মরণোত্তর মৃত্যুদিবস ও নৌকাকাণ্ড : শেষ

মামুন হুসাইন

সেই একই পথ, যে পথে বহুকাল আগের এক সকালে আমরা সমবেত যাত্রা উদ্বোধন করি। মোমেনা খাতুনের গলায় নিঃসঙ্গ-মৃত্যু-গাথা সরব হয় এবং সুরেলা হয়- অবাক বিস্ময়ে আমি আকাশ, গ্রামের ঘরবাড়ি, নদী, নৌকা দেখছি; আর সবাইকে এদের নাম জিজ্ঞেস করবো, কারণ আমি সব নাম ভুলে গেছি। বিছানার কিনার ঘেঁষে বসবো... আপনারা আমার নাম জিজ্ঞেস করবেন, আমার কথা বিশ্বাস করবেন, আর আমি আবার কান্নায় ভেঙে পড়বো। আপনাদের আনন্দ আমাকে সংক্রমিত করছে- বলুন তো জীবনে ফলবান হওয়ার ব্যাখ্যা কী? নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার অর্থ- আমি হারিয়ে যাব? প্রতিদিন আমার কপাল এবং বুকে এত আলো প্রক্ষেপণের কারণ কী, যদি আপনারা আমার খবর আদান-প্রদানেই অনাগ্রহী হয়ে পড়েন? মোমেনা খাতুন মৃত্যুমথিত অরক্ষিত মেঘ প্রদেশ থেকে কথা বলে : মৃত্যু আমার কাছে... ভয়ে-ভয়ে এবং সাহসে বলি : শীতল কিংবা প্রেমহীন নয়...! সাহস ছড়িয়ে বলি- মৃত্যু আমার ভেতর উত্তাপ ছড়াতে বসেছে। সঠিক কথাটা বোধকরি এখনো বলা হয় নি; আমার সত্যিই তীব্র ভয় করছে- প্রভু আপনি ভালোবাসা দিন, ...মৃত্যু শেষমেষ দুঃসহ-ভয়ঙ্কর একটি তেতো ঘটনা; এ যাত্রা আমার হাড়, মুখম-ল, জিহ্বা ক্রমশ দূর্বল, ক্ষীনণ ও ঝলসে পড়া। লোকেরা আমার মস্তিষ্কের এবং হৃদপিণ্ডের সকল বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা ক্ষীণ হয়ে আসায় বেঁচে থাকার শেষ ইঙ্গিত খুঁজছে। লোকেরা হাসপাতালের প্রকৃতিবাদী তথা ইকো-ফ্রেন্ডলি টেলিভিশনে, এক প্রাচীন হাতির মৃত্যু-প্রতীক্ষা উপভোগ করছে গভীর ধ্যানমগ্নতায়... হাতিদের শোভাযাত্রা স্তব্ধ হয়ে গেছে; একটি মাঠের ভেতর প্রাচীন মৃত হাতিদের নির্মম সাদা কঙ্কাল রাশি; ...এবার সর্বাপেক্ষা প্রবীণ হাতি, স্বনির্ধারিত মরণ-প্রজ্ঞাপন প্রতিপালনের জন্য সেই মাঠে খাদ্য-জল পরিত্যাগ করে নিঃসঙ্গ মৃত্যু পথযাত্রী হচ্ছে। মেয়েটি শুনল, কেউ শেখাল মোমেনা খাতুনকে- আত্মা কখনো বাদুড়ের রূপ নেয়; ...দেখল সামনের গাছে, একটি মাত্র পাতা- রঙ বদল হচ্ছে, ...হলুদ, মৃত্যুর রঙ; একটি হলুদ পাতা, মৃত্যুর রঙ হয়ে, আকাশ ছুঁয়ে আছে... আকাশ অর্থ মেঘ। বিস্তর জায়গা জুড়ে কেবল মেঘ। আমরা যেন একটি নৌকায়। আমাদের নৌকার দিকে আরেকটি নৌকা এত দ্রুত ছুটে আসছে- আঘাত হলেই সলীল সমাধি। আমরা চিৎকার করি- বিষয়টি ভুল হলো, ধেয়ে আসা নৌকায় তখন কেউ ছিল না, স্রোতের তোড়েই নৌকাটি অপরপ্রান্ত থেকে ধেয়ে আসছিল। মোমেনা খাতুন হাসপাতালের মুমূর্ষু অক্সিজেনে সাঁতার দিতে দিতে নিবুনিবু চোখে, এই প্রকার বিপন্ন-বিস্ময় চিহ্নিত করে এবং আবারও মেঘ রাজ্যে দ্রবীভূত হয়... দেখুন, সকল জায়গায় কেবল মেঘ, হাসপাতালের এই কাগজের ভেতরেও মেঘ : মেঘ ছাড়া বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি বিনা বৃক্ষ বাঁচে না, আর বৃক্ষ ছাড়া কাগজ তৈরি হয় না। কাগজ এবং মেঘের এই ব্যক্তিগত ভ্রমণ বৃত্তান্তের ভেতর মোমেনা খাতুনের নিশ্বাস ঘন হয়। অক্সিজেন টেন্ট সরে যাচ্ছে, অথবা আমাদের নিঃশ্বাস ও তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোমেনা খাতুন শরীর ও সত্তা শান্ত করার কারিগরি বিদ্যা শেখে। নিজেকে জলের ভেতর প্রতিফলিত দেখে। নিশ্বাস ভারি হচ্ছে, দ্রুত হচ্ছে, শান্ত হচ্ছে, অবসন্ন হচ্ছে... আর মোমেনা খাতুন তার নিশ্বাস অনুসরণ করতে করতে, মৃদু হাসি ছড়িয়ে মেঘ ও নৌকার দিকে চোখ মেলে, শান্ত শীতল হয়, শব্দহীন হয়... আর আকস্মিক শব্দহীন দ্রুতিতে ওজনহীন মেঘের মতো ঝুলে থাকে দিগন্তের আরও বহুদূরের এক জলাময় তুষারম-লে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে।

লোকসকল যদিও-বা গল্প গাছা ছড়ায়, তৈরি করে ভাবানুষঙ্গের বিবিধ স্বয়ংক্রিয় প্রকাশ, তৈরি করে অসংখ্য পাঠ থেকে পাঠান্তর, কিন্তু বিষয়টি এমনতর কদাচিৎ হয়... যখন মোমেনা খাতুনের আত্মা বাদুড় হয় এবং ভূ-গর্ভস্থ প্রাচীন নদীতে, জিহ্বায় রুপালি মুদ্রাসহ সে নৌকা আহরণ করেছে। বরঞ্চ প্রতীতি হয় যে- চীন দেশের জিপার, লেবেল কাটিং, পকেট ক্রিজিং মেশিন ইত্যাদির আহ্লাদে জীবনযাপন অবারিত হলেও একদিন নববর্ষের উৎসবে, ঐ চীন দেশ থেকেই একটি গোপন-হিংস্র-বিমাতা আতঙ্ক অগাধ শুঁড় দোলাতে-দোলাতে হ্যাপি-গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুনের শ্বাসনালীতে আশ্রয় নেয়। খবরে প্রকাশ পায়- মোমেনা খাতুন ভয় পায়, অনাথ হয়, স্তব্ধ হয়, অনিশ্চয়তায় ক্ষণিক হাহাকার করে এবং রূপান্তরিত হতে হতে ২২শে জুন ২০২০-এ ধ্রুব সমাপ্তির পথে নদী হওয়ার সম্ভাবনা ছড়ায়। গৃহচারী মানুষ, মোমেনা খাতুনের গ্রাম-প্রান্তর এবং দুগ্ধবতী গাভীর পালকবর্গ, মোমেনা খাতুনের মৃতদেহ যখন গ্রামের পথে- ‘মোমেনা খাতুনের শরীর নবনব লাগাতার মৃত্যুর উৎস’... এই উল্লাসে সকল সৎকারপর্বে বিরুদ্ধাচারী হয়, সংঘর্ষ ছড়ায় এবং এক স্তব্ধ-শূন্যতা প্রতিষ্ঠিত করে। অবিমিশ্র হাহাকারে মোমেনা খাতুনের বাবা, রাশিরাশি ছুটন্ত হাত এবং মৌন গর্জনে, চারপাশ শত্রুপক্ষের শিবির- এই বিবেচনায় অশ্রুপাত করে- ...তাহলে কন্যা আমার মাটি পাবে না, হায় আল্লাহ খোদা, এত যাতনার মৃত্যুর পর... কব্বোরও জুটবে না? প্রহরীদের অজ্ঞাতে, আত্মরক্ষার জন্য পিতা এবং মৃতকন্যা কোনো এক সাজঘরের পেছনে যায়, অন্ধকার খোঁজে এবং কবর খোঁড়ার সুনির্দিষ্ট যোগ্য জমি বরাদ্দ না পেয়ে উদ্বোধন করে শান্ত-নির্জন-নিশ্চল এক নৌকাকা-- পিতা ও কন্যা জলে ভাসে, পিতা কন্যার মরদেহ আগলায়, বুকের ভেতর চিৎকার করে, শৃগাল হাঁটতে দেখে এবং পলাতক হয় নৌকার আঁধার-ছায়ায়। নৌকার চিরস্থায়ী ভ্রমণ বৃত্তান্তে এবার দেখা যাবে- কোথাও বসতি, কোথাও অযোগ্য-অসমতল কাঁটাঝোপ আগাছা, উঁচু ডাব গাছ এবং ক্ষণে-ক্ষণে প্রগাঢ় নিশ্চল মানবমূর্তি, যেন পাড়া গাঁয়ের মোমেনা খাতুন কবরস্থ হয়ে কোনভাবেই চীন প্রবাসী সেই মৃত্যুবীজ রোপণের সুযোগ না পায় মাটিতে। লোকেরা শক্তিমান রক্ষীর মতো নৌকা এবং নদীর পাড় ছুঁয়ে হাঁটে, একটি-দুটি প্রশ্ন করে, কোথাও দাঁড়ায়, নিষ্ক্রান্ত হয় এবং লাঠি ঘষে-ঘষে সোচ্চার হয়... মোমেনা খাতুনের মৃত-জীবন এখন মেঘাবৃত বটে, কোনভাবেই মাটিতে গড়িয়ে পড়ার অনুমতি নেই। লোকেদের শপথ বাক্য এবং প্রশ্ন সকল আরও সুদীর্ঘ আয়ুষ্কালের অধিকারী হয়, ঘণ্টাধ্বনি শোনায় এবং মূর্তি হয়ে, প্রহরী হয়ে নৌকাকা- প্রদক্ষিণ করে। মোমেনা খাতুনের শান্ত রক্তস্রোত সুক্ষ্ম ও বিকট আকার হয়ে, সর্বকালের অজানা ক্ষতস্থানসমূহ স্পর্শ করার প্রস্তুতি নেয়... লোকেরা নিশ্চিত হয়, মোমেনা খাতুন নামক একখ- পিপাসার্ত পাথর-শরীর কালো রক্ত হয়ে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে বর্ষার গাঢ় অন্তিম স্রোতে। হ্যাপি গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন মলিন মৃতবস্ত্রে শায়িত হয়ে আত্মবিস্মৃত বৃক্ষশাখার পানে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকে, বৃষ্টির ফোঁটার মতো টুকরো হয়; আর বিবিধ ইঙ্গিতে বাকরুদ্ধ দুঃখ-দুদর্শার এই সুর বিনিময় করে তার হীনজন্ম-বাবা- কোথাও যেন ভূমিকম্প, কোথাও মেঘ, কোথাও ছায়ামূর্তি... আর এইসব প্রকম্পন, সরীসৃপ ও আগুনের হল্কা হয়ে অতঃপর শূন্যে ভাসমান হয়, অশ্রুসজল হয় এবং চুঁইয়ে পড়া নররক্ত ও কাদার ভেতর আশ্চর্য শীতলতা ধারণ করে।

পুরনো প্রাচীন নৌকাকাণ্ডের সূত্রে এবার উন্মাদ মৃত্তিকা ধারাস্নান গড়ে, বৃষ্টি পতনের মতো কাঁপে এবং মোমেনা খাতুনের বিদায় গৌরব লেখে, ধেয়ে আসা ছায়ামূর্তিদের সাক্ষী মেনে : ...তোমাদের অবগতির জন্য বলি, বহুকাল আগে সব ছিল জল। কী গভীর অতলান্ত জলরাশি : এক বিশাল সরীসৃপ ভেসে বেড়ায় সেখানে, তার বিশ্রামের প্রয়োজনে সে একদিন হেঁকে বললো, একটা প্রবালদ্বীপ উঠে আসুক। ...সেই থেকে ডাঙ্গার সৃষ্টি হলো। এরকম ভাবে এক শামান অনন্ত জলরাশির ওপর দিকে লালবুকওয়ালা পাখির সঙ্গে উড়ে যাচ্ছিল। বিশ্রামের জন্য মাটি খুঁড়তে বলে। প্রথমবার সফল হয় না পাখিটি। অবশেষে তৃতীয় বারের চেষ্টায় ঠোঁটে করে তুলে এনেছিল কাদামাটি, আর সেই হলো আদিম স্থলভাগ। তোমাদের প্রতীতি হয়... পরমেশ্বর থেকে প্রকৃত আকাশ উৎপন্ন হয়। আকাশ থেকে বায়ু। বায়ু থেকে অগ্নি। অগ্নি থেকে জল। জল থেকে পৃথিবী। পৃথিবী থেকে সর্ববিধ শস্য-বৃক্ষ। ঔষধি বৃক্ষ থেকে অন্ন। সেই অন্ন শুক্র শোণিত রূপে উৎপাদন করে জীব-শরীর। কিন্তু লোকেরা মোমেনা খাতুনের নৌকাযাত্রা দেখে, ভেঙে পড়া আকাশ দেখে এবং সেই দুঃখের ভেতর শান্তনা বাক্য লেখে- ...নদীতে নদীতে দেখা হয়, তবু বোনে বোনে দেখা হয় না! লোকেরা সুর নির্মাণ করে- ...জলে খেল, জলে খেল, জলে তুমার কে আছে? ভালো কইরে ভাইবে দেখ, জলের মাঝে ঘর আছে- ইতোপূর্বে এইসব সুর এবং মৃত গায়কদের কথা জানা গেলেও, একযোগে আকাশ পানে চেয়ে থাকা মানবকূল, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ার ছবি আন্দাজ করে এই প্রথম- ...আর ভাবে এই তীব্র কূলপ্লাবিত জলে একটি নৌকা এবং নৌকার ভেতর শায়িত মানবজমিনের কী গতি হবে? নৌকার ভেতর শায়িত হ্যাপি গার্মেন্টসের মোমেনা খাতুন এবং তার বাবা, বাধ্যতামূলক মৃত্যুবীজ প্রতিস্থাপনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য, জলের চেয়েও ক্লান্ত তাদের শরীর- জলের মৌন গর্জনে সমর্পিত করে। নৌকা এগোয়, স্তব্ধ হয়, প্রবাহমান হয়, আর বিস্ময়-বিপন্ন বাবা... মরদেহ ফিরিয়ে আনার ভিক্ষাপাত্র নিয়ে অশ্রু আড়াল করে এবং অন্ধকার-কাদায় তৈরি মূর্তির মতো কন্যার শয্যাপ্রান্তে বসে থাকে রোদনহীন। সারাদিনব্যাপী গ্রাম ও স্বরাষ্ট্র-বিভাগে অসিচালনা শেষে তার দেহ ও মন অবসন্ন- লোকটি আত্মরক্ষার উপায় খোঁজে, দিব্যমূর্তি ধারণকারী কাউকে অন্ধকারে মিশে যেতে দেখ, আর কন্যার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে : অমি বৃদ্ধ, জননী আমার- প্রত্যাশাহীন এবং অপেক্ষারত আমার নিজের মৃত্যুর জন্য। লোকটি নতজানু হয় এবং মৃতদেহ মুড়িয়ে রাখা কাপড় চুম্বন করে, অশ্রুপাত করে এবং বিগত-সমাগত সময়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। উৎসর্গকৃত নৌকা সাড়া না দিয়ে পারে না; জলের বজ্রকঠিন খেলাধূলার ভেতর আত্মগোপন করে একবার, আর একবার লোকসকলের মুখের দিকে গলুই ঘোরায়, ...যেন জল ক্রমশ ভাষা হয়ে আসে! জলের ভেতর গ্রামের নাম প্রতিফলিত হয়- মুংলি, বনকিশোর, চাঁদনগর, জোতকার্ত্তিক, বৈদ্যনাথতলা...! তারপর বড় নদী ছোট-নদী শাখা-নদী হয়ে মরদেহ বহনকারী নৌকা ক্রমশ সোনার তরী হয়। জলের ভেতর থেকে কেউ কথা বলে। অথবা আপনমনে কণ্ঠস্বর জ্বলে-নিভে : ...এই তিনটি ব্রিজ, ...আড়ানী, মালঞ্চী এবং বড়াল। পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের গা-ভেসে তুমি চলেছ এখন। অন্তত ১৩০ বছর আগে এই পাড়ে রেশমকুঠি ছিল। কনস্টেবল নং ১২৮২, মো. রইসউদ্দিনকে, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১, দুপুর সাড়ে এগারোটায় হত্যা করা হয় এই নদীর পাড়ে। নৌকা যাচ্ছে মুংলী বাজার বরাবর, ৯০ বিঘা আয়তনের লক্ষ্মীপুর আমবাগানের কথা জানা আছে? তুমি যদি রস্তমপুর ব্রীজ ছুঁইছুঁই হও, এখানে নদী থেকে একটি খাল বেরিয়ে গেছে- খালপাড়ে কুঠিবাড়ি ছিল, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সম্পত্তি। তোমাদের নৌকা ফুলতলা শ্বশান ঘাট ছুঁয়ে গেল। এই জলস্রোত ছুঁয়ে কাদিরাবাদ সেনানিবাস এলাকায় পৌঁছানো যায়। এই নদী যখন প্রমত্তা ছিল, তখন পাট বোঝাই একটি নৌকা ডুবে যায়। বর্তমান তিরাইল হাইস্কুলের মাঠটি সম্পূর্ণই ছিল নদীর অংশ। বলা যায়, নৌকা ক্রমশ এইভাবে এগোয় এবং দিগন্তব্যাপী নীরবতার আদিম কণ্ঠস্বর পুনরাবিষ্কার করে। ঝলসে ওঠা মানুষেরা পাড় থেকে নৌকাকা- দেখে- নৌকা এইপ্রকার অক্লান্ত মরণযাত্রায় কখনো গতিহারা হয়, দক্ষিণ পূর্বমুখী হয়ে বড় একটি বিলে পড়ে। বিল থেকে বেরিয়ে আবার বড় গাঙ; তারপর মিশে যায় আরও দূরে। ...ক্রমেক্রমে স্থির হয়- মোমেনা খাতুনের মরদেহ এইভাবে শত যোজনব্যাপী বৃষ্টি ধারায়, দুপুর-মধ্যাহ্ন-রাত হয়ে, ভৌতিক বাগান ঘেঁষে, ঘুরেঘুরে অত্যাশ্চর্য পথ হাঁটে; লোকেরা বাঁশচেরা বেঞ্চির ধারে দাঁড়ায়, প্রহর গণনা করে, বারবার ঝলসে ওঠে- আর সহসা মোমেনা খাতুনকে আশ্রম কন্যা ভেবে মরণের সুগন্ধ আঁচ করার কৌশল রপ্ত করে। তাদের ক্ষুধার বৃত্তাকার থালা শুষ্ক হয়, নিদ্রামগ্ন হয় এবং উল্লাস-আতঙ্কের কাহিনী ছড়ায় তারা অবিকল এইভাবে। নৌকা নামক জলযান ধীরে-ধীরে কিভাবে কুহক নিদ্রার শোভা হয়, অহর্নিশ কিভাবে কটাক্ষ ছড়ায়, চক্ষুকর্ণহীন হয়, উপবাস করে... সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্যকথা বলার গন্তব্যে ধাবিত হয় ক্রমশ। মোমেনা খাতুনের অবগুণ্ঠন দিব্যস্নান শেষে, তখন আরও দূরদেশে, আরও দূর নীরবতায় মিশে যাওয়ার আয়োজন নেয়। লোকেরা অপেক্ষায় অপেক্ষায় গৃহমূখী হয়, গৃহবিবাগী হয় এবং পুর্নবার গূঢ় জন্মান্তর-রহস্যে... কপর্দকহীন হয় ও শব্দহীন দুলে ওঠে। বাঁশপাতার স্তূপ মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দ হয় গ্রামবাসীদের পায়ে। [আপনি কী লক্ষ্য করলেন, আমরা দুজন ব্যতীত এখানে আর কেউ নৌকা-জল ছুঁয়ে নেই : বাবা আপনি কি উদ্বিগ্ন! নদীতে কী বাতাস! বাতাস বইছে? আপনাদের আলোচনার কিছু-কিছু অংশ ভেসে আসছিল, প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে। বোঝাতে পারলাম না। আমি মর্মার্থ স্পর্শ করতে চাই না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে চাই সময়ের গা-ঘেঁষে। আপনারা সবাই নিরাময়ের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। আমি হাঁটলাম ধ্বংেেসর পথে... ধ্বংসের ক্ষুধা অসীম-অশেষ; আপন অন্তরে শোকের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন কখনো? আমরা এখন মাত্র দুইজন। কী হাস্যকর! আমি যে আপনাদের আর কেউ নই, আমি যে আর ভূ-পৃথিবীতে নেই... এই সহজ কথাটা কেন যে বারবার বিস্মৃত হই? আপনারা ভারমুক্ত হতে চাইছেন? সেই গোড়ার বিনির্মিত নির্মাণ-পর্ব থেকেই একটা জল বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনছি আমার মৃত কশেরুকা ছুঁয়ে। এইভাবে বাক্যালাপের কোনো অস্বিত্ব আছে? ভাষা একটি শরীর, একটি জীবদেহ বটে- আর এই জীবের আবাস হলো যুগপৎ ব্যক্ত হওয়া এবং অব্যক্ত থাকা। ফিরে যাব তাহলে? কোথায় ফিরে যাব? না কোথাও নয়! বাবা, আপনি বলছেন- স্মৃতি বিচলিত করছে; আমি বললাম, এসব স্মৃতি নয়, অন্যকিছু, ...অনন্য প্রলয়, দৈত্যপুরী ও পোড়াঘাসের প্রান্তর। আপনি কি জানেন, বাবা, আমরা এই ভরা বর্ষার নদীতে এখন মাত্র দুজন? আপনাকে অন্যমনস্ক বোধ হচ্ছে। আমার এই নীরবতা মৃত-যোদ্ধার, ...আমি স্বয়ং মৃত্যুবান; আর কী আশ্চর্য, নৌকা থেকে বেরিয়ে স্থলদেশে পদাপর্ণ করার সামান্য কয়েক হাত মাটি আমার জন্য অবশিষ্ট নেই! যে কজন মানুষ অধোমুখ হয়ে, আমার পা ছুঁয়ে কাঁধ ছুঁয়ে নখ ছুঁয়ে- আমার জীবনের মধ্যপথ দিয়ে হেঁটেছিল, তাদেরকে স্মরণ করেছি কখনো। বাবা, আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, আমরা মাত্র দুজন?]- ...জলের শব্দে এই প্রকার আঁধার-সর্বনাশী ভাষা নৌকার গলুই হয়ে পুরো পাতাটন যেন দখল করে ফেলেছে। হ্যাপি গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন নিদ্রাচালিত নৌকায় বিছানা গুটিয়ে কখনো এইভাবে ক্লান্ত দেবদূত হয় এবং আকাশ-পাতাল ভাবনার ভেতর জনশূন্য-বাবার শরীর-মু-ু ও নিঃশ্বাসে অদ্ভুত প্রকম্পন ছড়ায়। বাবা শান্ত হয়। শান্ত হতে শেখে। আয়ুষ্কাল বিষয়ে নির্বান্ধব হয়। হাড়-হিম করা প্রতিধ্বনি শোনে নদীর তীব্র স্রোতে। যমদূতের সরীসৃপ হাত আন্দাজ করে গায়ে, আর তীব্র গন্ধ, গুচ্ছের বকুলগন্ধ! মু- জলে গড়িয়ে পড়ার ধুপধুপ শব্দ... অসংখ্য হাত-পা যমদূতের বকুলগন্ধ ও সরীসৃপ হয়ে, কিলবিল করে, আর আগুনের হল্কা ছড়ায়- যেন কোনভাবেই আর রক্ষা নেই!

নিভৃতির খুব প্রয়োজন- বাবা ভৌতিক বৃক্ষরাজির দিকে চেয়ে ভাবল। ভাবল- তুমি সামান্য এক ছায়া মানুষ, ...দুঃখ-দুর্দশার সুর বিনিময় করাই তোমার চলাফেরার প্রধান আলপথ। খানিকটা অনুমতি চাই বিশ্রামের জন্য, আমার শরীর এখন হীনবল! [...বহু বছর আগে রাউতারা’র এই ঘাটে আপনাদের রবি ঠাকুর বজরা ভিড়িয়ে আসা যাওয়া করতেন প্রায়শ]। রবি ঠাকুরের সম্মানে, আসুন আষাঢ় মাসের প্রারম্ভে, এই ঘাট থেকেই হিমশীতল মোমেনা খাতুনকে ভালোবেসে নিদ্রাচালিত নৌকায় একক বিসর্জন দিই। মোমেনা খাতুন মৃত্যুবান হয়ে, মৃত্যুবীজ হয়ে, কালবিলম্ব না করে অচেতন অনন্ত বর্ষণ ধারায় সিক্ত হতে-হতে, নির্জন এককের গান হয়ে, এবার অতীব-গোপন এক সূর্যস্নানের স্বপ্নে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। লোকসকল আবিষ্কার করে- জলের চেয়েও ক্লান্ত তার দেহের ওপর অপার উজ্জ্বলতম আলোক রশ্নি; আর ঘুম ফুরিয়ে যাওয়া তার শরীর বীরগতি প্রাপ্ত হয়ে অন্তরের অগাধ রাত্রির পানে ধাবিত; এবার দেখা যাবে ধরিত্রীর শেষ ক্রোশ, কুয়াশার কাছে গচ্ছিত পেয়ারাতলার অনন্ত পৃথিবী, বটবৃক্ষের ছেঁড়া মলিন ছায়া, ব্রহ্মা-ের মতো আকাশ, আকাশের মতো সমুদ্র এবং সমুদ্রের মতো নদী। বলা যায়- এই ভাবেই সহস্র নতুনতর মৃতদেহ অন্তরের অগাধ রাত্রির পানে একদিন যাত্রা করে এবং অনন্তকাল আমাদের অশান্ত মনের প্রভা হয় বিদ্যুৎ-স্পৃষ্ট নীরবতায়। (সমাপ্ত)

বৃহস্পতিবার, ০৩ জুন ২০২১ , ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২১ শাওয়াল ১৪৪২

মরণোত্তর মৃত্যুদিবস ও নৌকাকাণ্ড : শেষ

মামুন হুসাইন

image

সেই একই পথ, যে পথে বহুকাল আগের এক সকালে আমরা সমবেত যাত্রা উদ্বোধন করি। মোমেনা খাতুনের গলায় নিঃসঙ্গ-মৃত্যু-গাথা সরব হয় এবং সুরেলা হয়- অবাক বিস্ময়ে আমি আকাশ, গ্রামের ঘরবাড়ি, নদী, নৌকা দেখছি; আর সবাইকে এদের নাম জিজ্ঞেস করবো, কারণ আমি সব নাম ভুলে গেছি। বিছানার কিনার ঘেঁষে বসবো... আপনারা আমার নাম জিজ্ঞেস করবেন, আমার কথা বিশ্বাস করবেন, আর আমি আবার কান্নায় ভেঙে পড়বো। আপনাদের আনন্দ আমাকে সংক্রমিত করছে- বলুন তো জীবনে ফলবান হওয়ার ব্যাখ্যা কী? নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার অর্থ- আমি হারিয়ে যাব? প্রতিদিন আমার কপাল এবং বুকে এত আলো প্রক্ষেপণের কারণ কী, যদি আপনারা আমার খবর আদান-প্রদানেই অনাগ্রহী হয়ে পড়েন? মোমেনা খাতুন মৃত্যুমথিত অরক্ষিত মেঘ প্রদেশ থেকে কথা বলে : মৃত্যু আমার কাছে... ভয়ে-ভয়ে এবং সাহসে বলি : শীতল কিংবা প্রেমহীন নয়...! সাহস ছড়িয়ে বলি- মৃত্যু আমার ভেতর উত্তাপ ছড়াতে বসেছে। সঠিক কথাটা বোধকরি এখনো বলা হয় নি; আমার সত্যিই তীব্র ভয় করছে- প্রভু আপনি ভালোবাসা দিন, ...মৃত্যু শেষমেষ দুঃসহ-ভয়ঙ্কর একটি তেতো ঘটনা; এ যাত্রা আমার হাড়, মুখম-ল, জিহ্বা ক্রমশ দূর্বল, ক্ষীনণ ও ঝলসে পড়া। লোকেরা আমার মস্তিষ্কের এবং হৃদপিণ্ডের সকল বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা ক্ষীণ হয়ে আসায় বেঁচে থাকার শেষ ইঙ্গিত খুঁজছে। লোকেরা হাসপাতালের প্রকৃতিবাদী তথা ইকো-ফ্রেন্ডলি টেলিভিশনে, এক প্রাচীন হাতির মৃত্যু-প্রতীক্ষা উপভোগ করছে গভীর ধ্যানমগ্নতায়... হাতিদের শোভাযাত্রা স্তব্ধ হয়ে গেছে; একটি মাঠের ভেতর প্রাচীন মৃত হাতিদের নির্মম সাদা কঙ্কাল রাশি; ...এবার সর্বাপেক্ষা প্রবীণ হাতি, স্বনির্ধারিত মরণ-প্রজ্ঞাপন প্রতিপালনের জন্য সেই মাঠে খাদ্য-জল পরিত্যাগ করে নিঃসঙ্গ মৃত্যু পথযাত্রী হচ্ছে। মেয়েটি শুনল, কেউ শেখাল মোমেনা খাতুনকে- আত্মা কখনো বাদুড়ের রূপ নেয়; ...দেখল সামনের গাছে, একটি মাত্র পাতা- রঙ বদল হচ্ছে, ...হলুদ, মৃত্যুর রঙ; একটি হলুদ পাতা, মৃত্যুর রঙ হয়ে, আকাশ ছুঁয়ে আছে... আকাশ অর্থ মেঘ। বিস্তর জায়গা জুড়ে কেবল মেঘ। আমরা যেন একটি নৌকায়। আমাদের নৌকার দিকে আরেকটি নৌকা এত দ্রুত ছুটে আসছে- আঘাত হলেই সলীল সমাধি। আমরা চিৎকার করি- বিষয়টি ভুল হলো, ধেয়ে আসা নৌকায় তখন কেউ ছিল না, স্রোতের তোড়েই নৌকাটি অপরপ্রান্ত থেকে ধেয়ে আসছিল। মোমেনা খাতুন হাসপাতালের মুমূর্ষু অক্সিজেনে সাঁতার দিতে দিতে নিবুনিবু চোখে, এই প্রকার বিপন্ন-বিস্ময় চিহ্নিত করে এবং আবারও মেঘ রাজ্যে দ্রবীভূত হয়... দেখুন, সকল জায়গায় কেবল মেঘ, হাসপাতালের এই কাগজের ভেতরেও মেঘ : মেঘ ছাড়া বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি বিনা বৃক্ষ বাঁচে না, আর বৃক্ষ ছাড়া কাগজ তৈরি হয় না। কাগজ এবং মেঘের এই ব্যক্তিগত ভ্রমণ বৃত্তান্তের ভেতর মোমেনা খাতুনের নিশ্বাস ঘন হয়। অক্সিজেন টেন্ট সরে যাচ্ছে, অথবা আমাদের নিঃশ্বাস ও তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোমেনা খাতুন শরীর ও সত্তা শান্ত করার কারিগরি বিদ্যা শেখে। নিজেকে জলের ভেতর প্রতিফলিত দেখে। নিশ্বাস ভারি হচ্ছে, দ্রুত হচ্ছে, শান্ত হচ্ছে, অবসন্ন হচ্ছে... আর মোমেনা খাতুন তার নিশ্বাস অনুসরণ করতে করতে, মৃদু হাসি ছড়িয়ে মেঘ ও নৌকার দিকে চোখ মেলে, শান্ত শীতল হয়, শব্দহীন হয়... আর আকস্মিক শব্দহীন দ্রুতিতে ওজনহীন মেঘের মতো ঝুলে থাকে দিগন্তের আরও বহুদূরের এক জলাময় তুষারম-লে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে।

লোকসকল যদিও-বা গল্প গাছা ছড়ায়, তৈরি করে ভাবানুষঙ্গের বিবিধ স্বয়ংক্রিয় প্রকাশ, তৈরি করে অসংখ্য পাঠ থেকে পাঠান্তর, কিন্তু বিষয়টি এমনতর কদাচিৎ হয়... যখন মোমেনা খাতুনের আত্মা বাদুড় হয় এবং ভূ-গর্ভস্থ প্রাচীন নদীতে, জিহ্বায় রুপালি মুদ্রাসহ সে নৌকা আহরণ করেছে। বরঞ্চ প্রতীতি হয় যে- চীন দেশের জিপার, লেবেল কাটিং, পকেট ক্রিজিং মেশিন ইত্যাদির আহ্লাদে জীবনযাপন অবারিত হলেও একদিন নববর্ষের উৎসবে, ঐ চীন দেশ থেকেই একটি গোপন-হিংস্র-বিমাতা আতঙ্ক অগাধ শুঁড় দোলাতে-দোলাতে হ্যাপি-গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুনের শ্বাসনালীতে আশ্রয় নেয়। খবরে প্রকাশ পায়- মোমেনা খাতুন ভয় পায়, অনাথ হয়, স্তব্ধ হয়, অনিশ্চয়তায় ক্ষণিক হাহাকার করে এবং রূপান্তরিত হতে হতে ২২শে জুন ২০২০-এ ধ্রুব সমাপ্তির পথে নদী হওয়ার সম্ভাবনা ছড়ায়। গৃহচারী মানুষ, মোমেনা খাতুনের গ্রাম-প্রান্তর এবং দুগ্ধবতী গাভীর পালকবর্গ, মোমেনা খাতুনের মৃতদেহ যখন গ্রামের পথে- ‘মোমেনা খাতুনের শরীর নবনব লাগাতার মৃত্যুর উৎস’... এই উল্লাসে সকল সৎকারপর্বে বিরুদ্ধাচারী হয়, সংঘর্ষ ছড়ায় এবং এক স্তব্ধ-শূন্যতা প্রতিষ্ঠিত করে। অবিমিশ্র হাহাকারে মোমেনা খাতুনের বাবা, রাশিরাশি ছুটন্ত হাত এবং মৌন গর্জনে, চারপাশ শত্রুপক্ষের শিবির- এই বিবেচনায় অশ্রুপাত করে- ...তাহলে কন্যা আমার মাটি পাবে না, হায় আল্লাহ খোদা, এত যাতনার মৃত্যুর পর... কব্বোরও জুটবে না? প্রহরীদের অজ্ঞাতে, আত্মরক্ষার জন্য পিতা এবং মৃতকন্যা কোনো এক সাজঘরের পেছনে যায়, অন্ধকার খোঁজে এবং কবর খোঁড়ার সুনির্দিষ্ট যোগ্য জমি বরাদ্দ না পেয়ে উদ্বোধন করে শান্ত-নির্জন-নিশ্চল এক নৌকাকা-- পিতা ও কন্যা জলে ভাসে, পিতা কন্যার মরদেহ আগলায়, বুকের ভেতর চিৎকার করে, শৃগাল হাঁটতে দেখে এবং পলাতক হয় নৌকার আঁধার-ছায়ায়। নৌকার চিরস্থায়ী ভ্রমণ বৃত্তান্তে এবার দেখা যাবে- কোথাও বসতি, কোথাও অযোগ্য-অসমতল কাঁটাঝোপ আগাছা, উঁচু ডাব গাছ এবং ক্ষণে-ক্ষণে প্রগাঢ় নিশ্চল মানবমূর্তি, যেন পাড়া গাঁয়ের মোমেনা খাতুন কবরস্থ হয়ে কোনভাবেই চীন প্রবাসী সেই মৃত্যুবীজ রোপণের সুযোগ না পায় মাটিতে। লোকেরা শক্তিমান রক্ষীর মতো নৌকা এবং নদীর পাড় ছুঁয়ে হাঁটে, একটি-দুটি প্রশ্ন করে, কোথাও দাঁড়ায়, নিষ্ক্রান্ত হয় এবং লাঠি ঘষে-ঘষে সোচ্চার হয়... মোমেনা খাতুনের মৃত-জীবন এখন মেঘাবৃত বটে, কোনভাবেই মাটিতে গড়িয়ে পড়ার অনুমতি নেই। লোকেদের শপথ বাক্য এবং প্রশ্ন সকল আরও সুদীর্ঘ আয়ুষ্কালের অধিকারী হয়, ঘণ্টাধ্বনি শোনায় এবং মূর্তি হয়ে, প্রহরী হয়ে নৌকাকা- প্রদক্ষিণ করে। মোমেনা খাতুনের শান্ত রক্তস্রোত সুক্ষ্ম ও বিকট আকার হয়ে, সর্বকালের অজানা ক্ষতস্থানসমূহ স্পর্শ করার প্রস্তুতি নেয়... লোকেরা নিশ্চিত হয়, মোমেনা খাতুন নামক একখ- পিপাসার্ত পাথর-শরীর কালো রক্ত হয়ে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে বর্ষার গাঢ় অন্তিম স্রোতে। হ্যাপি গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন মলিন মৃতবস্ত্রে শায়িত হয়ে আত্মবিস্মৃত বৃক্ষশাখার পানে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকে, বৃষ্টির ফোঁটার মতো টুকরো হয়; আর বিবিধ ইঙ্গিতে বাকরুদ্ধ দুঃখ-দুদর্শার এই সুর বিনিময় করে তার হীনজন্ম-বাবা- কোথাও যেন ভূমিকম্প, কোথাও মেঘ, কোথাও ছায়ামূর্তি... আর এইসব প্রকম্পন, সরীসৃপ ও আগুনের হল্কা হয়ে অতঃপর শূন্যে ভাসমান হয়, অশ্রুসজল হয় এবং চুঁইয়ে পড়া নররক্ত ও কাদার ভেতর আশ্চর্য শীতলতা ধারণ করে।

পুরনো প্রাচীন নৌকাকাণ্ডের সূত্রে এবার উন্মাদ মৃত্তিকা ধারাস্নান গড়ে, বৃষ্টি পতনের মতো কাঁপে এবং মোমেনা খাতুনের বিদায় গৌরব লেখে, ধেয়ে আসা ছায়ামূর্তিদের সাক্ষী মেনে : ...তোমাদের অবগতির জন্য বলি, বহুকাল আগে সব ছিল জল। কী গভীর অতলান্ত জলরাশি : এক বিশাল সরীসৃপ ভেসে বেড়ায় সেখানে, তার বিশ্রামের প্রয়োজনে সে একদিন হেঁকে বললো, একটা প্রবালদ্বীপ উঠে আসুক। ...সেই থেকে ডাঙ্গার সৃষ্টি হলো। এরকম ভাবে এক শামান অনন্ত জলরাশির ওপর দিকে লালবুকওয়ালা পাখির সঙ্গে উড়ে যাচ্ছিল। বিশ্রামের জন্য মাটি খুঁড়তে বলে। প্রথমবার সফল হয় না পাখিটি। অবশেষে তৃতীয় বারের চেষ্টায় ঠোঁটে করে তুলে এনেছিল কাদামাটি, আর সেই হলো আদিম স্থলভাগ। তোমাদের প্রতীতি হয়... পরমেশ্বর থেকে প্রকৃত আকাশ উৎপন্ন হয়। আকাশ থেকে বায়ু। বায়ু থেকে অগ্নি। অগ্নি থেকে জল। জল থেকে পৃথিবী। পৃথিবী থেকে সর্ববিধ শস্য-বৃক্ষ। ঔষধি বৃক্ষ থেকে অন্ন। সেই অন্ন শুক্র শোণিত রূপে উৎপাদন করে জীব-শরীর। কিন্তু লোকেরা মোমেনা খাতুনের নৌকাযাত্রা দেখে, ভেঙে পড়া আকাশ দেখে এবং সেই দুঃখের ভেতর শান্তনা বাক্য লেখে- ...নদীতে নদীতে দেখা হয়, তবু বোনে বোনে দেখা হয় না! লোকেরা সুর নির্মাণ করে- ...জলে খেল, জলে খেল, জলে তুমার কে আছে? ভালো কইরে ভাইবে দেখ, জলের মাঝে ঘর আছে- ইতোপূর্বে এইসব সুর এবং মৃত গায়কদের কথা জানা গেলেও, একযোগে আকাশ পানে চেয়ে থাকা মানবকূল, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ার ছবি আন্দাজ করে এই প্রথম- ...আর ভাবে এই তীব্র কূলপ্লাবিত জলে একটি নৌকা এবং নৌকার ভেতর শায়িত মানবজমিনের কী গতি হবে? নৌকার ভেতর শায়িত হ্যাপি গার্মেন্টসের মোমেনা খাতুন এবং তার বাবা, বাধ্যতামূলক মৃত্যুবীজ প্রতিস্থাপনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য, জলের চেয়েও ক্লান্ত তাদের শরীর- জলের মৌন গর্জনে সমর্পিত করে। নৌকা এগোয়, স্তব্ধ হয়, প্রবাহমান হয়, আর বিস্ময়-বিপন্ন বাবা... মরদেহ ফিরিয়ে আনার ভিক্ষাপাত্র নিয়ে অশ্রু আড়াল করে এবং অন্ধকার-কাদায় তৈরি মূর্তির মতো কন্যার শয্যাপ্রান্তে বসে থাকে রোদনহীন। সারাদিনব্যাপী গ্রাম ও স্বরাষ্ট্র-বিভাগে অসিচালনা শেষে তার দেহ ও মন অবসন্ন- লোকটি আত্মরক্ষার উপায় খোঁজে, দিব্যমূর্তি ধারণকারী কাউকে অন্ধকারে মিশে যেতে দেখ, আর কন্যার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে : অমি বৃদ্ধ, জননী আমার- প্রত্যাশাহীন এবং অপেক্ষারত আমার নিজের মৃত্যুর জন্য। লোকটি নতজানু হয় এবং মৃতদেহ মুড়িয়ে রাখা কাপড় চুম্বন করে, অশ্রুপাত করে এবং বিগত-সমাগত সময়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। উৎসর্গকৃত নৌকা সাড়া না দিয়ে পারে না; জলের বজ্রকঠিন খেলাধূলার ভেতর আত্মগোপন করে একবার, আর একবার লোকসকলের মুখের দিকে গলুই ঘোরায়, ...যেন জল ক্রমশ ভাষা হয়ে আসে! জলের ভেতর গ্রামের নাম প্রতিফলিত হয়- মুংলি, বনকিশোর, চাঁদনগর, জোতকার্ত্তিক, বৈদ্যনাথতলা...! তারপর বড় নদী ছোট-নদী শাখা-নদী হয়ে মরদেহ বহনকারী নৌকা ক্রমশ সোনার তরী হয়। জলের ভেতর থেকে কেউ কথা বলে। অথবা আপনমনে কণ্ঠস্বর জ্বলে-নিভে : ...এই তিনটি ব্রিজ, ...আড়ানী, মালঞ্চী এবং বড়াল। পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের গা-ভেসে তুমি চলেছ এখন। অন্তত ১৩০ বছর আগে এই পাড়ে রেশমকুঠি ছিল। কনস্টেবল নং ১২৮২, মো. রইসউদ্দিনকে, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১, দুপুর সাড়ে এগারোটায় হত্যা করা হয় এই নদীর পাড়ে। নৌকা যাচ্ছে মুংলী বাজার বরাবর, ৯০ বিঘা আয়তনের লক্ষ্মীপুর আমবাগানের কথা জানা আছে? তুমি যদি রস্তমপুর ব্রীজ ছুঁইছুঁই হও, এখানে নদী থেকে একটি খাল বেরিয়ে গেছে- খালপাড়ে কুঠিবাড়ি ছিল, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সম্পত্তি। তোমাদের নৌকা ফুলতলা শ্বশান ঘাট ছুঁয়ে গেল। এই জলস্রোত ছুঁয়ে কাদিরাবাদ সেনানিবাস এলাকায় পৌঁছানো যায়। এই নদী যখন প্রমত্তা ছিল, তখন পাট বোঝাই একটি নৌকা ডুবে যায়। বর্তমান তিরাইল হাইস্কুলের মাঠটি সম্পূর্ণই ছিল নদীর অংশ। বলা যায়, নৌকা ক্রমশ এইভাবে এগোয় এবং দিগন্তব্যাপী নীরবতার আদিম কণ্ঠস্বর পুনরাবিষ্কার করে। ঝলসে ওঠা মানুষেরা পাড় থেকে নৌকাকা- দেখে- নৌকা এইপ্রকার অক্লান্ত মরণযাত্রায় কখনো গতিহারা হয়, দক্ষিণ পূর্বমুখী হয়ে বড় একটি বিলে পড়ে। বিল থেকে বেরিয়ে আবার বড় গাঙ; তারপর মিশে যায় আরও দূরে। ...ক্রমেক্রমে স্থির হয়- মোমেনা খাতুনের মরদেহ এইভাবে শত যোজনব্যাপী বৃষ্টি ধারায়, দুপুর-মধ্যাহ্ন-রাত হয়ে, ভৌতিক বাগান ঘেঁষে, ঘুরেঘুরে অত্যাশ্চর্য পথ হাঁটে; লোকেরা বাঁশচেরা বেঞ্চির ধারে দাঁড়ায়, প্রহর গণনা করে, বারবার ঝলসে ওঠে- আর সহসা মোমেনা খাতুনকে আশ্রম কন্যা ভেবে মরণের সুগন্ধ আঁচ করার কৌশল রপ্ত করে। তাদের ক্ষুধার বৃত্তাকার থালা শুষ্ক হয়, নিদ্রামগ্ন হয় এবং উল্লাস-আতঙ্কের কাহিনী ছড়ায় তারা অবিকল এইভাবে। নৌকা নামক জলযান ধীরে-ধীরে কিভাবে কুহক নিদ্রার শোভা হয়, অহর্নিশ কিভাবে কটাক্ষ ছড়ায়, চক্ষুকর্ণহীন হয়, উপবাস করে... সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্যকথা বলার গন্তব্যে ধাবিত হয় ক্রমশ। মোমেনা খাতুনের অবগুণ্ঠন দিব্যস্নান শেষে, তখন আরও দূরদেশে, আরও দূর নীরবতায় মিশে যাওয়ার আয়োজন নেয়। লোকেরা অপেক্ষায় অপেক্ষায় গৃহমূখী হয়, গৃহবিবাগী হয় এবং পুর্নবার গূঢ় জন্মান্তর-রহস্যে... কপর্দকহীন হয় ও শব্দহীন দুলে ওঠে। বাঁশপাতার স্তূপ মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দ হয় গ্রামবাসীদের পায়ে। [আপনি কী লক্ষ্য করলেন, আমরা দুজন ব্যতীত এখানে আর কেউ নৌকা-জল ছুঁয়ে নেই : বাবা আপনি কি উদ্বিগ্ন! নদীতে কী বাতাস! বাতাস বইছে? আপনাদের আলোচনার কিছু-কিছু অংশ ভেসে আসছিল, প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে। বোঝাতে পারলাম না। আমি মর্মার্থ স্পর্শ করতে চাই না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে চাই সময়ের গা-ঘেঁষে। আপনারা সবাই নিরাময়ের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। আমি হাঁটলাম ধ্বংেেসর পথে... ধ্বংসের ক্ষুধা অসীম-অশেষ; আপন অন্তরে শোকের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন কখনো? আমরা এখন মাত্র দুইজন। কী হাস্যকর! আমি যে আপনাদের আর কেউ নই, আমি যে আর ভূ-পৃথিবীতে নেই... এই সহজ কথাটা কেন যে বারবার বিস্মৃত হই? আপনারা ভারমুক্ত হতে চাইছেন? সেই গোড়ার বিনির্মিত নির্মাণ-পর্ব থেকেই একটা জল বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনছি আমার মৃত কশেরুকা ছুঁয়ে। এইভাবে বাক্যালাপের কোনো অস্বিত্ব আছে? ভাষা একটি শরীর, একটি জীবদেহ বটে- আর এই জীবের আবাস হলো যুগপৎ ব্যক্ত হওয়া এবং অব্যক্ত থাকা। ফিরে যাব তাহলে? কোথায় ফিরে যাব? না কোথাও নয়! বাবা, আপনি বলছেন- স্মৃতি বিচলিত করছে; আমি বললাম, এসব স্মৃতি নয়, অন্যকিছু, ...অনন্য প্রলয়, দৈত্যপুরী ও পোড়াঘাসের প্রান্তর। আপনি কি জানেন, বাবা, আমরা এই ভরা বর্ষার নদীতে এখন মাত্র দুজন? আপনাকে অন্যমনস্ক বোধ হচ্ছে। আমার এই নীরবতা মৃত-যোদ্ধার, ...আমি স্বয়ং মৃত্যুবান; আর কী আশ্চর্য, নৌকা থেকে বেরিয়ে স্থলদেশে পদাপর্ণ করার সামান্য কয়েক হাত মাটি আমার জন্য অবশিষ্ট নেই! যে কজন মানুষ অধোমুখ হয়ে, আমার পা ছুঁয়ে কাঁধ ছুঁয়ে নখ ছুঁয়ে- আমার জীবনের মধ্যপথ দিয়ে হেঁটেছিল, তাদেরকে স্মরণ করেছি কখনো। বাবা, আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, আমরা মাত্র দুজন?]- ...জলের শব্দে এই প্রকার আঁধার-সর্বনাশী ভাষা নৌকার গলুই হয়ে পুরো পাতাটন যেন দখল করে ফেলেছে। হ্যাপি গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন নিদ্রাচালিত নৌকায় বিছানা গুটিয়ে কখনো এইভাবে ক্লান্ত দেবদূত হয় এবং আকাশ-পাতাল ভাবনার ভেতর জনশূন্য-বাবার শরীর-মু-ু ও নিঃশ্বাসে অদ্ভুত প্রকম্পন ছড়ায়। বাবা শান্ত হয়। শান্ত হতে শেখে। আয়ুষ্কাল বিষয়ে নির্বান্ধব হয়। হাড়-হিম করা প্রতিধ্বনি শোনে নদীর তীব্র স্রোতে। যমদূতের সরীসৃপ হাত আন্দাজ করে গায়ে, আর তীব্র গন্ধ, গুচ্ছের বকুলগন্ধ! মু- জলে গড়িয়ে পড়ার ধুপধুপ শব্দ... অসংখ্য হাত-পা যমদূতের বকুলগন্ধ ও সরীসৃপ হয়ে, কিলবিল করে, আর আগুনের হল্কা ছড়ায়- যেন কোনভাবেই আর রক্ষা নেই!

নিভৃতির খুব প্রয়োজন- বাবা ভৌতিক বৃক্ষরাজির দিকে চেয়ে ভাবল। ভাবল- তুমি সামান্য এক ছায়া মানুষ, ...দুঃখ-দুর্দশার সুর বিনিময় করাই তোমার চলাফেরার প্রধান আলপথ। খানিকটা অনুমতি চাই বিশ্রামের জন্য, আমার শরীর এখন হীনবল! [...বহু বছর আগে রাউতারা’র এই ঘাটে আপনাদের রবি ঠাকুর বজরা ভিড়িয়ে আসা যাওয়া করতেন প্রায়শ]। রবি ঠাকুরের সম্মানে, আসুন আষাঢ় মাসের প্রারম্ভে, এই ঘাট থেকেই হিমশীতল মোমেনা খাতুনকে ভালোবেসে নিদ্রাচালিত নৌকায় একক বিসর্জন দিই। মোমেনা খাতুন মৃত্যুবান হয়ে, মৃত্যুবীজ হয়ে, কালবিলম্ব না করে অচেতন অনন্ত বর্ষণ ধারায় সিক্ত হতে-হতে, নির্জন এককের গান হয়ে, এবার অতীব-গোপন এক সূর্যস্নানের স্বপ্নে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। লোকসকল আবিষ্কার করে- জলের চেয়েও ক্লান্ত তার দেহের ওপর অপার উজ্জ্বলতম আলোক রশ্নি; আর ঘুম ফুরিয়ে যাওয়া তার শরীর বীরগতি প্রাপ্ত হয়ে অন্তরের অগাধ রাত্রির পানে ধাবিত; এবার দেখা যাবে ধরিত্রীর শেষ ক্রোশ, কুয়াশার কাছে গচ্ছিত পেয়ারাতলার অনন্ত পৃথিবী, বটবৃক্ষের ছেঁড়া মলিন ছায়া, ব্রহ্মা-ের মতো আকাশ, আকাশের মতো সমুদ্র এবং সমুদ্রের মতো নদী। বলা যায়- এই ভাবেই সহস্র নতুনতর মৃতদেহ অন্তরের অগাধ রাত্রির পানে একদিন যাত্রা করে এবং অনন্তকাল আমাদের অশান্ত মনের প্রভা হয় বিদ্যুৎ-স্পৃষ্ট নীরবতায়। (সমাপ্ত)