তিস্তার ডান তীরের মঙ্গা

ছোলজার রহমান

চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিস্তার বাম তীরে অবস্থিত লালমনিরহাট, নীলফামারি, এক বিস্তীর্ণ এলাকা বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস এবং ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাজ ও চরম খাদ্যাভাবে নিপতিত থাকত। জংলী কচু সেদ্ধ, ছোট ছোট কলার গাছ সেদ্ধ, গমের ভাত, ভাতের ফেন, কারণের ভাত, স্যাকালু বা মিষ্টি আলু সেদ্ধ, কাঁচা কাঁঠাল সিদ্ধ ইত্যাদি সামান্য সংগ্রহের মাধ্যমে খাবারের ব্যবস্থা হতো। সে সময়ে এসব এলাকায় এই সময় দুটিকে মঙ্গার কাল বলা হতো। একটি ছোট মঙ্গা ও পরেরটি বড় মঙ্গা। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে কিংবা ছেলেমেয়েদের মামীর হাতের ভাত খাওয়ার নামে পাঠিয়ে দিয়ে সাময়িক ২-৪ দিনের খাদ্যের অভাব মেটানোর একটি রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। মঙ্গাকালে খাদ্য দিতে না পারায় নিজের সন্তানকে অন্যের কাছে স্থায়ীভাবে দিয়ে দেয়াও হতো, উপার্জনে ভূমিকা না থাকায় গরিব পরিবারসমূহে মেয়ে সন্তানকে আপদ হিসেবে ধরা হতো। পূর্বাংশে লালমনিরহাট জেলার সম্পূর্ণ অংশ ও কুড়িগ্রাম জেলা, রংপুরের চতুর্দিকের গ্রামীণ এলাকা, গাইবান্ধা, উত্তরের পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁ জেলা, ডোমার ও কিশোরগঞ্জ উপজেলা, দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলায়ও কমবেশি এরূপ পরিস্থিতি বিরাজ করত।

মঙ্গা অবস্থার কারণ হিসেবে বলা যায়-উত্তরের অবহেলিত এসব এলাকা শিল্পে অনগ্রসর ও কৃষিনির্ভর ছিল। তাই কৃষির মৌসুমের কৃষিকাজ ব্যতীত অন্য কোন কাজ অন্য সময়গুলোতে থাকত না এবং শ্রমজীবী লোকেরা কাজের অভাবে বসে থাকত। ইরি-বোরো ধানের চাষের প্রচলন না থাকায় অগ্রহায়ণ-পৌষে প্রাপ্ত আমন ধান বৈশাখের শুরুতে শেষ হয়ে যেত। এরপর প্রাকৃতিক পানিসেচ নির্ভর আউশ ধানের ফলন অনেকাংশে যথাসময়ের বৃষ্টিনির্ভর হওয়ায় অনেকটা ভাগ্য প্রসূত ছিল এবং বৃষ্টিহীন খরার বছরে তা মোটেও পাওয়া যেত না। তাই অনিশ্চিত এ ফসল দ্বারা কোন রকমে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস পর্যন্ত খাদ্যের সংকুলান হতো। ব্যাপক তামাক চাষের এলাকা হলেও অধিক শ্রমনির্ভর ও কম ফলনের হওয়ায় তা দিয়ে বেশি দিনের জন্য খাদ্য সংকুলান করতে পারত না। এসব স্থানে ফাল্গুন-চৈত্র-আষাঢ় মাসজুড়ে সোনালী আঁশের ব্যাপক চাষ হলেও রপ্তানি নির্ভরতা, দামের অনিশ্চয়তা ও কমদামে বিক্রির কারণে হয়তবা ১ মাসের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারত। বাদাম, ভুট্টা, কাউন ও মিষ্টি আলুর দাম খুবই কম থাকায় খুব একটা চাষ হতো না।

পান-সুপারি খাওয়ার এলাকা হলেও সুপারি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হতো এবং পানের বিশাল অংশই রাজশাহী থেকে আনতে হতো। এ অঞ্চলের নদীতে ইলিশ না থাকায় বৎসরে ২/১ দিনের ইলিশ খাওয়ার শখ মেটাতে ৩ থেকে ৪ মণ পাট বা ১ বিঘা জমির উৎপাদন চলে যেত। পারিবারিক ন্যূনতম চাহিদা হিসেবে কেরোসিন তেল, চা পাতা, লবণ, চিনি, দিয়াশলাই ও কাপড় কিনতেই হতো এবং এগুলোর দাম মেটাতে উৎপাদিত ফসল ধান, পাট ও তামাকের একটি বড় অংশই চলে যেত। তাই মানুষের উদ্বৃত্ত বা সঞ্চয় থাকত না। বেশি সুদে যে ক’জন দাদন ব্যবসায়ী অভাব ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে চাষিদের শোষণ করত, তার সিংহভাগ পুঁজিই ছিল কোন না কোন শহরের ধনী ব্যক্তির অর্থ। আপাত বিপদ ও অভাব মেটানোর মাধ্যমে তারা দীর্ঘকাল ধরে এসব এলাকা থেকে অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছেন। ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখ মাসের খরা পরিস্থিতি থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য তিস্তা সেচ প্রকল্পের ফলে অল্প পয়সায় সেচ সুবিধা পাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমের ধানের ফলন বৃদ্ধি পায় ও লাভজনক হয় এবং মঙ্গা দূরীভূত হতে থাকে। কিন্তু তিস্তা ব্যারেজ থেকে ডানতীর বরাবর চার কিলোমিটার থেকে সাত কিলোমিটার প্রশস্ত ও ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এক বিস্তীর্ণ এলাকায় নতুনভাবে মঙ্গা দীর্ঘস্থায়ী ও চরম আকার ধারণ করতে থাকে। এ এলাকাটি নদীর পাশেই হওয়ায় এখানে ব্যারেজের কোন সেচ ক্যানেল হয়নি এবং কখনও হবে না।

আশির দশক পর্যন্ত তিস্তা নদী ডালিয়া থেকে দক্ষিণ পূর্ব মুখী প্রবাহে বাইশপুকুর ছাতুনামার পাশ দিয়ে গড্ডিমারীর পশ্চিমাংশ, সিন্দুর্ণার মধ্যাংশ, হলদিবাড়ি ও উত্তর ডাউয়াবাড়ির পূর্বাংশ দিয়ে প্রবাহিত হতো। সে সময়ে এই অংশে নদীটি প্রায় দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত এবং একটিমাত্র খাত বিশিষ্ট ছিল। উভয়তীরে প্রতি বৎসর সামান্যই নদীভাঙন হতো, বর্ষাকালের পানি বৃদ্ধি পেয়ে উভয় তীর প্লাবিত হতো এবং ডানতীরে ব্যাপক ফসল ফলত। স্থায়ী গ্রামগুলো কৃষি উৎপাদনে সমৃদ্ধ ছিল এবং এখানকার উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য কেনাবেচার জন্য পূর্বদিকের গড্ডিমারিহাট, বড়খাতা হাট, হাতিবান্ধা হাট, পারুলিয়া হাট, ভোটমারি হাট, ভুল্লার হাট, কালীগঞ্জ হাট, আমিনগঞ্জের হাট এবং পশ্চিমদিকের চাপানি হাট, ভাবনচুর হাট, নেকবক্ত হাট, আনসারের হাট, শৌলমারি হাট, কৈমারি হাট, বড়াইবাড়ি ও জলঢাকা হাট বেশ সরগরম থাকত। এ অংশটিতে প্রায় ৫০ হাজার লোকের বাস। নিজেদের পৈতৃক জমি ও বাপ-দাদার স্থায়ী ভিটেমাটি তাদের শত শত বৎসরের ঠিকানা ছিল। যাতায়াত-যোগাযোগ, কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকলেও এ অংশে বেশ দূরত্বে ৪টি হাইস্কুল ও ১৭টি প্রাইমারি স্কুল ছিল এবং এ অংশের পাশেই ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে আরও ১১টি হাইস্কুল থাকায় পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখা চালানো যেত। আউশ ধানের উৎপাদন অনিশ্চিত হলেও আমন মৌসুমের অতিরিক্ত ফলন অনেকটাই মঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখত।

আশির দশকের শেষদিকে ডালিয়ার ৩ কিলোমিটার পূর্বদিকে তিস্তার বামতীরে লালমনিরহাট জেলার দোয়ানী গ্রামে তিস্তা ব্যারেজটি মজবুতভাবে নির্মিত হয়। যেখানে ব্যারেজ নির্মিত হলো সেখানে নদী ছিল না। ডালিয়ার ১ কিলোমিটার উত্তর থেকে যন্ত্র দিয়ে দ্রুত প্রশস্ত খাল কেটে ব্যারেজের সামনে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় এবং ব্যারেজের নিচে দিয়ে দক্ষিণ দিকে ছাতুনামার কাছে পুনরায় তিস্তা নদীর সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়। খননকৃত এই মাটি ডালিয়া প্রান্তের নদীতে দ্রুত ফেলে বেঁধে ফেলা হয়। ফলে নদীর পানি এই কাটা খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্যারেজের নিচে দিয়ে ভাটিতে তিস্তার খাত দিয়েই প্রবাহিত হতে লাগল। এতে তিস্তা নদী আড়াই কিলোমিটারের বেশি পুবের দিকে সরে গেল এবং পুরোপুরি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। দোয়ানী অংশে গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ভাটিতেও নদী খাত ও প্রবাহে প্রতিবৎসর বড় ধরনের পরিবর্তন হতে লাগল। প্রতি বৎসর ডানতীরের গ্রাম ও ফসলি জমিসমূহ ভাঙতে ভাঙতে নদীপ্রবাহ তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার ডানদিকে সরে গেল। মূল নদী খাত সম্পূর্ণরূপে ভরাট হওয়ার ফলে তার তলদেশ ডানতীরের গ্রাম ও ফসলি জমির লেভেলে পরিণত হলো। মূল নদী খাত গভীর না হওয়ায় বর্ষাকালে নদীটি সব গ্রাম ও ফসলি জমির ওপর দিয়ে ৩-৪ ফুট উচ্চতার পানি প্রবাহিত হয় এবং নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রবাহহীন থাকে। শুষ্ক সময়কালে ১০০ গজ প্রশস্ততার একটি স্থান দিয়ে ১ থেকে ২ ফুট গভীরতার পানির সামান্যই প্রবাহ থাকে, যা বর্ষাকালে ছয় থেকে ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদী খাতের বাইরে সমতল ভূমির ওপর অনেকটা এলাকা দিয়ে অল্প গভীরতার পানির আকস্মিক ও সাময়িক প্রবাহকে পানিবিজ্ঞানে ফ্লাশ ফ্লাড, ভূপৃষ্ঠ প্রবাহ ও শিট ফ্লো বলা হয় যাতে আকস্মিকভাবে পার্বত্য অঞ্চল থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত পানিপ্রবাহ দ্রুত প্রবাহ হয়ে নেমে যায় এবং সে সঙ্গে কিছু পরিমাণ বালি এসে জমিসমূহের ওপর সঞ্চিত হয়। এতে জমিসমূহ চাষাবাদের অনুপযোগী ও অনুর্বর হয়ে পড়ে।

নতুন খাতে তিস্তাকে প্রবাহিত করার মাধ্যমে নদী তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে, কেড়ে নেয়া হয়েছে তার প্রবাহের খাত, বদলে দেয়া হয়েছে তার চরিত্র। ফলে নদী তার গতিপথের সুনির্দিষ্টতা বজায় রাখতে পারছে না। নদী খাত সম্পূর্ণরূপে ভরাট হয়ে যাওয়ায় সমতল ফসলি জমি ও গ্রামই এখন তার গতিপথ, পরিণামে অনেক পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, ফসলি জমি হয়েছে বালুকাময় ভূমি, অনিশ্চিত হয়েছে কৃষি উৎপাদন, বেড়েই চলেছে মঙ্গা।

[লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ, সরকারি এমএম কলেজ]

শনিবার, ০৫ জুন ২০২১ , ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৩ শাওয়াল ১৪৪২

তিস্তার ডান তীরের মঙ্গা

ছোলজার রহমান

চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিস্তার বাম তীরে অবস্থিত লালমনিরহাট, নীলফামারি, এক বিস্তীর্ণ এলাকা বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস এবং ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাজ ও চরম খাদ্যাভাবে নিপতিত থাকত। জংলী কচু সেদ্ধ, ছোট ছোট কলার গাছ সেদ্ধ, গমের ভাত, ভাতের ফেন, কারণের ভাত, স্যাকালু বা মিষ্টি আলু সেদ্ধ, কাঁচা কাঁঠাল সিদ্ধ ইত্যাদি সামান্য সংগ্রহের মাধ্যমে খাবারের ব্যবস্থা হতো। সে সময়ে এসব এলাকায় এই সময় দুটিকে মঙ্গার কাল বলা হতো। একটি ছোট মঙ্গা ও পরেরটি বড় মঙ্গা। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে কিংবা ছেলেমেয়েদের মামীর হাতের ভাত খাওয়ার নামে পাঠিয়ে দিয়ে সাময়িক ২-৪ দিনের খাদ্যের অভাব মেটানোর একটি রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। মঙ্গাকালে খাদ্য দিতে না পারায় নিজের সন্তানকে অন্যের কাছে স্থায়ীভাবে দিয়ে দেয়াও হতো, উপার্জনে ভূমিকা না থাকায় গরিব পরিবারসমূহে মেয়ে সন্তানকে আপদ হিসেবে ধরা হতো। পূর্বাংশে লালমনিরহাট জেলার সম্পূর্ণ অংশ ও কুড়িগ্রাম জেলা, রংপুরের চতুর্দিকের গ্রামীণ এলাকা, গাইবান্ধা, উত্তরের পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁ জেলা, ডোমার ও কিশোরগঞ্জ উপজেলা, দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলায়ও কমবেশি এরূপ পরিস্থিতি বিরাজ করত।

মঙ্গা অবস্থার কারণ হিসেবে বলা যায়-উত্তরের অবহেলিত এসব এলাকা শিল্পে অনগ্রসর ও কৃষিনির্ভর ছিল। তাই কৃষির মৌসুমের কৃষিকাজ ব্যতীত অন্য কোন কাজ অন্য সময়গুলোতে থাকত না এবং শ্রমজীবী লোকেরা কাজের অভাবে বসে থাকত। ইরি-বোরো ধানের চাষের প্রচলন না থাকায় অগ্রহায়ণ-পৌষে প্রাপ্ত আমন ধান বৈশাখের শুরুতে শেষ হয়ে যেত। এরপর প্রাকৃতিক পানিসেচ নির্ভর আউশ ধানের ফলন অনেকাংশে যথাসময়ের বৃষ্টিনির্ভর হওয়ায় অনেকটা ভাগ্য প্রসূত ছিল এবং বৃষ্টিহীন খরার বছরে তা মোটেও পাওয়া যেত না। তাই অনিশ্চিত এ ফসল দ্বারা কোন রকমে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস পর্যন্ত খাদ্যের সংকুলান হতো। ব্যাপক তামাক চাষের এলাকা হলেও অধিক শ্রমনির্ভর ও কম ফলনের হওয়ায় তা দিয়ে বেশি দিনের জন্য খাদ্য সংকুলান করতে পারত না। এসব স্থানে ফাল্গুন-চৈত্র-আষাঢ় মাসজুড়ে সোনালী আঁশের ব্যাপক চাষ হলেও রপ্তানি নির্ভরতা, দামের অনিশ্চয়তা ও কমদামে বিক্রির কারণে হয়তবা ১ মাসের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারত। বাদাম, ভুট্টা, কাউন ও মিষ্টি আলুর দাম খুবই কম থাকায় খুব একটা চাষ হতো না।

পান-সুপারি খাওয়ার এলাকা হলেও সুপারি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হতো এবং পানের বিশাল অংশই রাজশাহী থেকে আনতে হতো। এ অঞ্চলের নদীতে ইলিশ না থাকায় বৎসরে ২/১ দিনের ইলিশ খাওয়ার শখ মেটাতে ৩ থেকে ৪ মণ পাট বা ১ বিঘা জমির উৎপাদন চলে যেত। পারিবারিক ন্যূনতম চাহিদা হিসেবে কেরোসিন তেল, চা পাতা, লবণ, চিনি, দিয়াশলাই ও কাপড় কিনতেই হতো এবং এগুলোর দাম মেটাতে উৎপাদিত ফসল ধান, পাট ও তামাকের একটি বড় অংশই চলে যেত। তাই মানুষের উদ্বৃত্ত বা সঞ্চয় থাকত না। বেশি সুদে যে ক’জন দাদন ব্যবসায়ী অভাব ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে চাষিদের শোষণ করত, তার সিংহভাগ পুঁজিই ছিল কোন না কোন শহরের ধনী ব্যক্তির অর্থ। আপাত বিপদ ও অভাব মেটানোর মাধ্যমে তারা দীর্ঘকাল ধরে এসব এলাকা থেকে অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছেন। ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখ মাসের খরা পরিস্থিতি থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য তিস্তা সেচ প্রকল্পের ফলে অল্প পয়সায় সেচ সুবিধা পাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমের ধানের ফলন বৃদ্ধি পায় ও লাভজনক হয় এবং মঙ্গা দূরীভূত হতে থাকে। কিন্তু তিস্তা ব্যারেজ থেকে ডানতীর বরাবর চার কিলোমিটার থেকে সাত কিলোমিটার প্রশস্ত ও ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এক বিস্তীর্ণ এলাকায় নতুনভাবে মঙ্গা দীর্ঘস্থায়ী ও চরম আকার ধারণ করতে থাকে। এ এলাকাটি নদীর পাশেই হওয়ায় এখানে ব্যারেজের কোন সেচ ক্যানেল হয়নি এবং কখনও হবে না।

আশির দশক পর্যন্ত তিস্তা নদী ডালিয়া থেকে দক্ষিণ পূর্ব মুখী প্রবাহে বাইশপুকুর ছাতুনামার পাশ দিয়ে গড্ডিমারীর পশ্চিমাংশ, সিন্দুর্ণার মধ্যাংশ, হলদিবাড়ি ও উত্তর ডাউয়াবাড়ির পূর্বাংশ দিয়ে প্রবাহিত হতো। সে সময়ে এই অংশে নদীটি প্রায় দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত এবং একটিমাত্র খাত বিশিষ্ট ছিল। উভয়তীরে প্রতি বৎসর সামান্যই নদীভাঙন হতো, বর্ষাকালের পানি বৃদ্ধি পেয়ে উভয় তীর প্লাবিত হতো এবং ডানতীরে ব্যাপক ফসল ফলত। স্থায়ী গ্রামগুলো কৃষি উৎপাদনে সমৃদ্ধ ছিল এবং এখানকার উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য কেনাবেচার জন্য পূর্বদিকের গড্ডিমারিহাট, বড়খাতা হাট, হাতিবান্ধা হাট, পারুলিয়া হাট, ভোটমারি হাট, ভুল্লার হাট, কালীগঞ্জ হাট, আমিনগঞ্জের হাট এবং পশ্চিমদিকের চাপানি হাট, ভাবনচুর হাট, নেকবক্ত হাট, আনসারের হাট, শৌলমারি হাট, কৈমারি হাট, বড়াইবাড়ি ও জলঢাকা হাট বেশ সরগরম থাকত। এ অংশটিতে প্রায় ৫০ হাজার লোকের বাস। নিজেদের পৈতৃক জমি ও বাপ-দাদার স্থায়ী ভিটেমাটি তাদের শত শত বৎসরের ঠিকানা ছিল। যাতায়াত-যোগাযোগ, কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকলেও এ অংশে বেশ দূরত্বে ৪টি হাইস্কুল ও ১৭টি প্রাইমারি স্কুল ছিল এবং এ অংশের পাশেই ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে আরও ১১টি হাইস্কুল থাকায় পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখা চালানো যেত। আউশ ধানের উৎপাদন অনিশ্চিত হলেও আমন মৌসুমের অতিরিক্ত ফলন অনেকটাই মঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখত।

আশির দশকের শেষদিকে ডালিয়ার ৩ কিলোমিটার পূর্বদিকে তিস্তার বামতীরে লালমনিরহাট জেলার দোয়ানী গ্রামে তিস্তা ব্যারেজটি মজবুতভাবে নির্মিত হয়। যেখানে ব্যারেজ নির্মিত হলো সেখানে নদী ছিল না। ডালিয়ার ১ কিলোমিটার উত্তর থেকে যন্ত্র দিয়ে দ্রুত প্রশস্ত খাল কেটে ব্যারেজের সামনে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় এবং ব্যারেজের নিচে দিয়ে দক্ষিণ দিকে ছাতুনামার কাছে পুনরায় তিস্তা নদীর সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়। খননকৃত এই মাটি ডালিয়া প্রান্তের নদীতে দ্রুত ফেলে বেঁধে ফেলা হয়। ফলে নদীর পানি এই কাটা খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্যারেজের নিচে দিয়ে ভাটিতে তিস্তার খাত দিয়েই প্রবাহিত হতে লাগল। এতে তিস্তা নদী আড়াই কিলোমিটারের বেশি পুবের দিকে সরে গেল এবং পুরোপুরি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। দোয়ানী অংশে গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ভাটিতেও নদী খাত ও প্রবাহে প্রতিবৎসর বড় ধরনের পরিবর্তন হতে লাগল। প্রতি বৎসর ডানতীরের গ্রাম ও ফসলি জমিসমূহ ভাঙতে ভাঙতে নদীপ্রবাহ তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার ডানদিকে সরে গেল। মূল নদী খাত সম্পূর্ণরূপে ভরাট হওয়ার ফলে তার তলদেশ ডানতীরের গ্রাম ও ফসলি জমির লেভেলে পরিণত হলো। মূল নদী খাত গভীর না হওয়ায় বর্ষাকালে নদীটি সব গ্রাম ও ফসলি জমির ওপর দিয়ে ৩-৪ ফুট উচ্চতার পানি প্রবাহিত হয় এবং নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রবাহহীন থাকে। শুষ্ক সময়কালে ১০০ গজ প্রশস্ততার একটি স্থান দিয়ে ১ থেকে ২ ফুট গভীরতার পানির সামান্যই প্রবাহ থাকে, যা বর্ষাকালে ছয় থেকে ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদী খাতের বাইরে সমতল ভূমির ওপর অনেকটা এলাকা দিয়ে অল্প গভীরতার পানির আকস্মিক ও সাময়িক প্রবাহকে পানিবিজ্ঞানে ফ্লাশ ফ্লাড, ভূপৃষ্ঠ প্রবাহ ও শিট ফ্লো বলা হয় যাতে আকস্মিকভাবে পার্বত্য অঞ্চল থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত পানিপ্রবাহ দ্রুত প্রবাহ হয়ে নেমে যায় এবং সে সঙ্গে কিছু পরিমাণ বালি এসে জমিসমূহের ওপর সঞ্চিত হয়। এতে জমিসমূহ চাষাবাদের অনুপযোগী ও অনুর্বর হয়ে পড়ে।

নতুন খাতে তিস্তাকে প্রবাহিত করার মাধ্যমে নদী তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে, কেড়ে নেয়া হয়েছে তার প্রবাহের খাত, বদলে দেয়া হয়েছে তার চরিত্র। ফলে নদী তার গতিপথের সুনির্দিষ্টতা বজায় রাখতে পারছে না। নদী খাত সম্পূর্ণরূপে ভরাট হয়ে যাওয়ায় সমতল ফসলি জমি ও গ্রামই এখন তার গতিপথ, পরিণামে অনেক পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, ফসলি জমি হয়েছে বালুকাময় ভূমি, অনিশ্চিত হয়েছে কৃষি উৎপাদন, বেড়েই চলেছে মঙ্গা।

[লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ, সরকারি এমএম কলেজ]