খীরু নদী দখল-দূষণে মৃতপ্রায় হুমকিতে পরিবেশ মৎস্যসম্পদ

ভালুকা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খীরু নদীতে বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরি হতে বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি আর প্রভাবশালীদের দখলে খাল বিল চলে যাওয়ায় দেশীয় প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছ সম্পুর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এতে যেমন এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ হারিয়ে আমিষ জাতীয় খাদ্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবী জেলেরাও আয় রোজগারের পথ হারিয়ে অন্য পেশার দিকে ছুটতে বাধ্য হচ্ছে। শুকনা মৌসুমে উপজেলার ভালুকা, ভরাডোবা ও হবিরবাড়ী ইউনিয়নের জামিরদিয়া ও কাশর এলাকার অসংখ্য ডাইং মিল থেকে বিরামহীন দুর্গন্ধযুক্ত ঘন কালোপানি লাউতি খাল দিয়ে খীরু নদীতে নামায় পানি বিষাক্ত হয়ে মাছ সহ সকল রকম পোকা মাকর মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানায় নদীর কিনারসহ মাটি আলকাতরার মতো কিচকিচে কালো হয়ে গেছে। এসব কালো পানিতে নামলে শরীরে চুলকানিসহ নানা রকম চর্ম রোগের সৃষ্টি হয়।

অভিজ্ঞজনের মতে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে মিল ফ্যক্টরির বর্জ্য পানির সঙ্গে খাল বিল ও প্লাবন ভূমিতে বাঁধ দিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য চাষ, খীরু নদীর সাথে খাল বিলের সংযোগ স্থলে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহের গতিপথ অবরুদ্ধ করা বিলের কচুরিপানা ও ঘাস পরিষ্কার করে মাছের প্রজনন ও আবাস স্থল নষ্ট করে ফেলা উল্লেখযোগ্য কারণ। গ্রাম এলাকার খাল বিল ও প্লাবন ভূমিগুলো ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য চাষ হওয়ার কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো আর জন্মাতে পারছে না। ফলে সারাবছর মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরা হতে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার জনসাধারণ। এক সময় বর্ষা এলে খীরু নদীর মিঠা পানিতে পাওয়া যেত অনেক প্রজাতির সুস্বাদু দেশীয় মাছ। যেমন রুই, কাতল, বাউস, কালি বাউস, বোয়াল, গোলসা, টেংরা, কাচকি, চাপিলা, পাবদা, বাইলা, বড় বাইন, তারা বাইন, মলা, ঢেলা, ছেলা, বাঘাই, আইড়, বাছা, বড়চিংড়ি, বাইলা, কাইক্কা আরো অনেক প্রজাতির মাছ। বর্ষা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব মাছ প্রচুর ধরা পরতো জেলেদের জালে। এলাকার সব মানুষ ইচ্ছেমতো মাছ ধরায় মেতে উঠতো। শুকনা মৌসুমে ডোবা খাল বিলে পাওয়া যেত শিং, মাগুর, কৈ, শোল, গজার, টাকি, ফইলা, খৈলা, ভেদা, ছোট চিংড়ি, পুটি, টেংরা ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলের যেখানেই ছোট বড় জলাশয় চোখে পরতো সেখানেই এসব মাছ পাওয়া যেত। অথচ ওইসব জলাশয় প্রভাবশালীরা কৌশলে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে পোকা মাকড় মারার অজুহাতে বিষঢেলে দেশীয় প্রজাতির মাছ ধ্বংস করে তাতে থাই পাঙ্গাসের চাষ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অপরদিকে মলা ঢেলা শিং মাগুর ও কৈ মাছের মতো আমিষ জাতীয় খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার নারী শিশুসহ সর্ব সাধারণ। প্রসূতিপর মায়েদের শরীর স্বাস্থ্য পুনর্গঠনে শিং মাছ ও কাঁচা কলার ঝোল রান্না করে খাওয়ানো একটি উত্তম সেবার মধ্যে থাকত। শিশুদের চোখের জ্যোতি বাড়াতে মলা ঢেলা মাছ খাওয়ানোর জন্য ডাক্তার পরামর্শ দিতেন। এক কথায় প্রাকৃতিক উপায়ে এসব মাছ এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। মৎস্য অধিদপ্তরের উদ্ভাবিত কয়েক প্রজাতির মাছ বিভিন্ন খামারে চাষ হলেও চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। তাছাড়া অধিক মূল্যের কারণে এসব মাছ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ৬০০ টাকা কেজি শিং, ৮০০ টাকা কেজি পাবদা, ৬০০ টাকা দেশি ছোট চিংড়ি,৬০০ টাকা কেজি মলা মাছ কিনে খাওয়া এখন গরিব ও মধ্যবিত্তদের জন্য বিলাসিতার শামিল। উপজেলার ভরাডোবা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুস সোবান (৭০) জানান বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে যখন বৃষ্টি হতো তখন বিলের কচুরিপানার নীচ থেকে শিং, মাগুর, কৈ, মাছ পানির ঢল পেয়ে ডাঙ্গায় উঠতে শুরু করলে ছেলে বুড়ো সবাই মেতে উঠতেন মাছ ধরায়। গ্রামের প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হতো উজাই মাছ ধরা। আবার অতি বৃষ্টি হলে খাল নালা দিয়ে পানি নামার সময় হাত জাল দিয়ে মাছ ধরায় মেতে উঠতো সকলে। গ্রামের খালে বিলে বর্ষার নতুন পানিতে বরশি দিয়ে লাল টেংড়া, পুটি পাবদা, শিং কৈ মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠতো সবাই।

ময়মনসিংহ বিভাগ কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক শাহ মো. আশরাফুল হক জর্জ জানান খীরু নদী হতে অসংখ্য সংযোগ খাল দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বিল ও ডোবায় পানি প্রবাহিত হয়। দেশীয় প্রজাতির মাছের আবাস ও প্রজনন স্থল খীরু নদীতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ডাইং মিল হতে দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি নামার কারণে কিছুদিন পূর্বেও ডিমওয়ালা মা মাছসহ সব ধরনের মাছ মরে ভেসে উঠে। এসব কারণে ভালুকায় দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান মিল কারখানা হতে ইটিপির মাধ্যমে বর্জ্য পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেললে দেশীয় প্রজাতির মাছ গুলি ফিরে পাওয়া সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি সচেতন মহলের দাবি দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য প্রজনন স্থল সরকারি জল মহাল ও প্লাবন ভূমি মুক্ত জলাশয়গুলো প্রভাবশালীদের হাত থেকে উদ্ধার করে উন্মুক্ত রাখা ও মিল কারখানার বর্জ্যপানি নদীখালে ফেলা বন্ধ হলে পুনরায় নানা প্রজাতির দেশীয় মাছে ভরে উঠবে নদী নালা খাল বিল।

শুক্রবার, ২৮ মে ২০২১ , ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৫ শাওয়াল ১৪৪২

খীরু নদী দখল-দূষণে মৃতপ্রায় হুমকিতে পরিবেশ মৎস্যসম্পদ

আতাউর রহমান তরফদার, ভালুকা (ময়মনসিংহ)

image

ভালুকা (ময়মনসিংহ) : কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্যে খীরু নদীর পানি দূষণের কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ -সংবাদ

ভালুকা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খীরু নদীতে বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরি হতে বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি আর প্রভাবশালীদের দখলে খাল বিল চলে যাওয়ায় দেশীয় প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছ সম্পুর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এতে যেমন এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ হারিয়ে আমিষ জাতীয় খাদ্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবী জেলেরাও আয় রোজগারের পথ হারিয়ে অন্য পেশার দিকে ছুটতে বাধ্য হচ্ছে। শুকনা মৌসুমে উপজেলার ভালুকা, ভরাডোবা ও হবিরবাড়ী ইউনিয়নের জামিরদিয়া ও কাশর এলাকার অসংখ্য ডাইং মিল থেকে বিরামহীন দুর্গন্ধযুক্ত ঘন কালোপানি লাউতি খাল দিয়ে খীরু নদীতে নামায় পানি বিষাক্ত হয়ে মাছ সহ সকল রকম পোকা মাকর মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানায় নদীর কিনারসহ মাটি আলকাতরার মতো কিচকিচে কালো হয়ে গেছে। এসব কালো পানিতে নামলে শরীরে চুলকানিসহ নানা রকম চর্ম রোগের সৃষ্টি হয়।

অভিজ্ঞজনের মতে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে মিল ফ্যক্টরির বর্জ্য পানির সঙ্গে খাল বিল ও প্লাবন ভূমিতে বাঁধ দিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য চাষ, খীরু নদীর সাথে খাল বিলের সংযোগ স্থলে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহের গতিপথ অবরুদ্ধ করা বিলের কচুরিপানা ও ঘাস পরিষ্কার করে মাছের প্রজনন ও আবাস স্থল নষ্ট করে ফেলা উল্লেখযোগ্য কারণ। গ্রাম এলাকার খাল বিল ও প্লাবন ভূমিগুলো ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য চাষ হওয়ার কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো আর জন্মাতে পারছে না। ফলে সারাবছর মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরা হতে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার জনসাধারণ। এক সময় বর্ষা এলে খীরু নদীর মিঠা পানিতে পাওয়া যেত অনেক প্রজাতির সুস্বাদু দেশীয় মাছ। যেমন রুই, কাতল, বাউস, কালি বাউস, বোয়াল, গোলসা, টেংরা, কাচকি, চাপিলা, পাবদা, বাইলা, বড় বাইন, তারা বাইন, মলা, ঢেলা, ছেলা, বাঘাই, আইড়, বাছা, বড়চিংড়ি, বাইলা, কাইক্কা আরো অনেক প্রজাতির মাছ। বর্ষা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব মাছ প্রচুর ধরা পরতো জেলেদের জালে। এলাকার সব মানুষ ইচ্ছেমতো মাছ ধরায় মেতে উঠতো। শুকনা মৌসুমে ডোবা খাল বিলে পাওয়া যেত শিং, মাগুর, কৈ, শোল, গজার, টাকি, ফইলা, খৈলা, ভেদা, ছোট চিংড়ি, পুটি, টেংরা ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলের যেখানেই ছোট বড় জলাশয় চোখে পরতো সেখানেই এসব মাছ পাওয়া যেত। অথচ ওইসব জলাশয় প্রভাবশালীরা কৌশলে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে পোকা মাকড় মারার অজুহাতে বিষঢেলে দেশীয় প্রজাতির মাছ ধ্বংস করে তাতে থাই পাঙ্গাসের চাষ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অপরদিকে মলা ঢেলা শিং মাগুর ও কৈ মাছের মতো আমিষ জাতীয় খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার নারী শিশুসহ সর্ব সাধারণ। প্রসূতিপর মায়েদের শরীর স্বাস্থ্য পুনর্গঠনে শিং মাছ ও কাঁচা কলার ঝোল রান্না করে খাওয়ানো একটি উত্তম সেবার মধ্যে থাকত। শিশুদের চোখের জ্যোতি বাড়াতে মলা ঢেলা মাছ খাওয়ানোর জন্য ডাক্তার পরামর্শ দিতেন। এক কথায় প্রাকৃতিক উপায়ে এসব মাছ এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। মৎস্য অধিদপ্তরের উদ্ভাবিত কয়েক প্রজাতির মাছ বিভিন্ন খামারে চাষ হলেও চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। তাছাড়া অধিক মূল্যের কারণে এসব মাছ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ৬০০ টাকা কেজি শিং, ৮০০ টাকা কেজি পাবদা, ৬০০ টাকা দেশি ছোট চিংড়ি,৬০০ টাকা কেজি মলা মাছ কিনে খাওয়া এখন গরিব ও মধ্যবিত্তদের জন্য বিলাসিতার শামিল। উপজেলার ভরাডোবা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুস সোবান (৭০) জানান বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে যখন বৃষ্টি হতো তখন বিলের কচুরিপানার নীচ থেকে শিং, মাগুর, কৈ, মাছ পানির ঢল পেয়ে ডাঙ্গায় উঠতে শুরু করলে ছেলে বুড়ো সবাই মেতে উঠতেন মাছ ধরায়। গ্রামের প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হতো উজাই মাছ ধরা। আবার অতি বৃষ্টি হলে খাল নালা দিয়ে পানি নামার সময় হাত জাল দিয়ে মাছ ধরায় মেতে উঠতো সকলে। গ্রামের খালে বিলে বর্ষার নতুন পানিতে বরশি দিয়ে লাল টেংড়া, পুটি পাবদা, শিং কৈ মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠতো সবাই।

ময়মনসিংহ বিভাগ কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক শাহ মো. আশরাফুল হক জর্জ জানান খীরু নদী হতে অসংখ্য সংযোগ খাল দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বিল ও ডোবায় পানি প্রবাহিত হয়। দেশীয় প্রজাতির মাছের আবাস ও প্রজনন স্থল খীরু নদীতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ডাইং মিল হতে দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি নামার কারণে কিছুদিন পূর্বেও ডিমওয়ালা মা মাছসহ সব ধরনের মাছ মরে ভেসে উঠে। এসব কারণে ভালুকায় দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান মিল কারখানা হতে ইটিপির মাধ্যমে বর্জ্য পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেললে দেশীয় প্রজাতির মাছ গুলি ফিরে পাওয়া সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি সচেতন মহলের দাবি দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য প্রজনন স্থল সরকারি জল মহাল ও প্লাবন ভূমি মুক্ত জলাশয়গুলো প্রভাবশালীদের হাত থেকে উদ্ধার করে উন্মুক্ত রাখা ও মিল কারখানার বর্জ্যপানি নদীখালে ফেলা বন্ধ হলে পুনরায় নানা প্রজাতির দেশীয় মাছে ভরে উঠবে নদী নালা খাল বিল।