বিধি হয়নি, শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেয়ার উদ্যোগ

আদালতে চ্যালেঞ্জ মুসলিম লীগের

করোনা মহামারীর মধ্যেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর করা শুরু করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তীব্র বিরোধিতার কারণে নাগরিকত্ব আইনের বিধি তৈরি না করেই গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের ১৩টি জেলায় নাগরিকত্ব আইনের ১৯৫৫ এবং ২০০৯ সালের বিধির আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব দেয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে অথচ সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর হবে এর ভিত্তি বর্ষ।

মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তড়িঘড়ি করে সিএএ-বা ক্যা পাস করায় কিন্তু এখনও এই আইন কার্যকর করার জন্য বিধি তৈরি করেনি সরকার। বাংলায় ভোট প্রচারে এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব অমিত শাহ বলেছিলেন, কোভিডের কারণেই এই আইন কার্যকর করা যাচ্ছে না। কোভিড শেষ হলেই এর কাজ শুরু করবে ভারত সরকার। এখন অবশ্য অমিত শাহের নিজের রাজ্যেই শুরু হচ্ছে অমুসলিম উদ্বাস্তুদের মধ্যে নাগরিকত্ব দেয়ার কাজ।

ক্যা পাস করার দু’বছরেও এই আইনটি দেশে এখনও কার্যকর করতে পারেনি সরকার। অসমসহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে তীব্র বিরোধিতার কারণে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারে এসেও হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা অথচ ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই ক্যা (নাগরিকত্ব আইন) পাস করান বিজেপি সরকার। পাস করা এই আইনে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া হিন্দু, খ্রিস্টান, পার্সি, জৈন, শিখ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে শর্ত সাপেক্ষে নাগরিকত্ব দেবে ভারত সরকার কিন্তু ক্যা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের দুই বছর পরও আইন প্রয়োগের বিধি তৈরি করতে পারেনি সরকার।

অভিযোগ, আসামের বিধান সভা ভোটে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকার বিষয়টি বুঝতে পেরেই বিজেপি সরকার সেই সময় এই আইনটি কার্যকর করতে চায়নি। এখন আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়েই গুজরাটসহ ৫টি রাজ্যের ১৩টি জেলায় নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর পর থেকেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। ক্যাবিরোধী আন্দোলনের নেতা আসাম জাতীয় পর্ষদের সভাপতি ল্যুরিন জ্যোতি গগৈয়ের মতে, আসাম চুক্তির রক্ষা কবচকে অবজ্ঞা করে ১৯৭১ সালের পরবর্তী মানদ-ে ধর্মের ভিত্তিতে কোন অনুপ্রবেশকারীকে মাপা হবে না।

এ ব্যাপারে আসাম জাতীয় পর্ষদ (এজেপি)-র মুখপাত্র জিয়াউর রহমানের বক্তব্য, কোভিড-১৯-এ দুই বিধায়কসহ আসামে বহু মানুষ মারা গেছে এবং এখনও মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় আসাম সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতাকে ঢাকতেই ক্যা-কে সামনে নিয়ে আসছে বিজেপি সরকার। এ ব্যাপারে নাগরিক অধিকার কমিটির চেয়ারম্যান তপজ্যোতি ভট্টাচার্য্য বলেছেন, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার জন্যই আসলে এ আইন।

তিনি বলেন, কংগ্রেস আগাগোড়া এই বিল বাতিলের দাবি করে আসছে। তাদের মতে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেশের সংবিধানের মূল ধারার পরিপন্থী। বামেরাও এই বিলের বিরোধিতা করে আসছে শুরু থেকেই।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই এই আইনের বিরোধিতা করে এসেছেন, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি এবং সিএএ-ক্যা আমি বেঁচে থাকতে পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়ন করতে দেবো না। অন্য রাজ্যের সঙ্গেও এই নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় আমি সোচ্চার থাকব।

বিধান সভা ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে প্রচার করতে এসে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতারা এবং স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিতসাহ মতুয়া সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করেছিলেন ভোট মিটে গেলে নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা হবে। বিজেপির বনগাঁওয়ের সাংসদ শান্তনু ঠাকুর সরকারের এই আশ্বাসের কথা মতুয়াসহ ভারতে অবস্থানরত অন্য উদ্বাস্তুদের আশ্বস্ত করে আসছিলেন। ভোট মিটে যাওয়ার পর দেখা যায় অন্যান্য ৫টি রাজ্যে নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য সরকারি নোটিফিকেশন জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

এ ব্যাপারে শান্তনু ঠাকুরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি গুজরাটসহ অন্য ৫টি রাজ্যে এই আইন জারি করায় বিস্মিত হন। তিনি বলেন, নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য পশ্চিম বাংলাকেই প্রথমে বাছাই করা উচিত, কেননা দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। শান্তনু ঠাকুর বলেন, আমি এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে কথা বলব। তবে তার ধারণা, এর পরের ধাপে পশ্চিমবঙ্গেও এই আইন বলবৎ করবে কেন্দ্রীয় সরকার।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় বলে আসছেন এই রাজ্যে যারা বসবাস করছে সবাই ভারতের নাগরিক, তাদের সবার ভোটার আইডি কার্ড, আদার কার্ড, রেশন কার্ডসহ নাগরিক প্রমাণের সবকিছুই আছে তার পরেও আলাদা আবার নাগরিকত্বর ধুয়া কেন?

এ প্রসঙ্গে সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের প্রশ্ন, সব কিছুই যখন আছে তা হলে ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারতে যারা শরণার্থী হয়ে এসেছেন তাদের শিক্ষাগত সার্টিফিকেট কোন কাজে আসছে না কেন? তারা এই সার্টিফিকেট দেখিয়ে কোন চাকরি বা অন্যান্য পেশায় ঢুকতে পারছেন না কেন? শুধু নাগরিত্ব না পাওয়ার কারণে সাধারণ ছাড়াও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অ্যাডভোকেট যারা রয়েছেন তারা কেন এখানে এই সনদ দেখিয়ে স্ব-পেশায় কাজ করতে পারছেন না, এই ন্যায্য কথাগুলো এই পর্যন্ত কেউ বলছেন না। যখন বিজেপি সরকার এ ব্যাপার উদ্যোগ নিয়ে অন্তত একটি আইন আইন পাস করেছে এর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ না দিয়ে একটি মহল এই আইনের বিরোধিতা করে আসছে।

এদিকে দেশের পাঁচটি রাজ্যের তেরোটি জেলায় পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসা অমুসলিম আভিবাসীদের নাগরিকত্বসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সাম্প্রতিক জারি করা নোটিফিকেশন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দেশের সংবিধানের ১৪, ১৫ এবং ২১ নং অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হওয়ায় ১৯৫৫ কে চ্যালেঞ্জ করে ভারতীয় মুসলিম লীগ সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করে (মামলা নং ডব্লিউ পিসি ১৪৭০/২০১৯)।

গতবছর ১০ জানুয়ারি প্রথম দেশে জারি হয় এই ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ (সিএএ)। যদিও ২০১৯-র শেষ অর্থাৎ এই বিল পাস হওয়ার আগে থেকেই দেশে ঘনীভূত হয় সিএএবিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনে দিল্লিতে হিংসার বলি হন ৫০-র বেশি মানুষ। আন্দোলনের প্রবল চাপে পড়ে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বাজেট অধিবেশনে এই আইন কার্যকর করার সময়সীমা সরকার বৃদ্ধির অনুমোদন করে সংসদে। এই নির্দেশকে ‘অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি আবেদন পেশ করেছে ভারতীয় মুসলিম লীগ (আইইউএমএল)।

আবেদনে তারা বলেছে, সিএএ, ২০১৯ আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এর আগে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা মামালটি এখনও শীর্ষ আদালতে ঝুলছে অথচ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গত ২৮ মে ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনের ১৬ নং ধারায় নোটিফিকেশন জারি করেছে ভারতের ৫টি রাজ্যের ১৩ জেলায় ভারতে আসা অমুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদান করার জন্য এবং এর কর্তৃত্ব জেলা শাসকদের হাতে অর্পণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ঐ নোটিফিকেশনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে চ্যালেঞ্জ জানায় ভারতীয় মুসলিম লীগ।

আদালতে তাদের বক্তব্য ছিল, এই আইনের বিধি-ই এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি কিন্তু সুপ্রিম কোর্টকে এড়িয়ে সংশোধনী আইনকে চালু করার জন্য এবং এই উদ্দেশ্যে ২৮-মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে। এই নোটিফিকেশন অনুয়ায়ী পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে আসা অমুসলিমরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। নোটিফিকেশন অনুযায়ী গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মোট ১৩ জেলার হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা আবেদন করতে পারবেন কিন্তু মুসলিমদের বঞ্চিত করা হয়েছে। স্বভাবতই ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের বিবেচনার সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হলো ভারতীয় মুসলিম লীগ (আইইউএমএল)।

নোটিফিকেশনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ১৬ নং ধারা ও ২০০৯ সালের আইন সূত্রমতে, ‘অমুসলিম’ সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে অনলাইনে মাধ্যমে। পাশাপাশি জেলার কালেক্টর (জেলা শাসক ) এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রসচিব খতিয়ে দেখবেন এই সব আবেদন।

ভারতীয় মুসলিম লীগের বক্তব্য, সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল (সিএএ) সরাসরি চালু করতে না পারায় অর্থাৎ আইনি জটিলতার কারণে কেন্দ্র ঘুরিয়ে কৌশলে নাগরিত্ব দেয়ার কাজ শুরু করতেই এই নোটিফিকেশন জারি করেছে বিজেপি সরকার।

শনিবার, ০৫ জুন ২০২১ , ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৩ শাওয়াল ১৪৪২

ভারত

বিধি হয়নি, শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেয়ার উদ্যোগ

আদালতে চ্যালেঞ্জ মুসলিম লীগের

দীপক মুখার্জী, কলকাতা

করোনা মহামারীর মধ্যেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর করা শুরু করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তীব্র বিরোধিতার কারণে নাগরিকত্ব আইনের বিধি তৈরি না করেই গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের ১৩টি জেলায় নাগরিকত্ব আইনের ১৯৫৫ এবং ২০০৯ সালের বিধির আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব দেয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে অথচ সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর হবে এর ভিত্তি বর্ষ।

মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তড়িঘড়ি করে সিএএ-বা ক্যা পাস করায় কিন্তু এখনও এই আইন কার্যকর করার জন্য বিধি তৈরি করেনি সরকার। বাংলায় ভোট প্রচারে এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব অমিত শাহ বলেছিলেন, কোভিডের কারণেই এই আইন কার্যকর করা যাচ্ছে না। কোভিড শেষ হলেই এর কাজ শুরু করবে ভারত সরকার। এখন অবশ্য অমিত শাহের নিজের রাজ্যেই শুরু হচ্ছে অমুসলিম উদ্বাস্তুদের মধ্যে নাগরিকত্ব দেয়ার কাজ।

ক্যা পাস করার দু’বছরেও এই আইনটি দেশে এখনও কার্যকর করতে পারেনি সরকার। অসমসহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে তীব্র বিরোধিতার কারণে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারে এসেও হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা অথচ ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই ক্যা (নাগরিকত্ব আইন) পাস করান বিজেপি সরকার। পাস করা এই আইনে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া হিন্দু, খ্রিস্টান, পার্সি, জৈন, শিখ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে শর্ত সাপেক্ষে নাগরিকত্ব দেবে ভারত সরকার কিন্তু ক্যা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের দুই বছর পরও আইন প্রয়োগের বিধি তৈরি করতে পারেনি সরকার।

অভিযোগ, আসামের বিধান সভা ভোটে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকার বিষয়টি বুঝতে পেরেই বিজেপি সরকার সেই সময় এই আইনটি কার্যকর করতে চায়নি। এখন আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়েই গুজরাটসহ ৫টি রাজ্যের ১৩টি জেলায় নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর পর থেকেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। ক্যাবিরোধী আন্দোলনের নেতা আসাম জাতীয় পর্ষদের সভাপতি ল্যুরিন জ্যোতি গগৈয়ের মতে, আসাম চুক্তির রক্ষা কবচকে অবজ্ঞা করে ১৯৭১ সালের পরবর্তী মানদ-ে ধর্মের ভিত্তিতে কোন অনুপ্রবেশকারীকে মাপা হবে না।

এ ব্যাপারে আসাম জাতীয় পর্ষদ (এজেপি)-র মুখপাত্র জিয়াউর রহমানের বক্তব্য, কোভিড-১৯-এ দুই বিধায়কসহ আসামে বহু মানুষ মারা গেছে এবং এখনও মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় আসাম সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতাকে ঢাকতেই ক্যা-কে সামনে নিয়ে আসছে বিজেপি সরকার। এ ব্যাপারে নাগরিক অধিকার কমিটির চেয়ারম্যান তপজ্যোতি ভট্টাচার্য্য বলেছেন, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার জন্যই আসলে এ আইন।

তিনি বলেন, কংগ্রেস আগাগোড়া এই বিল বাতিলের দাবি করে আসছে। তাদের মতে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেশের সংবিধানের মূল ধারার পরিপন্থী। বামেরাও এই বিলের বিরোধিতা করে আসছে শুরু থেকেই।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই এই আইনের বিরোধিতা করে এসেছেন, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি এবং সিএএ-ক্যা আমি বেঁচে থাকতে পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়ন করতে দেবো না। অন্য রাজ্যের সঙ্গেও এই নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় আমি সোচ্চার থাকব।

বিধান সভা ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে প্রচার করতে এসে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতারা এবং স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিতসাহ মতুয়া সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করেছিলেন ভোট মিটে গেলে নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা হবে। বিজেপির বনগাঁওয়ের সাংসদ শান্তনু ঠাকুর সরকারের এই আশ্বাসের কথা মতুয়াসহ ভারতে অবস্থানরত অন্য উদ্বাস্তুদের আশ্বস্ত করে আসছিলেন। ভোট মিটে যাওয়ার পর দেখা যায় অন্যান্য ৫টি রাজ্যে নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য সরকারি নোটিফিকেশন জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

এ ব্যাপারে শান্তনু ঠাকুরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি গুজরাটসহ অন্য ৫টি রাজ্যে এই আইন জারি করায় বিস্মিত হন। তিনি বলেন, নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য পশ্চিম বাংলাকেই প্রথমে বাছাই করা উচিত, কেননা দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। শান্তনু ঠাকুর বলেন, আমি এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে কথা বলব। তবে তার ধারণা, এর পরের ধাপে পশ্চিমবঙ্গেও এই আইন বলবৎ করবে কেন্দ্রীয় সরকার।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় বলে আসছেন এই রাজ্যে যারা বসবাস করছে সবাই ভারতের নাগরিক, তাদের সবার ভোটার আইডি কার্ড, আদার কার্ড, রেশন কার্ডসহ নাগরিক প্রমাণের সবকিছুই আছে তার পরেও আলাদা আবার নাগরিকত্বর ধুয়া কেন?

এ প্রসঙ্গে সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের প্রশ্ন, সব কিছুই যখন আছে তা হলে ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারতে যারা শরণার্থী হয়ে এসেছেন তাদের শিক্ষাগত সার্টিফিকেট কোন কাজে আসছে না কেন? তারা এই সার্টিফিকেট দেখিয়ে কোন চাকরি বা অন্যান্য পেশায় ঢুকতে পারছেন না কেন? শুধু নাগরিত্ব না পাওয়ার কারণে সাধারণ ছাড়াও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অ্যাডভোকেট যারা রয়েছেন তারা কেন এখানে এই সনদ দেখিয়ে স্ব-পেশায় কাজ করতে পারছেন না, এই ন্যায্য কথাগুলো এই পর্যন্ত কেউ বলছেন না। যখন বিজেপি সরকার এ ব্যাপার উদ্যোগ নিয়ে অন্তত একটি আইন আইন পাস করেছে এর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ না দিয়ে একটি মহল এই আইনের বিরোধিতা করে আসছে।

এদিকে দেশের পাঁচটি রাজ্যের তেরোটি জেলায় পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসা অমুসলিম আভিবাসীদের নাগরিকত্বসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সাম্প্রতিক জারি করা নোটিফিকেশন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দেশের সংবিধানের ১৪, ১৫ এবং ২১ নং অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হওয়ায় ১৯৫৫ কে চ্যালেঞ্জ করে ভারতীয় মুসলিম লীগ সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করে (মামলা নং ডব্লিউ পিসি ১৪৭০/২০১৯)।

গতবছর ১০ জানুয়ারি প্রথম দেশে জারি হয় এই ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ (সিএএ)। যদিও ২০১৯-র শেষ অর্থাৎ এই বিল পাস হওয়ার আগে থেকেই দেশে ঘনীভূত হয় সিএএবিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনে দিল্লিতে হিংসার বলি হন ৫০-র বেশি মানুষ। আন্দোলনের প্রবল চাপে পড়ে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বাজেট অধিবেশনে এই আইন কার্যকর করার সময়সীমা সরকার বৃদ্ধির অনুমোদন করে সংসদে। এই নির্দেশকে ‘অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি আবেদন পেশ করেছে ভারতীয় মুসলিম লীগ (আইইউএমএল)।

আবেদনে তারা বলেছে, সিএএ, ২০১৯ আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এর আগে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা মামালটি এখনও শীর্ষ আদালতে ঝুলছে অথচ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গত ২৮ মে ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনের ১৬ নং ধারায় নোটিফিকেশন জারি করেছে ভারতের ৫টি রাজ্যের ১৩ জেলায় ভারতে আসা অমুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদান করার জন্য এবং এর কর্তৃত্ব জেলা শাসকদের হাতে অর্পণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ঐ নোটিফিকেশনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে চ্যালেঞ্জ জানায় ভারতীয় মুসলিম লীগ।

আদালতে তাদের বক্তব্য ছিল, এই আইনের বিধি-ই এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি কিন্তু সুপ্রিম কোর্টকে এড়িয়ে সংশোধনী আইনকে চালু করার জন্য এবং এই উদ্দেশ্যে ২৮-মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে। এই নোটিফিকেশন অনুয়ায়ী পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে আসা অমুসলিমরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। নোটিফিকেশন অনুযায়ী গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মোট ১৩ জেলার হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা আবেদন করতে পারবেন কিন্তু মুসলিমদের বঞ্চিত করা হয়েছে। স্বভাবতই ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের বিবেচনার সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হলো ভারতীয় মুসলিম লীগ (আইইউএমএল)।

নোটিফিকেশনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ১৬ নং ধারা ও ২০০৯ সালের আইন সূত্রমতে, ‘অমুসলিম’ সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে অনলাইনে মাধ্যমে। পাশাপাশি জেলার কালেক্টর (জেলা শাসক ) এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রসচিব খতিয়ে দেখবেন এই সব আবেদন।

ভারতীয় মুসলিম লীগের বক্তব্য, সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল (সিএএ) সরাসরি চালু করতে না পারায় অর্থাৎ আইনি জটিলতার কারণে কেন্দ্র ঘুরিয়ে কৌশলে নাগরিত্ব দেয়ার কাজ শুরু করতেই এই নোটিফিকেশন জারি করেছে বিজেপি সরকার।