ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে নিষেধাজ্ঞার কথা লেখা থাকলেও সম্প্রতি নতুন ছাপানো ই-পাসপোর্টে ‘ইসরায়েল ছাড়া সব দেশ’ এই কথাটি বাদ দেয়া হয়েছে। নতুন পাসপোর্ট ব্যাপকভাবে এখনও ইস্যু না হওয়ায় বিষয়টি অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে। হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্প্রতি লড়াই না বাদলে সম্ভবত কেউ বিষয়টি নিয়ে মাথাও ঘামাত না। এই বাদ দেয়ার খবরটি জনগণ জানতে পারে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারও একটা টুইট-বার্তা থেকে। ইসরায়েল বাংলাদেশের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশি পাসপোর্টে ইসরায়েল ভ্রমণে আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই; বাংলাদেশ ইসরায়েলকে স্বীকারও করে না। অপরদিকে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে মাহমুদ আব্বাস নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন সরকারকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ঢাকায় তাদের দূতাবাসও রয়েছে। এছাড়াও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পাসপোর্টের গুরুত্বও কম। অনেক দেশের পাসপোর্টে বিনা ভিসায় শতাধিক দেশ ভ্রমণ করা যায়। আমাদের পাসপোর্টে ভিসা থাকার পরও বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশনে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পৃথিবীর অনেক দেশের ইমিগ্রেশনে ইহুদিরা চাকরি করেন, তারা যখন দেখে আমাদের পাসপোর্টে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু লেখা আছে তখন ওই ইমিগ্রেশন-অফিসার বাংলাদেশি যাত্রীর প্রতি সদয় থাকে না। এছাড়াও যে দেশকে বাংলাদেশ স্বীকারই করে না সেই দেশের কথা পাসপোর্টে লিখে রাখা অর্থহীন ও বোকামি।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জগতে একটা নতুন চিন্তা-ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের বৈরী অবস্থানের অবসায়ন চায়। মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর কয়েকটির ক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন এলেও পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনও অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রই দেখে থাকে। কিন্তু এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে যখন ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা অনুমোদন করবে। কারণ তেয়াত্তর বছর ধরে ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করেও কোন লাভ হয়নি; যতবারই ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিন ও মুসলিম দেশগুলো লড়তে গেছে ততবারই ভূমি হারিয়েছে। এই অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার দূতিয়ালি করে কিছু দেশকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছে যে, এভাবে ইসরায়েলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কখনও সম্ভব হবে না, বরং ইসরায়েলকে মেনে নিয়েই মুসলিম দেশগুলোকে এগুতে হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, সুদান ও বাহরাইন সম্প্রতি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলিম দেশ তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৯৪৮ সনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বছর পরই তুরস্ক ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ইসরায়েলে রপ্তানিকারক শীর্ষ ১০ দেশের একটি তুরস্ক; অথচ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এখন বেশি সোচ্চার তুরস্ক, বিষয়টি মনে হয় রাজনৈতিক। আরব বিশ্বে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং নিজ দেশে ইসলামপন্থিদের দলে টেনে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্যে এরদোগান সাম্প্রতিক সময়ে ঘোর ইসরায়েল বিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। জর্ডান ও মিশরের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক বহু বছর আগে থেকেই। ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে ইসরায়েলকে কাবু করতে ব্যর্থ হয়ে মিসর ক্যাম্পডেভিট চুক্তি করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৭৯ সনে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। জর্ডান এই সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৯৪ সনে। আরব লীগের সদস্য মৌরিতানিয়া ১৯৯৯ সনে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও ২০১০ সনে আবার সম্পর্কোচ্ছেদ করে। সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের একটি গোপন আঁতাত গড়ে উঠার কথা সবাই বিশ্বাস করে। ভেতরে ভেতরে যত যোগাযোগই থাকুক না কেন, ইসরায়েলকে এক্ষুণি স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার মোড়লগিরির পদ হারাতে চাইবে না সৌদি আরব।

সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ হামাদ ৯২ মিলিয়ন ডলার বা ৭৮০ কোটি টাকা দিয়ে ‘বেইতার জেরুজালেম’ নামের একটি ইসরায়েলি ফুটবল ক্লাবের অর্ধেক শেয়ার কিনে নিয়েছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামেন নেতানিয়াহু এই ক্লাবটির সমর্থক, আর এই ক্লাবের উগ্র সমর্থকগোষ্ঠী আরবদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। মুসলমান বিদ্বেষী এমন একটি ফুটবল ক্লাব ক্রয় করার পরও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনগণের কোন উচ্চবাচ্য নেই। ভারত দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের বিপক্ষে ছিল এবং এই কারণেই ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না, সম্প্রতি মোদি সরকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে ভারতের সঙ্গে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর সম্পর্কের সামান্যতম অবনতিও হয়নি। অবশ্য স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইলে বরং মুসলিম দেশগুলো একঘরে হয়ে যাবে। কারণ জাতিসংঘের ১৯৩ দেশের মধ্যে ১৬৪টি দেশ ইতোমধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ইসরায়েল প্যালেস্টাইন অঞ্চলে যা হচ্ছে তেমন ঘটনা পৃথিবীর আরো নানা প্রান্তেও হচ্ছে। ফিলিস্তিনের জনগণের উপর ইসরায়েলের নির্যাতনের জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা না গেলে একই যুক্তিতে বাংলাদেশর উচিত কাশ্মীরের জনগণের দুর্দশার কথা ভেবে ভারতের সঙ্গে, বেলুচিস্তানের জনগণের কথা ভেবে পাকিস্তানের সঙ্গে, কুর্দি জনগণের প্রতি দয়ার্দ হয়ে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্কের সঙ্গে, রোহিঙ্গাদের সমর্থনে মিয়ানমারের সঙ্গে, উইঘুর জনগোষ্ঠীর পাশে থেকে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। এমন নির্যাতন পৃথিবীর নানা প্রান্তে আরও হচ্ছে, এখানে শুধু মুসলমান জাতিগুলো থেকেই কয়েকটি উদাহরণ নিলাম। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানকারী তুরস্ক, মিসরসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ যদি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতি দিতে পারে তাহলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বাংলাদেশের পক্ষেও তা করা সম্ভব। ইসরায়েল বাংলাদেশের শত্রু নয়, ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চাওয়া দেশটি হল ইসরায়েল এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনের ৪ এপ্রিল ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলেও বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সৌদি আরব, লিবিয়া প্রভৃতি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, বাংলাদেশকে নয়। যে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন পাবার জন্য বঙ্গবন্ধু ইসরায়েলের সমর্থন নেননি তারা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। হজ্বে বাধা দেয়ার মতো ধর্ম বিরোধী কাজটি থেকে বিরত রাখতে বঙ্গবন্ধুকে সৌদি বাদশাহের কাছে ছুটে যেতে হয়েছে, কিন্তু সৌদি আরব বাংলাদেশিদের হজ্জ করার সুযোগও দেয়নি। যে ফিলিস্তিনের জন্য মুসলমানেরা একাট্টা সেই ফিলিস্তিনই ইসরায়েলের সঙ্গে ইতোমধ্যে সমঝোতা করে ফেলেছে, তাহলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? পারবে না, কারণ বাংলাদেশি মুসলমানেরা ‘মিসকিন’ হয়েও মুসলিম উম্মার সঙ্গে রাজনৈতিক আবেগে একাত্ম হওয়ার তীব্র বাসনা পোষণ করে থাকে।

পাকিস্তানের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা মাওলানা মুহাম্মদ খান শেরানি স্পষ্ট করে বলেছেন, কোরআন এবং ইতিহাস অনুযায়ী ইসরায়েলিরা এখন যে জায়গা দখল করে আছে তা ইহুদিদের জায়গা, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া পাকিস্তানের উচিত হবে। কোন প্রেক্ষিতে তিনি কোরআনের কথা বলেছেন তার ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু জায়গাটি তো ফিলিস্তিনিদেরও। তাই ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। শক্তির জোরে ইসরায়েল যদি গোয়ার্তুমি করতেই থাকে, ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতন চালাতেই থাকে, তাহলে ইহুদিদের ঘৃণা করার ধর্মীয় অনুভূতি থামবে না। ইসরায়েলের এমন খারাপ আচরণের জন্যই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে এখনো একজন আরেকজনকে ‘তুই ইহুদি’ বলে গালি দিয়ে থাকে।

ইসরায়েলের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া বাংলাদেশে লাগেনি। উনপঞ্চাশ বছর আগে স্বাধীনতা লাভের সময় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সম্পর্কে বাংলাদেশের যে অবস্থান ছিল এখনও তাই রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের কূটনৈতিক চাপ না থাকলে বাংলাদেশের এই অবস্থানে শীঘ্রই কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশের জনগণকে সরকারের পক্ষে শান্ত রাখার জন্য ধর্মীয় আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া হয় ব্যাপকভাবে। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মের এত প্রভাব ছিল না। সরকার বুঝতে পেরেছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্য ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুললেও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণ একাট্টা। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব জোরালো থাকার কারণে ইসরায়েল ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল এবং বামপন্থিদের অবস্থান একই বিন্দুতে এসে মিলেছে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক] ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ০৬ জুন ২০২১ , ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৪ শাওয়াল ১৪৪২

ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে নিষেধাজ্ঞার কথা লেখা থাকলেও সম্প্রতি নতুন ছাপানো ই-পাসপোর্টে ‘ইসরায়েল ছাড়া সব দেশ’ এই কথাটি বাদ দেয়া হয়েছে। নতুন পাসপোর্ট ব্যাপকভাবে এখনও ইস্যু না হওয়ায় বিষয়টি অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে। হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্প্রতি লড়াই না বাদলে সম্ভবত কেউ বিষয়টি নিয়ে মাথাও ঘামাত না। এই বাদ দেয়ার খবরটি জনগণ জানতে পারে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারও একটা টুইট-বার্তা থেকে। ইসরায়েল বাংলাদেশের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশি পাসপোর্টে ইসরায়েল ভ্রমণে আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই; বাংলাদেশ ইসরায়েলকে স্বীকারও করে না। অপরদিকে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে মাহমুদ আব্বাস নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন সরকারকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ঢাকায় তাদের দূতাবাসও রয়েছে। এছাড়াও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পাসপোর্টের গুরুত্বও কম। অনেক দেশের পাসপোর্টে বিনা ভিসায় শতাধিক দেশ ভ্রমণ করা যায়। আমাদের পাসপোর্টে ভিসা থাকার পরও বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশনে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পৃথিবীর অনেক দেশের ইমিগ্রেশনে ইহুদিরা চাকরি করেন, তারা যখন দেখে আমাদের পাসপোর্টে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু লেখা আছে তখন ওই ইমিগ্রেশন-অফিসার বাংলাদেশি যাত্রীর প্রতি সদয় থাকে না। এছাড়াও যে দেশকে বাংলাদেশ স্বীকারই করে না সেই দেশের কথা পাসপোর্টে লিখে রাখা অর্থহীন ও বোকামি।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জগতে একটা নতুন চিন্তা-ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের বৈরী অবস্থানের অবসায়ন চায়। মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর কয়েকটির ক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন এলেও পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনও অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রই দেখে থাকে। কিন্তু এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে যখন ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা অনুমোদন করবে। কারণ তেয়াত্তর বছর ধরে ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করেও কোন লাভ হয়নি; যতবারই ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিন ও মুসলিম দেশগুলো লড়তে গেছে ততবারই ভূমি হারিয়েছে। এই অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার দূতিয়ালি করে কিছু দেশকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছে যে, এভাবে ইসরায়েলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কখনও সম্ভব হবে না, বরং ইসরায়েলকে মেনে নিয়েই মুসলিম দেশগুলোকে এগুতে হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, সুদান ও বাহরাইন সম্প্রতি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলিম দেশ তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৯৪৮ সনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বছর পরই তুরস্ক ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ইসরায়েলে রপ্তানিকারক শীর্ষ ১০ দেশের একটি তুরস্ক; অথচ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এখন বেশি সোচ্চার তুরস্ক, বিষয়টি মনে হয় রাজনৈতিক। আরব বিশ্বে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং নিজ দেশে ইসলামপন্থিদের দলে টেনে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্যে এরদোগান সাম্প্রতিক সময়ে ঘোর ইসরায়েল বিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। জর্ডান ও মিশরের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক বহু বছর আগে থেকেই। ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে ইসরায়েলকে কাবু করতে ব্যর্থ হয়ে মিসর ক্যাম্পডেভিট চুক্তি করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৭৯ সনে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। জর্ডান এই সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৯৪ সনে। আরব লীগের সদস্য মৌরিতানিয়া ১৯৯৯ সনে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও ২০১০ সনে আবার সম্পর্কোচ্ছেদ করে। সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের একটি গোপন আঁতাত গড়ে উঠার কথা সবাই বিশ্বাস করে। ভেতরে ভেতরে যত যোগাযোগই থাকুক না কেন, ইসরায়েলকে এক্ষুণি স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার মোড়লগিরির পদ হারাতে চাইবে না সৌদি আরব।

সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ হামাদ ৯২ মিলিয়ন ডলার বা ৭৮০ কোটি টাকা দিয়ে ‘বেইতার জেরুজালেম’ নামের একটি ইসরায়েলি ফুটবল ক্লাবের অর্ধেক শেয়ার কিনে নিয়েছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামেন নেতানিয়াহু এই ক্লাবটির সমর্থক, আর এই ক্লাবের উগ্র সমর্থকগোষ্ঠী আরবদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। মুসলমান বিদ্বেষী এমন একটি ফুটবল ক্লাব ক্রয় করার পরও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনগণের কোন উচ্চবাচ্য নেই। ভারত দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের বিপক্ষে ছিল এবং এই কারণেই ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না, সম্প্রতি মোদি সরকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে ভারতের সঙ্গে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর সম্পর্কের সামান্যতম অবনতিও হয়নি। অবশ্য স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইলে বরং মুসলিম দেশগুলো একঘরে হয়ে যাবে। কারণ জাতিসংঘের ১৯৩ দেশের মধ্যে ১৬৪টি দেশ ইতোমধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ইসরায়েল প্যালেস্টাইন অঞ্চলে যা হচ্ছে তেমন ঘটনা পৃথিবীর আরো নানা প্রান্তেও হচ্ছে। ফিলিস্তিনের জনগণের উপর ইসরায়েলের নির্যাতনের জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা না গেলে একই যুক্তিতে বাংলাদেশর উচিত কাশ্মীরের জনগণের দুর্দশার কথা ভেবে ভারতের সঙ্গে, বেলুচিস্তানের জনগণের কথা ভেবে পাকিস্তানের সঙ্গে, কুর্দি জনগণের প্রতি দয়ার্দ হয়ে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্কের সঙ্গে, রোহিঙ্গাদের সমর্থনে মিয়ানমারের সঙ্গে, উইঘুর জনগোষ্ঠীর পাশে থেকে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। এমন নির্যাতন পৃথিবীর নানা প্রান্তে আরও হচ্ছে, এখানে শুধু মুসলমান জাতিগুলো থেকেই কয়েকটি উদাহরণ নিলাম। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানকারী তুরস্ক, মিসরসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ যদি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতি দিতে পারে তাহলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বাংলাদেশের পক্ষেও তা করা সম্ভব। ইসরায়েল বাংলাদেশের শত্রু নয়, ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চাওয়া দেশটি হল ইসরায়েল এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনের ৪ এপ্রিল ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলেও বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সৌদি আরব, লিবিয়া প্রভৃতি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, বাংলাদেশকে নয়। যে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন পাবার জন্য বঙ্গবন্ধু ইসরায়েলের সমর্থন নেননি তারা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। হজ্বে বাধা দেয়ার মতো ধর্ম বিরোধী কাজটি থেকে বিরত রাখতে বঙ্গবন্ধুকে সৌদি বাদশাহের কাছে ছুটে যেতে হয়েছে, কিন্তু সৌদি আরব বাংলাদেশিদের হজ্জ করার সুযোগও দেয়নি। যে ফিলিস্তিনের জন্য মুসলমানেরা একাট্টা সেই ফিলিস্তিনই ইসরায়েলের সঙ্গে ইতোমধ্যে সমঝোতা করে ফেলেছে, তাহলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? পারবে না, কারণ বাংলাদেশি মুসলমানেরা ‘মিসকিন’ হয়েও মুসলিম উম্মার সঙ্গে রাজনৈতিক আবেগে একাত্ম হওয়ার তীব্র বাসনা পোষণ করে থাকে।

পাকিস্তানের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা মাওলানা মুহাম্মদ খান শেরানি স্পষ্ট করে বলেছেন, কোরআন এবং ইতিহাস অনুযায়ী ইসরায়েলিরা এখন যে জায়গা দখল করে আছে তা ইহুদিদের জায়গা, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া পাকিস্তানের উচিত হবে। কোন প্রেক্ষিতে তিনি কোরআনের কথা বলেছেন তার ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু জায়গাটি তো ফিলিস্তিনিদেরও। তাই ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। শক্তির জোরে ইসরায়েল যদি গোয়ার্তুমি করতেই থাকে, ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতন চালাতেই থাকে, তাহলে ইহুদিদের ঘৃণা করার ধর্মীয় অনুভূতি থামবে না। ইসরায়েলের এমন খারাপ আচরণের জন্যই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে এখনো একজন আরেকজনকে ‘তুই ইহুদি’ বলে গালি দিয়ে থাকে।

ইসরায়েলের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া বাংলাদেশে লাগেনি। উনপঞ্চাশ বছর আগে স্বাধীনতা লাভের সময় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সম্পর্কে বাংলাদেশের যে অবস্থান ছিল এখনও তাই রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের কূটনৈতিক চাপ না থাকলে বাংলাদেশের এই অবস্থানে শীঘ্রই কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশের জনগণকে সরকারের পক্ষে শান্ত রাখার জন্য ধর্মীয় আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া হয় ব্যাপকভাবে। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মের এত প্রভাব ছিল না। সরকার বুঝতে পেরেছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্য ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুললেও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণ একাট্টা। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব জোরালো থাকার কারণে ইসরায়েল ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল এবং বামপন্থিদের অবস্থান একই বিন্দুতে এসে মিলেছে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক] ahmedzeauddin0@gmail.com