চাকরির প্রলোভন : নায়িকা বানানোসহ নানা ফাঁদে ফেলা হয়

গত ৮ বছরে ভারতে ৫ শতাধিক নারীকে পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া এসব নারীকে সেখানে নিয়ে অসামাজিক কার্যক্রমে বাধ্য করা হতো। চাকরির প্রলোভন, নায়িকা বানানোসহ নানা ফাঁদে ফেলে নারী পাচারের অভিযোগে আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য মিলেছে। সম্প্রতি টিকটকের ফাঁদে ফেলে যে তরুণীকে পাচার করার পর নির্যাতন করা হয়েছে সেই তরুণীকে পাচারের মূলেও এই বস রাফিই ছিল।

গতকাল র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভারতের ব্যাঙ্গালুরুয় এক তরুণীকে নগ্ন করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার সূত্র ধরে ভারতের পুলিশ টিকটক রিফাজুল ইসলাম বাবু ওরফে টিকটক বাবু, সাগর, মোহাম্মদ বাবা শেখ, হাকিল ও দুই নারীসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গালুরু থানায় মামলা হয়। সেই সুবাদে একই চক্রের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায়ও একটি মামলা হয়। মামলার সূত্র ধরে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও তদন্তে নামে। গত সোমবার পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে র‌্যাব যশোরের অভয়নগর থেকে এ চক্রের মূলহোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে আশরাফ ম-ল ওরফে বস রাফিকে গ্রেপ্তার করে। পরে তার দেয়া তথ্যে সাহিদা বেগম ওরফে ম্যাডাম সাহিদা, মো. ইসমাইল সরদার এবং আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। র‌্যাব জানিয়েছে, আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি গত আট বছর ধরে ভারতে নিয়মিত বিভিন্ন বয়সী মেয়েকে পাচার করে আসছিল। গত ৮ বছরে সে কমপক্ষে ৫০০ নারীকে ভারতে পাচার করেছে বলে র‌্যাবের কাছে জানিয়েছে। ওই ৫০০ নারীকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের আবাসিক হোটেল, বাসা, ফ্ল্যাটে পতিতাবৃত্তির কাজে বাধ্য করা হয়েছে। টিকটক হৃদয় বাবুর মতো বস রাফি কমপক্ষে ৫০টি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে। যাদের মাধ্যমে রাফি ভারতে বিভিন্ন বয়সীর মেয়ে পাচার করে আসছিল।

র?্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। আট বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার যাতায়াত শুরু। প্রথমে সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার ও পরে হোটেলে রিসোর্ট কর্মচারী ও কাপড়ের ব্যবসা করত। গত দুই বছর আগে টিকটকের হৃদয়ের সঙ্গে রাফির পরিচয় হয়। এরপর টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে অর্ধশতাধিক তরুণীকে ভারতে পাচার করে সে। ভারতে যে বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এতে টিকটক হৃদয়ের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ওই ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা ২৭ মে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক হৃদয়সহ অজ্ঞাতনামা আরও চারজনকে আসামি করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র?্যাব ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩১ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত র?্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা ও র?্যাব-৩-এর অভিযানে ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল থেকে আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করত তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে বিভিন্ন বয়সের নারী ও তরুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করত টিকটক হৃদয়। এই গ্রুপে যেসব তরুণী ছিলেন, তাদের মডেল বানানোসহ ও বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করাত। পরবর্তীতে ভারতে বিভিন্ন সুপার শপ ও বিউটি পার্লারে চাকরি দেয়ার কথা বলে বস রাফির সহযোগিতায় এসব তরুণীকে বিদেশে পাচার করত। ভারতে তাদের পাচারের পর প্রথমে একটি সেফ হাউসে নেয়া হতো। র‌্যাব জানায়, সেফ হাউসে তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং জোর করে মাদক সেবন করতে বাধ্য করানো হতো। মাদক সেবনের পর তাদের জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ করা হতো। যাতে তাদের পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করা যায়। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয়পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি সম্পূর্ণ করত। প্রথমত ভিকটিমদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী জেলা- যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসত। এরপর ভিকটিমদের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউসে নিয়ে অবস্থান করানো হতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। এরপর ভারতের এজেন্টরা তাদের গ্রহণ করত।

বুধবার, ০২ জুন ২০২১ , ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২০ শাওয়াল ১৪৪২

আট বছরে ভারতে ৫ শতাধিক নারী পাচার

চাকরির প্রলোভন : নায়িকা বানানোসহ নানা ফাঁদে ফেলা হয়

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

গত ৮ বছরে ভারতে ৫ শতাধিক নারীকে পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া এসব নারীকে সেখানে নিয়ে অসামাজিক কার্যক্রমে বাধ্য করা হতো। চাকরির প্রলোভন, নায়িকা বানানোসহ নানা ফাঁদে ফেলে নারী পাচারের অভিযোগে আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য মিলেছে। সম্প্রতি টিকটকের ফাঁদে ফেলে যে তরুণীকে পাচার করার পর নির্যাতন করা হয়েছে সেই তরুণীকে পাচারের মূলেও এই বস রাফিই ছিল।

গতকাল র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভারতের ব্যাঙ্গালুরুয় এক তরুণীকে নগ্ন করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার সূত্র ধরে ভারতের পুলিশ টিকটক রিফাজুল ইসলাম বাবু ওরফে টিকটক বাবু, সাগর, মোহাম্মদ বাবা শেখ, হাকিল ও দুই নারীসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গালুরু থানায় মামলা হয়। সেই সুবাদে একই চক্রের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায়ও একটি মামলা হয়। মামলার সূত্র ধরে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও তদন্তে নামে। গত সোমবার পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে র‌্যাব যশোরের অভয়নগর থেকে এ চক্রের মূলহোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে আশরাফ ম-ল ওরফে বস রাফিকে গ্রেপ্তার করে। পরে তার দেয়া তথ্যে সাহিদা বেগম ওরফে ম্যাডাম সাহিদা, মো. ইসমাইল সরদার এবং আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। র‌্যাব জানিয়েছে, আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি গত আট বছর ধরে ভারতে নিয়মিত বিভিন্ন বয়সী মেয়েকে পাচার করে আসছিল। গত ৮ বছরে সে কমপক্ষে ৫০০ নারীকে ভারতে পাচার করেছে বলে র‌্যাবের কাছে জানিয়েছে। ওই ৫০০ নারীকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের আবাসিক হোটেল, বাসা, ফ্ল্যাটে পতিতাবৃত্তির কাজে বাধ্য করা হয়েছে। টিকটক হৃদয় বাবুর মতো বস রাফি কমপক্ষে ৫০টি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে। যাদের মাধ্যমে রাফি ভারতে বিভিন্ন বয়সীর মেয়ে পাচার করে আসছিল।

র?্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। আট বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার যাতায়াত শুরু। প্রথমে সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার ও পরে হোটেলে রিসোর্ট কর্মচারী ও কাপড়ের ব্যবসা করত। গত দুই বছর আগে টিকটকের হৃদয়ের সঙ্গে রাফির পরিচয় হয়। এরপর টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে অর্ধশতাধিক তরুণীকে ভারতে পাচার করে সে। ভারতে যে বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এতে টিকটক হৃদয়ের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ওই ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা ২৭ মে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক হৃদয়সহ অজ্ঞাতনামা আরও চারজনকে আসামি করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র?্যাব ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩১ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত র?্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা ও র?্যাব-৩-এর অভিযানে ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল থেকে আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করত তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে বিভিন্ন বয়সের নারী ও তরুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করত টিকটক হৃদয়। এই গ্রুপে যেসব তরুণী ছিলেন, তাদের মডেল বানানোসহ ও বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করাত। পরবর্তীতে ভারতে বিভিন্ন সুপার শপ ও বিউটি পার্লারে চাকরি দেয়ার কথা বলে বস রাফির সহযোগিতায় এসব তরুণীকে বিদেশে পাচার করত। ভারতে তাদের পাচারের পর প্রথমে একটি সেফ হাউসে নেয়া হতো। র‌্যাব জানায়, সেফ হাউসে তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং জোর করে মাদক সেবন করতে বাধ্য করানো হতো। মাদক সেবনের পর তাদের জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ করা হতো। যাতে তাদের পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করা যায়। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয়পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি সম্পূর্ণ করত। প্রথমত ভিকটিমদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী জেলা- যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসত। এরপর ভিকটিমদের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউসে নিয়ে অবস্থান করানো হতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। এরপর ভারতের এজেন্টরা তাদের গ্রহণ করত।