়া হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত লতিফ বাড়ি, খাঁ বাড়ি, খন্দকার বাড়ি ও নাগর বাড়ি বংশের তিন শতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটতরাজ করা হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

জামাল মুন্সি হত্যা ঘটনায় ২৭ জনের নামে মামলা হলেও ভয়ে-আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের হাজারো নারী পুরুষ। অবশ্য ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সিকে প্রধান আসামি করে আদালতে ৮টি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলায় হানিফের ভাই ও পরিবারের সদস্য ফাইজুর, রুবেল মুন্সি, রুমেল মুন্সি, রনি মুন্সি, আরিফ মুন্সি, জনি মুন্সি, সাগর মুন্সি, পায়েল মুন্সি, কামাল মুন্সি, চঞ্চল মুন্সি, সজল মুন্সি, হৃদয়, বাছির, উজ্জল মুন্সি, মোমিন মুন্সি প্রকাশ মোমিন ডাকাতসহ ২৫/৩০ জন করে আসামি।

মামলাগুলো পিবিআই ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে আদালত। মনোয়ারা বেগম, রওশন আরা বেগম, নিপা আক্তার, ফরিদা বেগম, মোছাম্মৎ জান্নাত বেগম, হাসনা বেগম ও রাবেয়া আক্তার বাদী হয়ে এসব মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ ওঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যান এসব মামলার তদন্তও থামিয়ে দিয়েছেন।

অত্যাচারের শিকার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ উপজেলা চেয়ারম্যানের কথায় উঠেন বসেন। থানায় মামলা দিতে গেলেও ওসি ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের। উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান লিমা সুলতানা জানান, তার বাবার বাড়ি চরচারতলায়। চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সদস্যরা তাকেও রেহাই দেয়নি। ৫ ভাই তার। তাদের সবার ঘর থেকে রাতে রাতে সব মালামাল লুট করে নেয়া হয়েছে। ঘরের মহিলাদের পর্যন্ত অত্যাচার করা হয়েছে। রোববার সরজমিনে চরচারতলায় গেলে অনেকে জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফের লোকজন জমিতে লাল নিশান উড়িয়ে দিয়ে ঘোষণা দেন সব জমি চেয়ারম্যান হানিফের। এরপর জমির বিভিন্ন ধরনের ফসল নিয়ে যান।

শনিবার রাতে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় খন্দকার বাড়ির স্বপ্না বেগমের ঘর। গৃহবধূ সুমি বলেন, আমরা তো কোন দোষ করিনি। আমাকে লাঠি দিয়ে মারছে। আমার শ্বশুরকে লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দিয়েছে। আমার ননদ গর্ভবতী, তাকেও মেরেছে। অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সি বলেন, লুটপাটের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তার ভাই হত্যায় জড়িত আসামিদের মালামাল পুলিশ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ভিডিও ফুটেজ তার কাছে রয়েছে। থানার অফিসার ইনচার্জ জাবেদ মাহমুদ ঘরবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তার দাবি এমন ঘটনায় কেউ তার কাছে মামলা নিয়ে আসেনি। জেলার পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান বলেন, হত্যা এবং বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট দুটোই অপরাধ। এরসঙ্গে কোন জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাকে ছাড়া হবে না।

বুধবার, ২৬ মে ২০২১ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৩ শাওয়াল ১৪৪২

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চরচারতলা গ্রামে চার মাস ধরে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য 

ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট : প্রতিদিনই আগুন, নির্বিকার পুলিশ প্রশাসন

মো. সাদেকুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

image

ভাঙচুর-লুটপাটে নিঃস্ব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের চরচারতলা গ্রামের শতাধিক পরিবার। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাজারো নারী-পুরুষ। গত ২২ জানুয়ারি রাতে ওই গ্রামের লতিফ বাড়ি ও মুন্সি বাড়ির মধ্যে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে টেঁটার আঘাতে নিহত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সির ভাই জামাল মুন্সি। ঘটনার পরদিন থেকে চেয়ারম্যান ও তার লোকজন প্রতিপক্ষে লোকজনের ঘরের মালামাল লুটপাট এমনকি টিনের চাল পর্যন্ত খুলে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখনও ঘরবাড়ি আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। অভিযোগ থানা পুলিশ প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার অনুগত হয়েই কাজ করছে। হামলা-ভাঙচুরের কোন মামলা থানা নেয়নি।

শুধু কান্নাই সম্বল বৃদ্ধ হালেমা খাতুনের। স্বামী নেই। ৪ সন্তানের ৩ জনই প্রতিবন্ধী। আরেক ছেলে প্রবাসী। লুটপাটে সবার ঘরই এখন ফাকা। এটাই সম্বল অসহায় এই বৃদ্ধার। জানান, ঘরে কোন খাটপালঙ্ক নেই। পানির মোটর, ফ্যান সবই লুট হয়ে গেছে। রান্নাবান্না করে খাওয়ার মতো কিছুই নেই। শূন্য একটি ঘর দেখিয়ে কাঁদছিলেন অনবরত।

আশুগঞ্জের চরচারতলার খন্দকার বাড়ির আলী রাজা খন্দকারের স্ত্রী হালিমা। ফরিদা বেগমের ৪০ বছরের সাজানো সংসারের কোন কিছুই নেই। লুটপাটে শূন্য তার ঘরও। আলমারি ভেঙে সোনা-গহনা সব কিছুই নিয়ে গেছে সরকারবাড়ি আর মুন্সিবাড়ির লোকজন। জানুয়ারি মাসে তার ঘরে হামলা হওয়ার কয়েকদিন আগে ৪ লাখ টাকা খরচ করে ঘরে টাইলস বসিয়ে ছিলেন। আরও সাজসজ্জা করেছিলেন। সেই ঘরে এখন ধ্বংসের ছাপ।

স্বামী সালাউদ্দিন মিয়া ছাড়াও তার দুই মেয়ের জামাই প্রবাসী। ফলে দামি জিনিসপত্রে ঠাসা ছিল এই ঘর। খন্দকার বাড়ি ছাড়াও হামলা-লুটপাটে নিস্ব চরচারতলার এমন আরও অনেক পরিবার। লতিফ বাড়ির ধনাঢ্য সেলিম পারভেজের ডুপ্লেক্স বাসভবনের শুধু ইটগুলো ছাড়া কোন কিছুই নেই। লুট করে নেয়া হয়েছে মসজিদের পাখাও।

গত প্রায় ৪ মাস ধরে নির্বিঘেœ চলছে ঘরবাড়িতে লুটপাট। কোন কোন বাড়িতে অবস্থানকারী মহিলাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। বাড়ি ছাড়ার জন্যে হুমকি দেয়া হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত লতিফ বাড়ি, খাঁ বাড়ি, খন্দকার বাড়ি ও নাগর বাড়ি বংশের তিন শতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটতরাজ করা হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

জামাল মুন্সি হত্যা ঘটনায় ২৭ জনের নামে মামলা হলেও ভয়ে-আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের হাজারো নারী পুরুষ। অবশ্য ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সিকে প্রধান আসামি করে আদালতে ৮টি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলায় হানিফের ভাই ও পরিবারের সদস্য ফাইজুর, রুবেল মুন্সি, রুমেল মুন্সি, রনি মুন্সি, আরিফ মুন্সি, জনি মুন্সি, সাগর মুন্সি, পায়েল মুন্সি, কামাল মুন্সি, চঞ্চল মুন্সি, সজল মুন্সি, হৃদয়, বাছির, উজ্জল মুন্সি, মোমিন মুন্সি প্রকাশ মোমিন ডাকাতসহ ২৫/৩০ জন করে আসামি।

মামলাগুলো পিবিআই ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে আদালত। মনোয়ারা বেগম, রওশন আরা বেগম, নিপা আক্তার, ফরিদা বেগম, মোছাম্মৎ জান্নাত বেগম, হাসনা বেগম ও রাবেয়া আক্তার বাদী হয়ে এসব মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ ওঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যান এসব মামলার তদন্তও থামিয়ে দিয়েছেন।

অত্যাচারের শিকার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ উপজেলা চেয়ারম্যানের কথায় উঠেন বসেন। থানায় মামলা দিতে গেলেও ওসি ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের। উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান লিমা সুলতানা জানান, তার বাবার বাড়ি চরচারতলায়। চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সদস্যরা তাকেও রেহাই দেয়নি। ৫ ভাই তার। তাদের সবার ঘর থেকে রাতে রাতে সব মালামাল লুট করে নেয়া হয়েছে। ঘরের মহিলাদের পর্যন্ত অত্যাচার করা হয়েছে। রোববার সরজমিনে চরচারতলায় গেলে অনেকে জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফের লোকজন জমিতে লাল নিশান উড়িয়ে দিয়ে ঘোষণা দেন সব জমি চেয়ারম্যান হানিফের। এরপর জমির বিভিন্ন ধরনের ফসল নিয়ে যান।

শনিবার রাতে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় খন্দকার বাড়ির স্বপ্না বেগমের ঘর। গৃহবধূ সুমি বলেন, আমরা তো কোন দোষ করিনি। আমাকে লাঠি দিয়ে মারছে। আমার শ্বশুরকে লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দিয়েছে। আমার ননদ গর্ভবতী, তাকেও মেরেছে। অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সি বলেন, লুটপাটের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তার ভাই হত্যায় জড়িত আসামিদের মালামাল পুলিশ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ভিডিও ফুটেজ তার কাছে রয়েছে। থানার অফিসার ইনচার্জ জাবেদ মাহমুদ ঘরবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তার দাবি এমন ঘটনায় কেউ তার কাছে মামলা নিয়ে আসেনি। জেলার পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান বলেন, হত্যা এবং বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট দুটোই অপরাধ। এরসঙ্গে কোন জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাকে ছাড়া হবে না।