উপকূলে বাঁধ রক্ষার যুদ্ধ

খুলনার উপকূলীয় উপজেলা ধরা হয় কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটাকে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়রা উপজেলা। গত বুধবার ১১টি পয়েন্ট ভেঙে ও উপচে নদীর জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় ৩৫টি গ্রাম।

পরে স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রমে ৮টি পয়েন্ট আটকাতে পারলেও মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া, পবনা এবং উত্তর বেদকাশী গাতির ঘেরী নামক স্থান আটকানো যায়নি।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরের জোয়ারে আরও ১৫ থেকে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। জানান, কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন।

ইমতিয়াজ বলেন, কয়রা উপজেলাটির চারপাশ নদীবেষ্টিত। উপজেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ১৫৫ কিলোমিটারের মতো। এর আগে আইলা, সিডর, বুলবুল ও আম্ফানে উপজেলার ব্যাপক ক্ষতি হয় এ উপজেলায়।

শুরু থেকেই ঝড়ের কোন প্রভাব ছিল না কয়রায়। গত মঙ্গলবার রাতের জোয়ারও ঠেকিয়ে দেন এলাকাবাসী। তবে বুধ- বৃহস্পতিবারের জোয়ারে আর শেষ রক্ষা হয়নি। এসব এলাকার পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।

স্বেচ্ছাশ্রমে গতকাল মহারাজপুর ইউনিয়নের মাঠবাড়ি গ্রামের মঠের মোসলেম সরদারের বাড়ির পাশে বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ করেছেন স্থানীয় সহস্রাধিক স্থানীয় বাসিন্দা।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল ভোর থেকে মঠবাড়ী গ্রামের মঠের মোসলেম সরদারের বাড়ির পাশের বেড়িবাঁধ সংস্কার শুরু করা হয়। এখানে প্রায় তিন হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে।

ওই এলাকার বাসিন্দা সঞ্জয় মন্ডল বলেন, কয়রার মানুষের এখন একটাই চাওয়া টেকসই বেড়িবাঁধ। প্রতিবছর মানুষ পানিতে ডুবছে। এজন্য তারা নিজেরাই বেড়িবাঁধ মেরামতে নেমেছেন।

সঞ্জয় বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে নদীর জোয়ারের পানিতে দুর্বল বাঁধ ভেঙে ও উপচে কয়রা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত দুদিন প্রবল স্রোতে উপজেলার দশহালিয়ার তিন কিলোমিটার, মঠবাড়ী, তেতুলতলার চর, আংটিহারা, মঠবাড়ী, গোবরা ঘাটাখালী, কয়রা সদরের তহসিল অফিস-সংলগ্ন বেড়িবাঁধ, দশহালিয়া, কাটকাটা, কাশির হাটখোলা, কাটমারচর, ২নং কয়রা, ৪নং কয়রা, পবনা, কাশির খালের গোড়া, হোগলা, উত্তর বেদকাশী গাতির ঘেরী, শাকবাড়িয়া, সুতির অফিস, নয়ানি, খোড়ল কাটি, জোড়শিংসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।

গতকাল দুপুরে সরজমিনে মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া এলাকায় কপোতাক্ষ নদ এবং উত্তর বেদকাশী এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর ধারে গিয়ে দেখা যায়, উত্তাল নদী, কিনার ছুঁই ছুঁই পানি। কোথাও কোথাও বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাঁধের ওপর।

মহারাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান জিএম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, উপজেলার অসংখ্য জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এখানকার বাঁধ সংস্কারের জন্য চেষ্টা করেও যথাসময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কাজের অনুমতি না মেলায় আজ এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।

লোনা পানি প্রবেশ করায় ফসলি জমি, মৎস্য, গবাদি পশুসহ প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে কয়রা উপজেলা প্রশাসন। তার মধ্যে মৎস্য ঘের ডুবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ২ হাজার ৫০?টি মৎস্য ঘের ও পুকুর ডু?বে প্রায় ১৫ কো?টি টাকার মৎস্যসম্পদ নষ্ট হয়েছে। বাড়িঘরে জোয়ারের পানি ঢোকায় ৫ সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।

খুলনার কয়রা উপজেলা প্রকল্প প্রকল্প কর্মকর্তা সাগর হোসেন সৈকত বলেন, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। বুধবার ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। প?রের দিন আরও কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কো?টি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা বিভাগ-২ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদিন বলেন, ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি উপচে কয়রা উপজেলার ২টি পোল্ডারের ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত ও কিছু স্থানের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে।

তিনি বলেন, বেশ কিছু স্থানে জিও ব্যাগ দিয়ে পানি আটকানো সম্ভব হয়েছে। তবে জোয়ারের চাপ থাকায় বেশি সময় কাজ করা যাচ্ছে না।

পাইকগাছা-কয়রার সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান বাবু বলেন, ইয়াসের প্রভাবে কয়রার আংটিহারা, গাতিরঘেরী, বেদকাশী, কাটকাটা, পবনা, দশালিয়া, চৌকুনী, খাসির খালপারসহ ৩০টি স্থানে ভেঙে গেছে। এতে ৭০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

তিনি বলেন, উপকূলের মানুষকে বাঁচাতে বেশ কিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে, কাজও হচ্ছে। কিন্তু দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়ছে না।

image

খুলনা : স্বেচ্ছাশ্রমে গতকাল মহারাজপুর ইউনিয়নের মাঠবাড়ি গ্রামের মোসলেম সরদারের বাড়ির পাশে বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ করছেন সহস্রাধিক স্থানীয় বাসিন্দা -সংবাদ

আরও খবর
কালো টাকা সাদা বহাল রাখা কার স্বার্থে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, চরম হতাশায় দিন কাটছে শিক্ষার্থীদের
দামে রেকর্ড গড়েছে ভোজ্যতেল
শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার সান্ত্বনার জয়

শনিবার, ২৯ মে ২০২১ , ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৬ শাওয়াল ১৪৪২

উপকূলে বাঁধ রক্ষার যুদ্ধ

শুভ্র শচীন, খুলনা

image

খুলনা : স্বেচ্ছাশ্রমে গতকাল মহারাজপুর ইউনিয়নের মাঠবাড়ি গ্রামের মোসলেম সরদারের বাড়ির পাশে বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ করছেন সহস্রাধিক স্থানীয় বাসিন্দা -সংবাদ

খুলনার উপকূলীয় উপজেলা ধরা হয় কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটাকে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়রা উপজেলা। গত বুধবার ১১টি পয়েন্ট ভেঙে ও উপচে নদীর জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় ৩৫টি গ্রাম।

পরে স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রমে ৮টি পয়েন্ট আটকাতে পারলেও মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া, পবনা এবং উত্তর বেদকাশী গাতির ঘেরী নামক স্থান আটকানো যায়নি।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরের জোয়ারে আরও ১৫ থেকে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। জানান, কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন।

ইমতিয়াজ বলেন, কয়রা উপজেলাটির চারপাশ নদীবেষ্টিত। উপজেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ১৫৫ কিলোমিটারের মতো। এর আগে আইলা, সিডর, বুলবুল ও আম্ফানে উপজেলার ব্যাপক ক্ষতি হয় এ উপজেলায়।

শুরু থেকেই ঝড়ের কোন প্রভাব ছিল না কয়রায়। গত মঙ্গলবার রাতের জোয়ারও ঠেকিয়ে দেন এলাকাবাসী। তবে বুধ- বৃহস্পতিবারের জোয়ারে আর শেষ রক্ষা হয়নি। এসব এলাকার পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।

স্বেচ্ছাশ্রমে গতকাল মহারাজপুর ইউনিয়নের মাঠবাড়ি গ্রামের মঠের মোসলেম সরদারের বাড়ির পাশে বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ করেছেন স্থানীয় সহস্রাধিক স্থানীয় বাসিন্দা।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল ভোর থেকে মঠবাড়ী গ্রামের মঠের মোসলেম সরদারের বাড়ির পাশের বেড়িবাঁধ সংস্কার শুরু করা হয়। এখানে প্রায় তিন হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে।

ওই এলাকার বাসিন্দা সঞ্জয় মন্ডল বলেন, কয়রার মানুষের এখন একটাই চাওয়া টেকসই বেড়িবাঁধ। প্রতিবছর মানুষ পানিতে ডুবছে। এজন্য তারা নিজেরাই বেড়িবাঁধ মেরামতে নেমেছেন।

সঞ্জয় বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে নদীর জোয়ারের পানিতে দুর্বল বাঁধ ভেঙে ও উপচে কয়রা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত দুদিন প্রবল স্রোতে উপজেলার দশহালিয়ার তিন কিলোমিটার, মঠবাড়ী, তেতুলতলার চর, আংটিহারা, মঠবাড়ী, গোবরা ঘাটাখালী, কয়রা সদরের তহসিল অফিস-সংলগ্ন বেড়িবাঁধ, দশহালিয়া, কাটকাটা, কাশির হাটখোলা, কাটমারচর, ২নং কয়রা, ৪নং কয়রা, পবনা, কাশির খালের গোড়া, হোগলা, উত্তর বেদকাশী গাতির ঘেরী, শাকবাড়িয়া, সুতির অফিস, নয়ানি, খোড়ল কাটি, জোড়শিংসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।

গতকাল দুপুরে সরজমিনে মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া এলাকায় কপোতাক্ষ নদ এবং উত্তর বেদকাশী এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর ধারে গিয়ে দেখা যায়, উত্তাল নদী, কিনার ছুঁই ছুঁই পানি। কোথাও কোথাও বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাঁধের ওপর।

মহারাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান জিএম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, উপজেলার অসংখ্য জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এখানকার বাঁধ সংস্কারের জন্য চেষ্টা করেও যথাসময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কাজের অনুমতি না মেলায় আজ এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।

লোনা পানি প্রবেশ করায় ফসলি জমি, মৎস্য, গবাদি পশুসহ প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে কয়রা উপজেলা প্রশাসন। তার মধ্যে মৎস্য ঘের ডুবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ২ হাজার ৫০?টি মৎস্য ঘের ও পুকুর ডু?বে প্রায় ১৫ কো?টি টাকার মৎস্যসম্পদ নষ্ট হয়েছে। বাড়িঘরে জোয়ারের পানি ঢোকায় ৫ সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।

খুলনার কয়রা উপজেলা প্রকল্প প্রকল্প কর্মকর্তা সাগর হোসেন সৈকত বলেন, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। বুধবার ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। প?রের দিন আরও কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কো?টি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা বিভাগ-২ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদিন বলেন, ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি উপচে কয়রা উপজেলার ২টি পোল্ডারের ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত ও কিছু স্থানের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে।

তিনি বলেন, বেশ কিছু স্থানে জিও ব্যাগ দিয়ে পানি আটকানো সম্ভব হয়েছে। তবে জোয়ারের চাপ থাকায় বেশি সময় কাজ করা যাচ্ছে না।

পাইকগাছা-কয়রার সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান বাবু বলেন, ইয়াসের প্রভাবে কয়রার আংটিহারা, গাতিরঘেরী, বেদকাশী, কাটকাটা, পবনা, দশালিয়া, চৌকুনী, খাসির খালপারসহ ৩০টি স্থানে ভেঙে গেছে। এতে ৭০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

তিনি বলেন, উপকূলের মানুষকে বাঁচাতে বেশ কিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে, কাজও হচ্ছে। কিন্তু দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়ছে না।