সাংবাদিক নির্যাতনকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল

অবশেষে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম মুক্তি পেলেন। দেরিতে হলেও সরকার ও বিচার বিভাগের বোধোদয় ঘটেছ। রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও গ্রেফতারের ঘটনায় খোদ জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তার মুক্তির দাবিতে গোটা দেশের সব সাংবাদিক সংগঠনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান ও মানববন্ধন করেছিলেন।

কিন্তু রোজিনাকে যারা নাজেহাল করে দেশে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তাদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে বলে কোনো খবর নজরে আসেনি। মাননীয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, বর্তমান সরকার সাংবাদিকবান্ধব সরকার। সরকারের সঙ্গে সাংবাদিকদের দূরত্ব সৃষ্টি করার জন্যই একটি মহলের এ অপচেষ্টা। ভালো কথা- যদি তারা এ সত্যটি উপলব্ধি করে থাকেন তাহলে যারা এ অপচেষ্টাটির হোতা তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? কিসের দুর্বলতা তাদের প্রতি? কেন এত নমনীয়তা?

সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আজকাল বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রোজিনা ইসলামের ঘটনাটিই সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ক্ষমতার ঘোল খেয়ে যে কোন বিষয়ে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দিয়েছে সরকারি চাকরিজীবীদের একটি বিরাট অংশে। এরা যে জনগণের সেবক, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় এদের সংসার চলে- সে কথাটি বেমালুম ভুলে যায়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে যে দায়বদ্ধতা, বিনয়, শিষ্টাচার ও নাগরিকপ্রীতি থাকার কথা তার কিছুই তাদের মধ্যে দেখা যায় না। পিয়ন থেকে সচিব পর্যন্ত এর সিংহ ভাগই এ দোষে দুষ্ট। নিজেদের ক্ষমতার তালুকদার ভেবে জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। রোজিনা ইসলামকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করাটা মূলত এ রেওয়াজেরই অংশ।

সাংবাদিক হেনস্তা হওয়ার ঘটনা কোনো নতুন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরেই সাংবাদিকরা নিপীড়িত ও নির্যাতিত হয়ে আসছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো কখনো তাদের পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে, কখনো প্রাণ দিতে হয়েছে। এসব উদাহরণের কোনো শেষ নেই। কিছুদিন আগেও দৈনিক সংবাদের এক সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একদল দুর্বৃত্ত কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হন। মরার মুখ থেকে ভদ্রলোক ফিরে আসেন। এমন হাজারো ঘটনা অহরহ ঘটছে। সুতরাং সাংবাদিকের মার খাওয়া, গালমন্দ খাওয়া- এসব এখন গা-সওয়া ব্যাপার। রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যা ঘটেছে তা যদি কোন সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত, বিশেষ বাহিনী বা কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা ঘটতো তাহলে এটাকেও আমি ‘গা-সওয়া’ ঘটনার তালিকায় রাখতাম। কিন্তু তিনি কোনো দুর্বৃত্ত বা সন্ত্রাসী নয়, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন সচিবালয়ের মতো একটি এলিট জায়গায় রাজন্য ব্যক্তিদের দ্বারা। যেখানে মন্ত্রীরা বসেন, সরকারের আমলারা বসেন- সেখানে যদি এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে তবে কী দেশের মান থাকে?

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাদের অভিযোগ সত্য- তাহলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ এনে যে মামলা করা হয়েছিল তা কেন তাৎক্ষণিকভাবেই করা হয়নি? কেন ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হলো? সচিবালয়ে কর্মরত যে ব্যক্তি তার গলা চেপে ধরেছিলেন তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? কে তার মোবাইল ফোন কেড়ে নিলেন?

সাংবাদিক নির্যাতনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল তাদের সবাইকে সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। গুটিকয়েক ব্যক্তির অপকর্মের দায়ভার সরকার কেন বহন করবে? সাংবাদিক নির্যাতনকারীদের হাত যতই লম্বা হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ধৃষ্টতা দেখাতে না পারে।

[লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী]

শুক্রবার, ২৮ মে ২০২১ , ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৫ শাওয়াল ১৪৪২

সাংবাদিক নির্যাতনকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল

অবশেষে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম মুক্তি পেলেন। দেরিতে হলেও সরকার ও বিচার বিভাগের বোধোদয় ঘটেছ। রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও গ্রেফতারের ঘটনায় খোদ জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তার মুক্তির দাবিতে গোটা দেশের সব সাংবাদিক সংগঠনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান ও মানববন্ধন করেছিলেন।

কিন্তু রোজিনাকে যারা নাজেহাল করে দেশে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তাদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে বলে কোনো খবর নজরে আসেনি। মাননীয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, বর্তমান সরকার সাংবাদিকবান্ধব সরকার। সরকারের সঙ্গে সাংবাদিকদের দূরত্ব সৃষ্টি করার জন্যই একটি মহলের এ অপচেষ্টা। ভালো কথা- যদি তারা এ সত্যটি উপলব্ধি করে থাকেন তাহলে যারা এ অপচেষ্টাটির হোতা তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? কিসের দুর্বলতা তাদের প্রতি? কেন এত নমনীয়তা?

সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আজকাল বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রোজিনা ইসলামের ঘটনাটিই সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ক্ষমতার ঘোল খেয়ে যে কোন বিষয়ে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দিয়েছে সরকারি চাকরিজীবীদের একটি বিরাট অংশে। এরা যে জনগণের সেবক, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় এদের সংসার চলে- সে কথাটি বেমালুম ভুলে যায়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে যে দায়বদ্ধতা, বিনয়, শিষ্টাচার ও নাগরিকপ্রীতি থাকার কথা তার কিছুই তাদের মধ্যে দেখা যায় না। পিয়ন থেকে সচিব পর্যন্ত এর সিংহ ভাগই এ দোষে দুষ্ট। নিজেদের ক্ষমতার তালুকদার ভেবে জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। রোজিনা ইসলামকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করাটা মূলত এ রেওয়াজেরই অংশ।

সাংবাদিক হেনস্তা হওয়ার ঘটনা কোনো নতুন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরেই সাংবাদিকরা নিপীড়িত ও নির্যাতিত হয়ে আসছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো কখনো তাদের পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে, কখনো প্রাণ দিতে হয়েছে। এসব উদাহরণের কোনো শেষ নেই। কিছুদিন আগেও দৈনিক সংবাদের এক সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একদল দুর্বৃত্ত কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হন। মরার মুখ থেকে ভদ্রলোক ফিরে আসেন। এমন হাজারো ঘটনা অহরহ ঘটছে। সুতরাং সাংবাদিকের মার খাওয়া, গালমন্দ খাওয়া- এসব এখন গা-সওয়া ব্যাপার। রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যা ঘটেছে তা যদি কোন সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত, বিশেষ বাহিনী বা কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা ঘটতো তাহলে এটাকেও আমি ‘গা-সওয়া’ ঘটনার তালিকায় রাখতাম। কিন্তু তিনি কোনো দুর্বৃত্ত বা সন্ত্রাসী নয়, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন সচিবালয়ের মতো একটি এলিট জায়গায় রাজন্য ব্যক্তিদের দ্বারা। যেখানে মন্ত্রীরা বসেন, সরকারের আমলারা বসেন- সেখানে যদি এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে তবে কী দেশের মান থাকে?

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাদের অভিযোগ সত্য- তাহলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ এনে যে মামলা করা হয়েছিল তা কেন তাৎক্ষণিকভাবেই করা হয়নি? কেন ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হলো? সচিবালয়ে কর্মরত যে ব্যক্তি তার গলা চেপে ধরেছিলেন তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? কে তার মোবাইল ফোন কেড়ে নিলেন?

সাংবাদিক নির্যাতনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল তাদের সবাইকে সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। গুটিকয়েক ব্যক্তির অপকর্মের দায়ভার সরকার কেন বহন করবে? সাংবাদিক নির্যাতনকারীদের হাত যতই লম্বা হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ধৃষ্টতা দেখাতে না পারে।

[লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী]