মানবসম্পদ উন্নয়নে চাই মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির সহায়ক শক্তি হিসেবে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিকাশ জরুরি হলেও এর বিকাশ তেমনটি ঘটেনি। তাই দেশে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে ক্রমশ ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে বেকারত্বের হার। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সম্ভাবনাময় তরুণসমাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি কার্যক্রম অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। অদক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণও হ্রাস পাচ্ছে। অথচ বেশি সংখ্যক মধ্যম স্তরের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণকারী প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রেরণ করা গেলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় অনেক বেড়ে যেতে পারে, দেশ মুক্তি পেতে পারে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে।

বর্তমানে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার অধীনে শিক্ষা গ্রহণরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক কম। জাপানে এ ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলের শতকরা হার ৬০ ভাগের বেশি, দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে ৪০% এবং মালয়েশিয়ায় ২৫%। এ সংখ্যা হয়ত আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর আশানুরূপ বিকাশও ঘটেনি। শিক্ষক স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত এবং পুরোনো যন্ত্রপাতি, মানহীন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আজ এ শিক্ষা ব্যবস্থার আশানুরূপ বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়নি। ফলে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের সম্ভাবনা ক্রমশ হতাশায় পর্যবসিত হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড। অথচ দেশের উন্নয়নের ধারা সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্নাতক প্রকৌশলীর পাশাপাশি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও দক্ষ শ্রমপোযোগী জনশক্তি বিশেষ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই তিন ধরনের পেশাজীবীর গ্রহণযোগ্য অনুপাত ১:৫:২৫ হলেও বাংলাদেশে তা নেই। স্নাতক প্রকৌশলীর অনুপাতে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং দক্ষমানের কোর্স সম্পন্নকারী শ্রমপোযোগী জনগোষ্ঠী রয়েছে অনেক কম। অথচ স্নাতক প্রকৌশলীদের কর্মপরিকল্পনাকে সঠিকভাবে দেখাশোনা ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও জনবল কাঠামো।

দেশে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্র আগের চেয়ে উন্মুক্ত হলেও তা আশানুরূপ নয়। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নির্ধারিত প্রকৌশল বিষয়সমূহ ছাড়াও কারিগরি শিক্ষার অধীনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কৃষি ডিপ্লোমা, টেক্সটাইল, মেরিন, মেডিকেল টেকনোলজি, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক্স ও গ্রাফিক আর্টস রয়েছে। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় মধ্যম স্তরের ডিপ্লোমা প্রকৌশল শিক্ষার জন্য মোট ৫০টি পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ছয়টি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট ও একটি সার্ভে ইনস্টিটিউট রয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) পর্যায়ের শিক্ষার জন্য রয়েছে ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এছাড়া বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিস্তারে রয়েছে ৩৮টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ৪০টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল কলেজ, ১৩টি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট।

কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারে বাংলাদেশে আরও চার হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসবের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে কারিগরি শিক্ষা বিভাগের কঠোর তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কেননা ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়া শুধু কাগুজে সনদ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের নেতিবাচক ফল গোটা দেশ ও জাতিকে ভোগ করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, টেলিকমিউনিকেশনের মতো সময়োপযোগী বিষয়সমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। অথচ এসব কোর্সে পাঠদানের জন্য বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে এসব শিক্ষায়তনে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থাও সম্প্রসারিত হয়নি। ২০০১ সাল থেকে প্রকৌশল ডিপ্লোমা কোর্স ৩ বছর থেকে ৪ বছরে উন্নীত করা হলেও নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রণীত পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন পাঠ্য পুস্তক সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়নি। ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রমে ৬০% ব্যবহারিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের অভাবে ব্যবহারিক ক্লাস পরিচালনায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়াই প্রকৌশল ডিপ্লোমা সনদ নিয়ে বাস্তব জীবনে প্রবেশ করে কর্মক্ষেত্রে নানারূপ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ২০২০ সালের মধ্যে করিগরি শিক্ষায়তনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেশের মোট শিক্ষার্থীর শতকরা ২০ ভাগে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশ-বিদেশের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউগুলোতে যুগোপযোগী নিত্যনতুন টেকনোলজি বা বিভাগ চালু করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৫ শতাংশ আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত রয়েছে।

পলিটেকনিক গ্র্যাজুয়েটদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এ লক্ষ্যে তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা প্রয়োজন। তাদের জন্য বিদেশে কর্মসংস্থানের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করার জোর তৎপরতা চালানো জরুরি। অদক্ষ জনশক্তির চেয়ে কারিগরি শিক্ষায় পারদর্শী জনবল বিদেশে পাঠাতে পারলে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমান ২/৩ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশে দক্ষ জনশক্তির প্রসার ঘটাতে ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে সারাদেশের বর্তমান কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক মানোন্নয়ন অত্যাবশ্যক। দেশের বর্তমান কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রতিটি জেলায় আধুনিক মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা প্রয়োজন। সব সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অবিলম্বে শিক্ষকের সব শূন্য পদ পূরণ এবং নতুন পদ সৃষ্টি করে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দান করা বিশেষ জরুরি। ৪-বছর মেয়াদি প্রকৌশল ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রম অনুসারে পর্যাপ্তসংখ্যক পাঠ্যপুস্তক এবং ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য উন্নত মানের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করা ছাড়া মানসম্পন্ন শিক্ষাদান সম্ভব নয়। তেজগাঁস্থ টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজকে সম্প্রসারিত করে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

কারিগরি শিক্ষার্থীদের শিল্প কারখানায় বাস্তব প্রশিক্ষণকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে কারখানা মালিককের উদ্ভুদ্ধ করতে শিক্ষা বিভাগকে উদ্যোগী হতে হবে। কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং সেলের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা অত্যাবশ্যক। মধ্যম স্তরের প্রকৌশলীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও কাজের সঠিক মূল্যায়নসহ দেশের উন্নয়নের ধারায় তাদের অধিকতর সম্পৃক্ত করা হলে তা দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়ক হবে যা পক্ষান্তরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে জনগণকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসাবে গড়ে তুলতে কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়ন জরুরি। বর্তমান সরকারের দিন বদলের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের যথাযথ অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে মধ্যম স্তরের কারিগরি শিক্ষা বিকাশের ধারা গতিশীল করা জরুরি। আগামীর বিশ্ব শ্রমবাজারে টিকে থাকতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে যুগোপযোগী, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে তুলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা গেলে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে আগামীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সহায়তা করবে।

[লেখক : সাবেক প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

শুক্রবার, ২৮ মে ২০২১ , ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৫ শাওয়াল ১৪৪২

মানবসম্পদ উন্নয়নে চাই মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

image

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির সহায়ক শক্তি হিসেবে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিকাশ জরুরি হলেও এর বিকাশ তেমনটি ঘটেনি। তাই দেশে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে ক্রমশ ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে বেকারত্বের হার। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সম্ভাবনাময় তরুণসমাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি কার্যক্রম অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। অদক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণও হ্রাস পাচ্ছে। অথচ বেশি সংখ্যক মধ্যম স্তরের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণকারী প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রেরণ করা গেলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় অনেক বেড়ে যেতে পারে, দেশ মুক্তি পেতে পারে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে।

বর্তমানে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার অধীনে শিক্ষা গ্রহণরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক কম। জাপানে এ ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলের শতকরা হার ৬০ ভাগের বেশি, দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে ৪০% এবং মালয়েশিয়ায় ২৫%। এ সংখ্যা হয়ত আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর আশানুরূপ বিকাশও ঘটেনি। শিক্ষক স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত এবং পুরোনো যন্ত্রপাতি, মানহীন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আজ এ শিক্ষা ব্যবস্থার আশানুরূপ বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়নি। ফলে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের সম্ভাবনা ক্রমশ হতাশায় পর্যবসিত হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড। অথচ দেশের উন্নয়নের ধারা সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্নাতক প্রকৌশলীর পাশাপাশি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও দক্ষ শ্রমপোযোগী জনশক্তি বিশেষ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই তিন ধরনের পেশাজীবীর গ্রহণযোগ্য অনুপাত ১:৫:২৫ হলেও বাংলাদেশে তা নেই। স্নাতক প্রকৌশলীর অনুপাতে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং দক্ষমানের কোর্স সম্পন্নকারী শ্রমপোযোগী জনগোষ্ঠী রয়েছে অনেক কম। অথচ স্নাতক প্রকৌশলীদের কর্মপরিকল্পনাকে সঠিকভাবে দেখাশোনা ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও জনবল কাঠামো।

দেশে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্র আগের চেয়ে উন্মুক্ত হলেও তা আশানুরূপ নয়। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নির্ধারিত প্রকৌশল বিষয়সমূহ ছাড়াও কারিগরি শিক্ষার অধীনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কৃষি ডিপ্লোমা, টেক্সটাইল, মেরিন, মেডিকেল টেকনোলজি, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক্স ও গ্রাফিক আর্টস রয়েছে। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় মধ্যম স্তরের ডিপ্লোমা প্রকৌশল শিক্ষার জন্য মোট ৫০টি পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ছয়টি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট ও একটি সার্ভে ইনস্টিটিউট রয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) পর্যায়ের শিক্ষার জন্য রয়েছে ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এছাড়া বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিস্তারে রয়েছে ৩৮টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ৪০টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল কলেজ, ১৩টি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট।

কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারে বাংলাদেশে আরও চার হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসবের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে কারিগরি শিক্ষা বিভাগের কঠোর তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কেননা ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়া শুধু কাগুজে সনদ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের নেতিবাচক ফল গোটা দেশ ও জাতিকে ভোগ করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, টেলিকমিউনিকেশনের মতো সময়োপযোগী বিষয়সমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। অথচ এসব কোর্সে পাঠদানের জন্য বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে এসব শিক্ষায়তনে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থাও সম্প্রসারিত হয়নি। ২০০১ সাল থেকে প্রকৌশল ডিপ্লোমা কোর্স ৩ বছর থেকে ৪ বছরে উন্নীত করা হলেও নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রণীত পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন পাঠ্য পুস্তক সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়নি। ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রমে ৬০% ব্যবহারিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের অভাবে ব্যবহারিক ক্লাস পরিচালনায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়াই প্রকৌশল ডিপ্লোমা সনদ নিয়ে বাস্তব জীবনে প্রবেশ করে কর্মক্ষেত্রে নানারূপ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ২০২০ সালের মধ্যে করিগরি শিক্ষায়তনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেশের মোট শিক্ষার্থীর শতকরা ২০ ভাগে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশ-বিদেশের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউগুলোতে যুগোপযোগী নিত্যনতুন টেকনোলজি বা বিভাগ চালু করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৫ শতাংশ আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত রয়েছে।

পলিটেকনিক গ্র্যাজুয়েটদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এ লক্ষ্যে তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা প্রয়োজন। তাদের জন্য বিদেশে কর্মসংস্থানের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করার জোর তৎপরতা চালানো জরুরি। অদক্ষ জনশক্তির চেয়ে কারিগরি শিক্ষায় পারদর্শী জনবল বিদেশে পাঠাতে পারলে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমান ২/৩ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশে দক্ষ জনশক্তির প্রসার ঘটাতে ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে সারাদেশের বর্তমান কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক মানোন্নয়ন অত্যাবশ্যক। দেশের বর্তমান কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রতিটি জেলায় আধুনিক মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা প্রয়োজন। সব সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অবিলম্বে শিক্ষকের সব শূন্য পদ পূরণ এবং নতুন পদ সৃষ্টি করে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দান করা বিশেষ জরুরি। ৪-বছর মেয়াদি প্রকৌশল ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রম অনুসারে পর্যাপ্তসংখ্যক পাঠ্যপুস্তক এবং ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য উন্নত মানের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করা ছাড়া মানসম্পন্ন শিক্ষাদান সম্ভব নয়। তেজগাঁস্থ টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজকে সম্প্রসারিত করে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

কারিগরি শিক্ষার্থীদের শিল্প কারখানায় বাস্তব প্রশিক্ষণকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে কারখানা মালিককের উদ্ভুদ্ধ করতে শিক্ষা বিভাগকে উদ্যোগী হতে হবে। কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং সেলের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা অত্যাবশ্যক। মধ্যম স্তরের প্রকৌশলীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও কাজের সঠিক মূল্যায়নসহ দেশের উন্নয়নের ধারায় তাদের অধিকতর সম্পৃক্ত করা হলে তা দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়ক হবে যা পক্ষান্তরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে জনগণকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসাবে গড়ে তুলতে কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়ন জরুরি। বর্তমান সরকারের দিন বদলের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের যথাযথ অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে মধ্যম স্তরের কারিগরি শিক্ষা বিকাশের ধারা গতিশীল করা জরুরি। আগামীর বিশ্ব শ্রমবাজারে টিকে থাকতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে যুগোপযোগী, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে তুলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা গেলে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে আগামীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সহায়তা করবে।

[লেখক : সাবেক প্রকৌশলী ও শিক্ষক]