বাজেট : প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হতে পারে ৩ জুন। মহামারি করোনায় বিশে^র টালমাটাল অবস্থা। বিশ্বজুড়েই দেখা দিয়েছে জীবন ও জীবিকার সংকট। এর মধ্যেই চলছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ। করোনা মহামারিতে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।

চলমান করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। প্রতি মুহূর্তে লড়াই করছে জীবন ও জীবিকা নিয়ে। আগামী বাজেটে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে প্রধান অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকার। এজন্য মানুষের জীবন ও জীবিকাকেও প্রাধান্য দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করছে অর্থ বিভাগ। তবে সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতিকে স্বাভাবিক রাখতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে বলে মনে করে অর্থ বিভাগ। করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিকে তৃতীয় অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সার, বীজের ভর্তুকি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের পাশাপাশি এসব উপকরণ ব্যবহার ও আধুনিক কৃষি সম্পর্কে সম্যক ধারণা বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বছরজুড়েই। চলতি বাজেটে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তিন বছরের মধ্যে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। বরং নতুন করে কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ফলে নতুন করে তিন কোটি মানুষ দরিদ্রর খাতায় নাম লিখিয়েছেন। ফলে সামনের দিনগুলোয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সরকারের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগামী বাজেটে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্বাস্থ্য খাত। তবে আগামী দিনগুলোয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, কমে গেছে আয়। ফলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে নতুন করে পরিকল্পনা নিতে হবে। অর্থ বিভাগ মনে করে কোভিড-১৯ পরবর্তী ধসে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি ফেরাতে হবে। শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করতে হবে। একইভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং নারী উদ্যোক্তা যারা ব্যাংক ঋণের বাইরে রয়েছেন তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। বৈদেশিক শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার করতে হবে। যেসব প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন কোভিড-১৯ পরবর্তী তাদের ফেরত পাঠাতে হবে। যাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না তাদের জন্য দেশেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

মহামারিতে অনেক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এছাড়া আছে অনেক বিত্তহীন মানুষ। ফলে এসব মানুষকে সহায়তা করতে আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সম্প্রসারণ করা হবে। এ বিষয়কে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে ধারণা করা হচ্ছে- আগামী বছরে প্রায় ৮৫ লাখ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যারা সুবিধাভোগী তাদের বাইরে অসংখ্য মানুষ রয়েছে নিম্ন ও গরিব। তাদের দেওয়া হবে স্বল্প ও বিনামূল্যে খাদ্য। এ বিষয়টি আগামী বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ১০ টাকা মূল্যে খাদ্য, কাবিখা, টিআর, ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএসের মাধ্যমে এসব সুবিধা দেওয়া হবে। এসব কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উৎপাদন পর্যায়ে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন ও সারের ভর্তুকি দেওয়া অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকছে। এছাড়া গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ এবং শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে জিডিপির আকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরে এগোচ্ছে। করোনার কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পুরোপুরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন খাত, পরিবহন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এখনো মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে।

আমরা অতীতে দেখেছি দেশে বাজেট দেওয়া হচ্ছে নতুন উদারপন্থি পুঁজিবাদের দর্শনের ভিত্তিতে। এ দর্শনের আলোকে দেওয়া বাজেট দ্রুতগতিতে ধনী-গরিব বৈষম্য বাড়াচ্ছে, দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, উদার পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সব দেশেই এ ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে এর প্রভাব হচ্ছে আরও ভয়াবহ। জাতীয় বাজেটে এ ধরনের দর্শন দেশের বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচারের সহায়ক হয়ে উঠছে। ফলে বাজেটের দর্শনগত দিকটি আগে ঠিক করতে হবে। মূল দর্শনকে পাশ কাটিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি খাতের বাজেট বরাদ্দ কিংবা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করা হবে অর্থহীন। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিগত দিক থেকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা হলে বাজেটকে অর্থবহ করে তুলবে।

করোনাকালে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে গার্মেন্ট মালিকদের। মালিকরা প্রথমেই সেখান থেকে একটা অংশ কেটে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শেষমেশ শ্রমিকরা এ প্রণোদনার কোনো সুফল পাননি। এই প্রণোদনা শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে পারেনি কিংবা করোনাকালীন তাদের বেতন কর্তন ও উপার্জন কমে যাওয়ার বিপর্যয় দূর করতে পারেনি। সরকার দরিদ্র মানুষকে সহায়তার জন্য যে অনুদান বা সহায়তা দিয়েছে, তারও অধিকাংশই বেহাত হয়ে গেছে বা সঠিক জায়গায় পৌঁছেনি। এর প্রধান কারণ হলো, যে নীতিগত অবস্থান থেকে বাজেট পরিকল্পনা ও প্রণয়ন করা হচ্ছে তা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীগত লুটপাটের সুবিধা করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ এর থেকে কিছুই পাচ্ছে না। বরং করোনাকালে সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান আরও প্রকট হয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে উদ্বেগজনক এবং আত্মঘাতীমূলক।

করোনা মহামারি সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন স্বনিয়োজিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা। তাই আসন্ন বাজেটে এক-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ করা উচিত স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও গতিশীল করতে, তরুণদের পুনর্বাসন ও বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য সহায়তা করতে। কারণ দেশে রিকশাচালক, ছোট দোকানি কিংবা এ ধরনের ছোট ছোট পেশায় কর্মসংস্থানই বেশি ঘটে। তারাই অর্থনীতির একটা বড় ভিত্তি। অথচ এদের বিপর্যয় কাটানোর জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। তারা কিন্তু নীরবেই টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন। মহামারি মোকাবিলায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবেন ঠিক আছে, কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে বেশি করে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানবান্ধব কর্মসূচি বা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই গণমুখী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। গতানুগতিক নীতিতে কর্মসংস্থানের জন্য কিছু পুঁজিপতির জন্য বরাদ্দ রাখা হলে তারা নতুন বিনিয়োগ কিংবা শিল্প স্থাপন করে কর্মসংস্থান বাড়াবেন- এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। সেটা বাস্তবে দেখা যায় না, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সেটা সম্ভবও নয়। বরং সেই বরাদ্দের সিংহভাগ নানাভাবে লুটপাট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। কারণ পুঁজিপতিরা দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে নয়, মুনাফার জায়গা থেকে চিন্তা করেন। তাই পুঁজিপতিরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সংকুচিত নীতি গ্রহণ করেন, যা এই করোনার সময়েও দেখা গেছে। কর্মসংস্থানের জন্য বরাদ্দ যেন স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানে যুক্ত কর্মজীবী, কর্মহীন বেকার যুবসমাজ ও উদ্যোক্তারা সরাসরি পান- সেটার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেটা করা না হলে করোনাকালে সৃষ্ট বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে না।

করোনকালের সংকট মোকাবিলায় অন্তত দেশের প্রান্তিক মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে প্রাধান্য দিয়ে স্বল্পপুঁজি ও স্বল্প আয়ের লোকদের ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রণোদনা প্রদানসহ মাইক্রো ক্রেডিট ঋণের সুযোগ দিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবন-জীবিকা ও কর্মসংস্থানকে টিকিয়ে রাখতে হবে। অন্যদিকে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর করোনাকালীন সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে সমবায়ভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় যেন তারা নিয়োজিত হতে পারে- সেদিকটায় নজর দেয়া হলে বেশিরভাগ মানুষ বাজেটের উপকারভোগী হবে। আর তা হলে এ বাজেট হবে জনকল্যাণমুখী এবং বাজেট যথার্থই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি]

সোমবার, ৩১ মে ২০২১ , ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৮ শাওয়াল ১৪৪২

বাজেট : প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

image

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হতে পারে ৩ জুন। মহামারি করোনায় বিশে^র টালমাটাল অবস্থা। বিশ্বজুড়েই দেখা দিয়েছে জীবন ও জীবিকার সংকট। এর মধ্যেই চলছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ। করোনা মহামারিতে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।

চলমান করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। প্রতি মুহূর্তে লড়াই করছে জীবন ও জীবিকা নিয়ে। আগামী বাজেটে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে প্রধান অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকার। এজন্য মানুষের জীবন ও জীবিকাকেও প্রাধান্য দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করছে অর্থ বিভাগ। তবে সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতিকে স্বাভাবিক রাখতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে বলে মনে করে অর্থ বিভাগ। করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিকে তৃতীয় অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সার, বীজের ভর্তুকি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের পাশাপাশি এসব উপকরণ ব্যবহার ও আধুনিক কৃষি সম্পর্কে সম্যক ধারণা বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বছরজুড়েই। চলতি বাজেটে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তিন বছরের মধ্যে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। বরং নতুন করে কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ফলে নতুন করে তিন কোটি মানুষ দরিদ্রর খাতায় নাম লিখিয়েছেন। ফলে সামনের দিনগুলোয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সরকারের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগামী বাজেটে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্বাস্থ্য খাত। তবে আগামী দিনগুলোয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, কমে গেছে আয়। ফলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে নতুন করে পরিকল্পনা নিতে হবে। অর্থ বিভাগ মনে করে কোভিড-১৯ পরবর্তী ধসে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি ফেরাতে হবে। শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করতে হবে। একইভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং নারী উদ্যোক্তা যারা ব্যাংক ঋণের বাইরে রয়েছেন তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির নতুন বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। বৈদেশিক শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার করতে হবে। যেসব প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন কোভিড-১৯ পরবর্তী তাদের ফেরত পাঠাতে হবে। যাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না তাদের জন্য দেশেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

মহামারিতে অনেক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এছাড়া আছে অনেক বিত্তহীন মানুষ। ফলে এসব মানুষকে সহায়তা করতে আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সম্প্রসারণ করা হবে। এ বিষয়কে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে ধারণা করা হচ্ছে- আগামী বছরে প্রায় ৮৫ লাখ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যারা সুবিধাভোগী তাদের বাইরে অসংখ্য মানুষ রয়েছে নিম্ন ও গরিব। তাদের দেওয়া হবে স্বল্প ও বিনামূল্যে খাদ্য। এ বিষয়টি আগামী বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ১০ টাকা মূল্যে খাদ্য, কাবিখা, টিআর, ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএসের মাধ্যমে এসব সুবিধা দেওয়া হবে। এসব কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উৎপাদন পর্যায়ে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন ও সারের ভর্তুকি দেওয়া অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকছে। এছাড়া গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ এবং শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে জিডিপির আকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরে এগোচ্ছে। করোনার কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পুরোপুরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন খাত, পরিবহন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এখনো মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে।

আমরা অতীতে দেখেছি দেশে বাজেট দেওয়া হচ্ছে নতুন উদারপন্থি পুঁজিবাদের দর্শনের ভিত্তিতে। এ দর্শনের আলোকে দেওয়া বাজেট দ্রুতগতিতে ধনী-গরিব বৈষম্য বাড়াচ্ছে, দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, উদার পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সব দেশেই এ ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে এর প্রভাব হচ্ছে আরও ভয়াবহ। জাতীয় বাজেটে এ ধরনের দর্শন দেশের বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচারের সহায়ক হয়ে উঠছে। ফলে বাজেটের দর্শনগত দিকটি আগে ঠিক করতে হবে। মূল দর্শনকে পাশ কাটিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি খাতের বাজেট বরাদ্দ কিংবা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করা হবে অর্থহীন। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিগত দিক থেকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা হলে বাজেটকে অর্থবহ করে তুলবে।

করোনাকালে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে গার্মেন্ট মালিকদের। মালিকরা প্রথমেই সেখান থেকে একটা অংশ কেটে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শেষমেশ শ্রমিকরা এ প্রণোদনার কোনো সুফল পাননি। এই প্রণোদনা শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে পারেনি কিংবা করোনাকালীন তাদের বেতন কর্তন ও উপার্জন কমে যাওয়ার বিপর্যয় দূর করতে পারেনি। সরকার দরিদ্র মানুষকে সহায়তার জন্য যে অনুদান বা সহায়তা দিয়েছে, তারও অধিকাংশই বেহাত হয়ে গেছে বা সঠিক জায়গায় পৌঁছেনি। এর প্রধান কারণ হলো, যে নীতিগত অবস্থান থেকে বাজেট পরিকল্পনা ও প্রণয়ন করা হচ্ছে তা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীগত লুটপাটের সুবিধা করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ এর থেকে কিছুই পাচ্ছে না। বরং করোনাকালে সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান আরও প্রকট হয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে উদ্বেগজনক এবং আত্মঘাতীমূলক।

করোনা মহামারি সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন স্বনিয়োজিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা। তাই আসন্ন বাজেটে এক-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ করা উচিত স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও গতিশীল করতে, তরুণদের পুনর্বাসন ও বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য সহায়তা করতে। কারণ দেশে রিকশাচালক, ছোট দোকানি কিংবা এ ধরনের ছোট ছোট পেশায় কর্মসংস্থানই বেশি ঘটে। তারাই অর্থনীতির একটা বড় ভিত্তি। অথচ এদের বিপর্যয় কাটানোর জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। তারা কিন্তু নীরবেই টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন। মহামারি মোকাবিলায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবেন ঠিক আছে, কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে বেশি করে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানবান্ধব কর্মসূচি বা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই গণমুখী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। গতানুগতিক নীতিতে কর্মসংস্থানের জন্য কিছু পুঁজিপতির জন্য বরাদ্দ রাখা হলে তারা নতুন বিনিয়োগ কিংবা শিল্প স্থাপন করে কর্মসংস্থান বাড়াবেন- এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। সেটা বাস্তবে দেখা যায় না, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সেটা সম্ভবও নয়। বরং সেই বরাদ্দের সিংহভাগ নানাভাবে লুটপাট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। কারণ পুঁজিপতিরা দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে নয়, মুনাফার জায়গা থেকে চিন্তা করেন। তাই পুঁজিপতিরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সংকুচিত নীতি গ্রহণ করেন, যা এই করোনার সময়েও দেখা গেছে। কর্মসংস্থানের জন্য বরাদ্দ যেন স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানে যুক্ত কর্মজীবী, কর্মহীন বেকার যুবসমাজ ও উদ্যোক্তারা সরাসরি পান- সেটার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেটা করা না হলে করোনাকালে সৃষ্ট বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে না।

করোনকালের সংকট মোকাবিলায় অন্তত দেশের প্রান্তিক মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে প্রাধান্য দিয়ে স্বল্পপুঁজি ও স্বল্প আয়ের লোকদের ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রণোদনা প্রদানসহ মাইক্রো ক্রেডিট ঋণের সুযোগ দিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবন-জীবিকা ও কর্মসংস্থানকে টিকিয়ে রাখতে হবে। অন্যদিকে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর করোনাকালীন সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে সমবায়ভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় যেন তারা নিয়োজিত হতে পারে- সেদিকটায় নজর দেয়া হলে বেশিরভাগ মানুষ বাজেটের উপকারভোগী হবে। আর তা হলে এ বাজেট হবে জনকল্যাণমুখী এবং বাজেট যথার্থই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি]