কৃষকের চেয়েও বেশি লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ী ও মিলমালিক

নিতাই চন্দ্র রায়

সরকারি গুদামে কমপক্ষে ১৫ লাখ টন চাল মজুদ থাকা উচিত। মজুদ এর নিচে নেমে গেলে বাজারে চালের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। ২০০৮ ও ২০২০ সালে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয় বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে সরকারি গুদামে চালের মজুদ কমে ২ লাখ ৮০ হাজার টনে নেমে গেলে বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ২০২০ সালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। পত্রিকায় প্রকাশিত খরব থেকে জানা যায়, বর্তমানে সরকারি গুদামে ৩ লাখ টন চালের মজুদ রয়েছে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। সরকারি গুদামে এত কম খাদ্যশস্য মজুদ থাকাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই অবিলম্বে মজুদ বাড়াতে হবে, নইলে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে এবং বিপদে পড়বে স্বল্প আয়ের মানুষ। চলমান মহামারীতে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। বেড়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম। চালের দাম আরও বাড়লে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না।

বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৬ থেকে ৫০, মাঝারি চাল ৫০ থেকে ৫৫ এবং সরু চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ দর। শুধু এখনই নয়, করোনাকালে সারা বছরই চড়া দামে বিক্রি হয়েছে চাল। সরকারি গুদামে মজুদ কম থাকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে চালকল মালিক, আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর পাইকারি বাজারের দামের সঙ্গে পরিবহন ব্যয়, অন্যান্য খরচ, মুনাফা যোগ করে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে। গত ২৫ এপ্রিলের যৌক্তিক মূল্য প্রতিবেদন অনুযায়ী বাজারে এক কেজি মোটা চালের দাম হওয়া উচিত ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা, অথচ সেই মোটা চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা। এক কেজি চিকন নাজিরশাইল চালের যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। অথচ নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৮ টাকা। কৃষি বিপণন আইন অনুয়াযী, ঘোষিত যৌক্তিক মূল্য বাস্তবায়িত না হলে সরকারি সংস্থাগুলো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না বললেই চলে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডএস) ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণা অনুয়াযী, দেশে প্রতি কেজি ধান বিক্রি করে কৃষকের লাভ হয় ৬০ পয়সা থেকে ১ টাকা। অপরদিকে চালকল মালিকেরা প্রতি কেজি চালে লাভ করেন আড়াই থেকে তিন টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরাও প্রায় একই পরিমাণ লাভ করেন। এর বাইরে পাইকারি ব্যবসায়ী, এজেন্ট ও ফড়িয়ারা কেজি প্রতি দেড় থেকে আড়াই টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেন।

কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করলেও প্রতি কেজিতে তার লাভ হয় মাত্র ৬০ পয়সা থেকে ১ টাকা। আর চালকল মালিক সেই ধান থেকে চাল উৎপাদন করে প্রতি কেজিতে লাভ করেন আড়াই থেকে তিন টাকা- একেই বলে কৃষকের দুর্ভাগ্য। এবার বোরো মৌসুমে ধান-চালের দাম নির্ধারণেও কৃষকের চেয়ে মিল মালিকদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কৃষকের ধানের দাম কেজি প্রতি ১ টাকা বাড়ানো হলেও মিল মালিকদের চালের দাম কেজি প্রতি বাড়ানো হয়েছে তিন টাকা। এটা ধান উৎপাদনকারী কৃষকের প্রতি চরম অবিচার এবং কোন যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এবছর প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে যথাক্রমে ২৬ টাকা ১ পয়সা ও ২৬ টাকা ১৯ পযসা। উৎপাদন খরচের সঙ্গে শতকরা ১০ ভাগ লাভ যোগ করলেও প্রতি কেজি ধানের সরকারি মূল্য হওয়া উচিত ছিল কমপক্ষে ২৮ টাকা ৬০ পয়সা। কিন্তু সরকার তা না করে প্রতি কেজি ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা।

এ বছর সারা দেশে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড ধানের আবাদ হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এবার বোরো মৌসুমে প্রায় ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে বেশি ধানের আবাদ হয়েছে। হাইব্রিড ধানের আবাদও বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমিতে। গরম বাতাস ও ব্লাস্ট রোগের কারণে হাওরাঞ্চলসহ দেশের কিছু স্থানে ধানে চিটা হওয়ার কারণে চালের উৎপাদন ২ লাখ টন কম হলেও মোট চাল উৎপাদন গত বছরের উৎপাদন ২ কোটি ২ লাখ টনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

সম্প্রতি সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৮ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ২৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৬ লাখ টন চাল, ৪০ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল ও ৩৯ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহ করবে সরকারের খাদ্য অধিদপ্তর। করোনার কারণে সারা বিশ্বে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেলে তার কিছুটা প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়ে ধান-চালের দাম বাজারে বেশি থাকার কারণে কৃষক ও চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকেরা গত বোরো ও আমন মৌসুমে সরকারি গুদামে লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক ধান-চাল সরবরাহ করেনি। গত বছর ১৬ লাখ ৭০ হাজার টন বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন হয়েছিল ৯ লাখ ১০ হাজার টন। আর সাড়ে ৮ লাখ টন আমন ধান ও চালের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছিল ৮৮ হাজার টন। চলতি বছরের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু পূরণ হবে- তা এ মুহূর্তে ঠিক বলা যাবে না।

খাদ্য অধিদপ্তরের মতে, চলতি অর্থবছরের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট ৯ লাখ ২৩ হাজার ১০০ টন চাল আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে মোট চাল আমদানির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৮০ টন। ওই সময়ে সরকারিভাবে কোন চাল আমদানি হয়নি। বেসরকারিভাবে আমদানি হলেও শুল্ক হার বেশি থাকায় আমদানির পরিমাণ খুব কম ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বেসরকারিভাবে চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে হ্রাস করা হয়। ওই শুল্ক সুবিধায় গত ৪ মাসে বেসরকারিভাবে ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৩০০ টন চাল আমদানি হলেও বাজারে তার কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। এখনও কিছু চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যার আমদানি কার্যক্রম ৩০ এপ্রিলের পর বন্ধ হয়ে যাবে।

বোরোর ভরা মৌসুমে যদি হ্রাসকৃত শুল্কে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হয়, তা হলে কৃষক তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই ৩০ এপ্রিলের পর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তকে আমার স্বাগত জানাই। সরকারি এই সিদ্ধান্ত কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার কোন বিকল্প নেই। কারণ আমরা জানি, ২০১৭ সালে শুল্ক হ্রাসের সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি চাল আমদানি করে। ফলশ্রতিতে কৃষক পরবর্তী দুই বছর ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে সর্বস্বান্ত হন, আবার দেশে ওই রকম অবস্থার সৃষ্টি হোক- এটা কারও কাম্য হতে পারে না।

করোনার কারণে দেশের গ্রাম ও শহর মিলে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার জীবন যাপন করছে। বিদেশ থেকেও ফিরে এসেছে অনেক কর্মজীবী মানুষ। দেশে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এসব মানুষের কথা ভেবে সরকারের উচিত চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে খোলা বাজারে চাল বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করা। ভিজিডি ও ভিজিএফের মাধ্যমে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে চাল বিতরণ করা। বাজারে ওপর কঠোর নজরদারি রাখা, যাতে করোনার অজুহাতে মজুদ বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে সরকারি গুদামে ন্যূনতম মজুদ নিশ্চিত করা।

সরকারি গুদামে কৃষক যে ধান সরবরাহ করেন, তার আর্দ্রতা থাকতে হবে ১২ শতাংশের নিচে। কৃষকের ধানের কোন আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নেই। সে অনুমান করে রোদে শুকিয়ে ধান নিয়ে যান সরকারি গুদামে। ফলে অনেক সময় বেশি আর্দ্রতার কারণে কৃষকের ধান সরকারি গুদাম থেকে ফেরত দেয়া হয়। এতে কৃষক হয়রানি ও আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সরকারিভাবে ধানের আধুনিক আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র সরবরাহ করা হলে তারা কৃষকের ধানের সঠিক আর্দ্রতা নিরূপণে সহায়তা করতে পারবেন। কৃষক হয়রানির হাত থেকে রেহাই পাবেন। খাদ্য অধিদপ্তরও লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক ধান সংগ্রহে সক্ষম হবে।

এবার বোরো মৌসুমে সেদ্ধ চালের সরবরাহ মূল্য প্রতি কেজিতে ৩ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকায় নির্ধারণ করে সরকার। এতে আশা করা যায় চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকেরা এবার চুক্তি মোতাবেক সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করবেন এবং করোনার মতো মহামারীতে সরকারিভাবে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে। তারপরও যদি কোন মিল মালিক চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহে ব্যর্থ হন তা হলে তার চালকলের লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষকদের সরকারি গুদামে ধান সরবরাহে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের জন্য কৃষিপণ্যের জাতীয় মূল্য কমিশন গঠনের ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। এছাড়া সরকারি খাদ্য গুদামের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পেডি সাইলো নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত করতে হবে।

[ লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ]

netairoy18@yahoo.com

শুক্রবার, ০৪ জুন ২০২১ , ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২২ শাওয়াল ১৪৪২

কৃষকের চেয়েও বেশি লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ী ও মিলমালিক

নিতাই চন্দ্র রায়

image

সরকারি গুদামে কমপক্ষে ১৫ লাখ টন চাল মজুদ থাকা উচিত। মজুদ এর নিচে নেমে গেলে বাজারে চালের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। ২০০৮ ও ২০২০ সালে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয় বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে সরকারি গুদামে চালের মজুদ কমে ২ লাখ ৮০ হাজার টনে নেমে গেলে বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ২০২০ সালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। পত্রিকায় প্রকাশিত খরব থেকে জানা যায়, বর্তমানে সরকারি গুদামে ৩ লাখ টন চালের মজুদ রয়েছে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। সরকারি গুদামে এত কম খাদ্যশস্য মজুদ থাকাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই অবিলম্বে মজুদ বাড়াতে হবে, নইলে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে এবং বিপদে পড়বে স্বল্প আয়ের মানুষ। চলমান মহামারীতে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। বেড়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম। চালের দাম আরও বাড়লে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না।

বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৬ থেকে ৫০, মাঝারি চাল ৫০ থেকে ৫৫ এবং সরু চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ দর। শুধু এখনই নয়, করোনাকালে সারা বছরই চড়া দামে বিক্রি হয়েছে চাল। সরকারি গুদামে মজুদ কম থাকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে চালকল মালিক, আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর পাইকারি বাজারের দামের সঙ্গে পরিবহন ব্যয়, অন্যান্য খরচ, মুনাফা যোগ করে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে। গত ২৫ এপ্রিলের যৌক্তিক মূল্য প্রতিবেদন অনুযায়ী বাজারে এক কেজি মোটা চালের দাম হওয়া উচিত ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা, অথচ সেই মোটা চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা। এক কেজি চিকন নাজিরশাইল চালের যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। অথচ নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৮ টাকা। কৃষি বিপণন আইন অনুয়াযী, ঘোষিত যৌক্তিক মূল্য বাস্তবায়িত না হলে সরকারি সংস্থাগুলো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না বললেই চলে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডএস) ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণা অনুয়াযী, দেশে প্রতি কেজি ধান বিক্রি করে কৃষকের লাভ হয় ৬০ পয়সা থেকে ১ টাকা। অপরদিকে চালকল মালিকেরা প্রতি কেজি চালে লাভ করেন আড়াই থেকে তিন টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরাও প্রায় একই পরিমাণ লাভ করেন। এর বাইরে পাইকারি ব্যবসায়ী, এজেন্ট ও ফড়িয়ারা কেজি প্রতি দেড় থেকে আড়াই টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেন।

কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করলেও প্রতি কেজিতে তার লাভ হয় মাত্র ৬০ পয়সা থেকে ১ টাকা। আর চালকল মালিক সেই ধান থেকে চাল উৎপাদন করে প্রতি কেজিতে লাভ করেন আড়াই থেকে তিন টাকা- একেই বলে কৃষকের দুর্ভাগ্য। এবার বোরো মৌসুমে ধান-চালের দাম নির্ধারণেও কৃষকের চেয়ে মিল মালিকদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কৃষকের ধানের দাম কেজি প্রতি ১ টাকা বাড়ানো হলেও মিল মালিকদের চালের দাম কেজি প্রতি বাড়ানো হয়েছে তিন টাকা। এটা ধান উৎপাদনকারী কৃষকের প্রতি চরম অবিচার এবং কোন যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এবছর প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে যথাক্রমে ২৬ টাকা ১ পয়সা ও ২৬ টাকা ১৯ পযসা। উৎপাদন খরচের সঙ্গে শতকরা ১০ ভাগ লাভ যোগ করলেও প্রতি কেজি ধানের সরকারি মূল্য হওয়া উচিত ছিল কমপক্ষে ২৮ টাকা ৬০ পয়সা। কিন্তু সরকার তা না করে প্রতি কেজি ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা।

এ বছর সারা দেশে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড ধানের আবাদ হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এবার বোরো মৌসুমে প্রায় ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে বেশি ধানের আবাদ হয়েছে। হাইব্রিড ধানের আবাদও বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমিতে। গরম বাতাস ও ব্লাস্ট রোগের কারণে হাওরাঞ্চলসহ দেশের কিছু স্থানে ধানে চিটা হওয়ার কারণে চালের উৎপাদন ২ লাখ টন কম হলেও মোট চাল উৎপাদন গত বছরের উৎপাদন ২ কোটি ২ লাখ টনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

সম্প্রতি সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৮ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ২৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৬ লাখ টন চাল, ৪০ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল ও ৩৯ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহ করবে সরকারের খাদ্য অধিদপ্তর। করোনার কারণে সারা বিশ্বে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেলে তার কিছুটা প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়ে ধান-চালের দাম বাজারে বেশি থাকার কারণে কৃষক ও চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকেরা গত বোরো ও আমন মৌসুমে সরকারি গুদামে লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক ধান-চাল সরবরাহ করেনি। গত বছর ১৬ লাখ ৭০ হাজার টন বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন হয়েছিল ৯ লাখ ১০ হাজার টন। আর সাড়ে ৮ লাখ টন আমন ধান ও চালের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছিল ৮৮ হাজার টন। চলতি বছরের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু পূরণ হবে- তা এ মুহূর্তে ঠিক বলা যাবে না।

খাদ্য অধিদপ্তরের মতে, চলতি অর্থবছরের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট ৯ লাখ ২৩ হাজার ১০০ টন চাল আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে মোট চাল আমদানির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৮০ টন। ওই সময়ে সরকারিভাবে কোন চাল আমদানি হয়নি। বেসরকারিভাবে আমদানি হলেও শুল্ক হার বেশি থাকায় আমদানির পরিমাণ খুব কম ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বেসরকারিভাবে চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে হ্রাস করা হয়। ওই শুল্ক সুবিধায় গত ৪ মাসে বেসরকারিভাবে ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৩০০ টন চাল আমদানি হলেও বাজারে তার কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। এখনও কিছু চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যার আমদানি কার্যক্রম ৩০ এপ্রিলের পর বন্ধ হয়ে যাবে।

বোরোর ভরা মৌসুমে যদি হ্রাসকৃত শুল্কে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হয়, তা হলে কৃষক তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই ৩০ এপ্রিলের পর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তকে আমার স্বাগত জানাই। সরকারি এই সিদ্ধান্ত কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার কোন বিকল্প নেই। কারণ আমরা জানি, ২০১৭ সালে শুল্ক হ্রাসের সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি চাল আমদানি করে। ফলশ্রতিতে কৃষক পরবর্তী দুই বছর ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে সর্বস্বান্ত হন, আবার দেশে ওই রকম অবস্থার সৃষ্টি হোক- এটা কারও কাম্য হতে পারে না।

করোনার কারণে দেশের গ্রাম ও শহর মিলে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার জীবন যাপন করছে। বিদেশ থেকেও ফিরে এসেছে অনেক কর্মজীবী মানুষ। দেশে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এসব মানুষের কথা ভেবে সরকারের উচিত চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে খোলা বাজারে চাল বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করা। ভিজিডি ও ভিজিএফের মাধ্যমে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে চাল বিতরণ করা। বাজারে ওপর কঠোর নজরদারি রাখা, যাতে করোনার অজুহাতে মজুদ বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে সরকারি গুদামে ন্যূনতম মজুদ নিশ্চিত করা।

সরকারি গুদামে কৃষক যে ধান সরবরাহ করেন, তার আর্দ্রতা থাকতে হবে ১২ শতাংশের নিচে। কৃষকের ধানের কোন আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নেই। সে অনুমান করে রোদে শুকিয়ে ধান নিয়ে যান সরকারি গুদামে। ফলে অনেক সময় বেশি আর্দ্রতার কারণে কৃষকের ধান সরকারি গুদাম থেকে ফেরত দেয়া হয়। এতে কৃষক হয়রানি ও আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সরকারিভাবে ধানের আধুনিক আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র সরবরাহ করা হলে তারা কৃষকের ধানের সঠিক আর্দ্রতা নিরূপণে সহায়তা করতে পারবেন। কৃষক হয়রানির হাত থেকে রেহাই পাবেন। খাদ্য অধিদপ্তরও লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক ধান সংগ্রহে সক্ষম হবে।

এবার বোরো মৌসুমে সেদ্ধ চালের সরবরাহ মূল্য প্রতি কেজিতে ৩ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকায় নির্ধারণ করে সরকার। এতে আশা করা যায় চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকেরা এবার চুক্তি মোতাবেক সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করবেন এবং করোনার মতো মহামারীতে সরকারিভাবে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে। তারপরও যদি কোন মিল মালিক চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহে ব্যর্থ হন তা হলে তার চালকলের লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষকদের সরকারি গুদামে ধান সরবরাহে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের জন্য কৃষিপণ্যের জাতীয় মূল্য কমিশন গঠনের ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। এছাড়া সরকারি খাদ্য গুদামের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পেডি সাইলো নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত করতে হবে।

[ লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ]

netairoy18@yahoo.com