বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, ভোগান্তি মানুষের

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে হাঁটুপানি

তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে অফিসগামী মানুষদের। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে তৈরি হয় তীব্র যানজট।

বৃষ্টির পানি জমে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে। জলবদ্ধতার কারণে সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছে মানুষ।

গতকাল ঢাকায় সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এ সময় ময়মনসিংহে ৪৮ মিলিমিটার, নেত্রকোনায় ৩৬ মিলিমিটার, টাঙ্গাইলে ৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে দেশের সর্বোচ্চ ১৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ফেনীতে ১০৪ ও নেত্রকোনায় হয়েছে ৯৭ মিলিমিটার।

গতকাল কম-বেশি সব জেলায় দমকা বাতাসসহ বজ্রবৃষ্টি হয়েছে। যা আরও দুই-একদিন থাকতে পারে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে।

এর আগে ২০১৭ সালের আগস্টে একদিনে ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড রয়েছে ঢাকায়। সে সময় তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই ডুবে যায় ঢাকার অনেক সড়ক। অল্প সময়ে এত বৃষ্টিপাত রাজধানীবাসী দেখে ১০ বছর পর।

পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্ষা সমাগত। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু (বর্ষা) আগামী পাঁচদিনের মধ্যে টেকনাফ উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে। ৪ বা ৫ জুনে উপকূলে পৌঁছলে ধীরে ধীরে তা জুন মাসের প্রথমার্ধে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। সে সময় বৃষ্টির প্রবণতাও বাড়বে।’

জলাবদ্ধতায় রাজধানীর

বিভিন্ন সড়কে হাঁটুপানি

‘বৃষ্টি মানেই সড়কে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি, বর্ষার আগে প্রতিবছর সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করে দুর্ভোগের সৃষ্টি করে কিন্তু জলাবদ্ধতার নিরসন হয় না। এবার একই অবস্থা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা ২ নম্বর গেট এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান।

তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। সকালে বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু সড়কে পানি জমে ছিল রাত পর্যন্ত। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা প্রতিটি গলিপথ। কাজলার পাড়ের খাল দিয়ে দ্রুত পানি অপসারণ হয় না। কারণ খালের অর্ধেক ময়লা ও অবর্জনা দিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। খালের কিছু অংশ ময়লা পরিষ্কার করা হলেও এখনও বেশিরভাগ ভরাট হয়ে আছে। তাই এই এলাকায় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে।’

শুধু যাত্রাবাড়ী নয়, গতকাল ঢাকায় প্রায় তিন ঘণ্টার একটানা বৃষ্টি বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির পানি জমে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর পানি, ডুবে গেছে সড়ক। কোন কোন নিচু এলাকায় দোকান ও বাসা-বাড়ির নিচতলায় প্রবেশ করেছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

গতাকলের বৃষ্টিতে রাজধানীর ধলপুর, রামপুরা, জুরাইন, পোস্তগোলা, পুরানা পল্টন, খিলগাঁও-গোড়ান, কমলাপুর, মতিঝিল, গুলিস্তান, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মালিবাগ, পুরান ঢাকা, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু এলাকায় বৃষ্টির ঘণ্টাখানিক পর সড়কের পানি নেমে গেলেও নিম্ন এলাকায় রাতে সড়কে পানি ছিল। সড়কে পানি নিষ্কাশনের পথগুলো আবর্জনায় ভরাট থাকায় দ্রুত পানি নামতে না পারায় প্রতিবারই এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

জলাবদ্ধতায় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে

গতকালের বৃষ্টিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে নির্মাণাধীন এ সড়কটির অনেক স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত ও খানাখন্দ। সড়কে ভোগড়া বাইপাস, চৌধুরী বাড়ি, চান্দনা চৌরাস্তা, স্টেশন রোড, তারগাছ, চেরাগআলীসহ বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পানিতে ডুবে থাকা সড়কের গর্তে পড়ে অনেক স্থানে যানবাহন বিকল হয়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলে স্থানীয় প্রতিনিধি জানান।

জামাল সিকদার নামের গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকার এক বাসিন্দা সংবাদকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বিআরটি প্রকল্পের আওতায় গাজীপুরে নালা ও সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। এখনও নালার কাজই শেষ করতে পারেনি। এছাড়া ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণের কাজও চলছে ঢিলেঢালাভাবে। এতে ঢাকা-গাজীপুর সড়কে শিববাড়ি থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অনেক গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই যান চলাচল বিঘিœত হয়। জলাবদ্ধতার কারণে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকা থেকে বাসে করে গাজীপুরের বড়বাড়ী পর্যন্ত যেতে এক ঘণ্টা লাগে বলে জানান তিনি।

গাজীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুদ্দিন জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানসহ সড়ক বিভাগের কার্যালয়ের সামনের সড়কে এখনও ড্রেন নির্মাণ করা হয়নি। হঠাৎ সকালে এসে দেখি মহাসড়কসহ বৃষ্টির পানিতে সড়ক বিভাগের অফিস তলিয়ে গেছে। বিআরটি কর্তৃপক্ষ সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত এবং পানি নিষ্কাশন কাজ করছে।

জলাবদ্ধতা নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বক্তব্য

বৃষ্টির পানি আগের থেকে দ্রুতই সরে গেছে বলে দাবি করেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। ওয়াসার থেকে পাওয়া খালগুলো পরিষ্কার হয়ে গেলে আগামীতে আরও দ্রুত পানি সরে যাবে জানায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ বিষয়ে গতকাল এক অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)’র মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আসন্ন বর্ষা মৌসুমে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ প্রদানের লক্ষ্যে ওয়াসা থেকে হস্তান্তরিত খাল ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করা হচ্ছে। করোনা মহামারীকালে স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের পাশাপাশি খাল ও জলাশয় পরিষ্কার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’

অতীতের মতো ঢাকাবাসীকে কোথাও কোমরপানি বা গলাপানিতে নাজেহাল হতে হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। গতকাল সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘গতকাল বৃষ্টিতে বেশ কয়েকটি জায়গায় জলজট হলেও বিগত সময়ের জলজটের পরিমাণ ও স্থান সংখ্যার তুলনায় তা অনেকাংশেই কম। বিগত পাঁচ মাসে আমাদের গৃহীত কার্যক্রম এবং আজ (মঙ্গলবার) সকাল থেকে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঠপর্যায়ে তৎপরতার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুততার সঙ্গে নেমে যায়। ৩ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় শতভাগ পানি নিষ্কাশন করতে সক্ষম হয়েছি, যদিও আমাদের লক্ষ্য ১ ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা। ’

তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সøুইস গেটগুলো দ্রুত আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হোক। তা এখনও হয়নি। এছাড়া ডিএনডি বাঁধ, হাতিরঝিল প্রকল্প, মেট্রোরেলের কার্যক্রমের ফলে জলাবদ্ধতার সম্পূর্ণ সমাধান এখন পর্যন্ত দেয়া সম্ভব না হলেও অতীতের মতো ঢাকাবাসীকে কোথাও কোমরপানি বা গলাপানিতে নাজেহাল হতে হয়নি।

নানা অভিযোগ নগরবাসীর

রাজধানীর ধলপুর এলাকায় সাইদুর রহমান নামের এক যাত্রী বলেন, ‘মহাখালী অফিসে যাব কিন্তু গণপরিবহন কম তাই হেঁটেই সামনের দিকে এগোতে শুরু করেছি কিন্তু সড়কেও জলাবদ্ধতা, হাঁটাও যাচ্ছে না। জলাবদ্ধতার কারণে এর মধ্য দিয়ে যখন গণপরিবহন চলছে তখন ফুটপাতেও ঢেউ এসে পড়ছে, জামা-কাপড়ও ভিজে যাচ্ছে কিন্তু অফিসে তো যেতে হবে, তাই এরমধ্যেই বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে।’

জাফর আহমেদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘প্রতিবছরই বৃষ্টি হলে রাজধানীতে এমন জলাবদ্ধতা হয়। সাধারণ মানুষ পড়ে ভোগান্তিতে কিন্তু এই জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। যার মাশুল দিতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের। যারা আজ কাজে বের হয়েছেন তাদের প্রত্যেকে ভোগান্তিতে পড়েছেন। কোথাও হাঁটুপানি, কোথায় গণপরিবহন সংকট সব মিলিয়ে ভোগান্তি যেন সাধারণ মানুষের। এছাড়া বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার মধ্যে যেসব মানুষ কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হচ্ছেন এমন সুযোগ বুঝে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকছেন।’

সাইফুল ইসলাম নামের একজন অটোরিকশা চালক বলেন, ‘টানা বৃষ্টির কারণে অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছে, এর মধ্যে গাড়ি নিয়ে গেলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। তারপরও আমরা যাত্রী পৌঁছে দেই। মানুষের প্রয়োজন আর আমরাও বৃষ্টির মধ্যে যাত্রী সেবা দিচ্ছি, তাই সবাই একটু বেশি ভাড়াই চাই। হাতিরঝিলের দিক থেকে আসার সময় গুদারাঘাটের আগে পানি জমা ছিল, সেখানে আসার পর আমার গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঠেলে এনেছি, এখন ঠিক হয়েছে। এসব কারণে আমরা একটু ভাড়া বেশি চাইছি এই সময়।’

বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা

সোমবার মধ্যরাতে বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। গতকাল ১৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামে। নদীবন্দরকে ১ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। থেমে থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নগরীর বিভিন্ন সড়কে। বেশিরভাগ খাল-নালা আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়া, খালের মুখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের স্লুইসগেটের চলমান কাজসহ নানা কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

বুধবার, ০২ জুন ২০২১ , ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২০ শাওয়াল ১৪৪২

বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, ভোগান্তি মানুষের

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে হাঁটুপানি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

গতকালের বৃষ্টিতে ডুবে যায় রাজধানীর অনেক সড়ক। তাই যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীরা পড়ে চরম দুর্ভোগে। মিরপুর শেওড়াপাড়া থেকে তোলা -সোহরাব আলম

তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে অফিসগামী মানুষদের। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে তৈরি হয় তীব্র যানজট।

বৃষ্টির পানি জমে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে। জলবদ্ধতার কারণে সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছে মানুষ।

গতকাল ঢাকায় সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এ সময় ময়মনসিংহে ৪৮ মিলিমিটার, নেত্রকোনায় ৩৬ মিলিমিটার, টাঙ্গাইলে ৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে দেশের সর্বোচ্চ ১৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ফেনীতে ১০৪ ও নেত্রকোনায় হয়েছে ৯৭ মিলিমিটার।

গতকাল কম-বেশি সব জেলায় দমকা বাতাসসহ বজ্রবৃষ্টি হয়েছে। যা আরও দুই-একদিন থাকতে পারে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে।

এর আগে ২০১৭ সালের আগস্টে একদিনে ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড রয়েছে ঢাকায়। সে সময় তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই ডুবে যায় ঢাকার অনেক সড়ক। অল্প সময়ে এত বৃষ্টিপাত রাজধানীবাসী দেখে ১০ বছর পর।

পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্ষা সমাগত। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু (বর্ষা) আগামী পাঁচদিনের মধ্যে টেকনাফ উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে। ৪ বা ৫ জুনে উপকূলে পৌঁছলে ধীরে ধীরে তা জুন মাসের প্রথমার্ধে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। সে সময় বৃষ্টির প্রবণতাও বাড়বে।’

জলাবদ্ধতায় রাজধানীর

বিভিন্ন সড়কে হাঁটুপানি

‘বৃষ্টি মানেই সড়কে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি, বর্ষার আগে প্রতিবছর সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করে দুর্ভোগের সৃষ্টি করে কিন্তু জলাবদ্ধতার নিরসন হয় না। এবার একই অবস্থা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা ২ নম্বর গেট এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান।

তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। সকালে বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু সড়কে পানি জমে ছিল রাত পর্যন্ত। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা প্রতিটি গলিপথ। কাজলার পাড়ের খাল দিয়ে দ্রুত পানি অপসারণ হয় না। কারণ খালের অর্ধেক ময়লা ও অবর্জনা দিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। খালের কিছু অংশ ময়লা পরিষ্কার করা হলেও এখনও বেশিরভাগ ভরাট হয়ে আছে। তাই এই এলাকায় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে।’

শুধু যাত্রাবাড়ী নয়, গতকাল ঢাকায় প্রায় তিন ঘণ্টার একটানা বৃষ্টি বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির পানি জমে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর পানি, ডুবে গেছে সড়ক। কোন কোন নিচু এলাকায় দোকান ও বাসা-বাড়ির নিচতলায় প্রবেশ করেছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

গতাকলের বৃষ্টিতে রাজধানীর ধলপুর, রামপুরা, জুরাইন, পোস্তগোলা, পুরানা পল্টন, খিলগাঁও-গোড়ান, কমলাপুর, মতিঝিল, গুলিস্তান, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মালিবাগ, পুরান ঢাকা, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু এলাকায় বৃষ্টির ঘণ্টাখানিক পর সড়কের পানি নেমে গেলেও নিম্ন এলাকায় রাতে সড়কে পানি ছিল। সড়কে পানি নিষ্কাশনের পথগুলো আবর্জনায় ভরাট থাকায় দ্রুত পানি নামতে না পারায় প্রতিবারই এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

জলাবদ্ধতায় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে

গতকালের বৃষ্টিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে নির্মাণাধীন এ সড়কটির অনেক স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত ও খানাখন্দ। সড়কে ভোগড়া বাইপাস, চৌধুরী বাড়ি, চান্দনা চৌরাস্তা, স্টেশন রোড, তারগাছ, চেরাগআলীসহ বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পানিতে ডুবে থাকা সড়কের গর্তে পড়ে অনেক স্থানে যানবাহন বিকল হয়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলে স্থানীয় প্রতিনিধি জানান।

জামাল সিকদার নামের গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকার এক বাসিন্দা সংবাদকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বিআরটি প্রকল্পের আওতায় গাজীপুরে নালা ও সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। এখনও নালার কাজই শেষ করতে পারেনি। এছাড়া ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণের কাজও চলছে ঢিলেঢালাভাবে। এতে ঢাকা-গাজীপুর সড়কে শিববাড়ি থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অনেক গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই যান চলাচল বিঘিœত হয়। জলাবদ্ধতার কারণে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকা থেকে বাসে করে গাজীপুরের বড়বাড়ী পর্যন্ত যেতে এক ঘণ্টা লাগে বলে জানান তিনি।

গাজীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুদ্দিন জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানসহ সড়ক বিভাগের কার্যালয়ের সামনের সড়কে এখনও ড্রেন নির্মাণ করা হয়নি। হঠাৎ সকালে এসে দেখি মহাসড়কসহ বৃষ্টির পানিতে সড়ক বিভাগের অফিস তলিয়ে গেছে। বিআরটি কর্তৃপক্ষ সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত এবং পানি নিষ্কাশন কাজ করছে।

জলাবদ্ধতা নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বক্তব্য

বৃষ্টির পানি আগের থেকে দ্রুতই সরে গেছে বলে দাবি করেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। ওয়াসার থেকে পাওয়া খালগুলো পরিষ্কার হয়ে গেলে আগামীতে আরও দ্রুত পানি সরে যাবে জানায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ বিষয়ে গতকাল এক অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)’র মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আসন্ন বর্ষা মৌসুমে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ প্রদানের লক্ষ্যে ওয়াসা থেকে হস্তান্তরিত খাল ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করা হচ্ছে। করোনা মহামারীকালে স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের পাশাপাশি খাল ও জলাশয় পরিষ্কার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’

অতীতের মতো ঢাকাবাসীকে কোথাও কোমরপানি বা গলাপানিতে নাজেহাল হতে হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। গতকাল সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘গতকাল বৃষ্টিতে বেশ কয়েকটি জায়গায় জলজট হলেও বিগত সময়ের জলজটের পরিমাণ ও স্থান সংখ্যার তুলনায় তা অনেকাংশেই কম। বিগত পাঁচ মাসে আমাদের গৃহীত কার্যক্রম এবং আজ (মঙ্গলবার) সকাল থেকে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঠপর্যায়ে তৎপরতার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুততার সঙ্গে নেমে যায়। ৩ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় শতভাগ পানি নিষ্কাশন করতে সক্ষম হয়েছি, যদিও আমাদের লক্ষ্য ১ ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা। ’

তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সøুইস গেটগুলো দ্রুত আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হোক। তা এখনও হয়নি। এছাড়া ডিএনডি বাঁধ, হাতিরঝিল প্রকল্প, মেট্রোরেলের কার্যক্রমের ফলে জলাবদ্ধতার সম্পূর্ণ সমাধান এখন পর্যন্ত দেয়া সম্ভব না হলেও অতীতের মতো ঢাকাবাসীকে কোথাও কোমরপানি বা গলাপানিতে নাজেহাল হতে হয়নি।

নানা অভিযোগ নগরবাসীর

রাজধানীর ধলপুর এলাকায় সাইদুর রহমান নামের এক যাত্রী বলেন, ‘মহাখালী অফিসে যাব কিন্তু গণপরিবহন কম তাই হেঁটেই সামনের দিকে এগোতে শুরু করেছি কিন্তু সড়কেও জলাবদ্ধতা, হাঁটাও যাচ্ছে না। জলাবদ্ধতার কারণে এর মধ্য দিয়ে যখন গণপরিবহন চলছে তখন ফুটপাতেও ঢেউ এসে পড়ছে, জামা-কাপড়ও ভিজে যাচ্ছে কিন্তু অফিসে তো যেতে হবে, তাই এরমধ্যেই বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে।’

জাফর আহমেদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘প্রতিবছরই বৃষ্টি হলে রাজধানীতে এমন জলাবদ্ধতা হয়। সাধারণ মানুষ পড়ে ভোগান্তিতে কিন্তু এই জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। যার মাশুল দিতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের। যারা আজ কাজে বের হয়েছেন তাদের প্রত্যেকে ভোগান্তিতে পড়েছেন। কোথাও হাঁটুপানি, কোথায় গণপরিবহন সংকট সব মিলিয়ে ভোগান্তি যেন সাধারণ মানুষের। এছাড়া বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার মধ্যে যেসব মানুষ কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হচ্ছেন এমন সুযোগ বুঝে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকছেন।’

সাইফুল ইসলাম নামের একজন অটোরিকশা চালক বলেন, ‘টানা বৃষ্টির কারণে অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছে, এর মধ্যে গাড়ি নিয়ে গেলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। তারপরও আমরা যাত্রী পৌঁছে দেই। মানুষের প্রয়োজন আর আমরাও বৃষ্টির মধ্যে যাত্রী সেবা দিচ্ছি, তাই সবাই একটু বেশি ভাড়াই চাই। হাতিরঝিলের দিক থেকে আসার সময় গুদারাঘাটের আগে পানি জমা ছিল, সেখানে আসার পর আমার গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঠেলে এনেছি, এখন ঠিক হয়েছে। এসব কারণে আমরা একটু ভাড়া বেশি চাইছি এই সময়।’

বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা

সোমবার মধ্যরাতে বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। গতকাল ১৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামে। নদীবন্দরকে ১ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। থেমে থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নগরীর বিভিন্ন সড়কে। বেশিরভাগ খাল-নালা আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়া, খালের মুখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের স্লুইসগেটের চলমান কাজসহ নানা কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।