বাঘের চামড়া ১৭ লাখ টাকা, হরিণের মাংস ৭শ টাকা কেজি

বাঘ হাবিবসহ ৩টি গ্রুপ বন্যপ্রাণী পাচারে জড়িত

হাবিব তালুকদার, সুন্দরবন এলাকায় বাঘ হাবিব নামে পরিচিত। বিভিন্ন সময়ে সে ৭০টি বাঘ হত্যা করেছে বলে স্থানীয় ভাবে জানা গেছে। এ হাবিবকে গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

পুলিশ ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩টি গ্রুপ বন্যপ্রাণী পাচারে জড়িত। এরা বাঘের চামড়া ১৩ থেকে ১৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে। হরিণের মাংস বিক্রি করে ৭শ’ টাকায়।

বাগেরহাটের শরণখোলা থানার ওসি সাইদুর রহমান সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, হাবিবের নামে শরণখোলা থানায় তিনটি মামলা রয়েছে। তিনটি মামলায় সে গ্রেপ্তারি পরোনাভুক্ত আসামি। বন বিভাগের কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ তাকে খুঁজছে। অবশেষে গোপন খবরের ভিত্তিতে গত শুক্রবার রাতে তাকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে পাঠালে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।

ওসি বলেন, হাবিব লেখাপড়া জানে না। শরণখোলার সোনাতলায় তার বাড়ি। সে বাঘ, হরিণ ও কুমির হত্যা ও চামড়া পাচার করে। বাঘ হত্যা করার কারণে তাকে স্থানীয়রা বাঘ হাবিব নাম দিয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হাবিব ছোটবেলা থেকে সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। সুন্দরবনের শরণখোলা সাউথখালি ইউনিয়নের মধ্য সোনাতলা এলাকার বাসিন্দা সাবেক বনদস্যু কদম আলী তালুকদারের ছেলে। তার পরিবারের সবাই বন্যপ্রাণী শিকারের সঙ্গে জড়িত। এরমধ্যে তার ছেলে হাসান ও মেয়ের জামাই মিজান এখন বন্যপ্রাণী নির্ধন ও পাচারে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। বাঘ হাবিব গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় প্রায় ৭০ বাঘ হত্যা করেছে বলে স্থানীয় ভাবে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। সে বেশিরভাগ সময় সুন্দরবনেই গোপন আস্তানায় কাটাত।

যেভাবে বাঘ হত্যা : বাঘ হাবিবসহ বন্যপ্রাণী পাচারকারী চক্র সুন্দরবনের যেসব স্পট দিয়ে বাঘ বিচরণ করে সেসব স্পটে ছাগল কিংবা মুরগির মাংসে বিষ মিশিয়ে রেখে দিত। তখন বাঘ ওই সব পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ছাগল ও মুরগির মাংস দেখে খাওয়া শুরু করলে কিছুক্ষণের মধ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জঙ্গলে পড়ে যেত। ওই সময়ে ওঁৎ পেতে থাকা শিকারি দল বাঘটিকে আটক করে হত্যা করত। হত্যার পর বাঘের চামড়া ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে প্রভাবশালী ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের কাছে বিক্রি করত। বাঘ হাবিব গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বহু বাঘ হত্যা করেছে।

সুন্দরবন সহব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) সহ-সভাপতি এম ওয়াদুদ আকন সাংবাদকে জানান, বাঘ হাবিব খুবই ভয়ঙ্কর। তার গোটা পরিবার একই অপরাধের সঙ্গে জড়িত।

সুন্দরবনের শরণখোলা স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান সংবাদকে বলেন, বাঘ হাবিব গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বাঘ হত্যা করছে। এ ছাড়াও হরিণ ও কুমির শিকার করত। বাঘ হাবিবের নামে কমপক্ষে ৯টি মামলা রয়েছে। শরণ খোলা এলাকার বন্যপ্রাণী শিকার ও চামড়া পাচার করার ঘটনায় ৩টি গ্রুপ আছে। হাবিব গ্রুপ ছাড়াও মালেক গ্রুপ ও তানজিল গ্রুপ রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে ৮ জন।

এ বন কর্মকর্তা আরও বলেন, তারা প্রায় দুই মাস আগে ফাঁদ পেতে বন্যপ্রাণীর চামড়া পাচারকারীর এক সদস্যকে আটক করা হয়েছে। সে একটি বাঘের চামড়া ১৭ লাখ টাকা বিক্রি করতে চেয়েছে। পরে দাম কমিয়ে ১৩ লাখ টাকায় রয়েল বেঙ্গলের চামড়া বিক্রি করতে রাজি হয়। টাকা নিতে গেলে র‌্যাবের সহায়তায় তাকে আটক করা হয়।

বনপ্রাণী পাচারকারী চক্র হরিণ শিকার করে হরিণের মাংস কেজি ৭শ’ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি করছে। আবার চামড়া বিক্রি করে। কুমিরের চামড়া ও মাংস পাচার ও বিক্রি করে। এ চক্রের সঙ্গে দেশি বিদেশি প্রভাবশালীরা জড়িত। বিভিন্ন তদবিরে হরিণের মাংস প্রভাবশালীদের গিফট দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বেলায়েত হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, বাঘের চামড়া পাচারে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত। চীন ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্র চামড়া, কলিজাসহ বিভিন্ন অঙ্গ পাচার করে আর হরিণের মাংস ঢাকা ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করে। গত ১৯ জানুয়ারি স্থানীয়ভাবে ১৩ লাখ টাকা বিক্রির চেষ্টার সময় একটি চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। চামড়া পাচারকারী চক্রের পলাতক অন্যদের ধরার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে।

বুধবার, ০২ জুন ২০২১ , ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২০ শাওয়াল ১৪৪২

বাঘের চামড়া ১৭ লাখ টাকা, হরিণের মাংস ৭শ টাকা কেজি

বাঘ হাবিবসহ ৩টি গ্রুপ বন্যপ্রাণী পাচারে জড়িত

বাকী বিল্লাহ, ঢাকা ও এমাদুল হক (শরণখোলা)

image

বাঘ হাবিব

হাবিব তালুকদার, সুন্দরবন এলাকায় বাঘ হাবিব নামে পরিচিত। বিভিন্ন সময়ে সে ৭০টি বাঘ হত্যা করেছে বলে স্থানীয় ভাবে জানা গেছে। এ হাবিবকে গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

পুলিশ ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩টি গ্রুপ বন্যপ্রাণী পাচারে জড়িত। এরা বাঘের চামড়া ১৩ থেকে ১৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে। হরিণের মাংস বিক্রি করে ৭শ’ টাকায়।

বাগেরহাটের শরণখোলা থানার ওসি সাইদুর রহমান সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, হাবিবের নামে শরণখোলা থানায় তিনটি মামলা রয়েছে। তিনটি মামলায় সে গ্রেপ্তারি পরোনাভুক্ত আসামি। বন বিভাগের কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ তাকে খুঁজছে। অবশেষে গোপন খবরের ভিত্তিতে গত শুক্রবার রাতে তাকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে পাঠালে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।

ওসি বলেন, হাবিব লেখাপড়া জানে না। শরণখোলার সোনাতলায় তার বাড়ি। সে বাঘ, হরিণ ও কুমির হত্যা ও চামড়া পাচার করে। বাঘ হত্যা করার কারণে তাকে স্থানীয়রা বাঘ হাবিব নাম দিয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হাবিব ছোটবেলা থেকে সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। সুন্দরবনের শরণখোলা সাউথখালি ইউনিয়নের মধ্য সোনাতলা এলাকার বাসিন্দা সাবেক বনদস্যু কদম আলী তালুকদারের ছেলে। তার পরিবারের সবাই বন্যপ্রাণী শিকারের সঙ্গে জড়িত। এরমধ্যে তার ছেলে হাসান ও মেয়ের জামাই মিজান এখন বন্যপ্রাণী নির্ধন ও পাচারে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। বাঘ হাবিব গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় প্রায় ৭০ বাঘ হত্যা করেছে বলে স্থানীয় ভাবে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। সে বেশিরভাগ সময় সুন্দরবনেই গোপন আস্তানায় কাটাত।

যেভাবে বাঘ হত্যা : বাঘ হাবিবসহ বন্যপ্রাণী পাচারকারী চক্র সুন্দরবনের যেসব স্পট দিয়ে বাঘ বিচরণ করে সেসব স্পটে ছাগল কিংবা মুরগির মাংসে বিষ মিশিয়ে রেখে দিত। তখন বাঘ ওই সব পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ছাগল ও মুরগির মাংস দেখে খাওয়া শুরু করলে কিছুক্ষণের মধ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জঙ্গলে পড়ে যেত। ওই সময়ে ওঁৎ পেতে থাকা শিকারি দল বাঘটিকে আটক করে হত্যা করত। হত্যার পর বাঘের চামড়া ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে প্রভাবশালী ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের কাছে বিক্রি করত। বাঘ হাবিব গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বহু বাঘ হত্যা করেছে।

সুন্দরবন সহব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) সহ-সভাপতি এম ওয়াদুদ আকন সাংবাদকে জানান, বাঘ হাবিব খুবই ভয়ঙ্কর। তার গোটা পরিবার একই অপরাধের সঙ্গে জড়িত।

সুন্দরবনের শরণখোলা স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান সংবাদকে বলেন, বাঘ হাবিব গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বাঘ হত্যা করছে। এ ছাড়াও হরিণ ও কুমির শিকার করত। বাঘ হাবিবের নামে কমপক্ষে ৯টি মামলা রয়েছে। শরণ খোলা এলাকার বন্যপ্রাণী শিকার ও চামড়া পাচার করার ঘটনায় ৩টি গ্রুপ আছে। হাবিব গ্রুপ ছাড়াও মালেক গ্রুপ ও তানজিল গ্রুপ রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে ৮ জন।

এ বন কর্মকর্তা আরও বলেন, তারা প্রায় দুই মাস আগে ফাঁদ পেতে বন্যপ্রাণীর চামড়া পাচারকারীর এক সদস্যকে আটক করা হয়েছে। সে একটি বাঘের চামড়া ১৭ লাখ টাকা বিক্রি করতে চেয়েছে। পরে দাম কমিয়ে ১৩ লাখ টাকায় রয়েল বেঙ্গলের চামড়া বিক্রি করতে রাজি হয়। টাকা নিতে গেলে র‌্যাবের সহায়তায় তাকে আটক করা হয়।

বনপ্রাণী পাচারকারী চক্র হরিণ শিকার করে হরিণের মাংস কেজি ৭শ’ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি করছে। আবার চামড়া বিক্রি করে। কুমিরের চামড়া ও মাংস পাচার ও বিক্রি করে। এ চক্রের সঙ্গে দেশি বিদেশি প্রভাবশালীরা জড়িত। বিভিন্ন তদবিরে হরিণের মাংস প্রভাবশালীদের গিফট দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বেলায়েত হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, বাঘের চামড়া পাচারে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত। চীন ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্র চামড়া, কলিজাসহ বিভিন্ন অঙ্গ পাচার করে আর হরিণের মাংস ঢাকা ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করে। গত ১৯ জানুয়ারি স্থানীয়ভাবে ১৩ লাখ টাকা বিক্রির চেষ্টার সময় একটি চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। চামড়া পাচারকারী চক্রের পলাতক অন্যদের ধরার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে।