শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, চরম হতাশায় দিন কাটছে শিক্ষার্থীদের

বড় সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়

করোনা সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা চরম হাতাশায় ভুগছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ‘বড়’ সেশনজটের কবলে পড়তে যাচ্ছে। চাকরি প্রত্যাশী অনেকের সরকারি চাকরির আবেদন করার বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পরবর্তী বর্ষে উন্নীত হওয়া, সম্মান চতুর্থ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের যথাক্রমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ হচ্ছে না। এসব কারণে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসছে।

করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে দীর্ঘ এক বছর দুই মাস ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য ও কিছু জরুরি সেবা খাত বাদে পরিবহন, পোশাকসহ দেশের সব খাত ছিল কঠোর লকডাউনের আওতায়। কিন্তু লকডাউন পরবর্তীতে সব খাতের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চললেও বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্র্থীদের একটি বড় অংশ টিউশন, পার্টটাইম জব করে অনেকেই নিজের ও পরিবারের ব্যয়ভার বহন করে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা এসব কাজ করতে পারছেন না। তারা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। এতে অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে আত্মহত্যা করছে কিংবা আত্মহত্যার প্রতি ঝুঁকছে।

একটি সমীক্ষায় জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর আত্মহত্যা করা ১৭ জন বিশ্ববিদ্যালওয়ের শিক্ষার্থীদর মধ্যে ১১ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এছাড়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এতে অনেক শিক্ষার্থীর ঝরেপড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় কী ক্ষতি হচ্ছে, এখনই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া যায় কিনা- এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ কথা বলেছে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সঙ্গে।

অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ইফাজ আবদুল্লাহ বলেন, আমরা যারা চতুর্থ বর্ষে আছি তারা ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারছি না। এতে কোন চাকরি পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে আমাদের চাকরির বয়সও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে আমরা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছি। চরম হতাশা আমদের আকড়ে ধরছে। কিভাবে এ হতাশা কাটাব বুঝতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয় এখনই না খুলতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম শাহরিয়ার বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত হবে যথাশীঘ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া। তা না হলে এই বিরাট ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আমাদের পড়ায় মন বসছে না। চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে আমাদের দিন কাটছে।

ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়া চক্রবর্তী বলেন, ১৫ মাস ধরে কোন ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ার এটা নিশ্চিত যে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটে পড়তে যাচ্ছি। যেটা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে। তাই এক্ষুণি একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কামরুল হাসান মামুন সংবাদকে বলেন, এটা খুবই আশ্চর্যজনক এবং একইসঙ্গে দুঃখজনক যে, বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে এমন কোন প্রতিষ্ঠান বা খাত নেই যেটি বন্ধ আছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের ভবিষ্যৎ জড়িত। এটা আমাদের ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক ব্যর্থতা।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১২ জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে পরদিন ১৩ জুন থেকে খুলে দেয়া হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলা হলো করোনার টিকা দেয়ার পরই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেয়া হবে। আর টিকার যা অবস্থা তাতে কবে নাগাদ সব ছাত্রীদের টিকা দেয়া সম্ভব হবে তা মাথায় ঢুকছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ৭ মণ ঘিও জোগাড় হবে না রাজার মেয়েও নাচবে না। এর আগে বলা হয়েছিল অনলাইনে ক্লাস এবং পরীক্ষাও চলবে। বোঝা যাচ্ছে সরকার নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চায়। তিনি বলেন, হল খুললে ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে আমাদের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা যেই পরিমাণ গাদাগাদি করে থাকে সে অবস্থায় খোলাটা আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট কোন বর্ষের জন্য খুলে কেবল পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাসগুলো নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। তবে এসব খুঁটিনাটি আইডিয়াতো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে চিন্তা করে সরকারকে পথ দেখাতে হতো কিন্তু এই উল্টো দেশে উল্টো জিনিস ঘটে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে পথ দেখায়। কী আর বলব?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিক আহসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ঝুঁকি নিতে চায় না। যে কোন নতুন আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছুটা ঝুঁকিতো থাকবেই। তাছাড়া প্রশাসনকে অতিরিক্ত কাজ করতে হবে। আমরা হয়ত ওটুকু করতে চাই না। বন্ধ রাখাটা সবচেয়ে ঝুঁকিহীন আরামের কাজ। কিন্তু এতে যে সারা বাংলাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি পারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন নয়? বিশেষ করে ঢাকার বাহিরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই।

আবাসিক হলের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, আবাসিক হলের অবস্থা উন্নত করার পরিকল্পনা কি সরকার নিয়েছে? এই বন্ধকালে আবাসিক ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন কি আদৌ আনা হয়েছে? পোস্ট-কোভিড সিচুয়েশনে আর আগের মতো ৪ জনের রুমে ১৫ জন বা গণরুম থাকতে পারবে না। সেজন্যই বলেছি এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে ন্যূনতম দ্বিগুণ বরাদ্দ অবশ্যই দিতে হবে।

ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিভাবে খোলা রাখা যায় সেজন্য বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ কিভাবে আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা সত্ত্বে¡ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখছে সেটা সরেজমিন দেখার কোন প্রজেক্ট এখনও হয়নি? এজন্যইতো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনও খোলা যাচ্ছে না। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অনতিবিলম্বে এক ঝাঁক কর্মকর্তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিভাবে করোনা এতো খারাপ পরিস্থিতিতে তারা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে তা সরেজমিন দেখে আসতে পাঠানো উচিত। রাত্রের বৃহত্তর স্বার্থে এটা খুবই জরুরি। শুনলাম সরকারি কর্মকর্তাদের এই করোনা সংকটের সময়েও বিদেশ ভ্রমণের বিলাসিতা বন্ধ হয়নি। তাহলে এই ব্যবস্থাটি এতদিনেও কেন করা হয়নি? কত তুচ্ছ বিষয়ে রাষ্ট্রের কত টাকা খরচ করে বিদেশ ঘুরে আসেন অথচ আমাদের লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে এটি কেন এতদিনেও করা হলো না দেখা উচিত। কার গাফিলতি বের করার জন্য একটা তদন্ত কমিটিও হওয়া উচিত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ উজ জামান বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশ এর চেয়ে খারাপ অবস্থা নিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখছে। সেখানে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে অসুবিধা কোথায়? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাতো পরের কথা দৃশ্যমান কোন চেষ্টাওতো আমরা দেখি না। এটা কি মন্ত্রণালয়ের লোকজন করবে, ওপর থেকে চাপিয়ে দিবে? তারা কে, তারা এটার কি বুঝে? তাদের কাজ হচ্ছে প্রাশাসনিক কাজ। এটা আমরা করব। এ বিষয়ে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিবে।

কারণ আমরা জানি আমাদের শিক্ষার্থীদের কী প্রয়োজন। আমাদের উচিত হবে কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায় সে বিষয়ে হোমওয়ার্ক, ওয়ার্কশপ, প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে দেয়া।

শনিবার, ২৯ মে ২০২১ , ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৬ শাওয়াল ১৪৪২

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, চরম হতাশায় দিন কাটছে শিক্ষার্থীদের

বড় সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়

খালেদ মাহমুদ, ঢাবি

করোনা সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা চরম হাতাশায় ভুগছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ‘বড়’ সেশনজটের কবলে পড়তে যাচ্ছে। চাকরি প্রত্যাশী অনেকের সরকারি চাকরির আবেদন করার বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পরবর্তী বর্ষে উন্নীত হওয়া, সম্মান চতুর্থ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের যথাক্রমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ হচ্ছে না। এসব কারণে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসছে।

করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে দীর্ঘ এক বছর দুই মাস ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য ও কিছু জরুরি সেবা খাত বাদে পরিবহন, পোশাকসহ দেশের সব খাত ছিল কঠোর লকডাউনের আওতায়। কিন্তু লকডাউন পরবর্তীতে সব খাতের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চললেও বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্র্থীদের একটি বড় অংশ টিউশন, পার্টটাইম জব করে অনেকেই নিজের ও পরিবারের ব্যয়ভার বহন করে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা এসব কাজ করতে পারছেন না। তারা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। এতে অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে আত্মহত্যা করছে কিংবা আত্মহত্যার প্রতি ঝুঁকছে।

একটি সমীক্ষায় জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর আত্মহত্যা করা ১৭ জন বিশ্ববিদ্যালওয়ের শিক্ষার্থীদর মধ্যে ১১ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এছাড়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এতে অনেক শিক্ষার্থীর ঝরেপড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় কী ক্ষতি হচ্ছে, এখনই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া যায় কিনা- এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ কথা বলেছে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সঙ্গে।

অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ইফাজ আবদুল্লাহ বলেন, আমরা যারা চতুর্থ বর্ষে আছি তারা ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারছি না। এতে কোন চাকরি পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে আমাদের চাকরির বয়সও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে আমরা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছি। চরম হতাশা আমদের আকড়ে ধরছে। কিভাবে এ হতাশা কাটাব বুঝতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয় এখনই না খুলতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম শাহরিয়ার বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত হবে যথাশীঘ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া। তা না হলে এই বিরাট ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আমাদের পড়ায় মন বসছে না। চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে আমাদের দিন কাটছে।

ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়া চক্রবর্তী বলেন, ১৫ মাস ধরে কোন ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ার এটা নিশ্চিত যে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটে পড়তে যাচ্ছি। যেটা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে। তাই এক্ষুণি একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কামরুল হাসান মামুন সংবাদকে বলেন, এটা খুবই আশ্চর্যজনক এবং একইসঙ্গে দুঃখজনক যে, বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে এমন কোন প্রতিষ্ঠান বা খাত নেই যেটি বন্ধ আছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের ভবিষ্যৎ জড়িত। এটা আমাদের ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক ব্যর্থতা।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১২ জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে পরদিন ১৩ জুন থেকে খুলে দেয়া হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলা হলো করোনার টিকা দেয়ার পরই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেয়া হবে। আর টিকার যা অবস্থা তাতে কবে নাগাদ সব ছাত্রীদের টিকা দেয়া সম্ভব হবে তা মাথায় ঢুকছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ৭ মণ ঘিও জোগাড় হবে না রাজার মেয়েও নাচবে না। এর আগে বলা হয়েছিল অনলাইনে ক্লাস এবং পরীক্ষাও চলবে। বোঝা যাচ্ছে সরকার নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চায়। তিনি বলেন, হল খুললে ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে আমাদের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা যেই পরিমাণ গাদাগাদি করে থাকে সে অবস্থায় খোলাটা আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট কোন বর্ষের জন্য খুলে কেবল পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাসগুলো নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। তবে এসব খুঁটিনাটি আইডিয়াতো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে চিন্তা করে সরকারকে পথ দেখাতে হতো কিন্তু এই উল্টো দেশে উল্টো জিনিস ঘটে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে পথ দেখায়। কী আর বলব?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিক আহসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ঝুঁকি নিতে চায় না। যে কোন নতুন আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছুটা ঝুঁকিতো থাকবেই। তাছাড়া প্রশাসনকে অতিরিক্ত কাজ করতে হবে। আমরা হয়ত ওটুকু করতে চাই না। বন্ধ রাখাটা সবচেয়ে ঝুঁকিহীন আরামের কাজ। কিন্তু এতে যে সারা বাংলাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি পারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন নয়? বিশেষ করে ঢাকার বাহিরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই।

আবাসিক হলের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, আবাসিক হলের অবস্থা উন্নত করার পরিকল্পনা কি সরকার নিয়েছে? এই বন্ধকালে আবাসিক ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন কি আদৌ আনা হয়েছে? পোস্ট-কোভিড সিচুয়েশনে আর আগের মতো ৪ জনের রুমে ১৫ জন বা গণরুম থাকতে পারবে না। সেজন্যই বলেছি এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে ন্যূনতম দ্বিগুণ বরাদ্দ অবশ্যই দিতে হবে।

ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিভাবে খোলা রাখা যায় সেজন্য বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ কিভাবে আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা সত্ত্বে¡ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখছে সেটা সরেজমিন দেখার কোন প্রজেক্ট এখনও হয়নি? এজন্যইতো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনও খোলা যাচ্ছে না। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অনতিবিলম্বে এক ঝাঁক কর্মকর্তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিভাবে করোনা এতো খারাপ পরিস্থিতিতে তারা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে তা সরেজমিন দেখে আসতে পাঠানো উচিত। রাত্রের বৃহত্তর স্বার্থে এটা খুবই জরুরি। শুনলাম সরকারি কর্মকর্তাদের এই করোনা সংকটের সময়েও বিদেশ ভ্রমণের বিলাসিতা বন্ধ হয়নি। তাহলে এই ব্যবস্থাটি এতদিনেও কেন করা হয়নি? কত তুচ্ছ বিষয়ে রাষ্ট্রের কত টাকা খরচ করে বিদেশ ঘুরে আসেন অথচ আমাদের লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে এটি কেন এতদিনেও করা হলো না দেখা উচিত। কার গাফিলতি বের করার জন্য একটা তদন্ত কমিটিও হওয়া উচিত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ উজ জামান বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশ এর চেয়ে খারাপ অবস্থা নিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখছে। সেখানে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে অসুবিধা কোথায়? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাতো পরের কথা দৃশ্যমান কোন চেষ্টাওতো আমরা দেখি না। এটা কি মন্ত্রণালয়ের লোকজন করবে, ওপর থেকে চাপিয়ে দিবে? তারা কে, তারা এটার কি বুঝে? তাদের কাজ হচ্ছে প্রাশাসনিক কাজ। এটা আমরা করব। এ বিষয়ে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিবে।

কারণ আমরা জানি আমাদের শিক্ষার্থীদের কী প্রয়োজন। আমাদের উচিত হবে কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায় সে বিষয়ে হোমওয়ার্ক, ওয়ার্কশপ, প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে দেয়া।