বাজেট বাস্তবায়নই অর্থমন্ত্রীর বড় চ্যালেঞ্জ

করোনা পরিস্থিতে দেশের অর্থনীতি চাপে আছে। বহু মানুষ হারিয়েছে আয় রোজগারের পথ। এই স্থবির অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রয়োজন। আর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।

সে কারণে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারকেই উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে হবে অর্থনীতিতে প্রাণচঞ্চল সৃষ্টি করার জন্য। উন্নয়ন ব্যয় বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে।

কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় দশ মাসে দেখা গেছে, উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ৪২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। আর করোনাকালে যে খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল, সেই খাতে গত অর্থবছরের দশ মাসে স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট বরাদ্দের মাত্র ২১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ চলমান মহামারীর সময়ে যে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, সেই খাতের বাজেট বাস্তবায়নই করেছে সবচেয়ে কম।

আবার সরকার যে রাজস্ব আয়ের ওপর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে তার চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বাকি রয়েছে আরও ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা।

অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। তার জন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, অর্থনীতি চাঙ্গা করা ও একই সঙ্গে সঠিকভাবে বাজেট বাস্তবায়ন করা।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘এবারের বাজেট সম্প্রসারণমূলক হওয়া দরকার। অর্থাৎ সরকারকে ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যয় বৃদ্ধি করলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। তবে সম্প্রসারণমূলক হওয়া মানে এই নয়, আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামাঞ্জস্য থাকবে না। ব্যয় যেমন করতে হবে বেশি, তেমনি আয়ও করতে হবে বেশি। এখন যেটা হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু আয় হচ্ছে না। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বৃদ্ধি করতে পারলে সেই সমস্যাটা থাকবে না।’

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে, বাকি চার মাসে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর সময়ে লক্ষ্যমাত্রার কতটা রাজস্ব আহরণ সম্ভব তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

সেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে। এছাড়া এবার এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য বাড়ানো হচ্ছে, যার আকার হবে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিবছর যে এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় এবং প্রতিবছরই এনবিআর তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। তাহলে বেশি লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে বা লাভ কি?

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুপারিশ করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানও। তিনি বলেছেন, ‘অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রামের প্রচ্ছন্ন বেকার মানুষগুলো এখনও শহরের দিকে আসার চেষ্টা করছে। এসব মানুষকে কিভাবে প্রণোদনার আওতায় আনা যায় তা মধ্য মেয়াদি কার্যক্রমের আওতায় খুঁজে বের করতে হবে।’

এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক সুরক্ষা খাত শক্তিশালী করা। এই খাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বরাদ্দের তুলনায় আমাদের বরাদ্দ সবচেয়ে কম।’

অর্থনীতি চাঙ্গা করতে উন্নয়ন ব্যয় বা এডিপির আকার বৃদ্ধির কথা বলা হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ প্রতি বাজেটে যে পরিমাণ উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয় তা বাস্তবায়ন হয় না।

চলতি অর্থবছরের নয় মাস পেরিয়ে গেলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্ধেক অর্থও খরচ করতে পারেনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। মার্চ পর্যন্ত এডিপির বাস্তবায়ন ৪২ শতাংশের নিচে, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে এডিপির আকার ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো, যা চলতি অর্থবছরের মূল বরাদ্দের চেয়ে ১২-১৫ হাজার কোটি টাকা বেশি।

গত বছরের শুরুতে করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়। সেই করোনা সংক্রমণকে মাথায় নিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাজেটে করোনা সংক্রমণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়। যে খাতটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হলো, সেই খাতটির বাজেট বাস্তবায়ন একেবারে হতাশাজনক। এই খাতটি সরকারের গলার কাঁটার মতো বিধে রয়েছে।

গত অর্থবছরের দশ মাসে স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট বরাদ্দের মাত্র ২১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। অথচ এ সময়ে বাজেট বাস্তবায়নের জাতীয় গড়ই ছিল ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ চলমান মহামারীর সময়ে যে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, সেই খাতের বাজেট বাস্তবায়নই করেছে সবচেয়ে কম।

এই তো গত বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। এগুলো ছাড়াও যে ২১ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলোও দুর্নীতিতে ভরা। বরাদ্দসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটায় নানা অনিয়ম উঠে এসেছে। যারা এর দায়িত্বে ছিলেন তারা ব্যাপক অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। করোনার সংকটময় সময়ে স্বাস্থ্য খাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার দাবি জনগণের পক্ষ থেকেই ছিল। সরকারও সেই খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে কিন্তু এই খাতের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে মিল না থাকার কারণেই ঘাটতি দেখা দেয়। বাজেটের আয়ের বড় অংশ আসে রাজস্ব খাত থেকে।

এক্ষেত্রে রাজস্বের পরিধি বাড়ানোর চেয়ে করজাল বৃদ্ধির পরামর্শ দেন মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘যারা কর দিচ্ছে তাদের না ধরে যারা করের আওতায় নেই তাদের ধরা উচিত। বাংলাদেশে যে সংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করের আওতায় রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করযোগ্য। যারা করযোগ্য তাদের করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’

সরকার প্রতিবছরই খুব উচ্চাশা নিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঘোষণা করে। কিন্তু সরকারের ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা নিয়েও বিশেষজ্ঞ মহলে নানা সমালোচনা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থাও বাংলাদেশের জিডিপি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। সরকার যেসব তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হিসাব করে সেই তথ্য-উপাত্তের ওপরও ভরসা পান না তারা।

তবে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই উচ্চাভিলাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে আসছে সরকার। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১ শতাংশের বেশি কমানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য থাকবে ৭ শতাংশের ঘরে।

এর আগে চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা এক দফা কমিয়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ করা হয়। এখন আরেক দফায় তা কমিয়ে ৬ শতাংশের নিচে আনা হবে বলে জানা গেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক সংবাদকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি, গত অর্থবছরের প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে এবং চলতি অর্থবছরেরটিও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আগামী বাজেটটিও বাস্তবসম্মত করা হচ্ছে।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আগামী ৩ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সরকার নতুন বাজেটের আকার ৬ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ধরে এগোচ্ছে। তবে শেষ মুহূর্তে কিছু বাড়তে বা কমতে পারে।

চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরের মতোই এবারও বাজেটের আকার বাড়ছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশের সমান। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেট হবে সম্প্রসারণমূলক। এতে ঘাটতি ধরা হবে জিডিপির ৬ দশমিক ২ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে।

সেই হিসাবে আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে। আর এটিই হবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাজেট ঘাটতি।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাজেট বাস্তবসম্মত করা উচিত। বড় বড় বাজেট দেয়া হলো, কিন্তু বছর শেষে বড় ঘাটতি থেকে গেল, তাহলে বড় বাজেট ঘোষণা করে লাভ হলো না। আয়-ব্যয়ের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা দরকার।’

মঙ্গলবার, ০১ জুন ২০২১ , ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৯ শাওয়াল ১৪৪২

বাজেট বাস্তবায়নই অর্থমন্ত্রীর বড় চ্যালেঞ্জ

রেজাউল করিম

করোনা পরিস্থিতে দেশের অর্থনীতি চাপে আছে। বহু মানুষ হারিয়েছে আয় রোজগারের পথ। এই স্থবির অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রয়োজন। আর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।

সে কারণে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারকেই উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে হবে অর্থনীতিতে প্রাণচঞ্চল সৃষ্টি করার জন্য। উন্নয়ন ব্যয় বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে।

কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় দশ মাসে দেখা গেছে, উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ৪২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। আর করোনাকালে যে খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল, সেই খাতে গত অর্থবছরের দশ মাসে স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট বরাদ্দের মাত্র ২১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ চলমান মহামারীর সময়ে যে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, সেই খাতের বাজেট বাস্তবায়নই করেছে সবচেয়ে কম।

আবার সরকার যে রাজস্ব আয়ের ওপর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে তার চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বাকি রয়েছে আরও ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা।

অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। তার জন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, অর্থনীতি চাঙ্গা করা ও একই সঙ্গে সঠিকভাবে বাজেট বাস্তবায়ন করা।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘এবারের বাজেট সম্প্রসারণমূলক হওয়া দরকার। অর্থাৎ সরকারকে ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যয় বৃদ্ধি করলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। তবে সম্প্রসারণমূলক হওয়া মানে এই নয়, আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামাঞ্জস্য থাকবে না। ব্যয় যেমন করতে হবে বেশি, তেমনি আয়ও করতে হবে বেশি। এখন যেটা হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু আয় হচ্ছে না। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বৃদ্ধি করতে পারলে সেই সমস্যাটা থাকবে না।’

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে, বাকি চার মাসে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর সময়ে লক্ষ্যমাত্রার কতটা রাজস্ব আহরণ সম্ভব তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

সেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে। এছাড়া এবার এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য বাড়ানো হচ্ছে, যার আকার হবে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিবছর যে এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় এবং প্রতিবছরই এনবিআর তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। তাহলে বেশি লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে বা লাভ কি?

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুপারিশ করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানও। তিনি বলেছেন, ‘অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রামের প্রচ্ছন্ন বেকার মানুষগুলো এখনও শহরের দিকে আসার চেষ্টা করছে। এসব মানুষকে কিভাবে প্রণোদনার আওতায় আনা যায় তা মধ্য মেয়াদি কার্যক্রমের আওতায় খুঁজে বের করতে হবে।’

এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক সুরক্ষা খাত শক্তিশালী করা। এই খাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বরাদ্দের তুলনায় আমাদের বরাদ্দ সবচেয়ে কম।’

অর্থনীতি চাঙ্গা করতে উন্নয়ন ব্যয় বা এডিপির আকার বৃদ্ধির কথা বলা হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ প্রতি বাজেটে যে পরিমাণ উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয় তা বাস্তবায়ন হয় না।

চলতি অর্থবছরের নয় মাস পেরিয়ে গেলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্ধেক অর্থও খরচ করতে পারেনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। মার্চ পর্যন্ত এডিপির বাস্তবায়ন ৪২ শতাংশের নিচে, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে এডিপির আকার ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো, যা চলতি অর্থবছরের মূল বরাদ্দের চেয়ে ১২-১৫ হাজার কোটি টাকা বেশি।

গত বছরের শুরুতে করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়। সেই করোনা সংক্রমণকে মাথায় নিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাজেটে করোনা সংক্রমণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়। যে খাতটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হলো, সেই খাতটির বাজেট বাস্তবায়ন একেবারে হতাশাজনক। এই খাতটি সরকারের গলার কাঁটার মতো বিধে রয়েছে।

গত অর্থবছরের দশ মাসে স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট বরাদ্দের মাত্র ২১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। অথচ এ সময়ে বাজেট বাস্তবায়নের জাতীয় গড়ই ছিল ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ চলমান মহামারীর সময়ে যে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, সেই খাতের বাজেট বাস্তবায়নই করেছে সবচেয়ে কম।

এই তো গত বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। এগুলো ছাড়াও যে ২১ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলোও দুর্নীতিতে ভরা। বরাদ্দসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটায় নানা অনিয়ম উঠে এসেছে। যারা এর দায়িত্বে ছিলেন তারা ব্যাপক অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। করোনার সংকটময় সময়ে স্বাস্থ্য খাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার দাবি জনগণের পক্ষ থেকেই ছিল। সরকারও সেই খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে কিন্তু এই খাতের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে মিল না থাকার কারণেই ঘাটতি দেখা দেয়। বাজেটের আয়ের বড় অংশ আসে রাজস্ব খাত থেকে।

এক্ষেত্রে রাজস্বের পরিধি বাড়ানোর চেয়ে করজাল বৃদ্ধির পরামর্শ দেন মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘যারা কর দিচ্ছে তাদের না ধরে যারা করের আওতায় নেই তাদের ধরা উচিত। বাংলাদেশে যে সংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করের আওতায় রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করযোগ্য। যারা করযোগ্য তাদের করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’

সরকার প্রতিবছরই খুব উচ্চাশা নিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঘোষণা করে। কিন্তু সরকারের ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা নিয়েও বিশেষজ্ঞ মহলে নানা সমালোচনা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থাও বাংলাদেশের জিডিপি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। সরকার যেসব তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হিসাব করে সেই তথ্য-উপাত্তের ওপরও ভরসা পান না তারা।

তবে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই উচ্চাভিলাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে আসছে সরকার। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১ শতাংশের বেশি কমানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য থাকবে ৭ শতাংশের ঘরে।

এর আগে চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা এক দফা কমিয়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ করা হয়। এখন আরেক দফায় তা কমিয়ে ৬ শতাংশের নিচে আনা হবে বলে জানা গেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক সংবাদকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি, গত অর্থবছরের প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে এবং চলতি অর্থবছরেরটিও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আগামী বাজেটটিও বাস্তবসম্মত করা হচ্ছে।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আগামী ৩ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সরকার নতুন বাজেটের আকার ৬ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ধরে এগোচ্ছে। তবে শেষ মুহূর্তে কিছু বাড়তে বা কমতে পারে।

চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরের মতোই এবারও বাজেটের আকার বাড়ছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশের সমান। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেট হবে সম্প্রসারণমূলক। এতে ঘাটতি ধরা হবে জিডিপির ৬ দশমিক ২ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে।

সেই হিসাবে আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে। আর এটিই হবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাজেট ঘাটতি।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাজেট বাস্তবসম্মত করা উচিত। বড় বড় বাজেট দেয়া হলো, কিন্তু বছর শেষে বড় ঘাটতি থেকে গেল, তাহলে বড় বাজেট ঘোষণা করে লাভ হলো না। আয়-ব্যয়ের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা দরকার।’