বাজেটে উচ্চাশা আছে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই বিনায়ক সেন

করোনা সংক্রমণের নেতিবাচক প্রভাবে বহু মানুষ বেকার হয়েছে। অনেকের আয় কমেছে। অনেক মধ্যবিত্ত দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এতে দেশে আগে যে পরিমাণ দরিদ্র মানুষ ছিল তা বেড়ে গেছে। এসব মানুষকে সহায়তা করার জন্য বাজেটে উচ্চাশার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে এই উচ্চাশা পূরণের জন্য যেসব সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার সেসব পরিকল্পনা নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।

তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের প্রতি ত্রৈমাসিকের জন্য আমরা দারিদ্র্যের প্রাক্কলন করেছিলাম। তাতে প্রথম প্রান্তিকে দারিদ্র্যের মাত্রা ছিল ২০ শতাংশ। কোভিড-১৯’র প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা একলাফে চলে যায় ২৯ শতাংশে। তৃতীয় প্রান্তিকে তা নেমে আসে ২৭ শতাংশে এবং চতুর্থ প্রান্তিকে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। চারটি প্রান্তিক মিলিয়ে সারা বছরের গড় দারিদ্র্য দাঁড়ায় ২৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ২৪ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। একইভাবে ২০২০ সালে চরম দারিদ্র্যের হার চার প্রান্তিক মিলিয়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ১৩ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কোভিড আমাদের পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। ২০১৬ এবং ২০২০-এর মধ্যে দারিদ্র্য-পরিস্থিতিতে কোনো সামগ্রিক অগ্রগতি হয়নি বরং চরম দারিদ্র্য কিছুটা বেড়েছে। এখন আবার করোনায় যোগ হয়েছে নতুন দারিদ্র্য বা নগর দারিদ্র্য। বাজেটে অর্থমন্ত্রী দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অনেক উচ্চাশা করেছেন। তবে এসব দরিদ্রকে কীভাবে খুঁজে বের করে সহায়তা করা হবে তার কোন নির্দেশনা নেই।’

এসব দরিদ্রকে খুঁজে বের করে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার জন্য সুপারিশ করেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় যেসব মানুষ চাকরি হারিয়েছেন লকডাউন উঠে গেলে তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ফের চাকরিতে ফিরে যেতে পারবেন। এতে এখন যে পরিমাণ মধ্যবিত্ত দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে তাদের সংখ্যা কমবে। তারপরও যেহেতু নতুন দরিদ্র হয়েছে সেই বিষয়টিকে আমি ছোট করে দেখছি না। আমার সুপারিশ হলো, আগে এদের খুঁজে বের করতে হবে। তারপর সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিবিএস খুব দ্রুত অর্থাৎ তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে জরিপ চালিয়ে এসব দরিদ্রকে খুঁজে বের করতে পারে এবং সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে পারে।’

এছাড়াও গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে টিকা দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন এবং তাদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালুর সুপারিশ করেন।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছরের বাজেটের মতো এ বছরের বাজেটকেও আমি বলতে চাই ‘ঝুঁকি মোকাবিলা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বাজেট’। অর্থাৎ এখানে প্রবৃদ্ধি হার বাড়ানো মূল লক্ষ্য না- যদি বাড়ে তো ভালোই, তবে পরিকল্পনাবিদ বা রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশামতো না বাড়লেও ক্ষতি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত জনকল্যাণের দিকে চোখ রেখে সামগ্রিকভাবে করোনার ঝুঁকি সামাল দেয়া যাচ্ছে ও অর্থনীতির ওপরে সেই করোনার ঝুঁকির অভিঘাতকে প্রশমিত করা যাচ্ছে। এটা লক্ষণীয় যে, টিকাদানের ব্যবস্থা না থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে সম্মানজনক মাত্রায়- বিশ্বব্যাংকের মতে, ৩ দশমিক ৬ শতাংশ; এডিবির মতে, ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ; সরকারি তথ্যমতে, আনুমানিক ৫ দশমিক ২ শতাংশ।’

বাজেট ঘাটতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু ঘাটতি-অর্থায়ন করাই যথেষ্ট নয়। অর্থের সদ্ব্যবহারও করা চাই। এ ব্যাপারে সবাই কম-বেশি একমতÑ মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত অর্থ সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে খামতি আছে। কোভিড-১৯’র বছরে কোন কোন মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যয় সক্ষমতার অভাব চোখে পড়ার মতো। সবাই চাচ্ছে, এই কোভিড-১৯’র সুবাদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য দপ্তর ও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত বাস্তবিকই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মতো পারঙ্গম জনস্বাস্থ্য খাত হয়ে উঠুক। এই একটি বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মনোযোগ জনগণ আশা করে। এই খাতকে শক্তিশালী করার জন্য পাবলিক-প্রাইভেট সেক্টরের স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা স্থাপন করা প্রয়োজন। এনজিওগুলোরও মাস্ক ইত্যাদি কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।’

প্রশাসনিক সিস্টেমকে সংস্কারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসলে অনেকেই চাইছেন করোনাকে উপলক্ষ করে পুরো অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক সিস্টেমকেই সংস্কার করতে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীতি-নির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এক অর্থে এরা পুঁজিবাদের মধ্যে দুটি ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রথমটি রক্ষণশীল পুঁজিবাদের ধারা, দ্বিতীয়টি প্রগতিশীল পুঁজিবাদের ধারা। একাংশ চাইছেন পুরনো ধারাই অব্যাহত রাখতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, নিকট অতীতের ধারা অনুসরণ করে যেহেতু ভালো অর্জন করা গেছেÑ মধ্যম আয়ের স্তরে প্রবেশ করা গেছে, দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বেগবান হয়েছে, অবকাঠামোর চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়েছে। সেহেতু এই স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনার দরকার কী? এরা প্রবৃদ্ধির মূল কাঠামোটাকে অক্ষুণœ রেখে কোভিড-১৯’র বছরে কিছু নতুন উপাদান সংযোজন করতে চান।’

শনিবার, ০৫ জুন ২০২১ , ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৩ শাওয়াল ১৪৪২

দারিদ্র্য বিমোচন

বাজেটে উচ্চাশা আছে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই বিনায়ক সেন

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

করোনা সংক্রমণের নেতিবাচক প্রভাবে বহু মানুষ বেকার হয়েছে। অনেকের আয় কমেছে। অনেক মধ্যবিত্ত দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এতে দেশে আগে যে পরিমাণ দরিদ্র মানুষ ছিল তা বেড়ে গেছে। এসব মানুষকে সহায়তা করার জন্য বাজেটে উচ্চাশার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে এই উচ্চাশা পূরণের জন্য যেসব সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার সেসব পরিকল্পনা নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।

তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের প্রতি ত্রৈমাসিকের জন্য আমরা দারিদ্র্যের প্রাক্কলন করেছিলাম। তাতে প্রথম প্রান্তিকে দারিদ্র্যের মাত্রা ছিল ২০ শতাংশ। কোভিড-১৯’র প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা একলাফে চলে যায় ২৯ শতাংশে। তৃতীয় প্রান্তিকে তা নেমে আসে ২৭ শতাংশে এবং চতুর্থ প্রান্তিকে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। চারটি প্রান্তিক মিলিয়ে সারা বছরের গড় দারিদ্র্য দাঁড়ায় ২৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ২৪ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। একইভাবে ২০২০ সালে চরম দারিদ্র্যের হার চার প্রান্তিক মিলিয়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ১৩ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কোভিড আমাদের পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। ২০১৬ এবং ২০২০-এর মধ্যে দারিদ্র্য-পরিস্থিতিতে কোনো সামগ্রিক অগ্রগতি হয়নি বরং চরম দারিদ্র্য কিছুটা বেড়েছে। এখন আবার করোনায় যোগ হয়েছে নতুন দারিদ্র্য বা নগর দারিদ্র্য। বাজেটে অর্থমন্ত্রী দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অনেক উচ্চাশা করেছেন। তবে এসব দরিদ্রকে কীভাবে খুঁজে বের করে সহায়তা করা হবে তার কোন নির্দেশনা নেই।’

এসব দরিদ্রকে খুঁজে বের করে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার জন্য সুপারিশ করেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় যেসব মানুষ চাকরি হারিয়েছেন লকডাউন উঠে গেলে তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ফের চাকরিতে ফিরে যেতে পারবেন। এতে এখন যে পরিমাণ মধ্যবিত্ত দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে তাদের সংখ্যা কমবে। তারপরও যেহেতু নতুন দরিদ্র হয়েছে সেই বিষয়টিকে আমি ছোট করে দেখছি না। আমার সুপারিশ হলো, আগে এদের খুঁজে বের করতে হবে। তারপর সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিবিএস খুব দ্রুত অর্থাৎ তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে জরিপ চালিয়ে এসব দরিদ্রকে খুঁজে বের করতে পারে এবং সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে পারে।’

এছাড়াও গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে টিকা দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন এবং তাদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালুর সুপারিশ করেন।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছরের বাজেটের মতো এ বছরের বাজেটকেও আমি বলতে চাই ‘ঝুঁকি মোকাবিলা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বাজেট’। অর্থাৎ এখানে প্রবৃদ্ধি হার বাড়ানো মূল লক্ষ্য না- যদি বাড়ে তো ভালোই, তবে পরিকল্পনাবিদ বা রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশামতো না বাড়লেও ক্ষতি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত জনকল্যাণের দিকে চোখ রেখে সামগ্রিকভাবে করোনার ঝুঁকি সামাল দেয়া যাচ্ছে ও অর্থনীতির ওপরে সেই করোনার ঝুঁকির অভিঘাতকে প্রশমিত করা যাচ্ছে। এটা লক্ষণীয় যে, টিকাদানের ব্যবস্থা না থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে সম্মানজনক মাত্রায়- বিশ্বব্যাংকের মতে, ৩ দশমিক ৬ শতাংশ; এডিবির মতে, ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ; সরকারি তথ্যমতে, আনুমানিক ৫ দশমিক ২ শতাংশ।’

বাজেট ঘাটতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু ঘাটতি-অর্থায়ন করাই যথেষ্ট নয়। অর্থের সদ্ব্যবহারও করা চাই। এ ব্যাপারে সবাই কম-বেশি একমতÑ মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত অর্থ সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে খামতি আছে। কোভিড-১৯’র বছরে কোন কোন মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যয় সক্ষমতার অভাব চোখে পড়ার মতো। সবাই চাচ্ছে, এই কোভিড-১৯’র সুবাদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য দপ্তর ও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত বাস্তবিকই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মতো পারঙ্গম জনস্বাস্থ্য খাত হয়ে উঠুক। এই একটি বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মনোযোগ জনগণ আশা করে। এই খাতকে শক্তিশালী করার জন্য পাবলিক-প্রাইভেট সেক্টরের স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা স্থাপন করা প্রয়োজন। এনজিওগুলোরও মাস্ক ইত্যাদি কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।’

প্রশাসনিক সিস্টেমকে সংস্কারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসলে অনেকেই চাইছেন করোনাকে উপলক্ষ করে পুরো অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক সিস্টেমকেই সংস্কার করতে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীতি-নির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এক অর্থে এরা পুঁজিবাদের মধ্যে দুটি ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রথমটি রক্ষণশীল পুঁজিবাদের ধারা, দ্বিতীয়টি প্রগতিশীল পুঁজিবাদের ধারা। একাংশ চাইছেন পুরনো ধারাই অব্যাহত রাখতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, নিকট অতীতের ধারা অনুসরণ করে যেহেতু ভালো অর্জন করা গেছেÑ মধ্যম আয়ের স্তরে প্রবেশ করা গেছে, দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বেগবান হয়েছে, অবকাঠামোর চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়েছে। সেহেতু এই স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনার দরকার কী? এরা প্রবৃদ্ধির মূল কাঠামোটাকে অক্ষুণœ রেখে কোভিড-১৯’র বছরে কিছু নতুন উপাদান সংযোজন করতে চান।’