কলাবাগানে ডা. সাবিরার মরদেহ উদ্ধার, তাকে হত্যা করা হয়েছে

পরিবার ও পুলিশের দাবি

রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে এক নারী চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপির (৪৭) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরিবার ও পুলিশ বলছে হত্যাকান্ড। গতকাল সকাল ১০টার দিকে কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের কনসালটেন্ট (সনোলজিস্ট) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিহতের পরিবার বলছে, সাবিরা রহমানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশও বলছে, এটি হত্যাকান্ড। তাকে শ্বাসনালী কেটে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়েছে।

নিহত সাবিরা রহমান যে বাসায় থাকতেন সেই বাসা থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখে ফায়ার সার্ভিসকে কল করেন বাড়ির অন্য লোকজন। খবর পেয়ে ওই বাসায় গিয়ে সাবিরা রহমানের লাশ দেখতে পান ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুমের ডিউটি অফিসার লিমা খানম বলেন, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে সেখানে গিয়ে ধোঁয়া দেখতে পান। সেখান থেকে একটি দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহটির গলা ও পায়ের সামনের অংশ দগ্ধ ছিল। পেটসহ অন্যান্য অংশ দগ্ধ ছিল না। ঘরের তোশক পুড়ে গিয়েছিল। এসব দেখে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পুলিশকে খবর দিলে পরে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।

সাবিরার মামাতো ভাই মো. রেজাউল হাসান জানান, সাবিরা রহমান যে বাসায় থাকতেন সেখানে তিনটি কক্ষের মধ্যে একটিতে তিনি একাই থাকতেন। বাকি দুটি কক্ষ সাবলেট দিয়েছিলেন। তবে বাড়ির মালিক মাহবুব ইসলাম বলেন, সাবলেট দেয়ার বিষয়টি তিনি জানতেন না। মরদেহ উদ্ধারের পর জানতে পেরেছেন, বাকি দুটি কক্ষ তিনি অন্যজনের কাছে ভাড়া দিয়েছিলেন। রেজাউল হাসান বলেন, সাবিরা রহমানের সঙ্গে একটি মেয়ে সাবলেট থাকত বলে জানি। মেয়েটি লেখাপড়া করে। সাবিরার মায়ের বাসা পাশেই। তার মায়ের এক ছেলে, এক মেয়ে থাকত। ছেলের বয়স ২১। ছেলেটি কানাডা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর মেয়ের বয়স ১১ বছর। মেয়েটি কলাবাগানের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। আর সাবিরার স্বামী সামসুদ্দিন আজাদ ন্যাশনাল ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি শান্তিনগরে থাকতেন।

নিহতের স্বামী সামসুদ্দিন আজাদ বলেন, গতকাল বেলা ১১টার দিকে তিনি শাশুড়ির ফোন পেয়ে সাবিরার বাসায় ছুটে আসেন। তবে প্রথমে পুলিশ তাকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। দুপুর আড়াইটার দিকে ঘরে প্রবেশ করে বিছানার উপর স্ত্রীকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান তিনি। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীকে নিঃসন্দেহে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো খুনিরা হত্যার মোটিভ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে। আমি মনে করি, এটি একটি হত্যাকান্ড। এ হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক তদন্ত ও দোষিদের বিচার হবে। স্ত্রীর সঙ্গে না থেকে কেন তিনি আলাদা বাসায় থাকতেন, জানতে চাইলে সামসুদ্দিন আজাদ বলেন, তার ১১ বছরের মেয়ে কলাবাগানের একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। আমার বৃদ্ধা শাশুড়িকে দেখভালের সুবিধার্থে লিপি কলাবাগানের ওই বাসায় থাকতেন।

এদিকে সাবিরা রহমান লিপির রক্তাক্ত ও দগ্ধ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ইতোমধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে, এটি ঠান্ডা মাথার খুন নাকি অগ্নিকান্ডেয মৃত্যু? খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। তারা মরদেহ থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন। সিআইডিও বলছে, অগ্নিকান্ড নয়, এটি হত্যাকান্ড। যা গত রোববার মধ্যরাতের যে কোন সময় সংঘটিত হয়েছে। ক্রাইম সিন জানায়, সাবিরাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর বিছানার তোশকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তবে দাহ্য পদার্থ না থাকায় আগুন তেমন ছড়াতে পারেনি।

সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের ইন্সপেক্টর শেখ রাসেল কবির বলেন, ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাবিরার শ্বাসনালী কেটে ফেলা হয়েছে। তার দেহে রক্ত ও পোড়ার ক্ষত আছে। তবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, এটি হত্যাকান্ড।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান ডিবি পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক। তিনি বলেন, গতকাল সকালে সাবলেটে থাকা তরুণী হাঁটতে বের হয়েছিলেন। হেঁটে আসার পর তিনি বাসায় ফিরে দেখেন, চিকিৎসক সাবিরার রুম বন্ধ। রুমের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। পরে তিনি দারোয়ানকে ডেকে চাবি এনে রুমের তালা খুলে দেখতে পান চিকিৎসক সাবিরা ফ্লোরে পড়ে আছেন। সবাই ভেবেছিলেন, চিকিৎসক আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। পরে ডিবি পুলিশ এসে তার গলায় একটি ও পিঠে দুটি আঘাতের চিহ্ন পায়। আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি, দ্রুত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারব। এ ঘটনার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাবলেট থাকা এক শিক্ষার্থী, তার এক বন্ধু ও বাড়ির দারোয়ান রমজানকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

ডিবি সূত্র জানায়, ডা. সাবিরা দুটি বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম স্বামী চিকিৎসক ছিলেন। তিনি একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে সাবিরা সামসুদ্দিন আজাদকে বিয়ে করেন। তবে দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে বনিবনা ছিল না তার। তার আগের স্বামীর ঘরে একটি ছেলে এবং দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে ১১ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রব্বানী জানান, নিহতের পরিবার মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

মঙ্গলবার, ০১ জুন ২০২১ , ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৯ শাওয়াল ১৪৪২

কলাবাগানে ডা. সাবিরার মরদেহ উদ্ধার, তাকে হত্যা করা হয়েছে

পরিবার ও পুলিশের দাবি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে এক নারী চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপির (৪৭) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরিবার ও পুলিশ বলছে হত্যাকান্ড। গতকাল সকাল ১০টার দিকে কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের কনসালটেন্ট (সনোলজিস্ট) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিহতের পরিবার বলছে, সাবিরা রহমানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশও বলছে, এটি হত্যাকান্ড। তাকে শ্বাসনালী কেটে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়েছে।

নিহত সাবিরা রহমান যে বাসায় থাকতেন সেই বাসা থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখে ফায়ার সার্ভিসকে কল করেন বাড়ির অন্য লোকজন। খবর পেয়ে ওই বাসায় গিয়ে সাবিরা রহমানের লাশ দেখতে পান ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুমের ডিউটি অফিসার লিমা খানম বলেন, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে সেখানে গিয়ে ধোঁয়া দেখতে পান। সেখান থেকে একটি দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহটির গলা ও পায়ের সামনের অংশ দগ্ধ ছিল। পেটসহ অন্যান্য অংশ দগ্ধ ছিল না। ঘরের তোশক পুড়ে গিয়েছিল। এসব দেখে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পুলিশকে খবর দিলে পরে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।

সাবিরার মামাতো ভাই মো. রেজাউল হাসান জানান, সাবিরা রহমান যে বাসায় থাকতেন সেখানে তিনটি কক্ষের মধ্যে একটিতে তিনি একাই থাকতেন। বাকি দুটি কক্ষ সাবলেট দিয়েছিলেন। তবে বাড়ির মালিক মাহবুব ইসলাম বলেন, সাবলেট দেয়ার বিষয়টি তিনি জানতেন না। মরদেহ উদ্ধারের পর জানতে পেরেছেন, বাকি দুটি কক্ষ তিনি অন্যজনের কাছে ভাড়া দিয়েছিলেন। রেজাউল হাসান বলেন, সাবিরা রহমানের সঙ্গে একটি মেয়ে সাবলেট থাকত বলে জানি। মেয়েটি লেখাপড়া করে। সাবিরার মায়ের বাসা পাশেই। তার মায়ের এক ছেলে, এক মেয়ে থাকত। ছেলের বয়স ২১। ছেলেটি কানাডা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর মেয়ের বয়স ১১ বছর। মেয়েটি কলাবাগানের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। আর সাবিরার স্বামী সামসুদ্দিন আজাদ ন্যাশনাল ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি শান্তিনগরে থাকতেন।

নিহতের স্বামী সামসুদ্দিন আজাদ বলেন, গতকাল বেলা ১১টার দিকে তিনি শাশুড়ির ফোন পেয়ে সাবিরার বাসায় ছুটে আসেন। তবে প্রথমে পুলিশ তাকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। দুপুর আড়াইটার দিকে ঘরে প্রবেশ করে বিছানার উপর স্ত্রীকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান তিনি। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীকে নিঃসন্দেহে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো খুনিরা হত্যার মোটিভ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে। আমি মনে করি, এটি একটি হত্যাকান্ড। এ হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক তদন্ত ও দোষিদের বিচার হবে। স্ত্রীর সঙ্গে না থেকে কেন তিনি আলাদা বাসায় থাকতেন, জানতে চাইলে সামসুদ্দিন আজাদ বলেন, তার ১১ বছরের মেয়ে কলাবাগানের একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। আমার বৃদ্ধা শাশুড়িকে দেখভালের সুবিধার্থে লিপি কলাবাগানের ওই বাসায় থাকতেন।

এদিকে সাবিরা রহমান লিপির রক্তাক্ত ও দগ্ধ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ইতোমধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে, এটি ঠান্ডা মাথার খুন নাকি অগ্নিকান্ডেয মৃত্যু? খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। তারা মরদেহ থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন। সিআইডিও বলছে, অগ্নিকান্ড নয়, এটি হত্যাকান্ড। যা গত রোববার মধ্যরাতের যে কোন সময় সংঘটিত হয়েছে। ক্রাইম সিন জানায়, সাবিরাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর বিছানার তোশকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তবে দাহ্য পদার্থ না থাকায় আগুন তেমন ছড়াতে পারেনি।

সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের ইন্সপেক্টর শেখ রাসেল কবির বলেন, ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাবিরার শ্বাসনালী কেটে ফেলা হয়েছে। তার দেহে রক্ত ও পোড়ার ক্ষত আছে। তবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, এটি হত্যাকান্ড।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান ডিবি পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক। তিনি বলেন, গতকাল সকালে সাবলেটে থাকা তরুণী হাঁটতে বের হয়েছিলেন। হেঁটে আসার পর তিনি বাসায় ফিরে দেখেন, চিকিৎসক সাবিরার রুম বন্ধ। রুমের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। পরে তিনি দারোয়ানকে ডেকে চাবি এনে রুমের তালা খুলে দেখতে পান চিকিৎসক সাবিরা ফ্লোরে পড়ে আছেন। সবাই ভেবেছিলেন, চিকিৎসক আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। পরে ডিবি পুলিশ এসে তার গলায় একটি ও পিঠে দুটি আঘাতের চিহ্ন পায়। আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি, দ্রুত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারব। এ ঘটনার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাবলেট থাকা এক শিক্ষার্থী, তার এক বন্ধু ও বাড়ির দারোয়ান রমজানকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

ডিবি সূত্র জানায়, ডা. সাবিরা দুটি বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম স্বামী চিকিৎসক ছিলেন। তিনি একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে সাবিরা সামসুদ্দিন আজাদকে বিয়ে করেন। তবে দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে বনিবনা ছিল না তার। তার আগের স্বামীর ঘরে একটি ছেলে এবং দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে ১১ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রব্বানী জানান, নিহতের পরিবার মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।