পরপর ৫ দফা ভূমিকম্প আতঙ্কে সিলেটবাসী

অতি ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি অঞ্চলের সিলেট হলো একটি

পর পর কয়েক দফা ভূমিকম্পে আতঙ্কিত পুরো সিলেট নগরী। গতকাল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫ দফা কম্পন সৃষ্টি হয়েছে সিলেটজুড়ে। এ সময় কর্মস্থল ও বাসাবাড়ি ছেড়ে সড়ক ও খোলা স্থানে জড়ো হয় স্থানীয় বাসিন্দারা। অনেকেই ভয়ে শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যেতে দেখা গেছে। তাদের ধারণা শহরের বহুতল ভবন থেকে গ্রামের টিনসেট বাড়ি নিরাপদ।

কয়েক দফা ছোট ছোট কম্পনের ফলে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝূঁকিতে রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর প্রভাব ঢাকার শহরেও পড়তে পারে। তাই এখন থেকে সতর্কমূলক প্রস্তুতি নেয়া উচিত। আগামী সাত থেকে দশদিন নগরবাসীকে সচেতন থাকার পরামর্শ। ভূমিকম্পন থেকে রক্ষার কোন উপায় নেই। তবুও বহুতল ভবনগুলো পরীক্ষা করে দেখা উচিত বলে পরামর্শ তাদের।

আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলে পাঁচবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে প্রথম ভূমিকম্প হয়। যা ছিল রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক শূন্য মাত্রায়। দ্বিতীয় কম্পন হয় ১০টা ৫০ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। ১১টা ২৯ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ২ দশমিক ৮ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এছাড়া দুপুর ২টার দিকে যে ভূকম্পন অনুভূত হয়, সেটার মাত্রা ছিল ৪ দশমিক শূন্য। চারটির উৎপত্তিস্থলই ঢাকা থেকে প্রায় ১৯৬ কিমি উত্তর পূর্বে। ছোট ভূমিকম্পের কারণে কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ডাউকি ফল্টের কারণে সিলেট ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল জৈন্তাপুর সীমান্তের দিকে। এর আগে গত ২৮ এপ্রিল আসামে রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার এবং ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মায়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল।

এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, ভূমিকম্পের একটা ধরন হচ্ছে, পিরিয়ডিক্যালি বড় ভূমিকম্প হয়। সেগুলো সাধারণত একশ বছর পরপর ঘুরে আসে। সেই হিসেবে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে, তাতে কিন্তু ওই মাত্রার কম্পন হয়নি। ভূমিকম্পন বিবেচনায় বাংলাদেশকে তিনটা জোনে ভাগ করা হয়েছে। একটা হলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, একটা হলো মধ্যম ঝুঁকিপূণ ও আরেকটা হলো কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে পড়েছে। তাই এই দুই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কোনভাবেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভূমিকম্পের কোন পূর্বাভাস নেই এবং ১২০ থেকে ১২২ বছর পূর্বে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, তাই এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুতরাং বড় ভূমিকম্প হতেই পারে।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এটা এমন একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশ্বের কারোরই রোধ করার উপায় জানা নেই। তবে আমরা যেটা করতে পারি, সেটা হচ্ছে তাৎক্ষণিক কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারি। এ ক্ষেত্রে ভবনের ভেতরে থাকলে, নিচে থাকলে বাইরে বের হয়ে যেতে হবে। আর উপর তলায় থাকলে শক্ত কোনকিছুর নিচে মাথায় হাত দিয়ে শোয়ার ভঙ্গিতে অবস্থান নিতে হবে অথবা ভিমের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। এসব তাৎক্ষণিক উপায় অবলম্বন ছাড়া কিছু করার নেই।

বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে সিলেট

ঘন ঘন এমন ঝাঁকুনিতে সিলেট নগরবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করেছে। অবশ্য এর আগের দিন শুক্রবার সিলেটের অদূরে ভারতের আসাম রাজ্যে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। আর এই সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য এক নম্বর জোন হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সিলেটে বেশ কয়েকবার বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়া আসামে ১৯৫০ সালে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে সিলেট অঞ্চল লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। সেসময় অনেক জায়গা ও অবকাঠামোও পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন থেকেই সিলেট ভূমিকম্প অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তবে অনেকেই ভবণ নির্মাণের ব্যবস্থাপনা মানছেন না।

এ বিষয়ে বুয়েটের পৌরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী সংবাদকে বলেন, ‘সাধারণত বড় কম্পনগুলো একশ’ থেকে দেড়শ’ বছর পর পর হয়ে থাকে। আর কম্পন আশার আগের ছোট ছোট কম্পন অনুভূত হয়। সর্বশেষ সিলেটে ১৯৯৮ সালে একটু বড় আকারের ভূমিকম্প হয়েছে। বেশি বড় নয় ৫-৬ মাত্রা ছিল এটি। এছাড়া ১৮৬৯ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত আসামসহ পুরো সিলেট এলাকায় কয়েকটি বড় মাত্রায় কম্পন হয়েছিল। এর মধ্যে ১০০ কিলোমিটার এলাকায় যেটি হয়েছিল এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। তখন পুরো এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আসামসহ পুরো সিলেট এলাকায় ১৫৪২ জন লোক মারা গিয়েছিল। এর প্রভাব ঢাকা অঞ্চলে পড়েছিল। ঢাকায়ও তখন ১৫ জন লোক মারা গিয়েছিল। বড় বড় কম্পন আসার আগে ছোট ছোট কিছু ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।’ গত কয়েক মাসে মনিপুর, আসাম ও সিলেট অঞ্চলে অনেকগুলো ছোট ভূমিকম্প হয়েছে। শনিবারও সিলেট অঞ্চলে ৫ বার কম্পন হয়েছে। তাই এখন থেকে সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেয়া উচিত। ভূমিকম্পন থেকে রক্ষার কোন উপায় নেই। তবুও বহুতল ভবনগুলো পরীক্ষা করে দেখা উচিত বলে পরামর্শ দেন তিনি।

এ বিষয়ে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম জানান, পর পর এতোবার ভূমিকম্প সিলেট অঞ্চলের জন্য অশনি সংকেত। আগামী সাত থেকে দশদিন নগরবাসীকে সচেতন থাকতে হবে। সিলেট সাধারণত আর্থ কুইক জোন। আগে একদিনে দুইবার ভূমিকম্প দেখেছি। কিন্তু শনিবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৭/৮ বার হয়েছে। এটা অদূর ভবিষ্যতে সিলেটে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়েছে। এর সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৪.১। এটা অদূর ভবিষ্যতে সিলেটে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার ইন্ডিকেশন।

তিনি বলেন, ১৯১৮ সালে সিলেটে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আগে অনেকগুলো ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। কিন্তু ১৮৯৭ সালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আগে এমনটা হয়নি। শনিবার ভূমিকম্পের সঙ্গে ওই সময়ের ভূমিকম্পের রিলেশন করা যাবে না। কারণ ভূমিকম্প প্রত্যেক সময়েই হচ্ছে। ১-২ মাত্রার হলে টের পাওয়া যায় না। এটা ২, ৩, ৪ মাত্রার হলে এর তীব্রতা টের পাই। ৫ মাত্রা হলে তীব্রতা আরও বেশি হয়। কিন্তু সিলেটে ১০-১২ বছরে যত ভবন নির্মাণ হয়ছে তা এতটা সহনীয় না। সিলেটে গ্যাস লাইন রয়েছে। গ্যাস লাইন লিকেজ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমরা ইতোমধ্যে মেয়রের সঙ্গে বসেছি। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। সবাইকে নির্দেশনা মানতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে।

কয়েক দফা ভূমিকম্পে আতঙ্কিত নগরবাসী

বারবার ভূমিকম্পে নগরীর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে অনেকে বাসাবাড়ি ছেড়ে সাময়িকভাবে পরিচিত কারও টিনশেডের বাসায় অবস্থান করছেন। আবার অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতেও চলে যাচ্ছেন। নগরীর লামাবাজারের নয়াপাড়ার বাসিন্দা দিপন্ত দাশ তার পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়ি বড়লেখায় চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামে অনেকটা নিরাপদ। বাড়িতে রয়েছে টিনশেডের ঘর। কিন্তু শহরে বহুতল ভবনে বেশি ঝুঁকি রয়েছে বিধায় পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।’ উপশহরের বাসিন্দা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘বহুতল ভবনে খুব ভয় লাগছে। তাই শাহপরাণে তার ভাইয়ের টিনশেডের বাসায় পরিবার নিয়ে চলে যান।’

ভূমিকম্প পরবর্তী জরুরি বৈঠক সিসিক

কয়েক দফা ভূমিকম্পের কারণে সিলেট সিটি করপোরেশন জরুরি বৈঠক করেছে। বৈঠকে ভূমিকম্প পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। শনিবার বিকেল ৫টার দিকে সিসিকের হল রুমে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে কিভাবে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। ভূমিকম্প পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটি নিয়ে আমরা ভাবছি। এ সময় মেয়র আরও বলেন, জনগণকে খুব আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

সিসিকের ওই বৈঠকে জালালাবাদ গ্যাস অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের ২৪ ঘণ্টা কাজ করে এমন টিম রয়েছে। কল সেন্টারে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে ভূমিকম্প পরবর্তীতে কোথাও গ্যাসলাইন লিকেজ হলে সঙ্গে সঙ্গে বিহিত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।

রবিবার, ৩০ মে ২০২১ , ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৭ শাওয়াল ১৪৪২

পরপর ৫ দফা ভূমিকম্প আতঙ্কে সিলেটবাসী

অতি ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি অঞ্চলের সিলেট হলো একটি

আকাশ চৌধুরী ও ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

পর পর কয়েক দফা ভূমিকম্পে আতঙ্কিত পুরো সিলেট নগরী। গতকাল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫ দফা কম্পন সৃষ্টি হয়েছে সিলেটজুড়ে। এ সময় কর্মস্থল ও বাসাবাড়ি ছেড়ে সড়ক ও খোলা স্থানে জড়ো হয় স্থানীয় বাসিন্দারা। অনেকেই ভয়ে শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যেতে দেখা গেছে। তাদের ধারণা শহরের বহুতল ভবন থেকে গ্রামের টিনসেট বাড়ি নিরাপদ।

কয়েক দফা ছোট ছোট কম্পনের ফলে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝূঁকিতে রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর প্রভাব ঢাকার শহরেও পড়তে পারে। তাই এখন থেকে সতর্কমূলক প্রস্তুতি নেয়া উচিত। আগামী সাত থেকে দশদিন নগরবাসীকে সচেতন থাকার পরামর্শ। ভূমিকম্পন থেকে রক্ষার কোন উপায় নেই। তবুও বহুতল ভবনগুলো পরীক্ষা করে দেখা উচিত বলে পরামর্শ তাদের।

আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলে পাঁচবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে প্রথম ভূমিকম্প হয়। যা ছিল রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক শূন্য মাত্রায়। দ্বিতীয় কম্পন হয় ১০টা ৫০ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। ১১টা ২৯ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ২ দশমিক ৮ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এছাড়া দুপুর ২টার দিকে যে ভূকম্পন অনুভূত হয়, সেটার মাত্রা ছিল ৪ দশমিক শূন্য। চারটির উৎপত্তিস্থলই ঢাকা থেকে প্রায় ১৯৬ কিমি উত্তর পূর্বে। ছোট ভূমিকম্পের কারণে কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ডাউকি ফল্টের কারণে সিলেট ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল জৈন্তাপুর সীমান্তের দিকে। এর আগে গত ২৮ এপ্রিল আসামে রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার এবং ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মায়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল।

এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, ভূমিকম্পের একটা ধরন হচ্ছে, পিরিয়ডিক্যালি বড় ভূমিকম্প হয়। সেগুলো সাধারণত একশ বছর পরপর ঘুরে আসে। সেই হিসেবে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে, তাতে কিন্তু ওই মাত্রার কম্পন হয়নি। ভূমিকম্পন বিবেচনায় বাংলাদেশকে তিনটা জোনে ভাগ করা হয়েছে। একটা হলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, একটা হলো মধ্যম ঝুঁকিপূণ ও আরেকটা হলো কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে পড়েছে। তাই এই দুই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কোনভাবেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভূমিকম্পের কোন পূর্বাভাস নেই এবং ১২০ থেকে ১২২ বছর পূর্বে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, তাই এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুতরাং বড় ভূমিকম্প হতেই পারে।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এটা এমন একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশ্বের কারোরই রোধ করার উপায় জানা নেই। তবে আমরা যেটা করতে পারি, সেটা হচ্ছে তাৎক্ষণিক কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারি। এ ক্ষেত্রে ভবনের ভেতরে থাকলে, নিচে থাকলে বাইরে বের হয়ে যেতে হবে। আর উপর তলায় থাকলে শক্ত কোনকিছুর নিচে মাথায় হাত দিয়ে শোয়ার ভঙ্গিতে অবস্থান নিতে হবে অথবা ভিমের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। এসব তাৎক্ষণিক উপায় অবলম্বন ছাড়া কিছু করার নেই।

বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে সিলেট

ঘন ঘন এমন ঝাঁকুনিতে সিলেট নগরবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করেছে। অবশ্য এর আগের দিন শুক্রবার সিলেটের অদূরে ভারতের আসাম রাজ্যে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। আর এই সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য এক নম্বর জোন হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সিলেটে বেশ কয়েকবার বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়া আসামে ১৯৫০ সালে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে সিলেট অঞ্চল লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। সেসময় অনেক জায়গা ও অবকাঠামোও পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন থেকেই সিলেট ভূমিকম্প অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তবে অনেকেই ভবণ নির্মাণের ব্যবস্থাপনা মানছেন না।

এ বিষয়ে বুয়েটের পৌরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী সংবাদকে বলেন, ‘সাধারণত বড় কম্পনগুলো একশ’ থেকে দেড়শ’ বছর পর পর হয়ে থাকে। আর কম্পন আশার আগের ছোট ছোট কম্পন অনুভূত হয়। সর্বশেষ সিলেটে ১৯৯৮ সালে একটু বড় আকারের ভূমিকম্প হয়েছে। বেশি বড় নয় ৫-৬ মাত্রা ছিল এটি। এছাড়া ১৮৬৯ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত আসামসহ পুরো সিলেট এলাকায় কয়েকটি বড় মাত্রায় কম্পন হয়েছিল। এর মধ্যে ১০০ কিলোমিটার এলাকায় যেটি হয়েছিল এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। তখন পুরো এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আসামসহ পুরো সিলেট এলাকায় ১৫৪২ জন লোক মারা গিয়েছিল। এর প্রভাব ঢাকা অঞ্চলে পড়েছিল। ঢাকায়ও তখন ১৫ জন লোক মারা গিয়েছিল। বড় বড় কম্পন আসার আগে ছোট ছোট কিছু ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।’ গত কয়েক মাসে মনিপুর, আসাম ও সিলেট অঞ্চলে অনেকগুলো ছোট ভূমিকম্প হয়েছে। শনিবারও সিলেট অঞ্চলে ৫ বার কম্পন হয়েছে। তাই এখন থেকে সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেয়া উচিত। ভূমিকম্পন থেকে রক্ষার কোন উপায় নেই। তবুও বহুতল ভবনগুলো পরীক্ষা করে দেখা উচিত বলে পরামর্শ দেন তিনি।

এ বিষয়ে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম জানান, পর পর এতোবার ভূমিকম্প সিলেট অঞ্চলের জন্য অশনি সংকেত। আগামী সাত থেকে দশদিন নগরবাসীকে সচেতন থাকতে হবে। সিলেট সাধারণত আর্থ কুইক জোন। আগে একদিনে দুইবার ভূমিকম্প দেখেছি। কিন্তু শনিবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৭/৮ বার হয়েছে। এটা অদূর ভবিষ্যতে সিলেটে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়েছে। এর সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৪.১। এটা অদূর ভবিষ্যতে সিলেটে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার ইন্ডিকেশন।

তিনি বলেন, ১৯১৮ সালে সিলেটে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আগে অনেকগুলো ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। কিন্তু ১৮৯৭ সালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আগে এমনটা হয়নি। শনিবার ভূমিকম্পের সঙ্গে ওই সময়ের ভূমিকম্পের রিলেশন করা যাবে না। কারণ ভূমিকম্প প্রত্যেক সময়েই হচ্ছে। ১-২ মাত্রার হলে টের পাওয়া যায় না। এটা ২, ৩, ৪ মাত্রার হলে এর তীব্রতা টের পাই। ৫ মাত্রা হলে তীব্রতা আরও বেশি হয়। কিন্তু সিলেটে ১০-১২ বছরে যত ভবন নির্মাণ হয়ছে তা এতটা সহনীয় না। সিলেটে গ্যাস লাইন রয়েছে। গ্যাস লাইন লিকেজ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমরা ইতোমধ্যে মেয়রের সঙ্গে বসেছি। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। সবাইকে নির্দেশনা মানতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে।

কয়েক দফা ভূমিকম্পে আতঙ্কিত নগরবাসী

বারবার ভূমিকম্পে নগরীর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে অনেকে বাসাবাড়ি ছেড়ে সাময়িকভাবে পরিচিত কারও টিনশেডের বাসায় অবস্থান করছেন। আবার অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতেও চলে যাচ্ছেন। নগরীর লামাবাজারের নয়াপাড়ার বাসিন্দা দিপন্ত দাশ তার পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়ি বড়লেখায় চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামে অনেকটা নিরাপদ। বাড়িতে রয়েছে টিনশেডের ঘর। কিন্তু শহরে বহুতল ভবনে বেশি ঝুঁকি রয়েছে বিধায় পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।’ উপশহরের বাসিন্দা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘বহুতল ভবনে খুব ভয় লাগছে। তাই শাহপরাণে তার ভাইয়ের টিনশেডের বাসায় পরিবার নিয়ে চলে যান।’

ভূমিকম্প পরবর্তী জরুরি বৈঠক সিসিক

কয়েক দফা ভূমিকম্পের কারণে সিলেট সিটি করপোরেশন জরুরি বৈঠক করেছে। বৈঠকে ভূমিকম্প পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। শনিবার বিকেল ৫টার দিকে সিসিকের হল রুমে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে কিভাবে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। ভূমিকম্প পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটি নিয়ে আমরা ভাবছি। এ সময় মেয়র আরও বলেন, জনগণকে খুব আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

সিসিকের ওই বৈঠকে জালালাবাদ গ্যাস অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের ২৪ ঘণ্টা কাজ করে এমন টিম রয়েছে। কল সেন্টারে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে ভূমিকম্প পরবর্তীতে কোথাও গ্যাসলাইন লিকেজ হলে সঙ্গে সঙ্গে বিহিত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।