ভারত-বাংলাদেশে ৫০ জনের গ্রুপ সক্রিয়

সাইফ বাবলু

ভারত ও বাংলাদেশে নারী পাচারকারী চক্রের অর্ধশত গ্রুপের একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ চক্র ভারত ছাড়াও দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ একাধিক দেশে নারী পাচারে সম্পৃক্ত। অল্প বয়সী তরুণীদের পাচার করে আন্তর্জাতিক চক্রের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করা হয়। চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ ১৬ র‌্যাব এবং পুলিশের পৃথক অভিযানে গ্রেপ্তার হলেও অধিকাংশ রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে পাচার হওয়া নারীদের একটি বড় অংশ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আটকে আছে। এসব নারীর তথ্য পুলিশের কাছেও নেই। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা সে বিষয়ে কোন স্পষ্টতা নেই।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, উচ্চ বেতনে চাকরি, বিদেশে মডেল বানানোর ফাঁদে ফেলে এ চক্র গত ৭ থেকে ৮ বছর ধরেই অল্প বয়সী মেয়েদের পাচার করত। আর পাচার হওয়া এসব মেয়েদের জিম্মি করে অসামাজিক কার্যক্রমে বাধ্য করতে। পুরো গ্রুপটির নিয়ন্ত্রক গত ৩১ মে যশোর থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি। পাচার হওয়া মেয়েদের অধিকাংশ ‘জেনে বুঝেই’ এ ফাঁদে পা দিয়েছিল। সীমান্তের ‘দুর্বল’ মনিটরিং ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে অহরহ ভারতে মেয়েদের পাচার ছিল নিত্য ঘটনা।

গোয়েন্দাসংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে নারীদের পাচার করা হলেও ‘টিকটক’ মাধ্যমে গত ২ বছর ধরে পাচার বেশি হয়েছে। ফান ভিডিও প্রকাশের অ্যাপস টিকটকের নায়িকা করার স্বপ্ন দেখিয়ে কিশোরী ও তরুণীদের পাচার করা হতো। সীমান্তে ‘দুর্বল’ মনিটরিংয়ের সুযোগ নিয়ে পাচারকারী অধিকাংশ নারীদের অবৈধভাবে পার করত। এর ফলে ঠিক কত নারী ভারতসহ বিভিন্নœ দেশে পাচার হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও নেই। গত কয়েক মাসে পাচার হওয়া বেশকিছু তরুণী পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে আসা এসব তরুণীদের অধিকাংশই সামাজিক সম্মানের ভয়ে কোন মামলা করেনি। তবে গত ১ জুন এক তরুণী মামলা করে। সেখানে সে পাচার হওয়া, নির্যাতন, দেশে পালিয়ে আসার সব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ওই মামলার সূত্র ধরে তদন্ত চলছে।

ভারতের বেঙ্গালুরে এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যতানের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার সূত্র ধরে ভারতের পুলিশ টিকটক রিফাজুল ইসলাম বাবু ওরফে টিকটকু বাবু, সাগর, মোহাম্মদ বাবা শেখ, হাকিল ও দুই নারীসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরু থানায় মামলা হয়। সেই সুবাদে একই চক্রের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায়ও একটি মামলা হয়। মামলার সূত্র ধরে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও তদন্তে নামে। গত সোমবার পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে র‌্যাব যশোরের অভয়নগর থেকে এ চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে আশরাফ মন্ডল ওরফে বস রাফিকে গ্রেপ্তার করে। পরে তার দেয়া তথ্যে সাহিদা বেগম ওরফে ম্যাডাম সাহিদা, মো. ইসমাইল সরদার এবং আবদুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে।

এরপর গত ১ মে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ গ্রেপ্তার করে ৩ জনকে। ওই ৩ জনের মাধ্যমে পাচার হওয়ার পর নির্যাতিত হয়। এক পর্যায়ে ওই তরুণীসহ ৩ জন পালিয়ে আসে। ওই তরুণী হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করে। মামলায় আসামি করা হয় রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, আবদুল কাদের, আনিস, মেহেদি হাসান বাবু, মহিউদ্দিন, হারুন, বকুল ওরফে ছোট খোকন, সবুজ, রুবেল ওরফে রাহুল, রুবেলের স্ত্রী সোনিয়া, আকিলস ও ডালিমকে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়। এসব আসামিদের মধ্যে পুলিশ মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলায় ওই তরুণী কিভাবে ভারতে পাচার হয়েছিলেন তার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়েছে। পুলিশের ভাষ্য ছিল টিকটক হৃদয়, মেহেদী চক্র ১ হাজার তরুণীকে ভারতে পাচার করেছে। পাচার হওয়া ওইসব তরুণীদের বিভিন্ন হোটেলে, আবাসিক ফ্ল্যাটে আটকে রেখে যৌনকাজে বাধ্য করা হতো। পুলিশের ভাষ্য, গত পাঁচদিনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। তাদের মধ্যে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়া তিন নারী পাচারকারীকে পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে আরও চারজনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ সংবাদকে জানান, গত কয়েকদিনে যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এদের নিয়ন্ত্রাধীন গ্রুপের বাইরে আরও একাধিক গ্রুপ থাকতে পারে। যারা নারী পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব গ্রুপের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশ।

র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান লে. কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম সংবাদকে জানান, ভারতের ব্যাঙ্গালুরে পাচার করা বাংলাদেশি তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যতনের ভিডিও ফাঁসের পর টিকটক ফাঁদে নারীদের পাচারের বিষয়টি সামনে আসে। এরপর তারা তদন্তে নেমে এ চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। বেঙ্গালুরে নির্যতন করা যে বাংলাদেশি তরুণীর ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল ওই তরুণীকে পাচারের মূল কারিগর ছিল বস রাফিই। টিকটক হৃদয়ের মতো বস রাফি এমন ৫০ জনের গ্রুপ নিয়ন্ত্রণকারী। ৫০ জনের এ গ্রুপের একটি অংশ বাংলাদেশ থেকে নারীদের সীমান্ত পার করার পর অন্য গ্রুপটি তাদের রিসিভ করে নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যায়। সেই চক্রটি ভারতীয় নাগরিক। দু’দেশে মিলে ৫০ জনের গ্রুপ পাচারে জড়িত। শুধু বস রাফিই এককভাবে ৫ শতাধিক নারীকে বিভিন্ন সময়ে পাচার করেছে। এরপর তাদের বাধ্য করা হয় অসামাজিক কার্যক্রমে। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের রাফি এমন তথ্যই দিয়েছে।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, তাদের পর্যবেক্ষণে এসেছে গত ৭ থেকে ৮ বছর ধরেই ভারতে বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের পাচার করা হতো। ভারত ছাড়াও দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে মেয়েদের পাচার করা হতো। তবে গত ২ বছর ধরে পাচারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ২০২০ সাল থেকে টিকটকের ফাঁদে পড়ে অল্প বয়সী মেয়েদের ভারতে পাঠানো হতো। এর মধ্যে ১৪ বছরের মেয়েদেরও পাচার করা হয়েছে এমন তথ্য প্রমাণ রয়েছে। সর্বোচ্চ ২৫ বছর বয়সী মেয়েদের বেশি পাচার করা হতো। এসব মেয়েদের মডেলিং করা, নাটক সিনেমায় কাজ করা, চাকরি করা এসব প্রলোভন দেখানো হতো। অনেক মেয়ে জেনেবুঝেও টিকটকের ফাঁদ পা দিত। নাকিয়া মডেল হওয়ার স্বপ্নে পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতো।

সিআইডির মানবপাচার প্রতিরোধ সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকতারুজ্জামান সংবাদকে জানান, সম্প্রতি পাচার হওয়া কয়েক তরুণী বাংলাদেশে ফেরত এসছিল। তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখার সময় সিআইডির একটি টিম প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা দেশে কী কাজ করত, কীভাবে পাচার হয়েছে, কে তাদের পাঠিয়েছে, পাঠানোর পর তাদের সঙ্গে কী আচরণ হয়েছে সব বিষয় নিয়েই কথা বলেছে। সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদের ফেরত আসা তরুণীরা নিজেদের জীবনের করুণ কাহিনীর কথা বর্ণনা করলেও সুনির্দিষ্টভাবে কারও নাম পরিচয় বলতে পারেনি। এর ফলে সিআইডি পাচারকারীদের বিষয়ে খুব বেশিদূর এগুতে পারেনি। তবে সিআইডি হালও ছাড়েনি। বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।

শনিবার, ০৫ জুন ২০২১ , ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৩ শাওয়াল ১৪৪২

নারী পাচার

ভারত-বাংলাদেশে ৫০ জনের গ্রুপ সক্রিয়

সাইফ বাবলু

ভারত ও বাংলাদেশে নারী পাচারকারী চক্রের অর্ধশত গ্রুপের একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ চক্র ভারত ছাড়াও দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ একাধিক দেশে নারী পাচারে সম্পৃক্ত। অল্প বয়সী তরুণীদের পাচার করে আন্তর্জাতিক চক্রের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করা হয়। চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ ১৬ র‌্যাব এবং পুলিশের পৃথক অভিযানে গ্রেপ্তার হলেও অধিকাংশ রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে পাচার হওয়া নারীদের একটি বড় অংশ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আটকে আছে। এসব নারীর তথ্য পুলিশের কাছেও নেই। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা সে বিষয়ে কোন স্পষ্টতা নেই।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, উচ্চ বেতনে চাকরি, বিদেশে মডেল বানানোর ফাঁদে ফেলে এ চক্র গত ৭ থেকে ৮ বছর ধরেই অল্প বয়সী মেয়েদের পাচার করত। আর পাচার হওয়া এসব মেয়েদের জিম্মি করে অসামাজিক কার্যক্রমে বাধ্য করতে। পুরো গ্রুপটির নিয়ন্ত্রক গত ৩১ মে যশোর থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি। পাচার হওয়া মেয়েদের অধিকাংশ ‘জেনে বুঝেই’ এ ফাঁদে পা দিয়েছিল। সীমান্তের ‘দুর্বল’ মনিটরিং ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে অহরহ ভারতে মেয়েদের পাচার ছিল নিত্য ঘটনা।

গোয়েন্দাসংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে নারীদের পাচার করা হলেও ‘টিকটক’ মাধ্যমে গত ২ বছর ধরে পাচার বেশি হয়েছে। ফান ভিডিও প্রকাশের অ্যাপস টিকটকের নায়িকা করার স্বপ্ন দেখিয়ে কিশোরী ও তরুণীদের পাচার করা হতো। সীমান্তে ‘দুর্বল’ মনিটরিংয়ের সুযোগ নিয়ে পাচারকারী অধিকাংশ নারীদের অবৈধভাবে পার করত। এর ফলে ঠিক কত নারী ভারতসহ বিভিন্নœ দেশে পাচার হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও নেই। গত কয়েক মাসে পাচার হওয়া বেশকিছু তরুণী পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে আসা এসব তরুণীদের অধিকাংশই সামাজিক সম্মানের ভয়ে কোন মামলা করেনি। তবে গত ১ জুন এক তরুণী মামলা করে। সেখানে সে পাচার হওয়া, নির্যাতন, দেশে পালিয়ে আসার সব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ওই মামলার সূত্র ধরে তদন্ত চলছে।

ভারতের বেঙ্গালুরে এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যতানের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার সূত্র ধরে ভারতের পুলিশ টিকটক রিফাজুল ইসলাম বাবু ওরফে টিকটকু বাবু, সাগর, মোহাম্মদ বাবা শেখ, হাকিল ও দুই নারীসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরু থানায় মামলা হয়। সেই সুবাদে একই চক্রের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায়ও একটি মামলা হয়। মামলার সূত্র ধরে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও তদন্তে নামে। গত সোমবার পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে র‌্যাব যশোরের অভয়নগর থেকে এ চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে আশরাফ মন্ডল ওরফে বস রাফিকে গ্রেপ্তার করে। পরে তার দেয়া তথ্যে সাহিদা বেগম ওরফে ম্যাডাম সাহিদা, মো. ইসমাইল সরদার এবং আবদুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে।

এরপর গত ১ মে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ গ্রেপ্তার করে ৩ জনকে। ওই ৩ জনের মাধ্যমে পাচার হওয়ার পর নির্যাতিত হয়। এক পর্যায়ে ওই তরুণীসহ ৩ জন পালিয়ে আসে। ওই তরুণী হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করে। মামলায় আসামি করা হয় রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, আবদুল কাদের, আনিস, মেহেদি হাসান বাবু, মহিউদ্দিন, হারুন, বকুল ওরফে ছোট খোকন, সবুজ, রুবেল ওরফে রাহুল, রুবেলের স্ত্রী সোনিয়া, আকিলস ও ডালিমকে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়। এসব আসামিদের মধ্যে পুলিশ মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলায় ওই তরুণী কিভাবে ভারতে পাচার হয়েছিলেন তার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়েছে। পুলিশের ভাষ্য ছিল টিকটক হৃদয়, মেহেদী চক্র ১ হাজার তরুণীকে ভারতে পাচার করেছে। পাচার হওয়া ওইসব তরুণীদের বিভিন্ন হোটেলে, আবাসিক ফ্ল্যাটে আটকে রেখে যৌনকাজে বাধ্য করা হতো। পুলিশের ভাষ্য, গত পাঁচদিনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। তাদের মধ্যে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়া তিন নারী পাচারকারীকে পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে আরও চারজনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ সংবাদকে জানান, গত কয়েকদিনে যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এদের নিয়ন্ত্রাধীন গ্রুপের বাইরে আরও একাধিক গ্রুপ থাকতে পারে। যারা নারী পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব গ্রুপের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশ।

র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান লে. কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম সংবাদকে জানান, ভারতের ব্যাঙ্গালুরে পাচার করা বাংলাদেশি তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যতনের ভিডিও ফাঁসের পর টিকটক ফাঁদে নারীদের পাচারের বিষয়টি সামনে আসে। এরপর তারা তদন্তে নেমে এ চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। বেঙ্গালুরে নির্যতন করা যে বাংলাদেশি তরুণীর ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল ওই তরুণীকে পাচারের মূল কারিগর ছিল বস রাফিই। টিকটক হৃদয়ের মতো বস রাফি এমন ৫০ জনের গ্রুপ নিয়ন্ত্রণকারী। ৫০ জনের এ গ্রুপের একটি অংশ বাংলাদেশ থেকে নারীদের সীমান্ত পার করার পর অন্য গ্রুপটি তাদের রিসিভ করে নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যায়। সেই চক্রটি ভারতীয় নাগরিক। দু’দেশে মিলে ৫০ জনের গ্রুপ পাচারে জড়িত। শুধু বস রাফিই এককভাবে ৫ শতাধিক নারীকে বিভিন্ন সময়ে পাচার করেছে। এরপর তাদের বাধ্য করা হয় অসামাজিক কার্যক্রমে। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের রাফি এমন তথ্যই দিয়েছে।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, তাদের পর্যবেক্ষণে এসেছে গত ৭ থেকে ৮ বছর ধরেই ভারতে বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের পাচার করা হতো। ভারত ছাড়াও দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে মেয়েদের পাচার করা হতো। তবে গত ২ বছর ধরে পাচারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ২০২০ সাল থেকে টিকটকের ফাঁদে পড়ে অল্প বয়সী মেয়েদের ভারতে পাঠানো হতো। এর মধ্যে ১৪ বছরের মেয়েদেরও পাচার করা হয়েছে এমন তথ্য প্রমাণ রয়েছে। সর্বোচ্চ ২৫ বছর বয়সী মেয়েদের বেশি পাচার করা হতো। এসব মেয়েদের মডেলিং করা, নাটক সিনেমায় কাজ করা, চাকরি করা এসব প্রলোভন দেখানো হতো। অনেক মেয়ে জেনেবুঝেও টিকটকের ফাঁদ পা দিত। নাকিয়া মডেল হওয়ার স্বপ্নে পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতো।

সিআইডির মানবপাচার প্রতিরোধ সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকতারুজ্জামান সংবাদকে জানান, সম্প্রতি পাচার হওয়া কয়েক তরুণী বাংলাদেশে ফেরত এসছিল। তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখার সময় সিআইডির একটি টিম প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা দেশে কী কাজ করত, কীভাবে পাচার হয়েছে, কে তাদের পাঠিয়েছে, পাঠানোর পর তাদের সঙ্গে কী আচরণ হয়েছে সব বিষয় নিয়েই কথা বলেছে। সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদের ফেরত আসা তরুণীরা নিজেদের জীবনের করুণ কাহিনীর কথা বর্ণনা করলেও সুনির্দিষ্টভাবে কারও নাম পরিচয় বলতে পারেনি। এর ফলে সিআইডি পাচারকারীদের বিষয়ে খুব বেশিদূর এগুতে পারেনি। তবে সিআইডি হালও ছাড়েনি। বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।