বৈশ্বিক মহামারীতে সম্প্রীতির শিক্ষা

মিথুশিলাক মুরমু

১.

করোনাকালীন ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আমার মনকে ছুঁয়ে গেছে। কেরালার তিরুবনন্তপুরমের পলাক্কড় জেলায় একটি বেসামরিক হাসপাতালে চিকিৎসক ডা. রেখা কৃষ্ণা একজন মুসলিম মৃত্যুপথযাত্রী করোনা রোগীকে শোনালেন ইসলাম ধর্মের পবিত্র কালেমা- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৫.৫.২০২১)। চিকিৎসক ডা. রেখা কৃষ্ণা হৃদয় থেকে উপলব্ধি করেছিলেন, রোগী কাকে যেন খুঁজে ফিরছেন; পরিস্থিতি বিবেচনা করেই রোগীর কাছে গিয়ে কানে নাকে শোনালেন ধর্মের অমীয় বাণী। তারপর তিনি দেখেন এক সুন্দর প্রশান্তি ওই রোগীর মধ্যে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময়ও এই প্রশান্তি লক্ষ্য করেছেন ডা. রেখা।

এক প্রশ্নের উত্তরে ডা. রেখা বলছিলেন, ‘আমি জন্মেছি ও বড় হয়েছি দুবাইতে। মুসলিমদের নানা প্রথা সম্পর্কে আমি অবহিত। আমি এরকম একটি পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে সমস্ত বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়া হয়। ... আমি আমার কর্তব্য করেছি। এটা কোনও ধর্মীয় আচার পালন করিনি, শুধু মানবিকতার কাজ করেছি।’ ইসলামিক স্কলাররা এতে খুবই উচ্ছ্বসিত এবং প্রশংসা করেছেন। বলেছেন- সাধারণত রোগীর অন্তিম সময়ে নিকটাত্মীয়রা বা ধর্মীয় শিক্ষকরা এ ধরনের প্রথা পালন করেন। এক্ষেত্রে অনন্য নজির তৈরি করেছেন ওই চিকিৎসক। মন ছুঁয়ে যাওয়া কাজ করেছেন চিকিৎসক। চিকিৎসকরাই তো সম্প্রীতির প্রতীক।

২.

বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জে করোনা রোগের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক ব্যবসায়ী। তার মৃত্যুতে একই ফ্ল্যাটে থাকা মুসলিম বন্ধু এগিয়ে আসেন। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মাকছুদুল আলম খন্দকার ও তার দলবল। এ কাজের পরপরই সংবাদে শিরোনাম হয়েছিল- ‘করোনাভাইরাস : নারায়ণগঞ্জে রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া হিন্দু ব্যবসায়ীর মুখাগ্নি করলেন মুসলিম কাউন্সিলর’ (ইত্তেফাক ২৭ এপ্রিল, ২০২০)। সেদিন মৃত ব্যক্তির ভাই ও শ্যালকের মাধ্যমে খবর পেয়ে মৃত ব্যক্তির সৎকারের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। হিন্দু ব্যবসায়ীর কোনো নিকটাত্মীয় না আসায় কাউন্সিলর স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এগিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন- আমরা তো মুসলিম, আমরা যদি সৎকার করি তাহলে কি কোনো আপত্তি আছে? স্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে ওই ব্যবসায়ীর লাশ সিটি কর্পোরেশনের কেন্দ্রীয় শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে থাকা পুরোহিতের সহায়তায় শেষকৃত্য করা হয়। আমরা নিজেরাই ওই ব্যক্তির মুখাগ্নি করি। কাউন্সিলরের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের মধ্যে কাঠমিস্ত্রি, গার্মেন্টস কর্মী ও শিক্ষার্থী রয়েছেন। ওই দিন পর্যন্ত ৩৪ জনের মধ্যে ৬ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, এদের মধ্যে ৩ জনের মুখাগ্নি নিজেই করেছেন।

৩.

পাবনার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সম্প্রীতির উদাহরণ অবিস্মরণীয়। পাবনা ব্যাপ্টিস্ট মিশনের খ্রিস্ট বিশ্বাসী জেমস সুব্রত গোস্বামী জ¦র, সর্দি, কাশির উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করলে আতঙ্কে স্বজন ও খ্রিস্টানরা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকে। এক পর্যায়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই স্বেচ্ছাসেবী দলের সহযোগিতা চায় পরিবারটি। ধর্ম পরিচয় ও সামাজিক সংকীর্ণতাকে তুচ্ছ করে যাজকের নির্দেশনায় খ্রিস্টীয় রীতিতে সম্মানের সঙ্গে তাকে সমাধিস্থ করেন কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবীরা। এছাড়াও এই স্বেচ্ছাসেবীরা দুইজন সনাতন ধর্মাবলম্বীর সৎকার সম্পন্ন করেছেন। তাদের এই কাজে উজ্জীবিত হয়েছে দেশবাসী, সব ধর্মের নাগরিক। পত্রিকা পাতায় লেখা হলো- ‘বিশ্বাস ভিন্ন, তবু শেষকৃত্য তাদেরই হাতে’ (ইত্তেফাক ২৭ জুন, ২০২০)।

পাবনা ব্যাপ্টিস্ট মিশনের কবরস্থান কমিটির সভাপতি কলিট তালুকদার বলেছেন- ‘জ¦র, সর্দি, কাশির উপসর্গে সুব্রত গোস্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও তার নমুনা পরীক্ষা করতে পারিনি। স্বেচ্ছাসেবকরা মুসলিম হওয়ায় তাই সঙ্কোচ বোধ করছিলাম, আদৌ তারা খ্রিস্টান ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করবে কিনা! কিন্তু ফোন করা মাত্র আমাকে অবাক করে দিয়ে ছুটে আসেন তারা। স্বেচ্ছাসেবীরা এই দুঃসময়ে যেভাবে কাজ করেছেন তা করোনাকালীন স্বার্থপরতা আর অমানবিকতার বিপরীতে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত, সাম্প্রদায়িকতা আর হিংসা-বিদ্বেষে ভরা সমাজের জন্য এক নতুন শিক্ষা।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ধর্মীয় রীতি মেনে তারা সৎকার করেছেন সব ধর্মের মানুষের মরদেহ। তারা করোনা মহামারীর দুর্যোগময় মুহূর্তে সাহসিকতার অনন্য নজির স্থাপন করে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছেন।

৪.

সমাজ যাদের অচ্ছুৎ মনে করে, যারা মৃত্যবরণ করলে কবরস্থানের মাটিতে স্থান সংকুলান হয় না কিংবা যাদেরকে দেখলে আমরা নিরাপদ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করি, সেই হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার সঞ্জীবনী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন; মানুষ মানুষের জন্যেই। সংস্কৃতির একটি শ্লোক প্রাণিধানযোগ্য- ‘যিনি রাজদ্বারে, দুর্ভিক্ষে দুর্দিনে এবং শ্মশানে বন্ধুর পাশেই থাকেন, তিনিই প্রকৃত বন্ধু’। এই ট্রান্সজেন্ডার সঞ্জীবনীর আরেক নাম সজীব সতেজ। জন্মে নামকরণ করা হয়েছিলো আশিকুল ইসলাম, স্রষ্টার কী ইচ্ছে আশিকুল রূপান্তরিত হয়ে গেলেন সঞ্জীবনীতে। সঞ্জীবনী মে-২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে করোনায় মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের দাফন-কাফন বা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি ও রেওয়াজ অনুযায়ী সৎকারের দায়িত্ব আনন্দের সঙ্গেই পালন করে আসছে। শুধু সঞ্জীবনী নয়, এটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরো পাঁচ পুরুষ সদস্য। মৃত ব্যক্তির স্বজন থাকলে তাদের সঙ্গে কথা বলাসহ পুরো কাজের সমন্বয় করেন। দলের সদস্য হিসেবে লাশের গোসল, দাফনসহ অন্যান্য কাজেও হাত লাগাতে হয়। দলনেতা হিসেবে তিনিই কাজটি করে থাকেন।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ক্যাম্প থেকে কাজ করছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে কোথায় করোনায় রোগী মারা গেছেন, সে তথ্য পেয়ে সঞ্জীবনী তার দলের সদস্যদের নিয়ে হাসপাতালে যান। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন লাশের কাছে যেতে ভয় পেতেন। তাই লাশের শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতার পুরো কাজটিই করতে হতো সঞ্জীবনী ও তার দলের সদস্যদের। সঞ্জীবনী ভাষ্যমতে, গত বছরের তুলনায় বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টেছে। বর্তমানে লাশের কাছে আসতে চান না, এমন স্বজনদের সংখ্যা কম। করোনায় মারা গেলে চারপাশে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক ছিল, তা-ও অনেক কমেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা সঞ্জীবনী বক্তব্য- মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অনুযায়ী বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতাগুলো শিখেছেন। মৃতের ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী কখনো লাশ নিয়ে যাচ্ছেন কবরস্থানে, কখনো শ্মশানে। ২৪ ঘণ্টায় সদা প্রস্তুত, যে কোনো সময় ডাক এলেই সুরক্ষিত পোশাক পিপিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজে নেমে পড়েন টিমসহ। তার মতে, সাহায্যের হিসাব চেয়ে কাজটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মমতার স্পর্শে শেষ বিদায় দিতে চান মৃতদের।

করোনাকালীন এবং রমজান মাসে বিদেশের মাটিতে অবলোকন করেছি, গির্জাঘরগুলো নামাজের লক্ষ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জুমার নামাজসহ সেখানে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পেরেছেন। সত্যিই কী অপূর্ব দৃষ্টান্ত, মানসিকতা ও মনোভাব।

বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ নিজ ধর্ম ও বিশ্বাসের মধ্যে থেকে সম্প্রীতিকে সাক্ষ্যে পরিণত করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত সম্প্রীতি আজ বিশ্বসভায় আলোচিত এবং বিশ্ববাসীকে পথ দেখায়। তিনি বলেতেন ‘...শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে আমরা বিশ্বাসী। আমরা প্রতিবেশীদের সহিত সম্মানজনক সম্পর্ক গড়িয়া তুলিতে চাই’ (আজাদ ৪ জানুয়ারি, ১৯৭১)। আরো বলেছেন- ‘...ইসলামী আদর্শেই আমি বলিতেছি, এই দেশে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান সমান অধিকার নিয়েই থাকিবে’ (আজাদ ৪ জানুয়ারি, ১৯৭১)। তিনি জীবনভর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বাস লালন করেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবোধে বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও শত-সহস্র জাতিগোষ্ঠীকে একীভূত করতে সমর্থ হয়েছেন। বাংলার জনসাধারণ ভালোবেসে ‘বঙ্গবন্ধুতে’ আখ্যায়িত করেছেন; সত্যিই তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।

মঙ্গলবার, ০১ জুন ২০২১ , ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৯ শাওয়াল ১৪৪২

বৈশ্বিক মহামারীতে সম্প্রীতির শিক্ষা

মিথুশিলাক মুরমু

১.

করোনাকালীন ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আমার মনকে ছুঁয়ে গেছে। কেরালার তিরুবনন্তপুরমের পলাক্কড় জেলায় একটি বেসামরিক হাসপাতালে চিকিৎসক ডা. রেখা কৃষ্ণা একজন মুসলিম মৃত্যুপথযাত্রী করোনা রোগীকে শোনালেন ইসলাম ধর্মের পবিত্র কালেমা- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৫.৫.২০২১)। চিকিৎসক ডা. রেখা কৃষ্ণা হৃদয় থেকে উপলব্ধি করেছিলেন, রোগী কাকে যেন খুঁজে ফিরছেন; পরিস্থিতি বিবেচনা করেই রোগীর কাছে গিয়ে কানে নাকে শোনালেন ধর্মের অমীয় বাণী। তারপর তিনি দেখেন এক সুন্দর প্রশান্তি ওই রোগীর মধ্যে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময়ও এই প্রশান্তি লক্ষ্য করেছেন ডা. রেখা।

এক প্রশ্নের উত্তরে ডা. রেখা বলছিলেন, ‘আমি জন্মেছি ও বড় হয়েছি দুবাইতে। মুসলিমদের নানা প্রথা সম্পর্কে আমি অবহিত। আমি এরকম একটি পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে সমস্ত বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়া হয়। ... আমি আমার কর্তব্য করেছি। এটা কোনও ধর্মীয় আচার পালন করিনি, শুধু মানবিকতার কাজ করেছি।’ ইসলামিক স্কলাররা এতে খুবই উচ্ছ্বসিত এবং প্রশংসা করেছেন। বলেছেন- সাধারণত রোগীর অন্তিম সময়ে নিকটাত্মীয়রা বা ধর্মীয় শিক্ষকরা এ ধরনের প্রথা পালন করেন। এক্ষেত্রে অনন্য নজির তৈরি করেছেন ওই চিকিৎসক। মন ছুঁয়ে যাওয়া কাজ করেছেন চিকিৎসক। চিকিৎসকরাই তো সম্প্রীতির প্রতীক।

২.

বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জে করোনা রোগের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক ব্যবসায়ী। তার মৃত্যুতে একই ফ্ল্যাটে থাকা মুসলিম বন্ধু এগিয়ে আসেন। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মাকছুদুল আলম খন্দকার ও তার দলবল। এ কাজের পরপরই সংবাদে শিরোনাম হয়েছিল- ‘করোনাভাইরাস : নারায়ণগঞ্জে রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া হিন্দু ব্যবসায়ীর মুখাগ্নি করলেন মুসলিম কাউন্সিলর’ (ইত্তেফাক ২৭ এপ্রিল, ২০২০)। সেদিন মৃত ব্যক্তির ভাই ও শ্যালকের মাধ্যমে খবর পেয়ে মৃত ব্যক্তির সৎকারের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। হিন্দু ব্যবসায়ীর কোনো নিকটাত্মীয় না আসায় কাউন্সিলর স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এগিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন- আমরা তো মুসলিম, আমরা যদি সৎকার করি তাহলে কি কোনো আপত্তি আছে? স্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে ওই ব্যবসায়ীর লাশ সিটি কর্পোরেশনের কেন্দ্রীয় শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে থাকা পুরোহিতের সহায়তায় শেষকৃত্য করা হয়। আমরা নিজেরাই ওই ব্যক্তির মুখাগ্নি করি। কাউন্সিলরের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের মধ্যে কাঠমিস্ত্রি, গার্মেন্টস কর্মী ও শিক্ষার্থী রয়েছেন। ওই দিন পর্যন্ত ৩৪ জনের মধ্যে ৬ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, এদের মধ্যে ৩ জনের মুখাগ্নি নিজেই করেছেন।

৩.

পাবনার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সম্প্রীতির উদাহরণ অবিস্মরণীয়। পাবনা ব্যাপ্টিস্ট মিশনের খ্রিস্ট বিশ্বাসী জেমস সুব্রত গোস্বামী জ¦র, সর্দি, কাশির উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করলে আতঙ্কে স্বজন ও খ্রিস্টানরা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকে। এক পর্যায়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই স্বেচ্ছাসেবী দলের সহযোগিতা চায় পরিবারটি। ধর্ম পরিচয় ও সামাজিক সংকীর্ণতাকে তুচ্ছ করে যাজকের নির্দেশনায় খ্রিস্টীয় রীতিতে সম্মানের সঙ্গে তাকে সমাধিস্থ করেন কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবীরা। এছাড়াও এই স্বেচ্ছাসেবীরা দুইজন সনাতন ধর্মাবলম্বীর সৎকার সম্পন্ন করেছেন। তাদের এই কাজে উজ্জীবিত হয়েছে দেশবাসী, সব ধর্মের নাগরিক। পত্রিকা পাতায় লেখা হলো- ‘বিশ্বাস ভিন্ন, তবু শেষকৃত্য তাদেরই হাতে’ (ইত্তেফাক ২৭ জুন, ২০২০)।

পাবনা ব্যাপ্টিস্ট মিশনের কবরস্থান কমিটির সভাপতি কলিট তালুকদার বলেছেন- ‘জ¦র, সর্দি, কাশির উপসর্গে সুব্রত গোস্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও তার নমুনা পরীক্ষা করতে পারিনি। স্বেচ্ছাসেবকরা মুসলিম হওয়ায় তাই সঙ্কোচ বোধ করছিলাম, আদৌ তারা খ্রিস্টান ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করবে কিনা! কিন্তু ফোন করা মাত্র আমাকে অবাক করে দিয়ে ছুটে আসেন তারা। স্বেচ্ছাসেবীরা এই দুঃসময়ে যেভাবে কাজ করেছেন তা করোনাকালীন স্বার্থপরতা আর অমানবিকতার বিপরীতে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত, সাম্প্রদায়িকতা আর হিংসা-বিদ্বেষে ভরা সমাজের জন্য এক নতুন শিক্ষা।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ধর্মীয় রীতি মেনে তারা সৎকার করেছেন সব ধর্মের মানুষের মরদেহ। তারা করোনা মহামারীর দুর্যোগময় মুহূর্তে সাহসিকতার অনন্য নজির স্থাপন করে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছেন।

৪.

সমাজ যাদের অচ্ছুৎ মনে করে, যারা মৃত্যবরণ করলে কবরস্থানের মাটিতে স্থান সংকুলান হয় না কিংবা যাদেরকে দেখলে আমরা নিরাপদ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করি, সেই হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার সঞ্জীবনী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন; মানুষ মানুষের জন্যেই। সংস্কৃতির একটি শ্লোক প্রাণিধানযোগ্য- ‘যিনি রাজদ্বারে, দুর্ভিক্ষে দুর্দিনে এবং শ্মশানে বন্ধুর পাশেই থাকেন, তিনিই প্রকৃত বন্ধু’। এই ট্রান্সজেন্ডার সঞ্জীবনীর আরেক নাম সজীব সতেজ। জন্মে নামকরণ করা হয়েছিলো আশিকুল ইসলাম, স্রষ্টার কী ইচ্ছে আশিকুল রূপান্তরিত হয়ে গেলেন সঞ্জীবনীতে। সঞ্জীবনী মে-২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে করোনায় মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের দাফন-কাফন বা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি ও রেওয়াজ অনুযায়ী সৎকারের দায়িত্ব আনন্দের সঙ্গেই পালন করে আসছে। শুধু সঞ্জীবনী নয়, এটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরো পাঁচ পুরুষ সদস্য। মৃত ব্যক্তির স্বজন থাকলে তাদের সঙ্গে কথা বলাসহ পুরো কাজের সমন্বয় করেন। দলের সদস্য হিসেবে লাশের গোসল, দাফনসহ অন্যান্য কাজেও হাত লাগাতে হয়। দলনেতা হিসেবে তিনিই কাজটি করে থাকেন।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ক্যাম্প থেকে কাজ করছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে কোথায় করোনায় রোগী মারা গেছেন, সে তথ্য পেয়ে সঞ্জীবনী তার দলের সদস্যদের নিয়ে হাসপাতালে যান। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন লাশের কাছে যেতে ভয় পেতেন। তাই লাশের শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতার পুরো কাজটিই করতে হতো সঞ্জীবনী ও তার দলের সদস্যদের। সঞ্জীবনী ভাষ্যমতে, গত বছরের তুলনায় বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টেছে। বর্তমানে লাশের কাছে আসতে চান না, এমন স্বজনদের সংখ্যা কম। করোনায় মারা গেলে চারপাশে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক ছিল, তা-ও অনেক কমেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা সঞ্জীবনী বক্তব্য- মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অনুযায়ী বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতাগুলো শিখেছেন। মৃতের ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী কখনো লাশ নিয়ে যাচ্ছেন কবরস্থানে, কখনো শ্মশানে। ২৪ ঘণ্টায় সদা প্রস্তুত, যে কোনো সময় ডাক এলেই সুরক্ষিত পোশাক পিপিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজে নেমে পড়েন টিমসহ। তার মতে, সাহায্যের হিসাব চেয়ে কাজটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মমতার স্পর্শে শেষ বিদায় দিতে চান মৃতদের।

করোনাকালীন এবং রমজান মাসে বিদেশের মাটিতে অবলোকন করেছি, গির্জাঘরগুলো নামাজের লক্ষ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জুমার নামাজসহ সেখানে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পেরেছেন। সত্যিই কী অপূর্ব দৃষ্টান্ত, মানসিকতা ও মনোভাব।

বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ নিজ ধর্ম ও বিশ্বাসের মধ্যে থেকে সম্প্রীতিকে সাক্ষ্যে পরিণত করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত সম্প্রীতি আজ বিশ্বসভায় আলোচিত এবং বিশ্ববাসীকে পথ দেখায়। তিনি বলেতেন ‘...শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে আমরা বিশ্বাসী। আমরা প্রতিবেশীদের সহিত সম্মানজনক সম্পর্ক গড়িয়া তুলিতে চাই’ (আজাদ ৪ জানুয়ারি, ১৯৭১)। আরো বলেছেন- ‘...ইসলামী আদর্শেই আমি বলিতেছি, এই দেশে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান সমান অধিকার নিয়েই থাকিবে’ (আজাদ ৪ জানুয়ারি, ১৯৭১)। তিনি জীবনভর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বাস লালন করেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবোধে বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও শত-সহস্র জাতিগোষ্ঠীকে একীভূত করতে সমর্থ হয়েছেন। বাংলার জনসাধারণ ভালোবেসে ‘বঙ্গবন্ধুতে’ আখ্যায়িত করেছেন; সত্যিই তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।