দেশের চা শিল্পে অগ্রযাত্রা

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

৪ জুন জাতীয় চা দিবস। চা যেমন জাতীয়ভাবে গুরুত্ব বহন করে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও। চা আমাদের রফতানি পণ্যের মধ্যে অনত্যম। এক সময় পাটের পরেই রফতানির দ্বিতীয় খাত ছিল চা। এখন চা রফতানি খাত থেকে উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। এ বাংলায় প্রথম ১৮ শতকে চা চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে চা চাষের জন্য ১৮২৮ সালে জমি বরাদ্দ হয়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরে বর্তমান চট্টগ্রাম কøাবের কাছে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; যা কু-দের বাগান নামে পরিচিত ছিল। পরে অবশ্য এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারপর ১৮৫৪ সালে মতান্তরের ১৮৪৭ সালে সিলেট শহরের বর্তমান বিমানবন্দরের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। বলতে গেলে মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র ২টি জেলায় চা চাষ করা হতো। একটি সিলেটে যা সুরমা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। আরেকটি চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বৃহৎ সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেগুলো হলো-লস্করপুর ভ্যালি, বালিশিয়া ভ্যালি, মনু-দলই ভ্যালি, লংলা ভ্যালি এবং নর্থ সিলেট ভ্যালি এবং হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৪ জুন ১৯৫৭ সালে হতে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসেবে চা বোর্ডে চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ১১১-১১৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ঢাকায় সরকার কতৃক বরাদ্দকৃত ০ দশমিক ৩৭১২ একর জামির ওপর চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। শুরু হলো বাংলায় চা বোর্ডের গতি। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের (ক্লোন) চা গাছের উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চায়ের উচ্চফলন এবং শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ‘টি অ্যাক্ট-১৯৫০’ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন; যা এখনো চালু রয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু এই শিল্পকে টেকসই খাতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করে যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন পরিত্যাক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়া যুদ্ধে বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বাগানগুলোকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাগান মালিকদের কাছে পুনরায় হস্তান্তর করেন। বঙ্গন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত চা বাগানগুলো পুনর্বাসনের জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ঋণ গ্রহণ করে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহকারীদের নগদ ভর্তুকি মূল্যের সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে সার সরবরাহ এখনো বলবৎ আছে। তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন। যেমন- বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের ফলে চা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে। ১৯৭০ সালে যেখানে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন কেজিতে। ওই বছর চা রফতানি ছিল ২ দশমিক ১৭ কেজি। প্রতি বছরই চা রফতানি বাড়ছে। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে রফতানি আয় দাঁড়ায় প্রায় ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর চা রফতানির পরিমাণ ২ দশমিক ২০ মিলিয়ন কেজিতে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬৭টি চা বাগান আছে। গত ২০০২ সাল থেকে দেশে উত্তরাঞ্চলে চা আবাদ শুরু হয়েছে। এ সম্পর্কিত প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্রায়তনে চা আবাদ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্প এরই মধ্যে ব্যাপক সফলতাও এনেছে বা আনছে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি চায়ের অবস্থান এখন পঞ্চম স্থানে আর ভিয়েতনাম অনেক পেছনে পড়ে গেছে।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট]

শুক্রবার, ০৪ জুন ২০২১ , ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২২ শাওয়াল ১৪৪২

দেশের চা শিল্পে অগ্রযাত্রা

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

image

৪ জুন জাতীয় চা দিবস। চা যেমন জাতীয়ভাবে গুরুত্ব বহন করে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও। চা আমাদের রফতানি পণ্যের মধ্যে অনত্যম। এক সময় পাটের পরেই রফতানির দ্বিতীয় খাত ছিল চা। এখন চা রফতানি খাত থেকে উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। এ বাংলায় প্রথম ১৮ শতকে চা চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে চা চাষের জন্য ১৮২৮ সালে জমি বরাদ্দ হয়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরে বর্তমান চট্টগ্রাম কøাবের কাছে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; যা কু-দের বাগান নামে পরিচিত ছিল। পরে অবশ্য এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারপর ১৮৫৪ সালে মতান্তরের ১৮৪৭ সালে সিলেট শহরের বর্তমান বিমানবন্দরের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। বলতে গেলে মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র ২টি জেলায় চা চাষ করা হতো। একটি সিলেটে যা সুরমা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। আরেকটি চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বৃহৎ সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেগুলো হলো-লস্করপুর ভ্যালি, বালিশিয়া ভ্যালি, মনু-দলই ভ্যালি, লংলা ভ্যালি এবং নর্থ সিলেট ভ্যালি এবং হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৪ জুন ১৯৫৭ সালে হতে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসেবে চা বোর্ডে চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ১১১-১১৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ঢাকায় সরকার কতৃক বরাদ্দকৃত ০ দশমিক ৩৭১২ একর জামির ওপর চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। শুরু হলো বাংলায় চা বোর্ডের গতি। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের (ক্লোন) চা গাছের উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চায়ের উচ্চফলন এবং শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ‘টি অ্যাক্ট-১৯৫০’ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন; যা এখনো চালু রয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু এই শিল্পকে টেকসই খাতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করে যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন পরিত্যাক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়া যুদ্ধে বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বাগানগুলোকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাগান মালিকদের কাছে পুনরায় হস্তান্তর করেন। বঙ্গন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত চা বাগানগুলো পুনর্বাসনের জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ঋণ গ্রহণ করে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহকারীদের নগদ ভর্তুকি মূল্যের সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে সার সরবরাহ এখনো বলবৎ আছে। তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন। যেমন- বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের ফলে চা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে। ১৯৭০ সালে যেখানে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন কেজিতে। ওই বছর চা রফতানি ছিল ২ দশমিক ১৭ কেজি। প্রতি বছরই চা রফতানি বাড়ছে। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে রফতানি আয় দাঁড়ায় প্রায় ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর চা রফতানির পরিমাণ ২ দশমিক ২০ মিলিয়ন কেজিতে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬৭টি চা বাগান আছে। গত ২০০২ সাল থেকে দেশে উত্তরাঞ্চলে চা আবাদ শুরু হয়েছে। এ সম্পর্কিত প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্রায়তনে চা আবাদ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্প এরই মধ্যে ব্যাপক সফলতাও এনেছে বা আনছে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি চায়ের অবস্থান এখন পঞ্চম স্থানে আর ভিয়েতনাম অনেক পেছনে পড়ে গেছে।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট]