মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি চান্দু মিয়া রিকশাচালকের বেশ ধরেও রক্ষা পায়নি

পাঁচ বছর পর সাভার থেকে গ্রেপ্তার

মসজিদের মোয়াজ্জিন থাকা অবস্থায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশে (জেএমবি) যোগদান করেন আবদুর রহমান ওরফে চান্দু মিয়া। সংগঠনের নির্দেশ অনুযায়ী রংপুরে মাজারের খাদেম রহমত আলীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যার মিশনে অংশগ্রহণ করেন। এরপর নিজেকে আড়াল করতে ছদ্মবেশ ধারণ করেন তিনি। কখনও রিকশা চালক, কখনও স্বল্প আয়ের কোন কাজ পেশা হিসেবে বেছে নেন। এমনকি নিজের নাম ঠিকানা পাল্টানোর পাশাপাশি বারবার অবস্থান পরিবর্তন করতেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার ৫ বছর পর গত সোমবার রাতে ঢাকা জেলার সাভারের গেন্ডা এলাকার কবরস্থানের পাশ থেকে খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। বর্তমানেও জেএমবির সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকলেও সক্রিয় ভূমিকায় ছিল না বলে জানিয়েছে এটিইউ। গতকাল রাজধানীর বারিধারায় এটিইউ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান এসব তথ্য জানান।

মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, গ্রেপ্তার জঙ্গি আবদুর রহমানের বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। তার শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লায়। কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার পর রিকশাচালকসহ বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধরেন তিনি। রংপুরের ঠিকানা পাল্টে ব্যবহার করতেন শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা। মূলতো ওই শ্বশুরবাড়ির সূত্র ধরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবদুর রহমান জানিয়েছেন, একটি মসজিদে মোয়াজ্জিন থাকাকালীন সময়ে জেএমবিতে যোগদান করেন তিনি। তখন তার বয়স ছিল ১৮-১৯ বছর। তিনি নিজে খাদেম রহমত আলীকে কুপিয়েছেন। এরপরেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে ছদ্মবেশ ধারণ করেন।

পালিয়ে থাকা সময়ে সংগঠন তাকে কোন সহযোগিতা করেনি জানিয়ে আবদুর রহমান আরও জানিয়েছেন, তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেএমবির ইসাবা গ্রুপের সদস্য। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জেএমবির কয়েকজন সদস্যের নাম জানা গেছে যারা বর্তমানে গোপনে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। খাদেম রহমত আলী হত্যায় কয়েকজন স্থানীয় অর্থায়ন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন আবদুর রহমান।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে এটিইউ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, খাদেম রহমত আলী শরীয়তপুরের ‘সুরেশ্বরী’ তরিকা পালন করতেন। বাড়ির পাশে তার বাবা-মার কবরকে মাজার ঘোষণা করেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে মাজার ও মসজিদসংলগ্ন একটি দরবার শরিফ গড়ে প্রতি বৃহস্পতিবার সুরেশ্বরী তরিকা মোতাবেক অনুসারীদের নিয়ে জিকির করতেন। রহমত আলীর এসব কর্মকাণ্ড জেএমবি সদস্যদের নজরে আসে। তাদের দাবি অনুযায়ী রহমত আলী একজন ভণ্ড পীর, শিরককারী এবং দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তাকে হত্যা করা আবশ্যক। তাই জেএমবি সদস্যরা খাদেম রহমত আলীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করে। খাদেম রহমত আলী হত্যার পর কাউনিয়া থানায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় আবদুর রহমানকে আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে জানান এটিইউয়ের এ কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের চৈতার মোড়ে মাজারের খাদেম রহমত আলীকে (৬০) হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় নিহতের ছেলে শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে কাউনিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মামুন অর রশীদ রংপুরে জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুনসহ ১৪ জঙ্গির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। পরের বছর ১৮ মার্চ রংপুরের বিশেষ জজ আদালতের বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার ওই মামলায় ৬ জনকে খালাস ও ৭ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আবদুর রহমান ব্যতীত বাকি সবাই বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে রয়েছেন। তারা হলো, মো. মাসুদ রানা ওরফে মন্ত্রী, বিজয় ওরফে মো. মোহাদ্দেস আলী ওরফে দর্জি, মো. লিটন মিয়া ওরফে রফিক, মো. ইসাহাক আলী, মো. সাখাওয়াত হোসেন ওরফে শফিক, মো. সারোয়ার হোসাইন ওরফে মিজান ওরফে ড্রাইভার। এদের মধ্যে মাসুদ রানা, এছাহাক আলী, লিটন মিয়া ও সাখাওয়াত হোসেন রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যা মামলারও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

বুধবার, ২৬ মে ২০২১ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৩ শাওয়াল ১৪৪২

রংপুরে খাদেম হত্যা

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি চান্দু মিয়া রিকশাচালকের বেশ ধরেও রক্ষা পায়নি

পাঁচ বছর পর সাভার থেকে গ্রেপ্তার

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

মসজিদের মোয়াজ্জিন থাকা অবস্থায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশে (জেএমবি) যোগদান করেন আবদুর রহমান ওরফে চান্দু মিয়া। সংগঠনের নির্দেশ অনুযায়ী রংপুরে মাজারের খাদেম রহমত আলীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যার মিশনে অংশগ্রহণ করেন। এরপর নিজেকে আড়াল করতে ছদ্মবেশ ধারণ করেন তিনি। কখনও রিকশা চালক, কখনও স্বল্প আয়ের কোন কাজ পেশা হিসেবে বেছে নেন। এমনকি নিজের নাম ঠিকানা পাল্টানোর পাশাপাশি বারবার অবস্থান পরিবর্তন করতেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার ৫ বছর পর গত সোমবার রাতে ঢাকা জেলার সাভারের গেন্ডা এলাকার কবরস্থানের পাশ থেকে খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। বর্তমানেও জেএমবির সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকলেও সক্রিয় ভূমিকায় ছিল না বলে জানিয়েছে এটিইউ। গতকাল রাজধানীর বারিধারায় এটিইউ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান এসব তথ্য জানান।

মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, গ্রেপ্তার জঙ্গি আবদুর রহমানের বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। তার শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লায়। কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার পর রিকশাচালকসহ বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধরেন তিনি। রংপুরের ঠিকানা পাল্টে ব্যবহার করতেন শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা। মূলতো ওই শ্বশুরবাড়ির সূত্র ধরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবদুর রহমান জানিয়েছেন, একটি মসজিদে মোয়াজ্জিন থাকাকালীন সময়ে জেএমবিতে যোগদান করেন তিনি। তখন তার বয়স ছিল ১৮-১৯ বছর। তিনি নিজে খাদেম রহমত আলীকে কুপিয়েছেন। এরপরেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে ছদ্মবেশ ধারণ করেন।

পালিয়ে থাকা সময়ে সংগঠন তাকে কোন সহযোগিতা করেনি জানিয়ে আবদুর রহমান আরও জানিয়েছেন, তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেএমবির ইসাবা গ্রুপের সদস্য। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জেএমবির কয়েকজন সদস্যের নাম জানা গেছে যারা বর্তমানে গোপনে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। খাদেম রহমত আলী হত্যায় কয়েকজন স্থানীয় অর্থায়ন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন আবদুর রহমান।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে এটিইউ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, খাদেম রহমত আলী শরীয়তপুরের ‘সুরেশ্বরী’ তরিকা পালন করতেন। বাড়ির পাশে তার বাবা-মার কবরকে মাজার ঘোষণা করেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে মাজার ও মসজিদসংলগ্ন একটি দরবার শরিফ গড়ে প্রতি বৃহস্পতিবার সুরেশ্বরী তরিকা মোতাবেক অনুসারীদের নিয়ে জিকির করতেন। রহমত আলীর এসব কর্মকাণ্ড জেএমবি সদস্যদের নজরে আসে। তাদের দাবি অনুযায়ী রহমত আলী একজন ভণ্ড পীর, শিরককারী এবং দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তাকে হত্যা করা আবশ্যক। তাই জেএমবি সদস্যরা খাদেম রহমত আলীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করে। খাদেম রহমত আলী হত্যার পর কাউনিয়া থানায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় আবদুর রহমানকে আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে জানান এটিইউয়ের এ কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের চৈতার মোড়ে মাজারের খাদেম রহমত আলীকে (৬০) হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় নিহতের ছেলে শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে কাউনিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মামুন অর রশীদ রংপুরে জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুনসহ ১৪ জঙ্গির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। পরের বছর ১৮ মার্চ রংপুরের বিশেষ জজ আদালতের বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার ওই মামলায় ৬ জনকে খালাস ও ৭ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আবদুর রহমান ব্যতীত বাকি সবাই বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে রয়েছেন। তারা হলো, মো. মাসুদ রানা ওরফে মন্ত্রী, বিজয় ওরফে মো. মোহাদ্দেস আলী ওরফে দর্জি, মো. লিটন মিয়া ওরফে রফিক, মো. ইসাহাক আলী, মো. সাখাওয়াত হোসেন ওরফে শফিক, মো. সারোয়ার হোসাইন ওরফে মিজান ওরফে ড্রাইভার। এদের মধ্যে মাসুদ রানা, এছাহাক আলী, লিটন মিয়া ও সাখাওয়াত হোসেন রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যা মামলারও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।