অপ্রদর্শিত অর্থের সামান্যই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ

তারপরও সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে অনেকে

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছে করদাতারা। এ সময় ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে ২৬০ কোটি টাকা বৈধ করেছেন দুই শতাধিক বিনিয়োগকারী। যা এই সময়কালে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার মাত্র ২.৩৬ শতাংশ। এই বিনিয়োগ দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দৈনিক গড় লেনদেনের যে কোন একদিনের ৩০ শতাংশেরও কম। মূলত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পুঁজিবাজারের লেনদেন ও উত্থানে কোন ভূমিকা রাখছে না বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা ও অর্থনীতিবিদরা।

তবে তারপরেও এই সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। এবারের বাজেটে নিয়ম-নীতি শিথিল করারও দাবি জানিয়েছেন তাদের কেউ কেউ।

অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৈনিক দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেনের রেকর্ড সৃষ্টি করা পুঁজিবাজারের উত্থানে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ কোন ভূমিকা রাখছে না। সরকারের পক্ষ থেকে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ করার ঘোষণা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নে সামান্য ভূমিকা রাখছে। যা পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুনর্গঠনের পর পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে বাধ্য করা ও আইপিও শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগের নির্দেশ প্রদান করায় পুঁজিবাজারের লেনদেনে গতি ফিরেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস অর্থাৎ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে ২৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে অর্থ বৈধ করেছেন দুই শতাধিক করদাতা। এ সময় ২৬ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার। এদিকে, বিগত ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত করোনা মহামারীর কারণে সীমিত আকারে ডিএসইতে ২২৮ কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এ সময় ডিএসইতে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। সে হিসাবে ডিএসইতে ৮১১ কোটি ২১ লাখ টাকার দৈনিক গড় লেনদেন হয়েছে।

পুঁজিবাজারে সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগের বিষয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছে, ১০ শতাংশ কর পরিশোধ করে পুঁজিবাজারে তিন বছরের জন্য এ অর্থ বিনিয়োগ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের অন্য কোন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন করতে পারবে না। গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতারা পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে স্টক, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট, বন্ড, ডিবেঞ্চার, সরকারি বন্ড ও সিকিউরিটিজ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত অন্য যেকোন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা যাবে। অবশ্য বাজারসংশ্লিষ্টদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সময়সীমা তিন থেকে কমিয়ে এক বছর করা হয়।

এদিকে, পুঁজিবাজার ছাড়াও জমি, ভবন-অ্যাপার্টমেন্ট, নগদ অর্থ, ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন করদাতারা। বিগত ১০ মাসে নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত ও অন্যান্য আর্থিক স্কিমে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন ছয় হাজারেরও বেশি করদাতা। এ বাবদ সরকার ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পেয়েছে। জমি কেনার মাধ্যমে দেড় হাজারের বেশি করদাতা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন। এ খাতে তারা কর দিয়েছেন ১২৪ কোটি টাকা। অ্যাপার্টমেন্ট কিনে অর্থ বৈধ করেছেন ২ হাজার ৬০০ করদাতা। এ বাবদ তারা সরকারকে ১২২ কোটি টাকা কর দিয়েছেন। সে হিসাবে এ খাতে বৈধ হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। চূড়ান্ত হিসাবে করদাতার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সংবাদকে বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে দুই ধরনের অপ্রদর্শিত অর্থ রয়েছে, একটি ব্লাক মানি (কালো টাকা), অন্যটি আনডিসক্লোজড আর্নিং। যারা অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জন করছে সেটা ব্লাক মানি। কিন্তু এমন অনেকেই রয়েছে যারা বৈধ প্রক্রিয়ায় আয় করলেও এখন পর্যন্ত আয়ের ঘোষণা দেয়নি বা কর দেন না, সেটা আনডিসক্লোজড আর্নিং। এমন অনেকেই এখন পুঁজিবাজারে বিও অ্যাকাউন্ট খুলছে। যার মাধ্যমে তারা সরকারের ট্যাক্স নেটে (করজাল) প্রবেশ করছে।

তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত আমাদের কর আদায়ের প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ ও প্রত্যেক গ্রাম, মহল্লায় না পৌঁছাবে ততদিন দেশে অপ্রদর্শিত অর্থ বাড়তেই থাকবে। এই টাকাগুলোকে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগের মাধ্যমে প্রত্যেককেই করজালের মধ্যে আনা হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ আয়কর প্রদানে সামর্থবানরা কর দিবে না ততক্ষণ পর্যন্ত এ সুযোগ রাখা উচিত।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া কোনভাবেই উচিত নয়। অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার জন্য ১০ শতাংশ কর প্রদানের নিয়ম রয়েছে। যেখানে সৎ করদাতারা প্রায় ২৫ শতাংশ কর দিচ্ছে। এটি এক ধরনের বৈষম্য। তাছাড়া সহজে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হলে এতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে উৎসাহিত করে।

পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ নাম মাত্র বিনিয়োগ আসার কারণ জানতে চাইলে দেশের অন্যতম শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংক এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব এইচ মজুমদার সংবাদকে বলেন, মূলত আইন না বুঝার কারণ এই বিনিয়োগ এসেছে। আইন সঠিকভাবে বুঝলে কেউই বিনিয়োগ করতো না। কারণ, পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১ বছর বিনিয়োগ স্থিতি রাখার বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়েছে। যেখানে ব্যাংকে তারল্য রাখার ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়নি। পুঁজিবাজার যেহেতু একটি উৎপাদনশীল খাত। এই খাতের বিনিয়োগের ঝুঁকিও আছে। তাই এই খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করলে কর ১০ শতাংশের স্থলে ৫ শতাংশ করা উচিত।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পুঁজিবাজারের উত্থানে বড় ভূমিকা রাখে না। তবুও বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নে সহায়তা করে। বিগত বছরগুলোতেও এই সুযোগে পুঁজিবাজারে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ আসে নাই।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান শেয়ারহোল্ডার পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় করোনা মহামারীর মধ্যেও পুঁজিবাজারের ইতিবাচক উত্থান হচ্ছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পুঁজিবাজারের উত্থানে তেমন ভূমিকা রাখে না। তবে, এই সুযোগ আগামী বাজেটেও থাকা জরুরি।

বৃহস্পতিবার, ০৩ জুন ২০২১ , ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২১ শাওয়াল ১৪৪২

অপ্রদর্শিত অর্থের সামান্যই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ

তারপরও সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে অনেকে

জাহিদুল ইসলাম সুজন

image

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছে করদাতারা। এ সময় ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে ২৬০ কোটি টাকা বৈধ করেছেন দুই শতাধিক বিনিয়োগকারী। যা এই সময়কালে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার মাত্র ২.৩৬ শতাংশ। এই বিনিয়োগ দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দৈনিক গড় লেনদেনের যে কোন একদিনের ৩০ শতাংশেরও কম। মূলত অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পুঁজিবাজারের লেনদেন ও উত্থানে কোন ভূমিকা রাখছে না বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা ও অর্থনীতিবিদরা।

তবে তারপরেও এই সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। এবারের বাজেটে নিয়ম-নীতি শিথিল করারও দাবি জানিয়েছেন তাদের কেউ কেউ।

অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৈনিক দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেনের রেকর্ড সৃষ্টি করা পুঁজিবাজারের উত্থানে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ কোন ভূমিকা রাখছে না। সরকারের পক্ষ থেকে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ করার ঘোষণা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নে সামান্য ভূমিকা রাখছে। যা পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুনর্গঠনের পর পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে বাধ্য করা ও আইপিও শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগের নির্দেশ প্রদান করায় পুঁজিবাজারের লেনদেনে গতি ফিরেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস অর্থাৎ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে ২৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে অর্থ বৈধ করেছেন দুই শতাধিক করদাতা। এ সময় ২৬ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার। এদিকে, বিগত ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত করোনা মহামারীর কারণে সীমিত আকারে ডিএসইতে ২২৮ কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এ সময় ডিএসইতে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। সে হিসাবে ডিএসইতে ৮১১ কোটি ২১ লাখ টাকার দৈনিক গড় লেনদেন হয়েছে।

পুঁজিবাজারে সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগের বিষয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছে, ১০ শতাংশ কর পরিশোধ করে পুঁজিবাজারে তিন বছরের জন্য এ অর্থ বিনিয়োগ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের অন্য কোন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন করতে পারবে না। গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতারা পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে স্টক, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট, বন্ড, ডিবেঞ্চার, সরকারি বন্ড ও সিকিউরিটিজ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত অন্য যেকোন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা যাবে। অবশ্য বাজারসংশ্লিষ্টদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সময়সীমা তিন থেকে কমিয়ে এক বছর করা হয়।

এদিকে, পুঁজিবাজার ছাড়াও জমি, ভবন-অ্যাপার্টমেন্ট, নগদ অর্থ, ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন করদাতারা। বিগত ১০ মাসে নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত ও অন্যান্য আর্থিক স্কিমে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন ছয় হাজারেরও বেশি করদাতা। এ বাবদ সরকার ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পেয়েছে। জমি কেনার মাধ্যমে দেড় হাজারের বেশি করদাতা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন। এ খাতে তারা কর দিয়েছেন ১২৪ কোটি টাকা। অ্যাপার্টমেন্ট কিনে অর্থ বৈধ করেছেন ২ হাজার ৬০০ করদাতা। এ বাবদ তারা সরকারকে ১২২ কোটি টাকা কর দিয়েছেন। সে হিসাবে এ খাতে বৈধ হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। চূড়ান্ত হিসাবে করদাতার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সংবাদকে বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে দুই ধরনের অপ্রদর্শিত অর্থ রয়েছে, একটি ব্লাক মানি (কালো টাকা), অন্যটি আনডিসক্লোজড আর্নিং। যারা অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জন করছে সেটা ব্লাক মানি। কিন্তু এমন অনেকেই রয়েছে যারা বৈধ প্রক্রিয়ায় আয় করলেও এখন পর্যন্ত আয়ের ঘোষণা দেয়নি বা কর দেন না, সেটা আনডিসক্লোজড আর্নিং। এমন অনেকেই এখন পুঁজিবাজারে বিও অ্যাকাউন্ট খুলছে। যার মাধ্যমে তারা সরকারের ট্যাক্স নেটে (করজাল) প্রবেশ করছে।

তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত আমাদের কর আদায়ের প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ ও প্রত্যেক গ্রাম, মহল্লায় না পৌঁছাবে ততদিন দেশে অপ্রদর্শিত অর্থ বাড়তেই থাকবে। এই টাকাগুলোকে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগের মাধ্যমে প্রত্যেককেই করজালের মধ্যে আনা হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ আয়কর প্রদানে সামর্থবানরা কর দিবে না ততক্ষণ পর্যন্ত এ সুযোগ রাখা উচিত।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া কোনভাবেই উচিত নয়। অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার জন্য ১০ শতাংশ কর প্রদানের নিয়ম রয়েছে। যেখানে সৎ করদাতারা প্রায় ২৫ শতাংশ কর দিচ্ছে। এটি এক ধরনের বৈষম্য। তাছাড়া সহজে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হলে এতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে উৎসাহিত করে।

পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ নাম মাত্র বিনিয়োগ আসার কারণ জানতে চাইলে দেশের অন্যতম শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংক এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব এইচ মজুমদার সংবাদকে বলেন, মূলত আইন না বুঝার কারণ এই বিনিয়োগ এসেছে। আইন সঠিকভাবে বুঝলে কেউই বিনিয়োগ করতো না। কারণ, পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১ বছর বিনিয়োগ স্থিতি রাখার বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়েছে। যেখানে ব্যাংকে তারল্য রাখার ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়নি। পুঁজিবাজার যেহেতু একটি উৎপাদনশীল খাত। এই খাতের বিনিয়োগের ঝুঁকিও আছে। তাই এই খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করলে কর ১০ শতাংশের স্থলে ৫ শতাংশ করা উচিত।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পুঁজিবাজারের উত্থানে বড় ভূমিকা রাখে না। তবুও বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নে সহায়তা করে। বিগত বছরগুলোতেও এই সুযোগে পুঁজিবাজারে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ আসে নাই।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান শেয়ারহোল্ডার পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় করোনা মহামারীর মধ্যেও পুঁজিবাজারের ইতিবাচক উত্থান হচ্ছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ পুঁজিবাজারের উত্থানে তেমন ভূমিকা রাখে না। তবে, এই সুযোগ আগামী বাজেটেও থাকা জরুরি।