লাইন টানা হয় নাই! কাটলো কেমনে?

তিতাসের কাছে প্রশ্ন

‘আমাগো গেরামে তো গ্যাস লাইনই টানা অয় নাই! কাটলো কেমনে?’- অনেকটা অবাক সুরেই কথাগুলো বললেন ইমামপুর গ্রামের বাসিন্দা কবির নেকী। ইমামপুর গ্রামের গ্যাস লাইন কি কেটে দিয়েছে তিতাস? সংবাদের এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল তিনি এসব কথা বলেন।

পেশায় কৃষক কবীর বলেন, ‘মেইন রোডের লগে অনেক গেরামে গ্যাস আছে। আমাগো গেরামে তো নেতা অনেকÑ উপজেলা চেয়ারম্যান (সাবেক)-ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ মেম্বার। তবে কেউ গ্যাস লাইন আনার পক্ষে না। সবাই কয়- বদনাম অইব। সরকারের বেলকা লিস্টে (ব্ল্যাক লিস্টে) নাম আইবো। তাই ইমামপুরে গ্যাস আইয়ে নাই।’

সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদ অভিযান সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তির একটি অংশে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) উল্লেখ করে, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর, বাঘাবন্দি (বাঘাইয়াকান্দি) ষোলআনি গ্রামের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

অভিযোগ উঠেছে, তিতাস গ্যাসের (টিজিটিডিসিএল) বিজ্ঞপ্তিতে এমন অনেক গ্রামের নাম এসেছে, যেখানে কোন সময় অবৈধ গ্যাসের লাইন নির্মাণ করা হয়নি।

এ বিষয়ে খোঁজ নিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয় সংবাদের।

গজারিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেফায়েত উল্লাহ খান (তোতা) সংবাদকে বলেন, ‘আমি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে অনেকে আমার গ্রাম ইমামপুরে অবৈধ গ্যাস সংযোগ আনার বিষয়ে সুপারিশ করেছে। তবে আমি অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ছিলাম। এরপরও গজারিয়ার কিছু এলাকায় অবৈধ সংযোগ নেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। স্থানীয় ও রাজনৈতিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সব জায়গায় অবৈধ সংযোগ নেয়ার বিষয়টি বন্ধ রাখা যায়নি। তবে আমার গ্রামে আমি সংযোগ নিতে দেইনি।’

রেফায়েত উল্লাহ খান বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস কীভাবে একটি গ্রামকে অবৈধ সংযোগ নেয়ার তালিকাভুক্ত করে, যে গ্রামে কখনও অবৈধ গ্যাস সংযোগ যায়নি।’

পেশায় শিক্ষক বাঘাইয়াকান্দি গ্রামের সাইফুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বৈদ্যেরগাঁও থেকে একটি লাইন মাথাভাঙ্গা, রসুলপুর হয়ে দৌলতপুর পর্যন্ত এসেছিল। তবে বৈদ্যেরগাঁওয়ের পরের গ্রামগুলোতে রান্নার সময় গ্যাস পাওয়া যায় না, এমন অভিযোগে স্থানীয়দের বিবাদ চলছিল। বেশ কয়েক বছর আগে অভিযানে মাথাভাঙ্গা এলাকা থেকে ওই লাইন কেটে দেয়া হয়। তখন থেকে রসুলপুর ও দৌলতপুরের লাইন অচল।’

সাইফুল বলেন, ‘বাঘাইয়াকান্দি তো দৌলতপুর থেকে অনেক দূর। প্রথমে ষোলআনী। ষোলআনীতে লাইন আসেনি। আগে ষোলআনী গ্যাস পেলে, পরে আমাদের গ্রামে আসতো।’

উপজেলা সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মুকুল খান সংবাদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অনেক আগে বৈদ্যেরগাঁও থেকে মাথাভাঙ্গা, রসুলপুর আর দৌলতপুরে গ্যাস লাইন টানা হয়েছিল। সেটা বন্ধ, তিন-চার বছর ধরে। তবে ইমামপুর, ষোলআনী, বাঘাইয়াকান্দি গ্রামে গ্যাসের কোন লাইনই যায়নি। মুকুল খান বলেন, এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলোর সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের এ জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত।

তিতাস গ্যাসের ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২২ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন ভাটেরচর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ লাইন উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর ফলে বৈদ্যেরগাঁও, মাথাভাঙ্গা, রসুলপুর, ইমামপুর, বাঘাবন্দি, ষোলআনী প্রভৃতি গ্রাম/ইউনিয়নের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এসব এলাকার বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে অবৈধ বিতরণ লাইন নির্মাণ করে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছিল। এই লাইন কাটার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার ১২ হাজার অবৈধ সংযোগ বন্ধ হয়েছে। যার মধ্যে আবাসিকের পাশাপাশি ছোট ছোট বাণিজ্যিক সংযোগও ছিল।

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, ২২ মে অভিযানে ভাটেরচর বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন এলাকা থেকে মেইন লাইন বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদের ফলে ভাটেরচর, মিরেরগাঁও, মিরপুর, টেঙ্গার চর আংশিক (ভিডারচর), উত্তর শাহপুর, বৈদ্যেরগাঁও গ্রামে নির্মাণ করা অন্তত ১০ কিলোমিটার অবৈধ লাইন বন্ধ হয়ে এবং প্রায় দুই হাজার অবৈধ আবাসিক গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ভাটেরচর-বৈদ্যারগাঁওয়ের লাইন কাটা হলেও স্থানীয় হোসেন্দী বাজারের পর থেকে তিন বছর আগে টানা অবৈধ গ্যাস লাইন এখনও চলছে। ওই লাইনটি সম্প্রতি আরও বর্ধিত হয়ে নাজিরচর হয়ে ফুলদি পর্যন্ত গেছে। সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে তিন-চার হাজারের মতো অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া, মেঘনা সেতুসংলগ্ন জামালদী বাসস্ট্যান্ডের পাশে বড় ভাটেরচর বেইলি ব্রিজ দিয়ে যাওয়া অবৈধ লাইনে ওপারের গ্রামেও অবৈধ গ্যাস চলছে।

যেসব গ্রামে লাইন টানা হয়নি, সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেগুলোর নাম আসা প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ কোন জবাব না দিলেও বিদ্যামান অবৈধ সংযোগের সংবাদকে বলেন, আমাদের অভিযান চলবে। শীঘ্রই অন্যান্য অবৈধ লাইন উচ্ছেদ করা হবে।

বুধবার, ২৬ মে ২০২১ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৩ শাওয়াল ১৪৪২

লাইন টানা হয় নাই! কাটলো কেমনে?

তিতাসের কাছে প্রশ্ন

ফয়েজ আহমেদ তুষার

‘আমাগো গেরামে তো গ্যাস লাইনই টানা অয় নাই! কাটলো কেমনে?’- অনেকটা অবাক সুরেই কথাগুলো বললেন ইমামপুর গ্রামের বাসিন্দা কবির নেকী। ইমামপুর গ্রামের গ্যাস লাইন কি কেটে দিয়েছে তিতাস? সংবাদের এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল তিনি এসব কথা বলেন।

পেশায় কৃষক কবীর বলেন, ‘মেইন রোডের লগে অনেক গেরামে গ্যাস আছে। আমাগো গেরামে তো নেতা অনেকÑ উপজেলা চেয়ারম্যান (সাবেক)-ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ মেম্বার। তবে কেউ গ্যাস লাইন আনার পক্ষে না। সবাই কয়- বদনাম অইব। সরকারের বেলকা লিস্টে (ব্ল্যাক লিস্টে) নাম আইবো। তাই ইমামপুরে গ্যাস আইয়ে নাই।’

সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদ অভিযান সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তির একটি অংশে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) উল্লেখ করে, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর, বাঘাবন্দি (বাঘাইয়াকান্দি) ষোলআনি গ্রামের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

অভিযোগ উঠেছে, তিতাস গ্যাসের (টিজিটিডিসিএল) বিজ্ঞপ্তিতে এমন অনেক গ্রামের নাম এসেছে, যেখানে কোন সময় অবৈধ গ্যাসের লাইন নির্মাণ করা হয়নি।

এ বিষয়ে খোঁজ নিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয় সংবাদের।

গজারিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেফায়েত উল্লাহ খান (তোতা) সংবাদকে বলেন, ‘আমি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে অনেকে আমার গ্রাম ইমামপুরে অবৈধ গ্যাস সংযোগ আনার বিষয়ে সুপারিশ করেছে। তবে আমি অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ছিলাম। এরপরও গজারিয়ার কিছু এলাকায় অবৈধ সংযোগ নেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। স্থানীয় ও রাজনৈতিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সব জায়গায় অবৈধ সংযোগ নেয়ার বিষয়টি বন্ধ রাখা যায়নি। তবে আমার গ্রামে আমি সংযোগ নিতে দেইনি।’

রেফায়েত উল্লাহ খান বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস কীভাবে একটি গ্রামকে অবৈধ সংযোগ নেয়ার তালিকাভুক্ত করে, যে গ্রামে কখনও অবৈধ গ্যাস সংযোগ যায়নি।’

পেশায় শিক্ষক বাঘাইয়াকান্দি গ্রামের সাইফুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বৈদ্যেরগাঁও থেকে একটি লাইন মাথাভাঙ্গা, রসুলপুর হয়ে দৌলতপুর পর্যন্ত এসেছিল। তবে বৈদ্যেরগাঁওয়ের পরের গ্রামগুলোতে রান্নার সময় গ্যাস পাওয়া যায় না, এমন অভিযোগে স্থানীয়দের বিবাদ চলছিল। বেশ কয়েক বছর আগে অভিযানে মাথাভাঙ্গা এলাকা থেকে ওই লাইন কেটে দেয়া হয়। তখন থেকে রসুলপুর ও দৌলতপুরের লাইন অচল।’

সাইফুল বলেন, ‘বাঘাইয়াকান্দি তো দৌলতপুর থেকে অনেক দূর। প্রথমে ষোলআনী। ষোলআনীতে লাইন আসেনি। আগে ষোলআনী গ্যাস পেলে, পরে আমাদের গ্রামে আসতো।’

উপজেলা সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মুকুল খান সংবাদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অনেক আগে বৈদ্যেরগাঁও থেকে মাথাভাঙ্গা, রসুলপুর আর দৌলতপুরে গ্যাস লাইন টানা হয়েছিল। সেটা বন্ধ, তিন-চার বছর ধরে। তবে ইমামপুর, ষোলআনী, বাঘাইয়াকান্দি গ্রামে গ্যাসের কোন লাইনই যায়নি। মুকুল খান বলেন, এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলোর সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের এ জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত।

তিতাস গ্যাসের ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২২ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন ভাটেরচর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ লাইন উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর ফলে বৈদ্যেরগাঁও, মাথাভাঙ্গা, রসুলপুর, ইমামপুর, বাঘাবন্দি, ষোলআনী প্রভৃতি গ্রাম/ইউনিয়নের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এসব এলাকার বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে অবৈধ বিতরণ লাইন নির্মাণ করে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছিল। এই লাইন কাটার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার ১২ হাজার অবৈধ সংযোগ বন্ধ হয়েছে। যার মধ্যে আবাসিকের পাশাপাশি ছোট ছোট বাণিজ্যিক সংযোগও ছিল।

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, ২২ মে অভিযানে ভাটেরচর বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন এলাকা থেকে মেইন লাইন বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদের ফলে ভাটেরচর, মিরেরগাঁও, মিরপুর, টেঙ্গার চর আংশিক (ভিডারচর), উত্তর শাহপুর, বৈদ্যেরগাঁও গ্রামে নির্মাণ করা অন্তত ১০ কিলোমিটার অবৈধ লাইন বন্ধ হয়ে এবং প্রায় দুই হাজার অবৈধ আবাসিক গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ভাটেরচর-বৈদ্যারগাঁওয়ের লাইন কাটা হলেও স্থানীয় হোসেন্দী বাজারের পর থেকে তিন বছর আগে টানা অবৈধ গ্যাস লাইন এখনও চলছে। ওই লাইনটি সম্প্রতি আরও বর্ধিত হয়ে নাজিরচর হয়ে ফুলদি পর্যন্ত গেছে। সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে তিন-চার হাজারের মতো অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া, মেঘনা সেতুসংলগ্ন জামালদী বাসস্ট্যান্ডের পাশে বড় ভাটেরচর বেইলি ব্রিজ দিয়ে যাওয়া অবৈধ লাইনে ওপারের গ্রামেও অবৈধ গ্যাস চলছে।

যেসব গ্রামে লাইন টানা হয়নি, সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেগুলোর নাম আসা প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ কোন জবাব না দিলেও বিদ্যামান অবৈধ সংযোগের সংবাদকে বলেন, আমাদের অভিযান চলবে। শীঘ্রই অন্যান্য অবৈধ লাইন উচ্ছেদ করা হবে।