মাস্ক বিক্রি করে বাঁচার সংগ্রাম দিপুর

‘দিপু’ নামে তাকে কম লোকই চেনে। পৈত্রিক দেয়া নামটা ঢাকা পড়ে গেছে তার ফেরি ব্যবসার আড়ালে। ঘরের বাইরে বেরুলে সবাই তাকে ডাকে ‘ও মাস্কওয়ালা ভাই’- ‘ও মাস্ক ভাই’। দিপু এখন মানুষের ওই হাঁক-ডাক শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এতে তার কোন দুঃখবোধ নেই। বরং ওই ডাক বদলে দিয়েছে তার দুঃসহ জীবনকে।

বৈশ্বয়িক মহামারী করোনা নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মজীবন তছনছ করে দিয়েছে। অদৃশ্য করোনার আঘাতে কর্মজীবী-শ্রমজীবী মানুষকে করেছে নিঃস্ব, ঋণগ্রস্ত ও বেকার। আবার এই সর্বনাশা করোনা কর্মহীন-বেকারদের দিয়েছে কাজের সন্ধান। এমনি এক করোনাকালের বেকার মুখ আনোয়ার হোসেন দিপু। তিনি বেকার জীবনে পেশা বদল করে হয়ে উঠেছেন মাস্ক পণ্যের ফেরিওয়ালা। করোনাকালে মাস্ক বিক্রির আয়ে চলছে তার সংসার। প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে সাইকেলে চেপে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। ঘাড়ে ঝুলিয়ে নেন মাস্ক ভর্তি ব্যাগ। শহর আর গ্রামের পাড়া-মহল্লা, মার্কেট, হাট-বাজার আর পথেঘাটে মাস্ক ফেরি করে বিক্রি করেন। সারাদিন যা আয় হয়, তা দিয়েই চলছে তার পরিবারের তিন সদস্যের ভরণপোষণ।

জীবননাশী করোনা দিপুকে দেখিয়েছে বেকারত্ব জয়ের নতুন পথ। শহরের বাঁশবাড়ী এলাকার বাসিন্দা দিপু ছিলেন প্রবাসী শ্রমিক তথা রেমিটেন্স যোদ্ধা। এক সময় কষ্টকর প্রবাসী জীবনের ইতি টেনে ফিরে আসেন দেশে। কাজ না পেয়ে হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ বেকার। কুলকিনারা না পেয়ে শেষমেষ শুরু করেন সামান্য পুঁজির চকলেটের ব্যবসা।

ঢাকা থেকে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি চকলেট এনে শহরের দোকানে দোকানে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। তাতে ব্যবসা জমে ওঠে না। আর ব্যবসা করতে হয় বাকিতে। আবার চকলেটের উৎপাদন মেয়াদ শেষে হয়ে গেলে পাল্টা দিতে হয়। এসব ঝুট ঝামেলা মেটাতে শেষ হয়ে যায় পুঁজি। সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। এরই মধ্যে দেশে শুরু হয় করোনা মহামারী। ব্যবসা বন্ধ, কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। হয়ে যান আবার বেকার। এরমধ্যে এক বন্ধু পরামর্শ দেয় ফেরি করে করোনা সুরক্ষার মাস্ক বিক্রির। মাত্র ৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন এই ব্যবসা। করোনাকালের প্রথমদিকে লাভ ভালোই হত। মাঝে করোনার প্রকোপ কমে এলে ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ফের জমে উঠেছে মাস্কের ব্যবসা। প্রতিদিন তার ৫০ থেকে ৬০ বক্স মাস্ক বিক্রি হয়। এ থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয় তার।

ব্যবসা নিয়ে শহরের পাঁচমাথা মোড়ে কথা হয় দিপুর সঙ্গে। দিপু উৎফুল্ল হয়ে বলেন, করোনা যেমন মানুষকে কর্মহীন করেছে, তেমনি দেখিয়েছে বাঁচার নতুন পথ। শুধু তিনিই নন, তার মতো অনেক বেকার এখন মাস্কের ফেরিওয়ালা। আমি কোন কাজকে ছোট করে দেখি না, সব কাজই আমার কাছে সম্মানের। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দেই সাইকেলে। শহর-গ্রাম মার্কেট, বাজার, দোকানপাট ও পথচারীদের কাছে বিক্রি করি মাস্ক।

এই মাস্ক বিক্রি করে আমার পরিবারই কেবল বাঁচছে না, আমার এ কাজে উপকার হচ্ছে সমাজ ও দেশের মানুষ।

দিপু তার পরিবারের কথা বলতে গিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলেন, পরিবারে তার এক মেয়ে আছে। সবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

মেয়েকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন।

মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় জায়গায় নিতে চাই। এই স্বপ্ন পূরণে সকাল-সন্ধ্যা সাইকেলে প্যাডেলে পা রেখে পথ চলছি। দিপু তার স্বপ্নের কথাগুলো ঝটপট বলে ফের প্যাডেলে পা রেখে মাস্ক বেচতে ছুটে যান মার্কেটের জন¯স্রোতে। আমাদের এই করোনাকালের এই গল্প শুধু দিপুর একার নয়, এমন অনেক দিপু রয়েছেন এই শহরের অট্টালিকার আড়ালে।

বুধবার, ০২ জুন ২০২১ , ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২০ শাওয়াল ১৪৪২

মাস্ক বিক্রি করে বাঁচার সংগ্রাম দিপুর

প্রতিনিধি, সৈয়দপুর (নীলফামারী)

image

‘দিপু’ নামে তাকে কম লোকই চেনে। পৈত্রিক দেয়া নামটা ঢাকা পড়ে গেছে তার ফেরি ব্যবসার আড়ালে। ঘরের বাইরে বেরুলে সবাই তাকে ডাকে ‘ও মাস্কওয়ালা ভাই’- ‘ও মাস্ক ভাই’। দিপু এখন মানুষের ওই হাঁক-ডাক শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এতে তার কোন দুঃখবোধ নেই। বরং ওই ডাক বদলে দিয়েছে তার দুঃসহ জীবনকে।

বৈশ্বয়িক মহামারী করোনা নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মজীবন তছনছ করে দিয়েছে। অদৃশ্য করোনার আঘাতে কর্মজীবী-শ্রমজীবী মানুষকে করেছে নিঃস্ব, ঋণগ্রস্ত ও বেকার। আবার এই সর্বনাশা করোনা কর্মহীন-বেকারদের দিয়েছে কাজের সন্ধান। এমনি এক করোনাকালের বেকার মুখ আনোয়ার হোসেন দিপু। তিনি বেকার জীবনে পেশা বদল করে হয়ে উঠেছেন মাস্ক পণ্যের ফেরিওয়ালা। করোনাকালে মাস্ক বিক্রির আয়ে চলছে তার সংসার। প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে সাইকেলে চেপে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। ঘাড়ে ঝুলিয়ে নেন মাস্ক ভর্তি ব্যাগ। শহর আর গ্রামের পাড়া-মহল্লা, মার্কেট, হাট-বাজার আর পথেঘাটে মাস্ক ফেরি করে বিক্রি করেন। সারাদিন যা আয় হয়, তা দিয়েই চলছে তার পরিবারের তিন সদস্যের ভরণপোষণ।

জীবননাশী করোনা দিপুকে দেখিয়েছে বেকারত্ব জয়ের নতুন পথ। শহরের বাঁশবাড়ী এলাকার বাসিন্দা দিপু ছিলেন প্রবাসী শ্রমিক তথা রেমিটেন্স যোদ্ধা। এক সময় কষ্টকর প্রবাসী জীবনের ইতি টেনে ফিরে আসেন দেশে। কাজ না পেয়ে হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ বেকার। কুলকিনারা না পেয়ে শেষমেষ শুরু করেন সামান্য পুঁজির চকলেটের ব্যবসা।

ঢাকা থেকে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি চকলেট এনে শহরের দোকানে দোকানে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। তাতে ব্যবসা জমে ওঠে না। আর ব্যবসা করতে হয় বাকিতে। আবার চকলেটের উৎপাদন মেয়াদ শেষে হয়ে গেলে পাল্টা দিতে হয়। এসব ঝুট ঝামেলা মেটাতে শেষ হয়ে যায় পুঁজি। সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। এরই মধ্যে দেশে শুরু হয় করোনা মহামারী। ব্যবসা বন্ধ, কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। হয়ে যান আবার বেকার। এরমধ্যে এক বন্ধু পরামর্শ দেয় ফেরি করে করোনা সুরক্ষার মাস্ক বিক্রির। মাত্র ৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন এই ব্যবসা। করোনাকালের প্রথমদিকে লাভ ভালোই হত। মাঝে করোনার প্রকোপ কমে এলে ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ফের জমে উঠেছে মাস্কের ব্যবসা। প্রতিদিন তার ৫০ থেকে ৬০ বক্স মাস্ক বিক্রি হয়। এ থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয় তার।

ব্যবসা নিয়ে শহরের পাঁচমাথা মোড়ে কথা হয় দিপুর সঙ্গে। দিপু উৎফুল্ল হয়ে বলেন, করোনা যেমন মানুষকে কর্মহীন করেছে, তেমনি দেখিয়েছে বাঁচার নতুন পথ। শুধু তিনিই নন, তার মতো অনেক বেকার এখন মাস্কের ফেরিওয়ালা। আমি কোন কাজকে ছোট করে দেখি না, সব কাজই আমার কাছে সম্মানের। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দেই সাইকেলে। শহর-গ্রাম মার্কেট, বাজার, দোকানপাট ও পথচারীদের কাছে বিক্রি করি মাস্ক।

এই মাস্ক বিক্রি করে আমার পরিবারই কেবল বাঁচছে না, আমার এ কাজে উপকার হচ্ছে সমাজ ও দেশের মানুষ।

দিপু তার পরিবারের কথা বলতে গিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলেন, পরিবারে তার এক মেয়ে আছে। সবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

মেয়েকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন।

মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় জায়গায় নিতে চাই। এই স্বপ্ন পূরণে সকাল-সন্ধ্যা সাইকেলে প্যাডেলে পা রেখে পথ চলছি। দিপু তার স্বপ্নের কথাগুলো ঝটপট বলে ফের প্যাডেলে পা রেখে মাস্ক বেচতে ছুটে যান মার্কেটের জন¯স্রোতে। আমাদের এই করোনাকালের এই গল্প শুধু দিপুর একার নয়, এমন অনেক দিপু রয়েছেন এই শহরের অট্টালিকার আড়ালে।